লুপ্তপ্রায় খেলা
' কিৎ -কিৎ '
' কিৎ-কিৎ' মূলত মেয়েদের খেলা । তবে খুব বাচ্চা বয়সে মেয়েদের সঙ্গে ওই খেলায় ছেলেদেরও অংশ নিতে দেখা যায়। সাধারণত ফাঁকা উঠোন , বাড়ির ছাদ প্রভৃতি জায়গায় ওই খেলা চলে। এককভাবে নুন্যতম ২ জন কিম্বা ৪ জন করে অথবা ২ জন করে জোড়ায় জোড়ায় ওই খেলা হয়।খেলার জন্য মাটিতে অথবা মেঝেতে দু'ধরনের ছক কেটে নেওয়া হয়। একটি ছকে আয়তাকার ঘরের মধ্যে ৮ টি বর্গাকার ঘর থাকে। যার মধ্যে ৫ নং ঘরটি 'ধা 'য়ের ঘর হিসাবে পরিচিত। অন্য ছকটিতে থাকে ৯ টি বর্গাকার ঘর।যার মধ্যস্থলের ঘরটি হল ' ধা ' য়ের ঘর। খেলার জন্য প্রয়োজন পোড়ামাটির টালি কিম্বা খোলামকুচি ঘষে ঘষে তৈরি গোলাকার একটি গুটি। কে বা কোন দল আগে দান নেবে ' টস ' করে ঠিক করে নেওয়া হয়।
আট ঘর বিশিষ্ট ছকের খেলার নিয়ম হলো , ' টস জয়ী ' খেলোয়াড়কে ১ নং ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ১ নং ঘরে সন্তর্পনে গুটি ফেলতে হয়।ছোড়া গুটি যাতে দাগ স্পর্শ কিম্বা ঘর অতিক্রম করে না যায় সেই বিষয়ে সব সময় সজাগ থাকতে হয়।কারণ ওই ঘটনা ঘটলেই তাকে ' মরা ' হয়ে দান নেওয়ার সুযোগ হারাতে হয়। অন্যথায় সফলভাবে গুটি ফেলতে পারলে এক পা তুলে ' চু -কিৎ- কিৎ' ডাক ধরে এক নিঃশ্বাসে গুটিটিকে পা দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে লাফিয়ে দাগ পার হয়ে একের পর এক ঘর পার করে পার করে পাঁচের ঘরে এসে ' ধা ' বলে দু'পা নামানো এবং নিঃশ্বাস ছাড়ার সুযোগ মেলে।এজন্য পাঁচের ঘরটিকে ' ধা ' বা বিশ্রামঘর বলা হয়। তারপর ফের একই কায়দায় নিঃশ্বাস ধরে গুটিটিকে বিশ্রামঘর থেকে ঠেলতে ঠেলতে ৬,৭ ,৮ ঘর পার করে ছকের বাইরে গিয়ে ' ধা ' বলে পা নামাতে হয়।
ক্রমান্বয়ে একইভাবে সমস্ত ঘর থেকে ওইভাবে গুটি বের করার পর শুরু হয় ' চান-চু এবং কিৎকিৎ পর্যায়। ওই পর্যায়ে দানচালকারী প্রতিপক্ষকে জিজ্ঞেস করে কতবার তাকে ' চান-চু' নিতে হবে। প্রতিপক্ষ তার ইচ্ছা মতো ২/৩ বার ' চান-চু ' নির্ধারণ করে দেয়। সেইমতো ' চান-চু ' নিতে হয় দান চালকারীকে। ' চান -চু ' নেওয়ার অর্থ হলো , বিপক্ষের ইচ্ছা অনুযায়ী ২/৩ বার গুটি ছাড়া এক নিঃশ্বাসে প্রথমে ' চান-চু ' ডাক ধরে পরে সমসংখ্যক বার ' চু -কিৎ - কিৎ ' ডাক ধরে ঘর পারাপার করতে হয়। তবে দুটিক্ষেত্রেই বিশ্রাম ঘরে পা নামানোর সুযোগ থাকলেও নিঃশ্বাস ছাড়ার সুযোগ নেই। ওই দুটি পর্যায় সফল ভাবে পার হতে পারলে আসে ' আপ ' পর্যায়।
এই পর্যায়ে ' আপ' বলে মুখে হাত চাপা দিয়ে গুটি ছাড়া একই ভাবে ঘর পারাপার করতে হয়।জোড়ায়-জোড়ায় খেলার ক্ষেত্রে এই পর্যায়ে সঙ্গী খেলোয়াড়কে বিশেষ সাবধনতা অবলম্বন করতে হয়। দানচালকারী ' আপ ' পর্যায় সম্পূর্ণ না করা পর্যন্ত সঙ্গী খেলোয়াড়কে মুখ বন্ধ করে থাকতে হয়। কারণ মুখ খুললেই দু'জনেই ' মরা ' হয়ে দান নেওয়ার সুযোগ হারায়।
' আপ ' পর্যায়ের পর আসে ' কলকাতা - লতাপাতা ' এবং ' জয়হিন - ফুটোটিন ' পর্যায়। এই দুই পর্যায়েও একই ভাবে যথাক্রমে ওই ডাক ধরে অর্থাৎ ' কলকাতা - লতাপাতা ' এবং ' জয় হিন ফুটোটিন ' আউড়াতে আউড়াতে নির্ধারিত সংখ্যক বার ঘর পার হতে হয়। তার পর আসে ' আউট ' পর্যায়। ওই পর্যায়ে উপরের দিকে মুখ তুলে আন্দাজে দাগ এড়িয়ে ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে একবার মাত্র গুটি ছাড়াই ' আউট - আউট ' বলতে বলতে ঘর পার হতে হয়। ' আউট ' পর্যায়ের পর ঘর কেনার পালা।ওই পর্যায়ে ' চানচু ' এবং ' কিৎকিৎ'এর মতোই দানচালকারী প্রতিপক্ষকে প্রশ্ন করে - 'বুড়ি বুড়ি , বসে না দাঁড়িয়ে ? ' বিপক্ষ তাদের ইচ্ছানুযায়ী বসে না দাঁড়িয়ে ঘর কিনতে হবে তা স্থির করে দেয়। সেই মতো ঘর কিনতে হয় দানচালকারীকে। অর্থাৎ বিপক্ষ বসে ঘর কেনা নির্ধারণ করে দিলে দানচালকারীকে এক কিম্বা আটের ঘরের সামনে উল্টো মুখ করে বসে মাথার উপর দিয়ে দাগ বাঁচিয়ে ৫ নং ঘর বাদ দিয়ে যেকোন একটি ঘরে গুটি ছুড়ে ফেলতে হয়।সফল ভাবে গুটি ফেলা সম্ভব হলে উঠে দাঁড়িয়ে ১ নং ঘর থেকে ' চু - কিৎ কিৎ ' ডাক ধরে সেই ঘরে পৌঁছোতে পারলেই সেই ঘরটি তার কেনা হয়ে যায়।তখন সেই ঘরে গুণিতক চিহ্ন এঁকে দিয়ে দানচালকারী তার দখল প্রতিষ্ঠা করে। সেক্ষেত্রে দানচালকারী পাঁচ নং ঘরের মতোই নিজের কেনা ঘরগুলিও বিশ্রামঘর হিসাবে ব্যবহারের সুযোগ পায়। অর্থাৎ ওই ঘরগুলিতেও পা নামানো এবং নিঃশ্বাস ছাড়ার সুযোগ লাভ করে।সব শেষে ৫ নং ঘরটি কেনা শেষ হলে দান শেষ হয়।
তখন বিপক্ষ দান নেওয়ার সুযোগ পায়। অন্যদিকে দাঁড়িয়ে ঘর দখলের ক্ষেত্রে একই ভাবে পিছনের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে গুটি ফেলতে হয়। এই খেলায় পা দিয়ে ঠেলার সময় গুটি যদি এক ঘর থেকে অন্য ঘরে পৌঁছানোর পরিবর্তে দাগে গিয়ে আটকে যায় কিম্বা গুটিতে অথবা দাগে পা পড়ে যায় তাহলে ' মরা ' হয়ে দানের সুযোগ হারাতে হয়।নিঃশ্বাস ছাড়লেও একই পরিনতি হয়।জোড়ায় জোড়ায় খেলার ক্ষেত্রে অবশ্য সহযোগী খোলোয়াড় নিজের দান সফলভাবে সম্পূর্ণ করতে পারলে সঙ্গী খেলোয়াড়ের অম্পূর্ণ দান সম্পূর্ণ করার সুযোগ লাভ করে।
৯ ঘরের খেলাটি ১ থেকে ৪ জন এককভাবে কিম্বা ৮ জন জোড়ায় জোড়ায় খেলা চলে। এই খেলায় ডাক এবং নিয়মকানুন অনেকটা একই থাকলেও কিছুটা ভিন্নতাও রয়েছে। এক্ষেত্রে ১ নং ঘরে গুটি ফেললেও সেই গুটিকে ধাক্কা দিতে দিতে অন্যান্য ঘরে নিয়ে যেতে হয় না। ডাক ধরে ঘরের দাগের বাইরে পাঠিয়ে নয়ের ঘরে 'ধা' বলে পা নামিয়ে দম এবং বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ মেলে। কিন্তু বাইরে পাঠানোর সময় গুটি যাতে বেশি দুরে চলে না যায় সে বিষয়ে সজাগ থাকতে হয়। কারণ ধা'য়ের ঘর থেকে দাগের বাইরে থাকা গুটিকে পা বাড়িয়ে ছুঁতে বা লাফিয়ে পৌঁছোতে হয়। তারপর প্রতি ঘরের ক্ষেত্রে একই নিয়ম আবর্তিত হয়।৯ নং ঘরে চোখ বন্ধ করে গুটি ফেলতে হয়।তারপর ১ নং ঘর থেকে ডাক ধরে সেখানে পৌঁছে গুটিকে বাইরে পাঠানোর পর একই কায়দায় সেটিকে ছোঁওয়ার পর ঘর কেনার সুযোগ মেলে। এভাবেই সম্পুর্ণ হয় একপক্ষের খেলার বৃত্ত। খেলা শেষে যে দল বা খেলোয়াড় সব থেকে বেশি ঘর কিনতে পারে সেই জয়ী হয়।
No comments:
Post a Comment