Short story, Features story,Novel,Poems,Pictures and social activities in Bengali language presented by Arghya Ghosh

লুপ্তপ্রায় খেলা -- ২৮


                                           

   
     ( শুরু হল হারিয়ে যাওয়া বা হারিয়ে যেতে বসা বিভিন্ন খেলা নিয়ে ধারাবাহিক লেখা  )



                 লুপ্তপ্রায় খেলা
         
        ( ১ -  বারি -দুরি খেলার দান )
                     
             ' ডাং-গুলি '



 একসময় নবান্নের মাস মানেই ছিল ডাংগুলি খেলার মরসুম। গ্রামাঞ্চলে বলা হত ' লবান হাজানো ' খেলা  ( নবান্নের খাবার হজম ) । বাচ্চারা তো বটেই , নবান্নের দিন বয়স্কদেরও ওই খেলায় মেতে উঠতে দেখা যেত।মূলত নবান্নের মাস অর্থাৎ অগ্রহায়ণে শুরু হয়ে ওই খেলা চলত সারা শীত মরসুম। বর্তমানে ' ডাং-গুলি ' কাউকে খেলতেই দেখা যায় না।তাই চর্চার অভাবে গ্রাম বাংলার ওই খেলাটিও হারিয়ে যেতে বসেছে।  ডাং-গুলি মূলত ছেলেদের খেলা। খোলা মাঠ ওই খেলার জন্য উপযুক্ত স্থান হিসাবে বিবেচিত হয়।' ডাং-গুলি ' নিয়ে সাধারণত দুই ধরণের খেলা প্রচলিত রয়েছে।একটি খেলার নাম ' বারি-দুরি' বা 'মোনা-দোনা' , অন্যটির নাম ' খাটা-খাটি ' বা ' ভজা-ভজি।'  প্রথমোক্ত খেলাটি দু'জন খেলোয়াড় নিয়ে এককভাবে খেলা হলেও ওই দলগত ভাবে খেলাতেই মজা বেশি।তাই ' বারি-দুরি '  দলগত ভাবেই খেলার প্রবণতা বেশি দেখা যেত। ' খাটা-খাটি ' দুই বা ততোধিক জোড় সংখ্যক খেলোয়াড়ের খেলা।
                         
              
                     

                                                ' ডাং-গুলি ' খেলায় কিছুটা ক্রিকেট খেলার ছায়া রয়েছে।খেলার জন্য প্রয়োজন গাছের ডাল কেটে তৈরি উইকেটের মতো ফুট দেড়েকের একটা দণ্ড। সেই ডণ্ডের একদিকের অগ্রভাগে একটি গর্ত করা হয়। আর প্রয়োজন ইঞ্চি ৫/৬ লম্বা দুইদিক সুন্দর ভাবে ছুঁচালো করা অপেক্ষাকৃত সরু আরও একটি ডাল।খেলার পরিভাষায় দণ্ডটিকে ' ডাং' , অগ্রভাগের গর্তটিকে ' গোপ ' আর ছুঁচালো ডালটি ' গুলি ' বলা হয়। ' বারি-দুরি' খেলার জন্য প্রচলিত কোন পদ্ধতি অনুসারে দুটি দল গঠন এবং কোন দল আগে দান নেবে তা স্থির করে নিতে হয়। খেলা শুরুর আগে মাঠের মাঝে ক্রিকেটের উইকেট বসানের মতো মাথায় খাঁজওয়ালা দুটি কঞ্চি অথবা সোজা কোন গাছের ডাল দেড় বা দু'ফুট ব্যবধানে পুঁতে খাঁজের মাথায় আর একটি সোজা ডাল বা লাঠি চাপিয়ে দেওয়া হয়।খাঁজ যুক্ত ডালের অভাবে দুই দিকে দুটি ইটও ব্যবহার করা যায়। এটি ' খেলার ঘর ' হিসাবে পরিচিত। 

   


                                     নিয়ম হলো , দানচালকারী দলের  একজন খোলোয়াড় সেই ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ডাংয়ের 'গোপের ' মধ্যে গুলিটি বসিয়ে দুরে ছুড়ে দেবে। আর বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়রা তার সামনে 'গুলিটি' লুফে নেওয়ার জন্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে ওঁত পেতে দাঁড়িয়ে থাকবে। গুলিটি লুফে নিতে পারলেই ' দানচালকারী ' খেলোয়ারটি ' মরা ' হয়ে দান নেওয়ার সুযোগ হারাবে। ওইভাবে ' দানচালকারী ' দলের খেলোয়াড়দের ছোড়া সমস্ত 'গুলি' লুফে নিতে পারলেই তারা দান নেওয়ার সুযোগ পায়। অন্যথায় গুলি কুড়িয়ে নিয়ে তাদের ঘর নিশানা করে ছুড়তে হয়।ছোড়া ' গুলি ' যদি দান ঘরের মধ্যে দিয়ে চলে যায় বা ঘরের ডাল কিম্বা ইট স্পর্শ করে তাহলেই দানচালকারী 'মরা' হয়ে দান নেওয়ার সুযোগ হারাবে।তখন তার দলের পরবর্তী খেলোয়াড় একই ভাবে ' দান ' নেওয়া শুরু করবে।কোথাও কোথাও এক্ষেত্রে বিপক্ষ দলের হাতে আরও একটি সুযোগ রয়েছে। সেটি হল ' জল ঝাঁপ ' এবং ' ঝুল ঝারুল।'  ' জল ঝাঁপে ' যদি দানচালকারীর ছোড়া ' গুলি ' যদি পুকুর বা কোন জলাশয়ে পড়ে তাহলে যদি বিপক্ষ দল সঙ্গে সঙ্গে ' জল ঝাঁপ - কুড়ি লাফ ' বলে চিৎকার করে উঠতে পারে তাহলে গুলির অবস্থান থেকে খেলার ঘর অভিমুখে পর পর কুড়ি বার লাফ দেওয়ার সুযোগ লাভ করে তারা।সেক্ষত্রে দুরত্ব কমে যাওয়ায় সহজেই গুলি ছুড়ে দানের ঘর স্পর্শ কিম্বা পার করার সুযোগ ঘটে।কিন্তু দানচালকারী দলের খেলায়াড় যদি আগেই ' জল ঝাঁপ - কুড়ি লাফ ' বলে ফেলে তাহলে সেই সুযোগ হারাতে হয় বিপক্ষকে।একই ভাবে ছোড়া ' গুলি ' যদি গাছ কিম্বা ঝোঁপ ঝাঁড়ে আটকে যায় তাহলে যদি বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়রা আগে ' ঝুল- ঝারুল ' বলে চিৎকার করে উঠতে পারে তাহলে গাছ কিম্বা 'ঝোঁপ ঝাড়ে' আটকে থাকা গুলি নাড়া দিয়ে ফেলার সময় লুফে নেওয়ার সুযোগ পায়।সেক্ষেত্রেও দানচালকারী খেলোয়াড় ' মরা ' হয়ে যায়।কিন্তু তার দলের কোন খেলোয়াড় যদি আগেই ' ঝুল ঝারুল ' বলে চিৎকার করে উঠে তাহলে বিপক্ষদল আর ওই সুযোগ পায় না।


                                                    কিন্তু ছোড়া  ' গুলি ' লক্ষ্যভ্রষ্ট অর্থাৎ ঘর স্পর্শ করতে ব্যর্থ হলে ' দানচালকারী ' সেই 'গুলি' ' টিসিয়ে ' দুরে পাঠানোর চেষ্টা করবে। ' টিসানো'র অর্থ হল 'গুলি'র ছুঁচালো কোন একটি প্রান্তে ডাং দিয়ে হালকা আঘাত করে মাটি থেকে সামান্য উপরে তোলা হয়।তারপর সেটি মাটিতে পড়ার আগেই 'ডাং' দিয়ে সজোরে বাড়ি মেরে দুরে পাঠানোর চেষ্টা করা হয়।এক্ষেত্রে ও মাটিতে পড়ার আগে বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়রা 'গুলি'টি লুফে নিতে পারলেই দান নেওয়ার সুযোগ হারায় দানচালকারী।অন্যথায় শুরু হয় দানের পরবর্তী পর্যায়।ওই পর্যায়ে দানচালকারী দূরে যাওয়া 'গুলি'র কাছে গিয়ে মাটিতে ' ডাং' ফেলে ফেলে ' বারি, দুরি , তেরি , চাল , চম্পা , ঢেক , লংকা বা ' মোনা , দোনা , তেনা , চারা , পাঁচা , ছই , ঘই ' বলে গুনতে গুনতে দান ঘরের দিকে ফেরে।একবার গণনা সম্পূর্ণ হলে অর্থাৎ  ' বারি থেকে লংকা ' বা ' মোনা থেকে ঘই ' গোনা হয়ে গেলে মনে রাখার সুবিধার্থে এক বারি , দুই বারি , তিন বারি'র মতো এক মোনা , দুই মোনা , তিন মোনার হিসাবে ধারাবাহিক ভাবে গণনার প্রচলন রয়েছে। ক্রি কেটের সেঞ্চুরির মতোই ১০০ / ৮০ ডাং বা পয়েন্টে -এ গজা ধরা হয়। ' টিসে'তেই যদি গজা সম্পূর্ণ হয়ে যায় তাহলে দানচালকারী দলের অন্য খোলোয়াড় 'দান' নেওয়া শুরু করে।কোথাও কোথাও ' গজা '  দেওয়া  খেলোয়াড় সবার শেষে ফের দান নেওয়ার সুযোগ পায় , আবার কোথাও ওই নিয়ম নেই।

                                                                                                                                  

                                             'টিসা'নোতে গজা সম্পূর্ণ না হলে তা পরবর্তী পর্যায়ে ' দান ' নিয়ে সম্পূর্ণ করার সুযোগ রয়েছে। গণনার মতোই 'দান' নেওয়াও সাতটি। পর্যায়গুলি হল বারি , দুরি , তেরি বা থেরি , চাল , চম্পা , ঢেক এবং লংকা।বারি বা পায়ে বারির ক্ষেত্রে পায়ের উপর ' গুলি ' রেখে তা হালকা করে  উপরের দিকে ছুড়ে দিয়ে ডাংয়ের আঘাতে দুরে পাঠানো হয়।  একইভাবে যথাক্রমে দুটি আঙুলের মাঝে  , ডাং দিয়ে এক পাক ঘুরিয়ে , হাতের তালুর উপরে , হাতের তালু বাঁকিয়ে , বুড়ো আঙুল এবং পার্শ্ববর্তী আঙুল যুক্ত করে , এবং বন্ধ চোখের উপর থেকে কায়দা করে ডাংএর আঘাতে পর্যায়ক্রমে দুরি, তেরি, চাল, চম্পা, ঢেক ও লংকা'তেও গুলি দুরে পাঠাতে হয়।প্রতি ক্ষেত্রেই বিপক্ষ 'গুলি' ছুড়ে ঘর স্পর্শ করতে পারলে দানচালকারী 'দান' নেওয়ার সুযোগ হারায়।বিপক্ষ 'গুলি' লুফে নিতে পারলেও ' একই ঘটনা ঘটে।সেক্ষেত্রে তার সংগৃহিত পয়েণ্ট ধরেই পরবর্তী খেলোয়াড় দান নিয়ে গজা সম্পূর্ণ করতে পারে।কিন্তু গুলি লুফে নেওয়া কিম্বা ঘর স্পর্শ লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে দানচালকারী প্রতিটি পর্যায়ে ' টিসিয়ে ' গুলি দুরে পাঠিয়ে ' গজা ' করার সুযোগ পায়।' মোনা -দোনা'র ক্ষেত্রেও প্রায় একই নিয়ম প্রচলিত রয়েছে।খেলা শেষে যে দল বিপক্ষকে বেশি ' গজা'  দিতে পারে সেই দল জয়ী ঘোষিত হয়।



                    ( খাটাখাটি খেলার দান )
                            
           
                  খাটাখাটি বা ভজাভজি খেলা দুই বা ততোধিক খেলোয়াড়ের একক খেলা। অন্যকে খাটানোই ওই খেলার মূল লক্ষ্য।৮/১০ খেলোয়াড় মিলে ওই খেলা চলে। ওই খেলায় প্রথমে ' টিসা'নোর অধিকার অর্জন করতে হয়। যে যত বেশি ' টিসানো'র অধিকার অর্জন করতে পারে সে এই খেলায় সৌভাগ্যবান হিসাবে বিবেচিত হয়। ডাংয়ের উপর 'গুলি' নিয়ে ক্রমাগত ঠুক ঠুক করে ঠেকানোর পর মাটিতে পড়ে গেলে ফের একবার টিসিয়ে গুলি উপরে তুলে একই কায়দায় ডাং দিয়ে গুলি স্পর্শ করাতে হয়।ওই প্রক্রিয়ায় যে যতবার গুলি স্পর্শ করাতে পারে সে খাটানোর ক্ষেত্রে ততবার 'টিসানোর ' অধিকার বা সুযোগ অর্জন করে। টিসানোর সংগৃহিত সুযোগ অনুযায়ী একজন খেলোয়াড় তার নিকটতম টিসানোর সুযোগ অর্জনকারীকে খাটানোর অধিকার লাভ করে।তবে সব থেকে বেশি টিসানোর অধিকার অর্জনকারী তার নিকটতম জনকে সর্বাগ্রে খাটানোর সুযোগ পায়। খাটানোর প্রক্রিয়াটিও বেশ মজার। এজন্য মাটিতে লম্বালম্বি ছোট্ট একটি গর্ত কাটা কিম্বা পাশাপাশি দুটি ইট বসানো হয়।তার উপর গুলি রেখে তলায় ডাং দিয়ে দুরে ছুড়ে দেয় দানচালকারী। আর তার নিকটতম প্রতিযোগী তা লুফে নেওয়ার চেষ্টা করে। অন্যথায় কুড়িয়ে নিয়ে ইট বা মাটির গর্ত নিশানা করে ছুড়ে দেয়। দুটি ক্ষেত্রের একটিতে সফল হলেই দানচালকারী দানের সুযোগ হারায়।তখন তাকে প্রতিপক্ষের কাছে খাটতে হয়। কিন্তু দুটি ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হলে দানচালকারী তার অর্জিত টিসানোর সংখ্যা অনুযায়ী ক্রমান্বয়ে টিসিয়ে টিসিয়ে 'গুলি'কে দুরে পাঠায়। ওইসময়ও বিপক্ষ ' গুলি ' লুফে নিতে পারলেই টিসানোর সুযোগ হারায় দানচালকারী।সেক্ষেত্রে লুফে নেওয়া স্থান থেকে চোখ কিম্বা মাথার উপরে ' গুলি ' রেখে সাবধানে ' দানঘরে' পৌঁছে দিয়ে তবেই রেহাই মেলে তার । ওইভাবে আনার সময় ' গুলি ' পড়ে ফের টিসিয়ে তা দুরে পাঠানোর সুযোগ পায় দান চালকারী।কিন্তু লুফতে বা গুলি ছুড়ে দানঘর স্পর্শ করতে ব্যর্থ হলে একই প্রক্রিয়ায় তাকে খেটেই যেতে হয়।অনেক সময় খাটতে খাটতে ক্লান্ত বিধ্বস্ত হয়ে খাটার ভয়ে ছুটে বাড়ি পালানোরও ঘটনা ঘটে। আবার গুলি-কিম্বা ডাংএর আঘাতে মারত্মক ভাবে আহত হওয়ার ঘটনাও ঘটে। কিন্তু সব ভুলে সেই  'ডাং-গুলি' হাতেই পরদিন দেখা মিলেছে কচিকাঁচাদের। সেই ছবিটাই আজ হারিয়ে গিয়েছে।                                              

     ( চলবে )


         নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 



    


                      --------০--------
                                        
                                                                                                                   

No comments:

Post a Comment