ইজ্জতের দাম
অর্ঘ্য ঘোষ
গত বর্ষায় কুঁয়ে নদীর বন্যায় ভেসে গিয়েছে ঘর গেরস্থালী। এবারে জল মেলে নি লাঙলহাটার বিলে। মাঠের ধান শুকিয়ে কাঠ। এতদিন ঘটি বাটি বেচে ছেলে মেয়ের মুখে কোন রকমে খুদ কুঁড়োটুকু তুলে দিতে পেরেছিল সোহাগী। কিন্তু বাড়িতে পাঁচটা হাঁমুখ ছাড়া আর কিছু নেই। ছেলেমেয়ে দুটো তো বটেই , বৃদ্ধা শাশুড়িও একেবারে খিদে সহ্য করতে পারে না। কথাটা পাড়তেই স্বামী রতন আরও নেতিয়ে পড়ল। তার মাথায় মাথায় চিন্তা। আধাআধি ভাগের চুক্তিতে গ্রামের হারান মোড়লের ৫ বিঘে জমিতে ধান চাষ করেছিল সে। মোড়ল সাফ জানিয়ে দিয়েছে, বিলে জল এল কি না , এল সে শুনবে না। ভাগ তার চাই। না হলে গায়ে গায়ে শোধ করে নেবে।
ইঙ্গিতটা বোঝে রতন। তাদের বাড়ির মেয়ে বৌ'দের ইজ্জতের দাম চায়ের ভাঁড়ের বেশি তো নয়। তাছাড়া হারান তো শুধু গ্রামের মোড়লই নয় , শাসক দলের নেতাও বটে। স্বাভাবিক ভাবেই ভেঙে পড়ে রতন। ওই সময় বেড়াতে এসেছিলেন পাড়ার আদরী পিসি। তিনি শিলিগুড়ির খালপট্টির ডাকসাইডে বারবনিতা। তার হাত ধরে আশেপাশের গ্রামের অনেক মেয়ে সেখানে পাড়ি জমিয়েছে। গ্রামে এখন তাদের নামে জমি জিরেত হয়েছে। পাকা বাড়িও হয়েছে অনেকের। ব্যাংকে টাকা আছে। সব শুনে আদরী বললেন, ও বৌ চল আমার সঙ্গে। ছেলেমেয়ে দুটো অন্তত খেয়ে পড়ে বাঁচবে। তোরও গায়ে গত্তি লাগবে। যা এক খানা চেহারা করেছিস , যমেও ছোবে না। আর এখানে থাকলে মোড়লের লোকেরা ছিঁড়ে খাবে। তাতে ইজ্জত যাবে , কিন্তু পেট ভরবে না। তাছাড়া আমাদের ইজ্জতের দামই বা কি।ও বাসনের মতো ধুয়ে নিলেই চলে।
স্বামীর মুখের দিকে তাকায় সোহাগ। সবেগে না বোধক ঘাড় নাড়ে রতন। রাতে স্বামীর বুকে হাত বোলাতে বোলাতে সোহাগী বলে, দেখ এভাবে চললে সাবাই না খেয়ে মরব। তার চেয়ে যাওয়াটাই ভাল নয় কি? সবাই তো জানবে আমি শহরে ঝিগিরি করতে যাচ্ছি। ক'দিন বইতো নয়। সংসারের হাল একটু ফিরলেই তো আমিও ফিরে আসবো। অগ্যতা নিমরাজি হয় রতন। পরদিন সকালে দুই ছেলে মেয়েকে ঘাড়ে নিয়ে আদরী পিসির সঙ্গে স্ত্রীকে আমোদপুর স্টেশনে তুলে দিতে যায় রতন। স্বামী ছেলে মেয়েকে রেখে ট্রেনে উঠতে যায় সোহাগী। তখন মায়ের আঁচল টেনে ধরে ছেলে মেয়েরা। হকারের কাছে দু প্যাকেট শোন পাপড়ি কিনে তাদের হাতে ধরিয়ে দেন আদরী। ছেলে মেয়েরা মায়ের আঁচল ছেড়ে দেয়। ছেড়ে দেয় ট্রেনও। হাত নাড়তে থাকেন রতন -সোহাগী। ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে যায়। দু জনেরই দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়। শুধু ছেলে মেয়ে দুটো মহানন্দে শোন পাপড়ি খেতে ব্যস্ত। এর আগে প্যাকেট ভর্তি শোনপাপড়ি তাদের দেয় নি কেউ। বেচারারা জানেই না কি হারিয়ে তারা কি পেল।
--------০--------
No comments:
Post a Comment