আধুনিক বিনোদনের মাঝেও টিকে রয়েছে লাভপুরে প্রবীণদের আড্ডা
অর্ঘ্য ঘোষ
হারিয়ে গিয়েছে বাঁশের মাচা। হারিয়ে গিয়েছে হ্যারিকেনের আলোর সেই জমাটি আসর। আধুনিক বিনোদনের দাপটে একের পর এক হারিয়ে গিয়েছে গ্রামাঞ্চলের অনেক সাবেকী বিনোদন। তারই মাঝে টানা কুড়ি বছর ধরে ' আড্ডা ' টিকিয়ে রেখে সাড়া ফেলেছেন ৭০ বছরের শক্তি দাস , ৬৬ বছরের কালীসাধন বন্দ্যোপাধ্যায়রা। তাবলে কিন্তু তারা নিচ্ছক আড্ডাবাজ নন। কেউ প্রাক্তন পুলিশকর্মী , স্কুল শিক্ষক, কেউবা রাজমিস্ত্রি কিম্বা দিনমজুর। কাজকর্ম সেরে সন্ধ্যাটুকু নিজেদের মতো করে কাটানোর জন্য আড্ডা বসান তারা। কি শীত , কি বর্ষা সবকিছু উপেক্ষা করে আড্ডায় মিলিত হওয়া চাই-ই-ই। এক - দু' মাস নয় টানা কুড়ি বছর ধরে নিয়মিত সেই আড্ডায় মিলিত হচ্ছেন একদল প্রবীণ মানুষ।
২০ বছরে আড্ডার কোন ছেদ ঘটে নি বলে সদস্যদের দাবি। কেবলমাত্র সদস্যদের কারও মৃত্যু হলে সেদিন আর আড্ডা বসে না। স্মৃতিচারণের পাশাপাশি সেদিন সবাই শোকজ্ঞাপন করতে প্রয়াত আডাবন্ধুর বাড়িতে যান।লাভপুরের ইন্দাস হাটতলা লাগোয়া প্রাক্তন এন, ভি,এফ কর্মী ৭৪ বছরের শ্রীদাম দাসবৈরাগ্যের দশকর্ম ভান্ডারে ওই আড্ডা বসে।
বিকাল ৫ থেকে ঘন্টা খানেক আড্ডা চলে। ১৫ জন প্রবীণ মানুষ ওই আড্ডায় যোগ দেন। সমাজ, সাহিত্য , আধ্যাত্মিক সহ সমস্ত বিষয়েই আলোচনা চলে। পাশের দোকান থেকে চা আসে বার কয়েক। স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে পালা ক্রমে তার দাম সদস্যরা।
প্রাক্তন পুলিশকর্মী ৬৩ বছরের করুণাসিন্ধু মন্ডল , ৬৬ বছরের প্রাক্তন স্কুল শিক্ষক কালীসাধন বন্দ্যোপাধ্যায় , জীবন বিমার এজেন্ট ৬২ বছরের জ্যোতির্ময় ঘোষরা জানান, আমাদের অধিকাংশের বাড়িতেই টি,ভি, ভিডিও প্লেয়ার সহ বিভিন্ন রকম বিনোদনের উপকরণ রয়েছে। কিন্তু আড্ডায় না এলে যেন পেটের ভাত হজম হয় না। নিজেদের কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা সবার সংগে ভাগ করে নিই।একই অভিব্যক্তি রাজমিস্ত্রী ৬২ বছরের বিনয় দাস , দিনমজুর ৬৮ বছরের মধু বাউড়িদেরও। তারা জানান , আড্ডায় কি করে যে সময়টা কেটে যায় বুঝতেই পারি না। আমাদের তো সব জায়গায় অন্যের কথা শুনতে হয়। কিন্তু এখানে আমাদের কথাও সবাই গুরুত্ব দিয়ে শোনেন, মতামত দেন। সেই টানেই আড্ডায় আসি।
নিছক শুধু সময়ই কাটানোই নয় , ওই আড্ডাই কয়েকজনের কু অভ্যাসও বদলে দিয়েছে। পঞ্চায়েত কর্মী শ্রীকুমার ঘোষ , স্কুল শিক্ষক অশোক মন্ডলরা জানান , একসময় আমাদের মধ্যে ৪ জনের বিভিন্ন ধরণের নেশা ছিল। তাই আড্ডায় এসে পালানোর সুযোগ খুঁজত তারা। তারপর নেশাগ্রস্থ অবস্থায় বাড়ি ফিরে অশান্তি বাঁধাত। আর আমাদের বদনাম হত। সেটা জানার পরই আমরা তাদের নেশা করতে যাওয়ার সময়টুকু আটকে রেখে কাউন্সিলিং করতাম
। তারপর একসংগে বাড়ি ফিরে যেতাম। ২ বছরের চেষ্টায় এখন তারা পুরোপুরি নেশামুক্ত হয়ে উঠেছেন।সে কথা স্বীকার করে নিয়েছেন ওই আড্ডার দুই সদস্য। তারা জানান , আগে আমাদের জন্য পরিবারে অশান্তি লেগেই ছিল। এখন আর সেই সমস্যা নেই।প্রতিবছর অক্ষয় তৃতীয়ার দিন ওইসব আড্ডাধারীদের পিকনিকও হয় স্থানীয় কালীমন্দিরে। অনাথ ঘোষ , বুদ্ধদেব কোনাইরা জানান, ওই দিনটার জন্য আমরা সারাবছর প্রতীক্ষায়। বয়সের কথা ভুলে যায়। হইহুল্লোড়ে মেতে উঠি।
এত কিছু আনন্দের মাঝে বিষাদও রয়েছে।
নীলমনি মন্ডল, শ্রীদাম দাসবৈরাগ্যরা জানান , ২০ বছরের এই আড্ডাতে আমরা ৪ জনকে হারিয়েছি। কেউ চলে গেলে সেদিন আডা বন্ধ থাকে। প্রতিবছর স্মৃতিচারণের মাধ্যমে তাদের মৃত্যু দিবস পালন করা হয়। বাড়ির লোকেরা কেমন চোখে দেখছেন প্রবীণদের এই আড্ডা ? নিতাই পালের স্ত্রী সন্ধ্যারাণী পাল, করুণাসিন্ধু মন্ডলের স্ত্রী বেদবিভা মন্ডলরা জানান , আড্ডা থেকে ফিরে ওদের মেজাজ ফুরে ফুরে থাকে। আড্ডার কথা আমাদের সঙ্গেও ভাগ করে নেন। বহু মজার মজার কথা শোনা যায়। তাই ওদের আড্ডার স্বাদ আমরাও পাই।
-------০------
No comments:
Post a Comment