কৃষিকাজের মাঝেও সুর ভাঁজেন শুকদেব
অর্ঘ্য ঘোষ
তাগিদে কখনও তাকে ধরতে হয়েছে লাঙ্গলের মুঠি। কখনও বা হাতে তুলে নিতে হয়েছে দাঁড়িপাল্লা। তারই ফাঁকে ফাঁকে সাহিত্য চর্চা করে সাড়া ফেলেছেন শুকদেব মিত্র। ময়ূরেশ্বরের কলেশ্বর গ্রামে মধ্যবিত্ত চাষি পরিবারে জন্ম শুকদেববাবুর। স্কুল জীবন থেকেই লেখালিখির অভ্যাস। স্কুল ম্যাগাজিন থেকে শিশুসাথী, সায়র, জল সারেঙ, অনিকেত, দিদিভাই, পূর্বাভাষ, বীরভূমি সহ জেলা এবং রাজ্যের বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তার লেখা। বাউল সংগীত, লোক সংগীত, ছোটদের ছড়া সহ বেশ কিছু বইও প্রকাশিত হয়েছে তার। তার গবেষণা ধর্মী লেখা ' কলেশ্বর কলেশনাথ ' বহু গবেষকের গবেষণার রসদ যুগিয়েছে। আকাশবাণীর পল্লীবেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠানে পড়া হয়েছে তার লেখা বীরভূমের দেবদেবী বিষয়ক রচনা।
একসময় বিঘে ১২ জমির উপর নির্ভর করেই তাকে চালাতে হয়েছে পাঁচ ছেলেমেয়ের লেখা পড়া সহ ৮ সদস্যের সংসার। তাই নিজে হাতে জমি চাষ করেছেন। জমিতে লাঙ্গল চালাতে চালাতেই ছন্দ মিলিয়েছেন , সুর ভেজেছেন।
তারপর রাতের বেলায় লন্ঠনের আলোয় লিপিবদ্ধ করেছেন সেইসব ছন্দ - সুর। কখনও নিজেদের ধান চালের আড়তে ওজনও করেছেন। তবু হাজার অনটনে লেখা ছাড়তে পারেন নি।ডাক পেলেই হেটে কিম্বা সাইকেলে হাজির হয়েছেন ১০/১৫ কিমি দুরের সাহিত্য সভায়। অধিকাংশ জায়গায় একটা টিফিনও জোটে নি। বাড়ি থেকে মুড়ি বেঁধে নিয়ে গিয়েও কবিতা -গল্প পড়ে এসেছেন ওইসব সাহিত্য সভায়।
৮১ বছর বয়সেও সেই অভ্যাস যায় নি। আজও সাহিত্য সভার ডাক পেলেই একই ভাবে ঝোলা কাঁধে বেরিয়ে পড়েন তিনি। আজ অবশ্য তাকে আর লাঙ্গলের মুঠি ধরতে হয় না। দুই মেয়ের বিয়ে হয়েগিয়েছে। বড় ছেলে শিক্ষকতা করেন। অন্য দুই ছেলে ব্যবসা এবং চাষ দেখা শোনা করেন। কিন্তু একটুও বদলান নি শুকদেববাবু। সেই একই ধুতি- পাঞ্জাবি আর কাঁধে ঝোলা 'ডেসকোডে'র মানুষটি জেলার শিল্পী সাহিত্যিক এবং সাংবাদিক মহলে পরিচিত নাম।
' রানার ' সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক তথা নাট্যকর্মী বিজয় দাস , সাপ্তাহিক ' নয়াপ্রজন্ম ' পত্রিকার সম্পাদক সমাজকর্মী কাঞ্চন সরকার জানান , শুকদেবদা অন্য ধারার মানুষ। সহজ সরল এবং অনাড়ম্বর জীবন যাপন তাকে অন্যদের থেকে আলাদা ভাবে চিনিয়ে দেয়। তার নীরব গবেষণাধর্মী সাহিত্য সাধনা সাহিত্য জগতকে সমৃদ্ধ করেছে। জেলার বহু অবহেলিত বিষয় তার কলমে উঠে এসেছে। কিন্তু তিনি নিজে প্রচারের আড়ালেই থেকে গিয়েছেন।
এ নিয়ে তার নিজের অবশ্য কোন আক্ষেপ নেই। তিনি সবিনয়ে জানিয়েছেন , ভালোবেসে কলম ধরেছিলাম। সেই সুবাদেই মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। এর বেশি আর আমি কিছু চাই না।একই বক্তব্য স্ত্রী রেবাদেবীরও। তিনি জানান, অভাবের দিনগুলিতে ওনার সাহিত্যরোগ গায়ে জ্বালা ধরাত। এখন বুঝেছি রোগ নয়, সাহিত্যটাও ওনার ভালোবাসার জায়গা। আর ভালবাসাকে কেউ কি ভুলতে পারে ?
শুকদেববাবুর এহেন সাহিত্যনুরাগ দেখে বিভিন্ন সময় তাকে সংবর্ধনা জানিয়েছে বীরভূম সাহিত্য পরিষদ, নেতাজী সংস্কৃতি মঞ্চ, পূর্বাভাস সাহিত্য গোষ্ঠী, দিদিভাই সাহিত্য গোষ্ঠী সহ বিভিন্ন সাহিত্য এবং সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী। নেতাজী সংস্কৃতি মঞ্চের কর্ণধার হিমাদ্রী শেখর দে, বীরভূম সাহিত্য পরিষদের সম্পাদক নবকুমার চক্রবর্তী জানান , শুকদেববাবুর সাহিত্যনুরাগ জেলার সাহিত্যচর্চায় অন্যান্যদের প্রেরণা অনুসরণযোগ্য তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
--------০-------
No comments:
Post a Comment