অনাদরে লাভপুরে পড়ে রয়েছে শাস্ত্রোজ্ঞ ভবদেব ভট্টের সমাধি
অর্ঘ্য ঘোষ
তার লিখিত পু্ঁথি অনুযায়ী আজও জন্ম-মৃত্যু - বিয়ের অধিকাংশ আচার আচরণ অনুসৃত হয়। অথচ সেই পুঁথির রচিয়তা ভবদেব ভট্টের সমাধি অনাদরে পড়ে রয়েছে লাভপুরের শীতলগ্রামে। অথচ তা নিয়ে কারও কোন হেলদোল নেই বলে অভিযোগ। ইতিহাস বলে , আনুমানিক ৭৪২ খ্রীষ্টাব্দে ভবদেব ভট্টের পূর্বপুরুষ বেদগর্ভ বা পরাসর বসতি স্থাপনের জন্যতদানীন্তন বাংলার রাজা আদিসুরের কাছে থেকে বটগ্রাম নামে একটি জনপদ লাভ করেন।
ওই বংশেরই পরবর্তী পুরুষ বশিষ্টও বাংলার রাজার কাছে বসবাসের জন্য সিদ্ধলগ্রাম নামে আরও একটি জনপদ লাভ করেন। বটগ্রামের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় নি। কিন্তু সিদ্ধলগ্রাম রয়েছে বলে মনে করা মনে করা হয়। লাভপুরের শীতলগ্রামই সেদিনের সেই সিদ্ধলগ্রাম বলে ইতিহাসবিদরা মনে করেন।
ওই বংশেরই সন্তান ছিলেন অট্টহাস। বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষা নেওয়ার পর তিনি ফুল্লরা মন্দির সংলগ্ন এলাকায় সাধনা করেন।
তার নামানুসারে আজও ওই এলাকা অট্টাহাস নামেই পরিচিত।শীতলগ্রামে ওই পরিবারেই জন্ম হয় ভবদেব ভট্টের। বালবলভীভুজঙ্গ উপাধিধারী ভবদেব ভট্ট ছিলেন ঢাকার বর্মণ রাজ হরিবর্মার মন্ত্রীসভার মহাসন্ধিবিগ্রহিক ছিলেন। তিনি একাধারে ছিলেন শাস্ত্র এবং অস্ত্র বিদ্যায় সমান পারদর্শী। তার সেই গুণাবলী প্রকাশের উদ্দ্যেশ্যে বর্মণ রাজের সভাপন্ডিত কবি বাচস্পতি মিশ্র ' ভবদেব কুলপ্রশস্তি ' রচনা করেন। উড়িষ্যার ভূবনেশ্বরের বিন্দু সাগরের তীরে অনন্ত বাসুদেবের মন্দিরে সেই কুলপ্রশস্তি এখনও আছে।
সেই প্রশস্তি এবং বিভিন্ন সূত্রে ভবদেব ভট্ট সম্পর্কে অনেক তথ্য জানা যায়। জানা গিয়েছে , ওই পরিবারের অষ্টম পুরুষ ভবদেব ভট্ট 'ব্যবহার তিলক', 'কর্মানুষ্ঠান পদ্ধতি', 'প্রায়চিত্ত প্রকরণ', 'সমন্ধ বিবেক', 'শবসূত কালাশৌচ প্রকরণ' , 'হেরো শাস্ত্র ' প্রভৃতি নামের ধর্মশাস্ত্র এবং 'টৈটাটিট - মত - তিলক' নামে মীমাংসা গ্রন্থ রচনা করেন। সেই সমস্ত শাস্ত্র অনুসরণ করে আজও আমাদের বিভিন্ন পুজোর মন্ত্রোচারণ - আচার আচরণ, পাত্র - পাত্রীর যোজক বিচার, জন্ম - মৃত্যুর অশৌচ পালন, পারলৌকিক ক্রীড়া কর্ম সহ বিভিন্ন ধর্মাচারণ এবং লোকাচার পালিত হয়।
শীতলগ্রামেই ভবদেব ভট্টের মৃত্যু হয় বলে অনেকের অনুমান। গ্রাম ঢুকতেই 'সমাজ তলা ' হিসাবে পরিচিত সমাধিক্ষেত্রে একটি সমাধিকে গ্রামের বাসিন্দারা ভবদেব ভট্টের সমাধি হিসাবে দাবি করেন।
চরম অবহেলা আর অনাদরে পড়ে রয়েছে সেই সমাধি। স্থানীয় বাসিন্দারাই জানিয়েছেন, এতদিন মাটির স্তুপ হয়ে পড়েছিল , সম্প্রতি স্থানীয় এক ব্যক্তি বাবার সমাধি নির্মাণের সময় সেই স্তুপটিও বাঁধিয়ে দিয়েছেন।স্থানীয় বাসিন্দা অশোক ঘোষ, অজয় গড়াইরা জানান , বংশ পরম্পরায় আমরা ওই সমাধিটি ভবদেব ভট্টের বলে শুনে আসছি। বিভিন্ন সময় অনেকে সমাধির ছবিও তুলে নিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু সমাধিটি সংরক্ষণের ব্যাপারে কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয় নি। স্থানীয় ওই ব্যক্তি বাঁধিয়ে না দিলে এতদিন সমাধিটা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে যেত।
ওই বিষয়ে পড়াশোনা এবং লেখা লিখি করেছেন অবসর প্রাপ্ত ইতিহাসের শিক্ষক প্রণব কুমার চট্টোপাধ্যায়। তিনি জানান , আমি ওই সমাধি দেখে এসেছি। কিন্তু সেটা ভবদেব ভট্টেরই কিনা তা নিয়ে প্রামাণ্য কোন নথি নেই ঠিকই , কিন্তু গ্রামবাসীদের দাবিও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কারণ বহু সূত্রে ওই গ্রামে ভবদেব ভট্টদের পরিবারের বসবাসের উল্লেখ পাওয়া যায়।
তাছাড়া যেক্ষেত্রে প্রামাণ্য নথি পাওয়া যায় না সেক্ষেত্রে পরম্পরার উপর ভিত্তি করেই ইতিহাসকে স্বীকৃতি দিতে হয়। সেই হিসাবে সমাধিটির বিষয়ে অনুসন্ধান করে রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করা উচিত।জেলা পরিষদের সভাধিপতি বিকাশ রায়চৌধুরী জানান , বিষয়টি আমার জানা নেই। খোঁজ নিয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলব। সেক্ষেত্রে যদি সত্যিই সমাধিটি সংরক্ষণের ব্যাপারে প্রশাসনিক উদ্যোগ নেওয়া যুক্তি সংগত হয় , তাহলে তা অবশ্যই করা হবে।
--------০-------
No comments:
Post a Comment