( ধারাবাহিক উপন্যাস )
অর্ঘ্য ঘোষ
( কিস্তি -- ১ )
তালপুকুরে ঘটি ডোবার দিন জমিদারবাবুদের অনেকদিন আগেই হারিয়ে গিয়েছে। তালপুকুরটাই নেই। কিন্তু জমিদারবাড়ির খেতাবটুকু আজও আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে অন্নপূর্ণাকে। হোক না চারআনির জমিদার বাড়ির ছোট তরফ। কিন্তু তাকে আজও কেউ ঠাকরুন মা, কেউ বা গিন্নীমা বলেই ডাকে। ডাকটা কেমন যেন বিদ্রুপের মতো মনে হয় অন্নপূর্ণার। কারণ ওই খেতাবটুকুই তার বিড়ম্বনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একই বিড়ম্বনার মুখে পড়তে হয়েছিল তার স্বামীকেও। খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার জন্য তারও জোটে নি কোন ভদ্রস্থ কর্মসংস্থান। জীবন ধারণের তাগিদেই তাই তাকে বেছে নিতে হয়েছিল নানা উন্ছবৃত্তি। আর সেই কারণেই অকালে স্বামীকে হারাতে হয় তাকে। না হলে হয়তো আজ তাকে ভিক্ষাবৃত্তি করতে হত না।
পরের বাড়ি মুড়িভেজে, ধানসিদ্ধ করে চালিয়ে নেবে ভেবেছিল সে। কিন্তু কেউ তাকে সেই কাজ দেয়নি। একে জমিদার বাড়ির গিন্নিমা , তার উপরে ব্রাহ্মণের বিধবাকে দিয়ে ওইসব কাজ করিয়ে কেউ মহাপাতক হতে চায় নি ! তাই শেষ পর্যন্ত ভিক্ষাবৃত্তিই বেছে নিতে হয় তাকে। কিন্তু গ্রামে সে ভিক্ষাও করতে পারে না। প্রথমদিকে দিন কতক চেষ্টা করেছিল। কিন্তু বেশিরভাগই মুখ বেজার করত। কি কারণে যে গ্রামের লোকেরা তারসঙ্গে ওইররকম ব্যবহার করত তা সেদিন বোঝে নি সে। বুঝেছিল অনেক পরে।
আসলে টাকা পয়সা না দিলেও ভগবান তাকে আর তার ছেলেমেয়েদের অঢেল রূপ দিয়েছিলেন। আর পয়সাওয়ালা ঘরের গৃহিণীদের সেটাই হয়ে উঠেছিল গাত্রদাহের কারণ। সেইদিক থেকেও এক অর্থে ভগবান তাকে মেরেই রেখেছেন। তারপর থেকেই কে কি বলবে সেই আশংকায় নিজের গ্রাম ছেড়ে দুর দুরান্তের গ্রামে যায় অন্নপূর্ণা। গড়পড়তা ভিক্ষাজীবিদের থেকে তাকে মেলাতে পারেন না ওইসব গ্রামের বাসিন্দারা। তার মুখের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে গৃ্হস্থ বাড়ির বৌ'ঝিরা তার সঙ্গে আলাপ জমায়। জানতে চায় , কেন তাকে ভিক্ষা করতে হচ্ছে। অনেকেই বলে , মা তোমাকে দেখে ভিক্ষা করার মতো পরিবারের মেয়ে মনে হয় না! জবাবে নিজের জীবনের
করুণ কাহিনী তাদের খুলে বলতে হয় তাকে। শুনতে শুনতে তার মতো ওইসব বৌ-ঝিদের চোখ শুকনো থাকে না। আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে তারা বলে , কেঁদ না মা। দেখো একদিন ভগবান ঠিক মুখ তুলে চাইবেন। কথাটা শুনতে শুনতে কান পচে গিয়েছে অন্নপূর্ণার। সে জানে শেষ পর্যন্ত সেই ভগবানের মুখ তুলে চাওয়ার কথাই বলবে সবাই। কিন্তু ভগবান যে কি কারণে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন তা সে জানে না। ভগবানের কথা উঠলে তাই তার অভিমান হয়। সেইজন্যই যেচে সে কাউকে তার জীবন যন্ত্রণার কথা বলতে চায় না।
কিন্তু বছরের পর বছর ধারাবাহিকভাবে তার জীবন কাহিনী শুনতে শুনতে দূর দুরান্তের
গ্রামের মানুষজন প্রায় সবাই তার কথা জেনে গিয়েছেন। তাদের বেশিরভাগই তাকে শুধু একজন ভিক্ষারিণী হিসাবেই দেখেন না বরং একটু সহানুভুতির চোখেই দেখে। কেউ বলে , ঠাকুরুন মা আজ আমাদের বাড়িতে নাম গান উপলক্ষ্যে লুচি মিষ্টির ফলার হবে। আপনিও চাট্টি খেয়ে যাবেন। কেউ বা বলে , গিন্নিমা , আজ আমার নাতির মুখেভাত। আপনি আমাদের সঙ্গে সেবা দেবেন গো।
যা ঘুরেছেন ঘুরেছেন , আর গাঁ ঘুরতে হবে না।আমরাই যাবার সময় পুষিয়ে দেব ক্ষণ ভালো ভালো খাবারের সামনে বসে কিছুতেই তা মুখে তুলতে পারে না অন্নপূর্ণা। ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলোর কথা মনে পড়ে যায় তার। কতদিন যে এইরকম ভালো খাবার ওরা চোখে দেখে নি তার ঠিক নেই। বিষয়টা নজর এড়ায় না বাড়ির গৃহিনী গৃহকর্তাদের। তারা বলে, ঠাকরুন মা অপনি সব খেয়ে নিন। আপনার ছেলে মেয়ের জন্য বেঁধে দেওয়া হবে। যাবার সময় চাল, জমির ফসল সহ খাবারও বেঁধে অনেকে। আর তাদের মঙ্গলের জন্য সেই ভগবানের কাছেই প্রার্থনা করে সে। তার ভালো না হোক, তাকে যারা ভালোবাসে তাদের যেন ভালো হয়। কখনও চোখে জল চলে আসে তার। তা দেখে বৌ-ঝিরা বলে, একেই বলে নারী জন্ম। জন্মে থেকে শুধুই জ্বালা। তা জ্বলছে বইকি অন্নপূর্ণা।
জ্বালাটা যে ঠিক কবে থেকে শুরু হয়েছিল তা অবশ্য জানে না সে। তবে এখন ভিতরটা তার জ্বলেপুড়ে খাঁক হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এমন হওয়ার কথা ছিল না। জমিদার বাড়ির বৌ হওয়ারও কথা ছিল না তার। তার দিদি বোনেরা চাষী পরিবারের বৌ হয়ে ছেলেমেয়ে নিয়ে দিব্যি সুখে ঘরকন্না করছে। তার তো ওই রকম একটা সংসার হতে পারত। দিব্যি ছায়া ঘেরা খড়ের চালের মাটির বাড়ি।
তকতকে করে গোবর নিকানো উঠোনের এক কোনে তুলসী মঞ্চ। দুটো বলদ , বাছুর সহ একটি গাই। কয়েকটা ছাগল , হাস মুরগী। কিছুটা দুরেই ধানী জমি। এই ছিল তার কুমারী জীবনের স্বপ্ন। স্বপ্নেও ভাবেনি ভগ্নপ্রায় জমিদার বাড়ির দরদালানে একদিন বৌ হিসাবে পা রাখতে হবে তাকে। যেখানে খাপ খাওয়াতেই গড়িয়ে যাবে কয়েকটা বছর। ওইসব কথা ভাবতে ভাবতেই হুড়মুড়িয়ে সামনে এসে দাঁড়ায় অতীত। রূপ কারও কাছে আর্শিবাদ, আবার কারও কাছে অভিশাপ হয়ে উঠে বলে শুনেছে অন্নপূর্ণা। কিন্তু তার কাছে সেটা যে কি তা অবশ্য সে আজও বুঝে উঠতে পারে নি। তিন বোনের মধ্যে মেজ সে। অন্য দুই বোনের থেকে দেখতে শুনতে অনেকটাই ভালো। যেমন গড়ন , তেমনই যেন দুধে আলতায় গোলা রঙ। যে দেখতে সেই বলত , যার ঘরে যাবে তার ঘর আলো করবে। কেমন লক্ষী প্রতিমার মতো গড়ন।
মেয়ের প্রশংসায় বাবা-মায়ের মনে চাপা গর্ব হলেও এক লহমায় তা গ্রাস করে নিত একরাশ দুশ্চিন্তা। তাদের মতো পরিবারে লক্ষীশ্রীর কিই বা দাম আছে। সেই তো ধানসিদ্ধ , মুড়িভাজা নিম্ন মধ্যবিত্ত
পরিবারেই মেয়ের বিয়ে দিতে হবে। দুদিনেই মেয়ের সোনার বরণ কালী হয়ে যাবে। রাখহরি -- পূর্ণিমা মনে মনে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেন , এই মেয়েটার একটা ভালো ঘরে গতি করে দিও ঠাকুর। ভগবান বোধহয় সেদিন অলক্ষ্যে হেসেছিলেন , নাহলে কি এই হয় ? সুন্দরী মেয়ের জন্য যে ধানসিদ্ধ , মুড়িভাজার যে কাজকে বাবা --মা খাটো করে দেখেছিলেন আজ সেই কাজই তাকে কেউ দিতে চায়না।
সব কথা আজ মনে পড়ে যাচ্ছে অন্নপূর্ণার। বাবা--মা আর তিন বোনকে নিয়ে ছিল তাদের সংসার। পাশের গ্রামের জমিদার ভবতারণবাবুদের জমি চাষ করে কোনরকমে তাদের চলে যেত। অভাবের সংসারে বাবা তাদের লেখাপড়ার ব্যাপারে কোন রকম আপোস করে নি। রীতিমতো প্রাইভেট মাস্টার রেখে পড়ানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনবোনই পাশের গ্রামের বড় ইস্কুলে পড়ত। তারই মধ্যে গ্রামেরই চাষী পরিবারের একটি ছেলের সঙ্গে দিদির বিয়ে প্রায় ফাইন্যাল হয়েছিল। পঞ্জিকা দেখে দিনক্ষণ ঠিক করলেই হয়। কিন্তু হঠাৎ যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত। থেমে যায় সেই বিয়ের প্রস্ততি।
No comments:
Post a Comment