অর্ঘ্য ঘোষ
( কিস্তি -- ২ )
দিদির বিয়ের জন্য সেবারে জমিদারের খাজনা দিতে পারেননি বাবা। সেই খাজনা আদায়ের জন্য গোমস্তাকে নিয়ে সটান জমিদারবাবু তাদের বাড়িতে হাজির হন। বাবা তার সামনে হাত কচলাতে কচলাতে বলেন , বাবু মেয়েটার বিয়ে নিয়ে খুব আতান্তরে পড়েছি। নাহলে খাজনা বাকি পড়ত না। এবারটা আমাকে সময় দিন। আগামীবার একসঙ্গে দিয়ে দেব।
বেশ তবে তাই দিও -- বলে জমিদারবাবু চলে যাবার জন্য পা বাড়াতেই দু'গ্লাস ঘোলের সরবত নিয়ে হাজির হয় অন্নপূর্ণা। তার হাত থেকে একগ্লাস সরবত নিয়ে জমিদারবাবু বলেন, ঘোলের সরবত আমার খুব প্রিয়। তা রাখহরি তোমার এই মেয়েরই বুঝি বিয়ে ? বাহ , বেশ দেখতে মেয়েটি তো তোমার। তারপর কিছুক্ষণ মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে থাকেন।
বাবা বলেন , না কর্তা ও তো আমার মেজমেয়ে অন্নপূর্ণা। বিয়ে তো বড় মেয়ে প্রতিমার। আমার তিন মেয়ে, ছোট---।
বাবাকে আর কথা শেষ করতে দেন না জমিদারবাবু। বলেন, তাহলে তো আমাকে আর একবার বসতে হয়। তারপর কারও কিছু বলার অপেক্ষা না করেই মোড়ায় বসে পড়েন তিনি। গোমস্তাকে বলেন, তুমি যাও দিকিনি গ্রামে কার কত বাকি আছে একটু তাগাদা করে এসো। আমি ততক্ষণে আর গ্লাস সরবত খাই। নাগাড়ে কথাগুলি বলে জমিদারবাবু তার দিকে ফেরেন, কই গো মা অন্নপূর্ণা তুমি নিজে হাতে আর একগ্লাস ঘোলের সরবত করে আনো তো। দেখি কেমন তুমি পারো।
অন্নপূর্ণা ফের সরবত করে আনে। সরবতের গ্লাসটা হাতে নিয়ে জমিদারবাবু বলেন, তুমিও একটু বোস মা। আ
গে তোমার বাবার সঙ্গে কথা বলে নিই , তা বলো রাখহরি। তোমার কি মত শুনি ?
বাবা বলেন , কর্তা আপনি যা বলছেন তা তো আমাদের কাছে স্বপ্নের অতীত। আপনার ছেলের সঙ্গে আমার মেয়ের বিয়ে মানে তো আকাশের চাঁদ পাওয়ার সামিল। কিন্তু জানেনই তো কর্তা -----।
বাবার কথা শেষ হয় না। জমিদারবাবু বলে ওঠেন , ও নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। মাকে আমিই সাজিয়ে নিয়ে যাব। তুমি কেবল নিয়ম রক্ষার্থে শাঁখা সিঁদুরটুকু দিও তাহলেই হবে।
অবাক হয়ে যায় অন্নপূর্ণা । কার বিয়ে ? তাহলে কি জমিদারবাবু তার ছেলের সঙ্গে দিদির বিয়ে দেবেন। গ্রামে হবে না দিদির বিয়ে ? সে এক হিসাবে ভালোই হবে। দিদি জমিদারবাড়ির বৌ হলে গ্রামের লোকেদের কাছে তাদের ওজন অনেক বেড়ে যাবে। কেউ আর তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতে পারবে না। তারাও কেমন জমিদার বাড়ি বেড়াতে যেতে পারবে। উত্তেজনায় যেন ফুটতে থাকে সে। আর জমিদারবাবুর কথায় বাবা যেন কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যান।
কোনরকমে বলতে পারে , সে কর্তা আপনি যেমনটি বলবেন, তেমনটিই হবে।
----- তাহলে তুমি একবার তোমার স্ত্রীর সঙ্গে আলোচনাটা সেরেই এসো। আমি একেবারে আর্শিবাদের দিনক্ষণ ঠিক করেই যাব।
----- ও, মেয়েমানুষ কি আর বলবে কর্তা। তাছাড়া আপনারা হলেন আমাদের অন্নদাতা। আপনাদের কথা কি আমরা ফেলতে পারি ?
----- তাহলেও সে তো মেয়ের মা। তারও মতামত নেওয়া দরকার।
----- বেশ কর্তা আমি তাহলে কথা বলে এক ফাঁকে আপনাকে জানিয়ে আসব। ------ তাই কোর।
অন্নপূর্ণা ভাবে, দিদির কি ভাগ্য। একেবারে রাজরানী হয়ে যাবে। কিন্তু জমিদারবাবুর কথায় ভুল ভাঙে তার। জমিদারবাবু তার দিকে ফিরে বলেন -- কিগো মা , তুমি যাবে তো মা আমার ঘরে ?
শুনে লজ্জায় লাল হয়ে যায় তার মুখ। কি শুনছে সে !
তার লজ্জা রাঙা মুখ দেখে জমিদারবাবু বলেছিলেন , বুঝেছি বুঝেছি। আর বলতে হবে না মা।
সব যেন আজও ছবির মতো চোখের সামনে ভাঁসছে। জমিদারববাবু চলে যেতেই মায়ের সঙ্গে সলা-পরামর্শ শুরু করেন বাবা। প্রথম দিকে কিছুটা দোটানায় ছিলেন পূর্ণিমা। বাবাকে বলেছিলেন, হ্যাগো বিয়ে সাদি সমানে সমানে হওয়াটাই ভালো।
কাঁধে কাঁধ না মিললে যে দেঁড়ে টেনে হাঁফিয়ে মরতে হবে। তাছাড়া প্রতিমার বিয়েও ফাইন্যাল হয়ে আছে। দুটো বিয়ে সামাল দেবে কি করে ? বাবা তখন জমিদার বাড়িতে মেয়েকে পাত্রস্থ করার জন্য মরীয়া। এককথায় মায়ের সব আপত্তি নাকোচ করে দেন। বেশ জোরের সঙ্গে বলেন , কিসে আমরা কম? ওদের টাকা পয়সা আছে , আমাদের মেয়ের রূপ-গুণ আছে। আর তা অন্যদের থেকে যথেষ্ট বেশি আছে বলেই না জমিদারবাবু যেচে প্রস্তাব দিয়েছেন।
বাবার যুক্তির কাছে পিছু হঠতে হয় মাকে। অন্নপূর্ণা কিন্তু বাবার কথার সঙ্গে নিজেকে কিছুতেই মেলাতে পারে। রূপের কথা যদি মেনেও নেওয়া হয় , তাহলে ওই তো সেলাই ফোঁড়াই আর এইট পাশের বিদ্যাকে কেউ গুণ বলে না। আর তার থেকে ঢের সুন্দরী অনেক আছে। জমিদারবাবুর কি দেখে যে তাকে পছন্দ হলো ভেবে পায় না অন্নপূর্ণা। তবে কথাটা শোনার পর থেকে তারও তো অবচেতন মনে কখন যেন নিজেকে জমিদারবাড়ির বৌ হিসাবে দেখার ইচ্ছে মনে বাঁসা বেঁধেছিল বইকি। তবে মা কিছুটা মিনমিন করে কেবল বলতে পেরেছিলেন --- কিন্তু প্রতিমার বিয়েটা ?
বাবা বলেছিলেন , প্রয়োজনে প্রতিমার বিয়েটা একবছর পিছিয়ে দেব। তাতে ওরা একবছর অপেক্ষা করতে রাজী থাকে ভালো। নাহলে ফের অন্য জায়গায় সমন্ধ দেখব। ওই রকম পাত্র অনেক মিলবে। কিন্তু জমিদারবাড়ির সমন্ধ আর আসবে ? তাছাড়া ওদের জমি চাষ করে , বলতে গেলে ওদের দয়ায় আমরা খেয়ে পড়ে বেঁচে আছি। বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলে অপমানিত হয়ে ওরা যদি জমিজমা সব কেড়ে নেয় তখন কি হবে ভেবে দেখেছ ?
সত্যিই ভাবনার কথা। জমিদারবাবুদের জমিই যে তাদের খাওয়া পড়ার একমাত্র সংস্থান। তাছাড়া প্রস্তাব ফেরালে যদি বকেয়া খাজনার জন্য চাপ সৃষ্টি করেন তাহলে তো প্রতিমার বিয়েটাও আটকে যাবে। তাই মা'ও শেষ পর্যন্ত সায় দেন বাবার কথায়। বলেন , তবে তাই কর। মুহুর্তের মধ্যে দাবানলের মতো সারা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে খবরটা। আর ছাইয়ের মতো হাওয়ায় উড়ে আসে নানা ব্যঙ্গ - বিদ্রুপ।
পাচুপিসি বলেন -- বলি ও রাধার মা শুনেছো খবরটা। রাখার বাড়িতেই এবার জমিদারের কাচারি হবে গো। খাজনা দিতে আর জমিদারবাড়ি যেতে হবে না।
কেউ বা বলে , রাখার বৌ পুনোর তো আর গরমে মাটিতে পা পড়বে না গো। জমিদার মেয়ের রূপ দেখে ঘরের বৌ করে নিয়ে যাছে , মায়ের গরম তো হবেই। তবে জানি তো জমিদারদের ওই রকম বৌ এক -- আধটা নয় গো, গন্ডা-- গন্ডা থাকে। শখ মিটে গেলেই সব ছুড়ে ফেলে দেয়।
গ্রামের মাইক হিসাবে পরিচিত রুনু মোল্লান। হাঁড়ির খবর চালাচালি না করলে তার নাকি পেটের ভাত হজম হয়না।
সেও ছড়া কেটে বলে সেই গো কথায় বলে না, বড়োলোকের বড়কথা ইলসে মাছের কুটি / কখনও আদরে ছেঁড়ে চাদর, কখনও ধুলোয় লুটোপুটি।
পুকুর-ঘাট, মাঠ কোথাও কান পাততে পারে না অন্নপূর্ণারা। যেন খুব বড়ো একটা গর্হিত কাজ করে ফেলেছে তারা।আসলে জমিদার বাড়িতে তার বিয়েটাকে কেউই মন থেকে নিতে পারে না। বাবাও মাকে সেই কথাই বলে , জানো সব হিংসায় জ্বলে-পুড়ে মরছে বুঝলে। সবাই ভাবছে, আমাদের বাড়িতে মেয়ে থাকতে জমিদার কেন বেছে বেছে রাখার বিটিকেই বউ করে নিয়ে যাবে। আরে অত যদি গায়ের জ্বালা তা কথাটা জমিদারকে গিয়েই বল না। আমাদের হুল ফোটাচ্ছিস কেন বাপু।
গ্রামবাসীদের গায়ে জ্বালা ধরার কারণটা আন্দাজ করে অন্নপূর্ণাও। তাই তাদের টিক্কাটিপ্পনী গায়ে মাখে না সে। বরং হেসে ঠাট্টার ছলে জবাব দিতে ছাড়ে না সেও। তার কষ্টটা অন্য জায়গায়।
No comments:
Post a Comment