অর্ঘ্য ঘোষ
( কিস্তি -- ৩ )
কষ্টটা আজও তার বুকে কাঁটার মতো বিঁধে আছে। কতই বা তখন বয়েস তাদের ? দিদি টেনের ছাত্রী। সে পড়ে নাইনে আর ভগবতী এইটে। পিঠোপিঠি তিন বোনে পুকুর ঘাটে সাঁতার কাটত, স্কুলে যেত। এক টিফিনের কৌটো থেকে মুড়ি খেত। একটা হ্যারিকেনেই গোল হয়ে বসে পড়ত তিনজনে। ভগবতী চিৎকার করে পড়ত বলে দিদির খুব অসুবিধা হত। দিদি এত বলত তবু ভগবতীর নাকি চেঁচিয়ে না পড়লে পড়া মুখস্থ হত না। তাই দিদিকে মানিয়ে নিত হত। কারণ তাদের বাড়িতে তো একটাই হ্যারিকেন ছিল। দিদির ওই মানিয়ে নেওয়া স্বভাবটাই তারও অস্বস্তির কারণ। কথাটা মনে পড়লে আজও নিজেকে অপরাধী মনে হয় তার। তিন বোনে এতদিন খাওয়া -শোওয়া সব একসঙ্গেই করেছে।
কিন্তু জমিদার বাড়িতে তার বিয়ের প্রস্তাবের পরই কোথাই যেন একটা সুক্ষ্ম চিঁড় সৃষ্টি হয়। কারণ বাবা তার বিয়ের জন্য দিদির বিয়েটা একবছর পিছিয়ে দেওয়ার জন্য তার হবু শ্বশুরবাড়িতে কথা বলতে গিয়েছিলেন। তারা নাকি বাবাকে অপমান করে বিয়েটাই ভেঙ্গে দিয়েছে। ছেলের বাবা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, জমিদারের ছেলেটাই বুঝি ছেলে। আর তার ছেলে কিছু নয় ? জমিদারের ছেলের বিয়ের জন্য আগে থেকে ঠিক করে রাখা বিয়ে যারা পিছিয়ে দিতে পারে তাদের বাড়িতে আর বিয়েই নয়। ওই দিনেই অন্য জায়গায় ছেলে বিয়ে দিয়ে তবে ছাড়ব। বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়ার খবরটা দিদির কানেও যায়।
তারপর থেকেই দিদিটা কেমন যেন চুপচাপ হয়ে যায়। এমনিতেই চাপা স্বভাবের দিদিকে দেখে কিছু বোঝার উপায় ছিল না। দিব্যি তার বিয়ে নিয়ে হাসি ঠাট্টায় মাতিয়ে রাখত। কিন্তু সেই হাসির ঠাট্টার আড়ালে কত যে যন্ত্রণা লুকিয়েছিল তা কেবল সে'ই টের পেত। কতদিন রাতে ঘুম ভেঙে দেখেছে দিদি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। সে দিদিকে কোন সান্ত্বনাও দিতে পারে নি। কারণ পাশের ঘরেই বাবা মা থাকতেন। তারা যদি জেনে যান সবকিছু , তাহলে চরম দোটানায় পড়বেন। তাছাড়া সে কিই'বা সান্ত্বনা দেবে ?
তার জন্যই তো দিদির এই অবস্থা। কিন্তু দিদির যন্ত্রনাটা সে উপলব্ধি করে। বড় বোনের আগে ছোট বোনের বিয়ে হলে বড়বোনের মনে এক ধরণের হীনমন্যতা বোধ কু্ঁড়ে কু্ঁড়ে খাই। মনে হয় যেন মেয়ের অক্ষমতাই একমাত্র কারণ। প্রতিবেশীরাই সেটা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আরও বাড়িয়ে দেয়। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয় না। তাদেরকে শুনিয়েই শুনিয়েই প্রতিবেশীরা হাওয়ায় কথা ছুড়ে দেয়। তার মধ্যে মাইক কাকীর গলাটা বেশি শোনা যায়। সে বলে , বলি ও শান্তর মা ব্যাপারটা শুনেছো ? রাখার বড় মেয়েটার নাকি বিয়ে ভেঙে গিয়েছে গো। তার বদলে মেজটার নাকি জমিদারের ছেলের সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে। এরপর আর বড়টার ভালো ঘরে বিয়ে হবে ভাবছ ? সবাই তো খুঁতে বলবে। নাহলে বড় থাকতে ছোটর কেউ বিয়ে দেয় ? শান্তর মাও গলার স্বর উঁচুতে তুলে বলে , তা যা বলেছো কাকী। খুঁত যে নেই তারই বা ঠিক কি আছে ? নাহলে কি এক কথায় কেউ একবছর আগে থেকে ঠিক করে রাখা বিয়ে ভেঙে দেয় ?
কথাগুলো দিদির কানেও যায়। প্রতিবেশীদের কথার হুল তাকে অহরহ মনে পড়িয়ে দেয় তার অযোগ্যতার কথা। কিন্তু সেসব ছাপিয়েও অন্য এক যন্ত্রনায় ভিজে যায় দিদির চোখ। সেটা অন্নপূর্ণার চোখ এড়ায় না। দিদির কষ্টটা কোথাই তা সে অনুভব করে। আসলে তাপসদার সঙ্গে দিদির বিয়ে ঠিক হওয়ার পর ঘনিষ্ঠতা গড়ে না উঠলেও কিছুটা কাছাকাছি তো দুজনে হয়েছিল। পথ ঘাটে দেখা হলে কথাবার্তা হত দুজনের। ওই বয়সে আর পাঁচটা মেয়ের মতোই দিদিও তাপসদাকে ঘিরে রঙিন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল।
তাই স্বপ্নটা ভেঙ্গে যাওয়ায় দিদিও মনে মনে বেশ ভেঙ্গে পড়ে। একদিন স্নান করতে গিয়ে পুকুরঘাটে দিদিকে একা পেয়ে ধরেছিল অন্নপূর্ণা। বলেছিল , দিদি তোর কষ্টটা আমি বুঝি। আমি কিছুতেই এই বিয়ে করব না। আজই বাবাকে বলব। আর যদি করতেই হয় আগে তোর বিয়ে হবে তারপর। তাপসদার বাড়ির লোকেরা তো ঠিক কথাই বলেছে। আগে থেকে ঠিক করে রাখা বিয়ে আর এক মেয়ের বিয়ের জন্য পিছিয়ে দেওয়া কোন পাত্রপক্ষই মানবে না।সব শুনে দিদি চোখ পাকিয়ে বলেছিল, তোমাকে পাকা বুড়ির মতো এনিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না। তাছাড়া ওই বাড়িতে আমি আর বিয়েই করব না। যারা একটা বছর অপেক্ষা করতে পারে না , তারা সারাজীবন আমাকে বইবে কেমন করে ?
----- কিন্তু তুই যে ভিতরে ভিতরে খুব কষ্ট পাচ্ছিস দিদি। আমি যে তা সইতে পারছি না।
------ তুই সব জেনে বসে আছিস। কে বলল আমি কষ্ট পাচ্ছি ? আমার বোনটা জমিদারবাড়ির বৌ হবে তার থেকে বড়ো আনন্দ আর কি হতে পারে বল। তখন না হয় আমার একটা ভালো ঘর দেখে বিয়ে দিয়ে দিবি। কিরে দিবি তো ?
আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না অন্নপূর্ণা। দিদিকে জড়িয়ে ধরে পুকুর ঘাটেই কান্নায় ভেঙে পড়ে। কান্না ধরে রাখতে পারে না দিদিও। কতক্ষণ যে তারা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিল তার ঠিক নেই। দুই বোনের আলিঙ্গন দৃশ্যের স্বাক্ষী হয়েছিল কেবল সান বাঁধানো নির্জন পুকুর ঘাট। সম্বিত ফিরেছিল জল পিপি পাখির ডাকে। দুই বোনকে রাঙিয়ে দিয়েছিল গোধুলি বেলার ডুবু ডুবুু সূর্যের এক অন্য রকম আলো।
ফেরার আগে বোনের হাতটা মাথায় তুলে ভগবতী সেদিন বলেছিল, আমার মাথা ছুঁয়ে কথা দে তুই কাউকে কিচ্ছুটি বলবি না। জমিদারবাড়ির বৌ হওয়া ক'জনের ভাগ্যে জোটে রে। তারপর আমাদের বাড়ির অবস্থা তো জানিস। আমাদের তিন বোনকে পার করা নিয়ে বাবা--মায়ের দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। সেখানে অত বড়ো ঘরে নিখর্চায় তোর বিয়ে হচ্ছে। ভাব তো বাবা মায়ের কতটা চাপ কমে যাচ্ছে। অন্নপূর্ণা সব বোঝে। তাদের মতো ঘরে মেয়ে মানেই তো বোঝা।
কিন্তু দিদির মনের ভাবটাও সে বোঝে। আসলে বোনের ভালো ঘরে বিয়ের সুযোগটাকে সে কিছুতেই হাতছাড়া হতে দিতে চায় না। তারপর একদিন আর্শিবাদ হয়ে যায় অন্নপূর্ণার। সোনার হার দিয়ে আর্শিবাদ করে যান জমিদারবাবু।
মাস খানেকের মাথায় বিয়ের দিনও ঠিক হয়। দিদি হাসি মুখে কোমর বেঁধে বিয়ের সমস্ত কাজ করতে শুরু করে। অন্নপূর্ণা বোঝে দিদি আসলে হাসি দিয়ে কান্না লুকোতে চাইছে। বিয়ের পর তার যদি সেই সুযোগ থাকে তাহলে দিদির একটা ভালো ঘরে বিয়ের ব্যবস্থা করবে সে। যথাসময়ে জমিদারবাবুর ছোট ছেলে সায়ন্তনের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যায় অন্নপূর্ণার।যাবতীয় স্ত্রী আচার শেষ করে বোনর হাত ধরে পাল্কিতে তুলে দেয় ভববতী। দুজনের চোখেই তখন জল। দিদি সেদিন সায়ন্তনকে বলেছিল , ছোট থেকেই আমরা তিন বোন একসঙ্গে আছি। এই প্রথম ও বাড়ির বাইরে পা রাখল। ওকে তুমি যেন সুখে রেখো। লজ্জায় লোকজনের সামনে সায়ন্তন সেদিন অবশ্য কোন কথা বলতে পারে নি। কিন্তু অন্নপূর্ণার মনে হয়েছিল, দিদি নিজের সুখের পথে কাঁটা দিয়ে তার জন্য সুখের দরজা খুলে দিল। হাসির আড়ালে চাপা পড়ে গেল বোবা কান্না। মেয়েরা তো এ রকমই হয়। প্রিয়জনের জন্য নিজেকে বলি দিতে বোধহয় মেয়েরাই পারে।
------০-----
No comments:
Post a Comment