( ধারাবাহিক উপন্যাস )
অর্ঘ্য ঘোষ
( কিস্তি -- ৪ )
আসার সময় সারা রাস্তা সে দিদির কথা ভাবতে ভাবতেই আসে। শ্বশুরবাড়িতে পা রাখার পর হাজার ব্যস্ততার মাঝেও মন থেকে দিদির ভাবনা যায় না। কিন্তু বিয়ে , বৌভাতের জন্য তাকে দূরে সরিয়ে রাখতে হয় সেই ভাবনা। কারণ পড়তি অবস্থা হলে কি হবে , আয়োজনের কোন ত্রুটি রাখেন নি শ্বশুরমশাই। বসানো হয়েছিল রসুন চৌকির বাজনা। চন্দননগর থেকে এসেছিল আলো। আর লাভপুরের পূর্ণা থেকে বাজিকররা এনেছিলেন রকমারি সব বাজিপটকা। খাওয়া- দাওয়ারও ছিল এলাহি আয়োজন। অন্নপূর্ণা আশা করেছিল বৌভাতে দিদিও আসবে। কিন্তু কয়েকজন আত্মীয় আর বোনকে নিয়ে এসেছিলেন কেবল বাবা। না এলেই বোধ হয় ভালো ছিল।
অন্নপূর্ণা লক্ষ্য করছিল জমিদার বাড়ির চড়া আভিজাত্যের আলোয় বাবাদের কেমন যেন ম্যাড়মেড়ে দেখাচ্ছিল। নিমন্ত্রিতদের সঙ্গে তাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া দুরের কথা, ভালো করে কেউ তাদের সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলে নি। তবু বোকার মতো মুখে হাসি ঝুলিয়ে আধো অন্ধকারে বাবারা একাকী কয়েকটা চেয়ারে বসেছিলেন। চোখ ফেটে জল আসছিল তার। মনে হচ্ছিল ছুটে বাবাদের কাছে চলে যায়। কিন্তু শাশুড়ি তাকে সিংহাসনে বসিয়ে দিয়ে বলে গিয়েছেন, মনে রেখ এটা জমিদার বাড়ি জমিদারবাড়ির নিজস্ব একটা আদব কায়দা রয়েছে। এখানে চাপা হাসি, আর মাপা কথা বলাটাই দস্তুর। নিমন্ত্রিতরা সব বিদায় না হওয়া পর্যন্ত উঠবে না। আজ এতদিন পরেও সব মনে আছে অন্নপূর্ণার।
সেদিন তাকে নববধুর সাজে দেখে কতজন কত প্রশংসা সূচক কথা বলছিলেন , উপহার দিচ্ছিলেন , কিন্তু সেদিকে তার মন ছিল না। নিজেকে কেমন যেন জল ছাড়া মাছের মতো মনে হচ্ছিল তার। অনেক রাতে নিমন্ত্রিতদের খাওয়া দাওয়ার পর বাবাদের সঙ্গেই খেতে বসে অন্নপূর্ণাও। পাঁচ কিমি দূরে তাদের বাড়ি। বাবারা এসেছেন সাইকেলে। রাতেই ফিরে যাবেন সবাই। শ্বশুরবাড়ির লোকেরা তাদের রাতে থাকার জন্য একবার বলেনও নি। অন্নপূর্ণার মনে হয় বাপের বাড়ির সঙ্গে তার বোধ হয় সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেল। যাওয়ার আগে একবার বাবার সঙ্গে একান্তে দেখা হয়। প্রনাম করতেই বাবা মাথায় হাত রেখে বলেন , সুখী হও মা।
বাবাকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে সে। কিছুটা দূর থেকেই শাশুড়ি মায়ের গলা শোনা যায় , বৌমা রাত্রি হয়েছে। ওনাদের তো যেতে হবে। এবার ওনাদের ছেড়ে দাও। বাবারা চলে যেতেই এক নিঃসীম শুন্যতা গ্রাস করে নেয় তাকে। বিয়ের পাট চুকতেই সেই শুন্যতা আরও বেশি প্রকট হয়ে ওঠে। তারই মধ্যে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা শুরু হয় তার। একে একে তার নজরে পড়ে রঙ চটে যাওয়া জমিদার বাড়ির দরদালানে ভেঙে পড়েছে খিলান। শেওলা ধরা দেওয়ালে একটা সোঁদা সোঁদা গন্ধ। সর্বত্র কেমন যেন একটা নি:প্রাণ ভাব। তার মধ্যে একপাল পায়রা বকম বকম করে প্রানের সঞ্চার ঘটায়। ওদের সঙ্গেই সখ্যতা গড়ে ওঠে তার। তবুও তার অবচেতন মনে ঘুরে ফিরে আসে গ্রামের পুকুরে ডুব সাঁতার , মাঠে ছোলা কলাই তোলা , আখ মাড়াই কলে আখ কিম্বা গরম গুড় খাওয়া , ভাদ্র মাসের ভোরে পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে তাল কুড়ানোর কথা। আর কি কোনদিন তার গ্রামে ফিরে যাওয়া হবে ?
তার আশংকাটাই যেন সত্যি হয়। কয়েকদিন পরেই শ্বশুরমশাইয়ের সামনে কথাটা বলেই ফেললেন শাশুড়িমা। কোনরকম রাখঢাক না করেই তিনি বললেন , দেখ বৌমা তোমাকে দেখে তোমার শ্বশুরমশাইয়ের ভালো লেগেছিল। তাই তোমাকে ছেলের বৌ করে এনেছেন। আমরা আপত্তি করি নি , মেনে নিয়েছি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে , তোমাদের গুষ্ঠি শুদ্ধো সবাইকে আমাদের মেনে নিতে হবে। জলে তেলে কোনদিন মেশে নি , আর আজও মিশবে না। তোমার বাপের বাড়ির লোকজনরা এ বাড়িতে না এলেই ভালো।পরিচয় দিতে আমাদের খুউব অস্বস্তি হয়। তোমারও বাপের বাড়ি ভুলতে হবে। শ্বশুরমশাইও সব শুনলেন। কিন্তু মুখে একটি কথাও বললেন না। তার মানে শ্বাশুড়ি মায়ের কথায় তারও সায় রয়েছে। আর স্বামীকে বলা না বলা সমান।
এ বাড়িতে তার মতামতের কোন মুল্যই নেই। বাবার অন্নে প্রতিপালিত ছেলের বৌ হওয়া যে কি জ্বালা তা হাড়ে হাড়ে টের পায় অন্নপূর্ণা। মানুষটা খুব একটা খারাপ নয়। কিন্তু ক্ষয়িষ্ণু জমিদার বাড়ির বর্তমান প্রজন্মের সাধারণত যেসব গুণ থাকার কথা তা পুরোমাত্রায় সায়ন্ত্রনেরও ছিল। পুরোমাত্রায় আয়েসী , উদ্যমহীন, নেশাসক্ত। অন্নপূর্ণার বুঝতে বাকি থাকে না শুধু মাত্র ছেলেকে বশে আনতেই শ্বশুরমশাই তাকে ঘরের বৌ করে এনেছেন। ওইসব কথা ভাবতে ভাবতেই তার খুব কান্না পায়। কিন্তু শ্বশুর--শাশুড়ির সামনে কাঁদতেও পারে না। কাঁদার সুযোগ মেলে দ্বিরাগমনে বাপেরবাড়ি গিয়ে। স্বায়ন্তনকে তার বাবা--মা আসতে দেয়নি। পাছে তাদেরই প্রজার বাড়িতে গিয়ে জমিদার বাড়ির অহমিকায় ঘা লাগে বলেই তাকে আসতে দেওয়া হয়নি তা বুঝতে বাকি থাকে না অন্নপূর্ণার। তাই নিয়ে বিয়ের আগের মতোই আর এক প্রস্ত টিকাটিপ্পনী হজম করতে হয় বাবা মাকে।
সব কিছুর জন্য নিজেকেই দায়ি মনে হয় তার। বিশেষ করে দিদির চোখে সে চোখ রাখতে পারে না। দিদিও নানান ব্যস্ততার অজুহাতে কেমন যেন পালিয়ে পালিয়ে বেড়ায়। অন্নপূর্ণা ভাবে এক হিসাবে দিদির ওই আচরণ তাকে অস্বস্তির হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। বড় মুখ করে বলেছিল , জমিদার বাড়িতে বিয়ের পর তার ভালো ঘরে বিয়ের ব্যবস্থা করবে। সে যে কত বড়ো ভুল ছিল তা এখন বুঝতে পারছে। জমিদার বাড়িতে সে বউঠাকুরাণীর তকমা পেয়েছে মাত্র। কিন্তু ওইটুকুই। ওই বাড়িতে নিজের ইচ্ছা মতো কিছু করার অধিকারই তার নেই। তাই কেমন যেন আনমনা দেখায় তাকে।
সদ্য বিবাহিতা মেয়ের ওই ভাব চোখ এড়ায় না পূর্ণিমার। মেয়েকে একান্তে ডেকে মা জিজ্ঞেস করেন - হ্যারে দ্বিরাগমনে সায়ন্তন এল না কেন ? মায়ের এই প্রশ্নের মুখোমুখি যে তাকে হতে হবে তা জানত সে। এ ক্ষেত্রে অন্যান্য মেয়েরা যা করে তাই করার কথা ভেবে রেখেছিল অন্নপূর্ণাও। মেয়ের মুখে একটু হাসি দেখার জন্য বাবা--মা সর্বশান্ত হয়ে মেয়ের বিয়ে দেন। তাই যাই হোক না কেন , বাবা -- মায়ের মুখে হাসি দেখার জন্য বিয়ের পর প্রথম বাপের বাড়ি গিয়ে মেয়েরাও শ্বশুরবাড়ি সম্পর্কে সাতকাহন করে বলে। অন্নপূর্ণাও সেই রকমই গল্প পরিবেশন করতে যাচ্ছিল। কিন্তু মা'ই তাকে তখনকার মতো মিথ্যা বলার হাত থেকে বাঁচিয়ে দেয়।
জিজ্ঞেস করে , খুব বুঝি কাজের চাপ ?
----- ঠিক ধরেছো। শ্বশুরমশাই তো আর সবদিক সামাল দিতে পারেন না । তাই ওকেই সামাল দিতে হয়।
---- তা ভালো, এই তো কাজের বয়েস। দ্বিরাগমনে আসা হলো না তো কি হয়েছে। পরে সময় সুযোগ মতো জোড়ে এলেই হবে।
সঙ্গে সঙ্গে শাশুড়ি মায়ের কথা মনে পড়ে যায় অন্নপূর্ণার। তাই সঙ্গে সঙ্গে সে বলে ওঠে, কি যে বলো না মা তুমি। এখনই আসার সময় পেল না, পরে আবার আসবে তা হলেই হয়েছে।
------ হ্যারে , তাহলে প্রতিমা - ভগবতীর বিয়েতেও কি তোরা আসবি না ?
------ সেটা এখন থেকে কি করে বলি বলোতো ? এমনিতেই শ্বশুরমশাই বলেন বৌমা তোমার হাতের ঘোলের সরবত না হলে কিন্তু আমার চলবে না। আর শাশুড়ির আবার আমার সাজা পান না হলে ভাতই হজম হয় না। তাই দুজনেই আমাকে কাছ ছাড়া করতে চান না।
অভিমানহত গলায় মা বলেন, বুঝেছি বুঝেছি। আর বলতে হবে না। নতুন বাবা--মা পেয়ে আমাদের ভুলে গিয়েছো তো? পরক্ষণেই সুর নামিয়ে তার মাথায় চুমু খেয়ে মা বলেন , এমন শ্বশুরবাড়ি ভাগ্য ক'টা মেয়ের হয় মা। তুমি যেন সারা জীবন শ্বশুরবাড়িতে সবার আদরের ধন হয়ে থেকো।
আর পারছিল না অন্নপূর্না। সুখীর অভিনয় করতে করতে সে হাঁফিয়ে উঠেছিল। সেই সময় তাকে যেন স্বস্তি দিতে বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়ায় জমিদার বাড়ির পালকি।
------০-----
No comments:
Post a Comment