Short story, Features story,Novel,Poems,Pictures and social activities in Bengali language presented by Arghya Ghosh

ঠাকরুন মা -- ৫ /



                    ( ধারাবাহিক  উপন্যাস )

                     অর্ঘ্য ঘোষ 




               ( কিস্তি -- ৫ ) 



হাঁফ ছেড়ে বাঁচে অন্নপূর্ণা । বাবা--মা'কে প্রনাম করে পালকিতে ওঠার জন্য পাবাড়াতেই সামনে এসে দাঁড়ায় দিদি আর বোন। তাদের দু'জনের চোখ তখন ঠলো ঠলো। পালকিছাড়ার আগে তারা একটি প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বলে , যোগলকুন্ডুর বাগানের গোলাপ জামআর খেঁজুর  আছে। তুই খুউব ভালোবাসতিস। তাই আমরা ভোরবেলায় উঠে কুড়িয়ে এনেছি।পরে বাবার হাত দিয়ে করমচা আর কামরাঙ্গাও পাঠিয়ে দেব। নুন-লংকা গুঁড়ো মেখে খাবি, দেখবি খুউব ভালো লাগবে। তাদের কথা শেষ হয় না।  দুচোখে বৃষ্টি নামেঅন্নপূর্ণার। পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে তিন বোন। কাঁদতে কাঁদতেইঅন্নপূর্ণার মনে পড়ে যায় ছোটবেলার কথা। তিনবোন ভোরে উঠে আম, জাম কুড়িয়ে আনত।কত সব জাম রয়েছে যোগলকূন্ডুর বাগানে। খুদি, কাদা আর গোলাপজাম। স্বাদও বিচিত্র।গোলাপ জামে কেমন যেন গোলাপের মতো গন্ধ। কুড়িয়ে এনে নুনজলে ভিজিয়ে রাখত সেইসবজাম। ঘুরত--ফিরত আর টপাটপ মুখে পুড়ত। জামায় দাগ লেগে যেত বলে মা খুব বকাবকিকরত। কিন্তু তারা কানেই তুলত না। মা তত রেগে যেত। কখনও কখনও চেলাকাঠ নিয়ে তেড়েআসত। তারা ছুটে ছুটে পালাত। তাদের ধরতে না পেরে মা যখন রাগে চোখ মুখ লাল করেফেলত তখন বাবা মুচকে মুচকে হাসত। মা যেত আরও ক্ষেপে। বাবা তখন তাদের পক্ষ নিয়ে বলতেন ,  থাক না পূর্ণিমা। ওদের বকাবকি করছ কেন , আমরা কি কখনও ওদের ফলমুলকিছু কিনে খাওয়াতে পারি ? ওরাই বরং কুড়িয়ে আনে বলে আমরা তালের সময় তাল, আমেরসময় আমটা খেতে পায়।



                                     বাবার কথায় তখনকার মত ক্ষান্ত দিতেন মা। কেবল কপট রাগ দেখিয়ে বলতেন , তোমার আশকারা পেয়েই ওরা দিন দিন ধিঙ্গী হচ্ছে  আর মাথায় উঠছে।বাবার মুখে তখন কেমন নির্ভেজাল হাসি লেগে থাকত।  স্বাচ্ছল্য ছিল না , কিন্তুদুখের অন্ন সুখের করে খাওয়ার মন ছিল। ভাদ্র আশ্বিন মাস চরম টানের সময় যেত তাদের। মুড়ি দুরের কথা সবদিন ভাতের চালও জুটত না। ওরা তিন বোন কুড়ানো তালঅবস্থাপন্নদের বাড়িতে দিয়ে আঁচলে করে মুড়ি নিয়ে ফিরত। তারপর ঝুড়ির নিচে থালারেখে  তাল ঘসতে বসত। ভগবতীর একটুও ধৈর্য্য ছিল না। সে একটু করে তাল ঘসত আরঝুড়ি তুলে তুলে মুখে পুরত। দিদি আর সে ওকে পেটুক বলে খ্যাপাত। মা বলতেন , থাক না বাপু ও তো ছোট খিদে সহ্য করতে পারে না।  ওর পিছনে লাগছিস কেন ? তালঘষা হয়ে গেলে সবাই গোল হয়ে বসত। বদলে আনা মুড়ি আর তালের মারি তারিয়ে তারিয়েখেত। খাওয়া শেষে বাবা পরিতৃপ্তির ঢেকুর তুলতেন। মনে হত যেন পোলাও -- বিরিয়ানি খেয়েছেন। আসলে বাবা ওরকমই। সারা বছর অভাবের সঙ্গে লড়াই করে ক্ষতবিক্ষত হয়েওকাউকে বুঝতে দিতেন না নিজের ক্ষত। জমিদারের যৎসামান্য জমি চাষ করেই তাদেরসংসার চলত। জমি চাষ করার জন্য খোরাকি বাবদ যা ধান মেলে তা আষাঢ় -- শ্রাবণমাসেই শেষ হয়ে যায়। ফসল উঠলে দেড়গুণ ফেরত দেওয়ার শর্তে তখন আবার ধান দেড়ে নিতেহয়। ফসল তোলার পর জমিদারের পাওনা, দেড়েদারদের পাওনা মিটিয়ে দিয়ে বাবাকে ফিরতেহয় প্রায় খালি হাতে। মা যৎসামান্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে অন্যের  ধান সিদ্ধ করে, মুড়ি ভেজে জোড়াতালি দিয়ে কোন রকমে সংসারটা চালিয়ে নেন। এক মুহুর্তেমেয়েবেলাটা যেন ছবির  মতো স্পষ্ট ভেসে ওঠে তার চোখের সামনে।

           
                                              পালকিটা দুলেউঠতেই সম্বিত ফেরে তার। ক্রমশ গ্রাম ছাড়িয়ে এগিয়ে চলে ছয় বেহারার দল। ঝাপসাহয়ে যায় তাদের বাড়ি, প্রিয়জনদের মুখ। বেহারাদের গানে ছন্দ ফেরে পালকি। কেবল অন্নপূর্ণার জীবনের ছন্দটা কোথাই যেন হারিয়ে যায়। তার এখন প্রায়ই মনে হয় মা ঠিকই বলতেন। বিয়ে সাদী সমানে সমানে হওয়াই ভালো।নিজেকে তার কেমন পুতুল পুতুল লাগে। মেলা গিয়ে ভালো লাগলে ছেলে মেয়েরা পুতুল কিনে আনে। দিন কয়েক খুবযত্নআত্তি করে। তারপর ইচ্ছে হলে খেলে , না  ইচ্ছে হলে  আলমারিতে তুলে রেখে দেয়। নিজেকেও মাঝেমধ্যে জমিদারবাড়ির পুতুল মনে হয়। এমনিতে সব ঠিক আছে। এখন সেনতুন বৌ হিসাবে জমিদারবাড়ির নতুন বৌঠান। কিন্তু ওই সম্বোধনটার মধ্যেও যেনআভিজাত্য লুকিয়ে রয়েছে। বড়োলোকদের বাড়িতেই সাধারণত ওই ধরণের সম্বোধন শোনা যায়।তবু নিজেকে আস্তে আস্তে পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে চেষ্টা করে সে। কিন্তু শ্বশুরবাড়ির লোকেরা তাকে কেমন যেন অন্য চোখে দেখে। বিশেষ করে তার দুই জা।এমনিতে কথাবার্তা খুব একটা হয়না। যেটুকু হয় তার মধ্যেও তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের ভাব।আসলে তারাও সব পড়তি জমিদার বাড়ি থেকে এসেছে। তাদের বাপের বাড়ি থেকে যখন কেউআসে তখন তারা কত নামীদামী উপহার আনে। আর তার বাবা আনে জমির লাউ, কুমড়ো, পটল,মুলো। তাই অন্নপূর্ণাকে তারা ধর্তব্যের মধ্যেই আনে না। তা নিয়ে অবশ্যঅন্নপূর্ণার কোন অনুযোগ কিন্বা আক্ষেপ নেই। কিন্তু ওরা যখন তার গরীব বাবারপ্রসঙ্গ তুলে খোঁটা দেয় তখন তার চোখ ফেটে জল আসে। কিন্তু সবার সামনে কাঁদতেও পারে না। অনেক রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে কেঁদে একটু হালকা হয় সে। মনে মনে ভাবেমেয়ে হয়েও জা'রা কি করে আর একটা মেয়ের বাবা তুলে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতে পারে ?বাবার সম্মান তো সবার কাছেই সমান। শাশুড়িমা যখন কোন বিষয় নিয়ে ওদের বাপের বাড়িতুলে খোঁটা দেন তখন তো দিব্যি মুখ কালো হয়ে যায়। তবু কেন যে ওরা তার বাবারসম্পর্কে অপমান সূচক কথা বলে তা বোঝে না সে। 


                            
                                          বাবার কথা খুব মনে পড়ে। এত কষ্ট ,তবু সব হাসি মুখে হজম করে নেয় বাবা। কবে আবার বাবার সঙ্গে দেখা হবে কে জানে! খুব ইচ্ছে করছে বাবাকে দেখতে। দিন কয়েক পরেই অবশ্য মেয়ের বাড়ি আসে রাখহরি।বাবার হাতে বিয়ের কার্ড দেখেই অন্নপূর্ণা আন্দাজ করে বাবা বিয়ের নিমন্ত্রণ করতে এসেছে। সেবারে গিয়েই তো শুনে এসেছিল পাশের গ্রামে একই বাড়িতে দুই ভাইয়ের সঙ্গে দিদি আর বোনের বিয়ের কথা চলছে। তাহলে কি একই সঙ্গে দুজনেরই বিয়ে হচ্ছে ? জানতে খুব আগ্রহ হচ্ছে তার। কিন্তু সে সুযোগ নেই। বৈঠকখানায় বাইরের লোকের মতো কম্বলে বসে আছে বাবা। শ্বশুর আর শাশুড়িমা বসে রয়েছেন চেয়ারে। আরও চেয়ার খালি থাকা স্বত্বেও বাবাকে তাতে বসতে বলা হয়নি। এ বাড়ির এটাই রীতি। অর্থকৌলিন্য নাথাকলে তাদের নীচু নজরে দেখা হয়।ওইভাবেই বুঝিয়ে দেওয়া হয় পার্থক্য। বাবার সঙ্গে এই আচরণ খুব ব্যাথা দেয় তাকে। তাদের অবস্থা দেখেই তো শ্বশুরমশাই যেচে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেলেন। তাকে বৌমা হিসাবে মানতে পারলে তার বাবাকে মানতে এতো অনীহা কিসের ? বাবা অবশ্য ওসব অপমান গায়েই মাখেন না। ওটা যে এক ধরণের অপমানসেই বোধই নেই বাবার। বাবা সত্যিই খুব ভালো মানুষ। ভালো মানুষদের কপালেই যেকষ্ট লেখেন ভগবান। দূর থেকেই  অন্নপূর্ণা দেখতে পায় বাবা অত্যন্ত সংকোচেরসঙ্গে  শ্বশুরমশাইয়ের টেবিলের সামনে বিয়ের কার্ডটা নামিয়ে রাখেন। বাবাকে দেখে তার মনে হয় বিয়ের নিমন্ত্রণ নয় , বেয়াইও নয় , যেন কোন অনুগত প্রজা খাজনাদিচ্ছে। শ্বশুরমশাই ফিরেও কার্ডটা দেখলেন না। বাবা হেসে কিছু যেন বলার চেষ্টাকরছিলেন। দুর থেকে কিছু শুনতে পাচ্ছিল না সে। মাঝপথেই তাকে থামিয়ে দেন শ্বাশুড়ি মা। তখন বাবার হাসিটা বড়ো করুন দেখাচ্ছিল। মেয়ের সুখের জন্য বাবারাই তো পারে সমস্ত যন্ত্রনা ভুলে এমন হাসি হাসতে।


              ( ক্রমশ )

No comments:

Post a Comment