Short story, Features story,Novel,Poems,Pictures and social activities in Bengali language presented by Arghya Ghosh

ঠাকরুন মা -- ৬ /

  

                    ( ধারাবাহিক  উপন্যাস )


        অর্ঘ্য ঘোষ 


    (  কিস্তি -- ৬ ) 




শাশুড়িমায়ের কথা শুনে বাবাকে কিছুটা হতাশ দেখাচ্ছিল। তাই বাবার সঙ্গে শাশুড়িমায়ের কি কথা হচ্ছে জানতে খুব কৌতুহল হয় তার। সে বৈঠকখানাঘরের কিছুটা কাছে গিয়ে  দাঁড়ায়। তখন স্পষ্ট হয়ে ওঠে শাশুড়িমায়ের গলা।
--- ছোটবৌমা তো সন্তান সম্ভবা।  আমাদের পরিবারের নিয়ম হল প্রথম বার অন্তঃস্বত্ত্বা অবস্থায়  কোথাও যেতে নেই। তাই আপনার দুই মেয়ের বিয়েতে ওকে তো পাঠাতে পারব না। তবে যৌতুক নিয়ে আমাদের গোমস্তা যাবে। লৌকিকতা বলেও তো একটা কথা আছে। এই আশংকাটাই মনে মনে করছিল অন্নপূর্ণা। বিয়েতে তাকে হয়তো যেতে দেওয়া হবে না। সেটাই সত্যি হল। তবে পারিবারিক নিয়মের কথা বলে তাকে অনেকখানিই অস্বস্তির হাত থেকে  বাঁচিয়ে দিয়েছেন শাশুড়িমা। বাবার মনটা অন্তত বুঝবে। আত্মীয়-- স্বজন, পাড়া --প্রতিবেশীদের কাছে অন্তত তার না যাওয়ার একটা ব্যাখ্যা দিতে পারবে। অন্তঃস্বত্ত্বা হওয়ার বিষয়টি সত্যি হলেও , নিয়মটা শুধু তাকে আটকে রাখার জন্যই অজুহাত হিসাবে খাড়া করা হল কিনা তা নিয়ে অবশ্য সন্দেহ রয়েছে তার মনে।বাবা অবশ্য অত কিছু তলিয়ে ভাবার মানুষ নন। তাই শশব্যস্ত হয়ে বলেন , নিশ্চয় - নিশ্চয়। পরিবারের নিয়ম তো অমান্য করা চলে না। সে সন্তান হওয়ার পরই না হয় যাবে। আমি এসে তখন নিয়ে যাব।শ্বশুর-শাশুড়িমা কোন প্রত্যুত্তর দেন না। তারা বেরিয়ে যেতেই চা নিয়ে ঘরে ঢোকে সে। বাবা তাকে দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন। বিয়ের যোগাড়পাতি কতদুর কি হয়েছে খোঁজ নেয় সে। বাবা জানান , গরু ছাগল সব বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। এমনকি বাড়ির সামনের একফালি জমিটাও বিক্রি করতে হয়েছে। তাতেও সবদিক সামাল দেওয়া যায় নি। এখনও একটা গলার হার কেনা বাকি রয়েছে। 



                                        অন্নপূর্ণার মনে পড়ে যায় সে একদিন বড়ো মুখ  করে দিদিকে বলেছিল তার ভালো ঘরে বিয়ের ব্যবস্থা করবে সে। সেই ক্ষমতা কোথাই তার ? বিয়ের পর কান, নাক, হাত  আর গলায় এক গাছা হার ছাড়া সব গয়না খুলে দিতে হয়েছে শাশুড়িমাকে। সামান্য কিছু টাকা জমেছিল তার। সেই টাকা ক'টা আর গলার হারটা খুলে বাবার হাতে তুলে দিতে যায় সে। বাবা হাত সরিয়ে নিয়ে তীব্র আপত্তি তোলেন --- না, না এ আমি নিতে পারব না। তোর শ্বশুরবাড়ির জিনিস আমি নিতে পারব না। তুই চিন্তা করিস না ,  ব্যবস্থা একটা হয়ে যাবে।
 ----- বাবা এই হারটা শ্বশুরবাড়ির নয়। এটা তো তুমিই আমাকে দিয়েছিলে।  বাবার হাতে জোর করে হার আর টাকা কয়েকটা গুঁজে দেয় অন্নপূর্ণা। যাবার আগে বাবা বলেন , তুই থাকবি না বিয়েতে। আমাদের কারও ভালো লাগবে না। কিন্তু  পরিবারের প্রচলিত নিয়ম তো মানতে হবে। অন্নপূর্ণা ভাবে কত সরল তার ভালোমানুষ বাবা। একবারও তার মনে নিয়মটা নিয়ে কোন সন্দেহই জাগল না। তার  মনে হল না নিয়মটা আসলে একটা অজুহাত মাত্র। বাবা চলে যেতেই খুব মন খারাপ হয়ে যায় তার। এই সময় বাবার পাশে দাঁড়াতে পারলে কত সুবিধা হত। তাদের তো তেমন কেউ নেই। নিজের বিয়ের যোগাড়পাতি হয়তো দিদি--বোনকেই করতে হবে।  নিজেকে খুউব অসহায় লাগে তার। জমিদারবাড়ির বউঠাকরুন সে। কিন্তু সাধারণ পরিবারের একজন গৃহবধুও তার থেকে অনেক ভালো অবস্থায় থাকে। স্বাচ্ছল্য না থাকলেও তাদের পরিবারে আত্মীয়তা আছে। নিছক লোক দেখানো লৌকিকতা নয়, আন্তরিকতার বন্ধনে বাঁধা সেই আত্মীয়তা।কিন্তু বড়োলোকেদের কাছে গরীব আত্মীয়দের যে কোন সম্মানই নেই তার প্রমাণ আরও একবার পেল অন্নপূর্ণা। হঠাৎ একদিন খাওয়ার সময় তার গলার দিকে নজর পড়তেই শ্বাশুড়ি মা বলেন , ছোটবৌমা তোমার গলার হারটা কোথাই গেল ? সত্যি কথাটাই বলে সে। আর তা শুনেই খাপ্পা হয়ে ওঠেন শাশুড়িমা।  সবার সামনেই বলে ওঠেন --এই জন্যই বুঝি মেয়ের সঙ্গে  এত গুজগুজ ফুসফুস হচ্ছিল সেদিন ? নিমন্ত্রণপত্র দিতে আসাটা তাহলে বাহানা ছিল। আসল উদ্দেশ্য ছিল মেয়ের হার হাতানো ? জা'রা বলে, আর ওই তো নিমন্ত্রণপত্রের ছিরি। মনে হচ্ছে যেন শ্রাদ্ধবাড়ির কার্ড। কার্ড দেখলেই বোঝা যায় কাদের কেমন রুচি। আমাদের গ্রামের চাষাভুষোরাও এখন এর চেয়ে ভালো কার্ড করে। কার্ড দেখেই বোঝা যাচ্ছে বিয়ে কেমন হবে। আরে বিবাহিত মেয়ের হার নিয়েই যদি বিয়ে দিতে হয় তাহলে বড়োলোকি করে কার্ড ছাপানোর কি দরকার ছিল ? খুব ভাগ্য ভাল পরিবারের কাউকে যেতে হচ্ছে না। না হলে তো লজ্জায় মাথা কাটা যেত।


                         কথাগুলো শুনে চোখের  জল বাগ মানেনা অন্নপূর্নার। তার তো অজানা নয় , সে চাষাভুষো পরিবার থেকেই এসেছে। কোনদিন কোন বড়াইও সে করে না। তবু কেন বার বার একই প্রসঙ্গ তুলে বিদ্রুপ করা ? তাদের বাড়িতে কার্ড ছাপানোর চল নেই। মুখেই , বড়োজোর সুপারি দিয়েই এতদিন নিমন্ত্রণ করা হয়েছে। তার শ্বশুরবাড়ির কথা ভেবেই এই প্রথম কার্ড ছাপানো হল। তাই কার্ডের গুণাগুণ বাবা জানবে কেমন করে ? আরও নানা কথা ভিড় করে আসে মনের মধ্যে। কিন্তু সে কেবল বলতে পারে --- বিশ্বাস করুন মা ,  বাবা কিন্তু হারটা কিছুতেই নিতে চায়নি। আমিই জোর করে দিয়েছি। হারটা তো বাবারই দেওয়া। কথাটা শুনে শাশুড়িমা সেদিন শুধু আগুন ঝরা দৃষ্টিতে চেয়েছিলেন, মুখে কিছু বলেন নি। সে ভেবেছিল, যাক বিষয়টা অল্পের মধ্যেই মিটে গেল। কিন্তু কয়েকদিন পরই তার ভুল ভাঙে।সেদিন সকাল থেকেই তার মনটা খুব খারাপ। সেদিনই যে দিদি -- আর বোনের বিয়ে। সকালেই শাশুড়িমা গোমস্তাকাকাকে দু'খানা আটপৌরে শাড়ি দিয়ে তার বাপের বাড়িতে পাঠায়।যাওয়ার আগে চুপিসারে শাশুড়িমা কি যেন বলেন তাকে। অন্নপূর্ণা মনে মনে ভাবে , তার গরীব ভালোমানুষ বাবার পান থেকে চুন খসলে তো সাত গুষ্টি উদ্ধার করে ছাড়েন। নিমন্ত্রণ কার্ড ভালো হয়নি বলে কম খোঁটা শুনতে হয়নি তাকে। আর নিজেদের বেলা ?  সেই তো চাষাভুষোদের মতোই উপহার দিয়ে লোকদেখানো লৌকিকতা করতে পাঠানো হল।  তবে তার বাবা অবশ্য তাতেই খুশী হবেন। কারণ উপহার নয় , তার কাছে মেয়ের শ্বশুরবাড়ি থেকে কারও যাওয়াটাই বড়ো ব্যাপার। গোমস্তাকাকা সেই অর্থে তাদের পরিবারের কেউ নন ঠিকই , কিন্তু তিনি অনেক দিনের পুরনো মানুষ। জমিদারবাড়ির মুশকিল আসান বলতে তাকেই বোঝায়। গ্রামের মানুষজন তাকেই জমিদারবাড়ির লোক হিসাবেই দেখে। সেদিক থেকে বিয়েতে গোমস্তাকাকার যাওয়া মানেই লোকে জমিদারের যাওয়ারই সামিল বলে ধরে নেবে। তাতেই বাবার মুখ রক্ষা হবে। 



                                            কিন্তু শাশুড়িমা গোমস্তাকাকাকে কি কথা বললেন তা জানতে খুব কৌতুহল হচ্ছে তার। গোমস্তাকাকা তাকে স্নেহের চোখে দেখেন। সেই ভরসায় তাকে একা পেয়ে কথাটা জিজ্ঞেস করে অন্নপূর্ণা। কিন্তু গোমস্তাকাকা বলেন , সেকথা তো মা তোমাকে এখনই বলতে পারব না। গিন্নিমার নিষেধ আছে , এখনই যেন কথাটা পাঁচকান না হয়। বোঝই তো মা সব। তবে আমি ফিরে এলেই তুমি সব জানতে পারবে। অন্নপূর্ণা মনে মনে ভাবে শাশুড়িমা কি তাহলে গোমস্তা কাকার হাত দিয়ে কোন সাহায্য পাঠাচ্ছে ?  দুই জা যাতে জানতে না পারে তার জন্যই কি এত গোপনীয়তা ? অথচ শাশুড়িমা সম্পর্কে সে কত কি খারাপ ধারণা পোষণ করেছিল। নিজেকে ধিক্কার দেয় সে। একদিন পরেই অবশ্য ধারণাটা তার পাল্টে যায়। মানুষ যে কত নির্মম হতে পারে তা সেদিনই বুঝেছিল সে। পরদিন সকালেই বিয়েবাড়ি থেকে ফিরে আসেন গোমস্তাকাকা।  মা কৌটো ভর্তি করে ভাজা মাছ , মিষ্টি পাঠিয়েছিলেন গোমস্তাকাকার হাত দিয়ে। তা দেখে শাশুড়িমা নাক সিঁটকে বলেন, মদন তুমি আবার ওসব বয়ে আনতে গেলে কেন ? কে খাবে ওসব বাসি খাবার ?  সরলার মাকে বরং দিয়ে দাও। শুনে খুব কষ্ট হয় অন্নপূর্ণার। খাবার যাই হোক না কেন, তাতে যে মায়ের ভালোবাসার স্পর্শ লেগে রয়েছে। সে যে তার কাছে অমৃতের সমান। খুব লোভ হচ্ছে তার। কিন্তু তার তো আর মুখে তোলার উপায় নেই। কাজের মাসি সরলার মাকে সব দিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাও ভালো শাশুড়িমা খাবারগুলো কুকুরকে খাইয়ে দিতে বলেন নি। গরীব মানুষ সরলার মা'রা ওই খাবার  খেয়ে নিশ্চয় খুশী হবে। তাহলেই তার মায়ের খাবার পাঠানোটা সার্থক হবে। কথাটা ভেবে মনে মনে অনেকখানি সান্ত্বনা পায় অন্নপূর্ণা।


                                  ( ক্রমশ )


No comments:

Post a Comment