অর্ঘ্য ঘোষ
( ধারাবাহিক উপন্যাস )
( কিস্তি -- ৭ )
কিন্তু পরক্ষণেই অশান্ত হয়ে ওঠে তার মন। গোমস্তাকাকা চলে যাওয়ার পর শাশুড়িমা তার গলায় একটা হার এনে পড়িয়ে দেন। হারটা পড়িয়ে দিয়ে শাশুড়িমা বলেন , আর যেন গলা থেকে হার খুলে একে - তাকে দিয়ে দিতে না দেখি। হারটা দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে যায় সে। এ যে তার বাবাকে দেওয়া সেই হারটা। এতক্ষণে সেদিন গোমস্তাকাকার সাথে শাশুড়িমায়ের চুপিসারে কথা বলার কারণটা সে ধরতে পারে। অনুমান করতে পারে গোমস্তাকাকার তাকে এড়িয়ে যাওয়ার কারণটাও। বিয়ের দিন হার ফিরিয়ে নেওয়ায় সবার সামনে বাবাকে কতটা অপ্রস্তুত হতে হয়েছিল ভেবে খুব কষ্ট হয় তার। হারটা যেন কাঁটার মতো তার গলায় বেঁধে। বোনের গলা থেকে খুলে আনা হার পড়ে থাকতে তার যে কত কষ্ট হচ্ছে তা সে'ই জানে।
বাবার কাছে আর সে মুখ দেখাতেই পারবে না। বাবাই কি গ্রামের লোকের কাছে মুখ দেখাতে পারবেন ? এমনিতেই জমিদারবাড়িতে মেয়ের বিয়ে দেওয়া নিয়ে তো কম কথা শুনতে হয়নি তাদের। তার উপরে এই বিষয়টা জানাজানি হওয়ার পর বাবাকে কতই না হাসির খোরাক হতে হয়েছে কে জানে ! অথচ বাবা তো কিছুতেই হার নিতে চান নি। বাবা বোধহয় আন্দাজ করেছিলেন এমন কিছু ঘটতে পারে। তার জন্যই এমনটা হয়েছে ভেবে নিজেকে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারে না সে। সেদিন কি হয়েছিল জানতে খুব ইচ্ছে করে তার।
একদিন গোমস্তাকাকাকে একান্তে পেয়ে চেপে ধরে অন্নপূর্ণা -- কাকা, এত বড়ো অভিসন্ধির কথাটা সেদিন আমার কাছে চেপে গেলেন ? বিয়ের আসরে বাবাকে কত বড়ো হেনস্থার মুখে পড়তে হলো বলুন তো ?
---- মা , আমি অনেকদিন জমিদারবাড়ির নুন খেয়েছি , আজও খাচ্ছি। তাই গিন্নিমার নির্দেশ অমান্য করে তোমাকে যদি সেদিন কথাটা বলে দিতাম তাহলে এবাড়ির ভাত কি আর আমার থাকত ? কাজ গেলে এই বয়সে আমি আর কি করতাম বলো তো মা ?
---- আপনি শুধু নিজের পেটের ভাতের কথাটাই ভাবলেন ? একবারও বিয়ের আসরে ওই পরিস্থিতিতে একজন মেয়ের বাবার কি হতে পারে সেই কথাটা ভাবলেন না ?
----- মা গো আমাকে কি তুমি অতই কসাই ভাবো ? জমিদারবাড়ির ভাত আমার পেটে আছে ঠিকই , ওই ভাতের জন্যই জমিদারবাড়ির নির্দেশে অনেক নির্মম কাজও করতে হয়। কিন্তু জমিদারদের মতো মনের মানুষ আমি যে আজও হয়ে উঠতে পারি নি মা।
----- মানে ?
----- আমিও মেয়ের বাবা। আমারও একদিন তোমার বাবার মতোই পরিস্থিতি হয়েছিল। সমস্ত চাহিদা মেটানোর পর কথা মতো একটি আংটি দিতে পারিনি বলে বিয়ের আসর থেকে বর তুলে চলে গিয়েছিল পাত্রপক্ষ। কেউ সেদিন আমার পাশে দাঁড়ায় নি।
----- কি বলছেন আপনি ?
----- লগ্নভ্রষ্টা হয়ে ভোররাতে গলায় দড়ি দিয়ে লোকলজ্জার হাত থেকে মেয়েটা আমাকে মুক্তি দিয়ে চলে যায়।
কথা বলতে বলতে দু'চোখ জলে ভিজে যায় গোমস্তাকাকার। নিজেকে ধরে রাখতে পারে না অন্নপূর্ণাও। লোকটার বুকের মধ্যে যে এতবড়ো একটা যন্ত্রণা লুকিয়ে আছে তা সে কোনদিন টের পায়নি । নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে গোমস্তাকাকা ফের বলতে শুরু করেন --- গিন্নিমার নির্দেশ উপেক্ষা করতে যে পারব না তা আমি জানতাম। নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে ওই পরিস্থিতিতে মেয়ের বাবার কি হয় তা'ও আমার অজানা ছিল না। তাই গিন্নিমার নির্দেশ পাওয়ার পরই ঠিক করেছিলাম মেয়ের হারটা তো বাক্সবন্দী হয়ে পড়েই রয়েছে , এবার ভগবান কাজে লাগানোর সুযোগ দিয়েছেন। সেই হারটা নিয়েই তোমাদের বাড়ি গিয়েছিলাম। তোমার বাবাকে সব খুলে বলে হারটা তুলে দিয়েছিলাম তার হাতে। কেউ জানতেও পারেনি কখন তোমার হার বদলে আমার মেয়ের হারটা তোমার বোনের গলায় পড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সেদিন তোমার বোনকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন আমার মেয়েরই বিয়ে হচ্ছে।
নির্বাক হয়ে যায় অন্নপূর্ণা। কিছুতেই আর চোখের জল ধরে রাখতে পারে না সে। এমন মানুষও আছে ? গোমস্তাকাকা বলেন , ভবিষ্যতের জন্য হারটা রেখেছিলাম। কিন্তু আমাদের আর কিসেরই বা ভবিষ্যত ? বুড়োবুড়ি ছাড়া আমাদের তো আর কেউ নেই।
----- কে বললো কেউ নেই ? আমি বুঝি আপনার মেয়ে নই ?
গোমস্তাকাকাকে প্রণাম করে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে অন্নপূর্ণা। আর তার মাথায় তখন গোমস্তাকাকার আর্শিবাদের হাত। দুজনেরই কথা হারিয়ে যায় , চোখ দিয়ে শুধু আনন্দাশ্রু ঝরে পড়ে।জমিদারবাড়ির চড়া আভিজাত্যের পর্দা ভেদ করে সহমর্মিতার আলোয় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে বিপরীত মেরুতে থাকা দুটি মানুষের হৃদয়। অন্নপূর্ণার মনে হয় মায়া মমতাহীন জমিদারবাড়িতে পিতৃস্নেহ পাওয়ার মতো অন্তত একটি লোক সে এতদিনে খুঁজে পেল। আর অন্নপূর্ণার মধ্যেই মদন গোমস্তা যেন খুঁজে পায় তার আত্মঘাতী মেয়ে অতসীকে। জমিদারবাড়ির কেউ জানতেও পারে না ওই ঘটনার কথা। কেমন যেন একটা ভালো লাগায় ভরে যায় অন্নপূর্ণার মন। কিন্তু অল্পদিন পরেই আবার শ্বশুরবাড়ির বিষ নজরে পড়তে হয় তাকে। তার দুই জায়ের দুটি করে মেয়ে।
তাই তার সন্তান সম্ভাবনাকে ঘিরে পরিরারে একটি পুত্রের জন্য আশার সঞ্চার হয়েছিল। কিন্তু দুই জায়ের মতোই সে'ও কন্যা সন্তানেরই জন্ম দেয়। তারপরই মুখ ভার হয়ে ওঠে শাশুড়ি মায়ের। তাকে শুনিয়ে শুনিয়েই বলেন , আমারই পোড়া কপাল। আগের দু'জন তো পারলই না , ইনিও সেই পথেরই পথিক হলেন। এখন বংশরক্ষা হলে হয়। শাশুড়িমায়ের ভাবখানাই এমন যে তার দুই জায়ের পুত্রসন্তান না হওয়ার দায়ও যেন তার। সে ইচ্ছে করলেই যেন পুত্র সন্তানের জন্ম দিতে পারত। বদমায়েশি করেই পরিবারের বংশররক্ষার কথা না ভেবে কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়েছে। তার এই পরিস্থিতিতে দুই জা অবশ্য মহা খুশী।অন্নপূর্ণা পুত্রসন্তানের জন্ম দিলে জমিদারবাড়িতে তার কদর বেড়ে যেতে পারে বলে এতদিন যেন তাদের পেটের ভাত হজম হচ্ছিল না। অন্নপূর্ণা ভাবে , শাশুড়িমা আর তার দুই জা মেয়ে হয়েও আর একটি মেয়েকে কেন যে এত হেনস্থা করে মজা পায় কে জানে ?
আসলে মেয়েরা নিজেরাই অন্য মেয়েদের সম্মান দেয় না বলেই সমাজও এত অসম্মান করার সাহস পায়। কথাটা ভেবেই খুব খারাপ লাগে তার। স্বভাবতই তার মা হওয়া নিয়ে খুব একটা উচ্ছাস দেখা যায় না শ্বশুরবাড়িতে। বরং সবার মধ্যেই কেমন একটা বিরক্তি ভাব। সে অবশ্য মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে সবকিছু ভুলে যায়। বসন্তকালে জন্ম বলে মেয়ের নাম রাখা হয় বাসন্তী। অন্নপূর্ণার নিস্তরঙ্গ জীবনে বাসন্তীই যেন বয়ে আনে বসন্ত বাতাস। কিন্তু ৬ মাসের মাথায় বাসন্তীকে কেন্দ্র করেই চরম দুশ্চিন্তায় পড়ে অন্নপূর্ণা। মেয়ের মুখেভাত উপলক্ষ্যে মামারবাড়ির তরফে কিছু দেওয়া থোওয়ার ব্যাপার থাকে।
কিন্তু তার বাবার যা অবস্থা , তার উপরে সদ্য দুই বোনের বিয়ে দেওয়ার পর বাবার পক্ষে সেই লৌকিকতা বজায় রাখা যে কিছুতেই সম্ভব নয় তা ভালোই জানে অন্নপূর্ণা। মেয়ে হয়েছে বলে মুখেভাতের অনুষ্ঠান কিছু হবে না , কেবল নিয়ম রক্ষার্থে মুখে ভাতটুকু তুলে দেওয়া হবে মাত্র। কিন্তু মামার বাড়ির তরফে মেয়েকে কিছু দেওয়া না হলে কেউ কথা শোনাতে ছাড়বেন না। শাশুড়িমার কানভারী করে মজা দেখবে দুই জা। তার আভাস এখন থেকেই পাচ্ছে অন্নপূর্ণা।
তাকে শুনিয়ে শুনিয়েই সেদিন শাশুড়িমাকে বড়জা সুলতা বলছিল , মা আপনার আরও নাতনি আছে ঠিকই। কিন্তু আপনার ছোট বৌমার বাবার কিন্তু এখন একটাই নাতনি। দেখুন ভালো কিছু নিশ্চয় দেবে। তার সঙ্গে গলা মেলায় মেজো বৌ মঞ্জুও। সে বলে , দিতে তো হবেই জমিদারবাড়ির ব্যাপার বলে কথা। আমাদের বাবাদের তো সব দিতে হয়েছে। অন্নপূর্ণা বোঝে তার বাবার কিছু দেওয়ার সামর্থ্য নেই বলেই শাশুড়িমাকে তাতাচ্ছে ওরা। শাশুড়িমাও ওদের কথাকে মান্যতা দিতে বলেন , সে তো দিতেই হবে। ওইসব কথাবার্তা শুনে খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে অন্নপূর্না। কিন্তু মুখেভাতের দিন অবাক হয়ে যায় সে। দেখে শাশুড়িমায়ের হাতে একটা সোনার চুলোটি, একজোড়া রূপোর বাঁক সহ অন্যান্য সামগ্রী তুলে দেয় বাবা। আর সেসব দেখে দুই জায়ের মুখ আঁধার হয়ে যায়। তারা ভেবে রেখেছিল আজ একচোট নেবে তাকে।
কিন্তু এখন নিজেরাই মুখ লুকানোর জায়গা পাচ্ছে না। কারণ শাশুড়ি নিজেও 'থ' হয়ে যান। তিনিও ভাবতে পারেন নি তার বাবা সবকিছু তার হাতে ওইভাবে তুলে দেবেন। অন্নপূর্ণা কিন্তু ভেবে পায়না বাবা কিভাবে এতসব যোগাড় করল। শেষে বাড়িটাও বিক্রি করে দিল নাকি ? কাজকর্ম সব চুকে যাওয়ার পর বাবাকে একান্তে ডেকে সে বলে ---- এসবের কি দরকার ছিল ? আমাকে না হয় কিছুটা গঞ্জনাই সইতে হত। তাবলে বাড়ি বিক্রি করে এতসব? এরপর কি তাহলে আমার জন্য শেষে তোমরা গাছতলায় থাকবে বাবা ? মেয়ের কথা শুনে বাবার মুখে ফুটে ওঠে করুণ হাসি।
------০-----
No comments:
Post a Comment