Short story, Features story,Novel,Poems,Pictures and social activities in Bengali language presented by Arghya Ghosh

অন্তরালে -- ১






           অন্তরালে 

             অর্ঘ্য ঘোষ


     
      ( ধারাবাহিক উপন্যাস ) 


শ্বশুর সুহৃদরঞ্জন আর  শাশুড়ি অন্নপূর্ণার দেব দ্বিজে যে সবিশেষ ভক্তি ছিল তা নিয়ে কোন সংশয় নেই হরপার্বতীর। চাষাভুষো মানুষ হলে কি হবে , গলায় তুলসী কাঠের মালা নিয়ে  শ্বশুরমশাই  সকাল সন্ধ্যা খঞ্জনি বাজিয়ে নামগান করতেন। গোটা বৈশাখ মাস সন্ধ্যায় নামের দলের সঙ্গে পাড়ায় পাড়ায় হরিনাম সংকীর্তন করে বেড়াতেন।শাশুড়ি মা'ও বারো মাস সকাল সন্ধ্যা জপ-আহ্নিক না করে জলস্পর্শ করতেন না।বাউল ফকির কেউ এলে একবেলা সেবা না করিয়ে ছাড়তেন না। সবাই বলত আজকের দিনে প্রভাতকুসুমের বাবা-মায়ের মত মানুষ হয় না। কারও কাঁচা আলে পা দেন না। বাস্তবিকই তারা  দু'জনেই ছিলেন প্রচণ্ড ধর্মভীরু মানুষ। সেজন্যই বোধ হয় নাতির নামকরণেও তারই বহ্বিপ্রকাশ ঘটেছিল। দুজনে আলোচনা করেই হরপার্বতীর ছেলের নাম রেখে ছিলেন দেবপ্রিয়। সেই ছেলে দেবতার কতটা প্রিয় তা জানেন না হরপার্বতী। কিন্তু ছেলে যে সকল মানুষের খুব প্রিয় হয়ে উঠেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। 
শ্বশুর- শাশুড়ি বলতেন , যে মানুষের প্রিয় হয় , সে ভগবানেরও প্রিয় হয়।মানুষের মধ্যেই যে ভগবানের  বাস। গ্রামের মানুষের কাছে প্রিয় সত্যি সত্যিই প্রিয়জন হয়ে উঠেছে। কারও বাড়িতে কেউ মারা গেলে সর্বাগ্রে ডাক পড়ে প্রিয়র। আত্মীয়দের  খবর দিতে হবে। তারা এসে না পৌঁছানো পর্যন্ত শবযাত্রীরা মৃতদেহ নিয়ে শ্মশানে যেতে পারবেন না। অমনি প্রিয় দাদুর আমলের লজঝরে মার্কা হারকিউলেক্স সাইকেলটা নিয়ে ৮/১০ কিমি দুরের আত্মীয় বাড়িতে খবর দিতে ছোটে। কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েছে , বাড়িতে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাওয়ার কেউ নেই তো কি হয়েছে ?  প্রিয় তো আছে। সিউড়ি-বর্ধমানে যেখানেই হোক, ঠিক ডাক্তার দেখিয়ে রোগীকে বাড়ি পৌঁচ্ছে দেবে সে। এখন সবাই আর অনুরোধ নয় , ঘরের ছেলের মতোই ফরমাইশ করে। একদিন ছেলেকে হরপার্ব্বতী জিজ্ঞেস করেছিলেন -- প্রিয় ঘরের খেয়ে ওইসব বনের মোষ তাড়িয়ে কি পাস তুই ?
একটুও না ভেবে প্রিয় উত্তর দিয়েছিল -- কিছু পাওয়ার কথা ভেবে তো ওইসব করি না। ভালো লাগে তাই করি মা।
ছেলের ভালোলাগার কথা শুনে মায়েরও ভালো লাগে।ওদের বংশের ধারাটাই যে ওই। কারও বিপদ আপদের কথা শুনলেই হলো। শ্বশুর থেকে স্বামী , সবাইকে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখেছে হরপার্ব্বতী। তাদের বংশের ছেলে হয়ে প্রিযই় বা কি করে গ্রামের মানুষের ডাক উপেক্ষা করে  থাকতে পারে ?


                        মনোহরপুর গ্রামে আরও পাঁচটা চাষাভুষো পরিবারের মতোই হরপার্বতীরও অভাবের সংসার। বিঘে দুয়েক পৈত্রিক জমি ভাগে পেয়েছিলেন প্রভাতকুসুম। সেই জমির ফসলের উপর নির্ভর করেই ছেলে প্রিয় আর মেয়ে মধুরিমার পড়াশোনা সহ চার সদস্যের সংসার কোনরকমে জোড়াতালি দিয়ে চালাতে হয়েছে হরপার্বতীকে। তাও প্রিয়র বাবা নিজে গায়ে গতরে খাটে বলে কোন রকমে চলে যায়। চলে যাওয়া বলতে অবশ্য ওই নুন আনতে পান্তা ফুরনোর মতো হাল।কোনকালেই ছেলেমেয়েদের শখ আহ্লাদ তেমন একটা মেটাতে পারেন নি। সব বার পুজোতেই জামা প্যান্ট কিনে দিতে পারেন নি। প্রিয় সংসারের হালচাল কিছুটা বুঝলেও মেয়েটা কিছুতেই বুঝতে চাইত না। স্কুলের বান্ধবীদের দেখে কখনো জামা , কখনো বা সুগন্ধি তেলের জন্য ঘ্যানঘ্যান করতো। তাই নিয়ে কম বকুনি খেয়েছে মধুরিমা ? সেই মেয়েই আজ পরের ঘরে। বছর দুয়েক হল পাশের গ্রামের স্বপন মণ্ডলের একমাত্র ছেলে সৌরভের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে তার। সৌরভ এমনিতে কিছু করে না ঠিকই , কিন্তু ছেলে হিসাবে খুবই ভালো। কিছু জমি জমা আর পুকুর গড়েও আছে ওদের। মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবার। মধুরিমাকে দেখে ওদের খুব পচ্ছন্দ হয়ে যায়। তাই দেনাপাওনা নিয়ে দরাদরি  করেন নি। তাও বিয়ে দিতে গিয়ে বিঘে খানেক জমি ঘুচে গিয়েছে। তা যাক , তা নিয়ে তাদের কোন আক্ষেপ নেই।মেয়েটা তো সুখী হয়েছে। এর চেয়ে বড় কথা আর কি'ই বা হতে পারে ?  জমি ঘুচে গেলে চাষি পরিবারের লোকেদের মনে খুবই কষ্ট হয়। বসুমতী মৃত্তিকাকে মা জ্ঞান করেন চাষিরা। তাই পারতপক্ষে কেউ জমি বিক্রি করতে চান না। হয় ভালো জমি কেনার জন্য খারপ জমি বিক্রি করে , নয়তো খুব আতান্তরে পড়লে জমি বন্ধক দেয়। তারপর হয়তো এক পুরুষ আর সেই জমি ছাড়াতেই পারে না , তবু জমি বিক্রি করে না। কিন্তু তাদের তো বিক্রি না করে কোন উপায়ও ছিল না। কানাকড়িও তো সঞ্চয় ছিল না তাদের। বিয়ের পর মধুরিমার হাসিখুশী মুখ তাদের জমি বিক্রির যন্ত্রণা ভুলিয়ে দিয়েছে। তাদের আক্ষেপ শুধু একটাই , জমি বিক্রি হয়ে যাওয়ার পর লেখাপড়ায় ভালো মাথা থাকা স্বত্ত্বেও তারা স্বামী-স্ত্রী বার বার বলেও  ছেলেটাকে আর কলেজে পাঠাতে পারেন নি।সামান্য ওই এক বিঘে জমির আয়ে তাকে পড়াতে গেলে সংসারের হাল আরও বেহাল হয়ে পড়বে সেই ভেবেই যে ছেলেটা আর কলেজমুখো হতে চায় নি তা বুঝতে অসুবিধা হয় না হরপার্ব্বতীর। তবু একদিন শেষ চেষ্টা হিসাবেছেলেকে চেপে ধরেছিলেন হরপার্ব্বতী -- হ্যা রে প্রিয় , তুই আর পড়তে চাস না কেন রে ? তোর কি ধারণা তোকে পড়াতে হলে আমরা সবাই না খেয়ে মরে যাব? সেই দুঃশ্চিন্তা করতে হবে না। আমি কোন রকমে ঠিক চালিয়ে নেব।
প্রিয় সেই কথা কানেই তোলে নি। বরং তাকেই এক প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল সে। সরাসরি জিজ্ঞেস করেছিল -- কি হবে আর পড়ে ?  বেশি পড়লেই কি চাকরি হয়ে যাবে ভাবছ ? এই তো রাজুদা -ঋজুদারা সব বড়ো বড়ো পাশ দিয়ে বসে আছে , চাকরি হচ্ছে ? হবার হলে যেটুকু পড়েছি তাতেই হবে। তাবলে তোমাদের  দুজনকে  আধপেটা খেয়ে আমার লেখাপড়ার পিছনে অনর্থক টাকা পয়সা খরচ করতে আমি দেব না। তার চেয়ে যতদিন কিছু না হয় ততদিন বরং বাবার সঙ্গে মাঠেই খাটি।


                  ছেলেকে তখন কিছু বলতে পারেন নি প্রভাতকুসুম। দেবপ্রিয়র কথাটা তো আর ফেলে দেওয়ার নয়। তাদের ছোট্ট গ্রামেই অভাবের সঙ্গে লড়াই করে পড়াশোনা করার পর ছেলেগুলো সব ফ্যা-ফ্যা করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তবে ছেলেকে মাঠে খাটতেও দেন নি তিনি। শিক্ষিত ছেলে এই বয়েস থেকে মাঠে খেটে শরীর মাটি করবে তা মন থেকে মেনে নিতে পারেন নি প্রভাতকুসুম। তাদের পরিবারে প্রিয়ই তো সব থেকে বেশি শিক্ষিত। তাই মুড়ি-জলখাবার নিয়ে প্রিয় মাঠের কাজে হাত লাগানোর উপক্রম করতেই না - না করে ওঠেন প্রভাতকুসুম। বলেন,  -- যা - যা বাড়ি যা। গায়ে রোদ লাগাস না , ঘেমে সর্দ্দিগর্মি হয়ে যাবে। আমি যতদিন পারি ততদিন তোকে এসব করতে হবে না। চাকরি-বাকরির চেষ্টা কর। 
প্রিয়ও সেই চেষ্টাই করে।  পাশাপাশি রোগীদের ডাক্তার দেখানোর কাজটাও সমান তালে চলে। সেই কাজ করতে গিয়েই সে সুশোভন মিশ্রের সুনজরে পড়ে যায়।  সুশোভনবাবু নাম করা ডাক্তার। বোলপুরে চেম্বার আর নার্সিং হোম দুইই রয়েছে তার। প্রিয় বিভিন্ন গ্রাম থেকে রোগীদের তার কাছে দেখাতে নিয়ে যেত। ডাক্তারবাবু প্রথমে ভেবেছিলেন প্রিয় হয়তো টাকার বিনিময়ে ওইসব রোগীদের তার কাছে দেখাতে নিয়ে আসে। তাই চেম্বার কিম্বা নার্সিং হোমে রোগী আনার জন্য রিক্সাচালক , গাড়ির ডাইভারদের যেমন কমিশন  দেন তেমনি প্রিয়কেও একান্তে ডেকে কিছু টাকা তুলে দিতে গিয়েছিলেন। প্রথমে ব্যাপারটি বুঝতে না পেরে ডাক্তারবাবুর মুখের দিকে অবাক হয়ে চেয়েছিল প্রিয়। তারপর ডাক্তারবাবুর মুখে সব শোনার পর বিনীত ভাবে বলেছিল -- স্যার আমি বেকার ঠিকই ,  কিন্তু রোগী আনার জন্য কমিশন নিতে পারব না। আমাকে ক্ষমা করবেন।
কথাটা শুনে নিজের কানকেও যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না সুশোভনবাবু। আজকের দিনে এ'ও সম্ভব ? এভাবে কেউ হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলে ? মনের ভাব চেপে রেখে বলেন , চলে যেও না, বাইরের ঘরে একটু বসো। আমি রোগী ক'টা দেখে নিই। তারপর তোমার সঙ্গে কথা বলব। কিছুক্ষণ পরেই প্রিয়কে নিজের চেম্বারে ডেকে নিয়েছিলেন তিনি। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব জানার পর বলেছিলেন , তোমাকে তো প্রায়ই পেশেন্ট নিয়ে আসতে দেখি। যতদিন অন্যকিছু না জোটে ততদিন তুমি বরং আমার চেম্বারে রোগীদের নাম লেখার কাজ কর। যেদিন তোমার সঙ্গে রোগী থাকবে সেদিন ডাক্তার দেখানোর ব্যবস্থা করে দেবার পরও তুমি কাজটা করতে পার। আর যেদিন কেউ থাকবে না সেদিন তো কোন কথাই নেই। সেই থেকেই রোগী নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি ডাক্তারের নাম লেখানোর কাজ শুরু করে প্রিয়। 


                               কিন্তু বাড়িতে মা - বাবাকে কিছু জানতেই দেয় নি। হরপার্ব্বতী ভেবেছিলেন যেমন রোগী নিয়ে যায় তেমনই হয়তো যাওয়া আসা করছে। আসল বিষয়টি মাস খানেক পর জানতে পারেন তারা। একদিন বাড়ি ফিরে হঠাৎ মায়ের হাতে ৭ টা ১০০ টাকার নোট ধরিয়ে দেয় প্রিয়। হরপার্ব্বতী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইতেই তার পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করে প্রিয় বলে , টাকার অঙ্কটা খুব বেশি নয়, কিন্তু তোমার ছেলের প্রথম রোজগারের টাকা। ওই টাকা তুমি আর বাবা তোমাদের খুশী মতো খরচ কোর। হরপার্ব্বতীর মনে হয় প্রিয় যেন সেই ছোট্টটি আছে। ছোটবেলাতেও ঠিক এই ভাবে বনবাদার থেকে দুই ভাইবোনে কচুপাতার ঠোঙ্গায় করে বৈচিকুল কিম্বা খুদিজাম এনে বলত , মা তুমি আর বাবা এগুলো মজা করে খাবে। তারপর ছেলের মুখে সব কথা শুনে আনন্দে গর্বে বুক ভরে ওঠে। আবেগে গলা বুজে আসে তার। কোন কথা বলতে পারেন না। বেশ কিছুক্ষণ পর নিজেকে সামলে বলেন , ওরে মায়ের কাছে ছেলের রোজগারের টাকার অঙ্কটা বড়ো কথা নয়। আজকের যুগে ক'জন মায়ের ছেলের রোজগারের টাকা হাতে পাওয়ার সৌভাগ্য হয় ? কিন্তু বাবা এতদিন আমাদের কিছু বলিস নি কেন ? সেই যে তোরা কি যেন বলিস না রে কথাটা ? ওই যে - - সারপ্রাইজ দিবি বলে ? 
আর যাই কোথাই ? হরপার্ব্বতীর কথা শেষ হতে না হতেই মাকে দু'হাতে তুলে ধরে পাক কত ঘুরিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে বলে -- ঠিক বলেছো মা।
হরপার্ব্বতী সেই ছোটবেলার মতোই ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে  কপালে ঠোঁট ছোঁওয়ান।




      ( ক্রমশ ) 

No comments:

Post a Comment