অন্তরালে
অর্ঘ্য ঘোষ
( ধারাবাহিক উপন্যাস )
প্রিয়র মুখের দিকে চাইতেই ওদের ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যায় তার। প্রভাতকুসুম বাড়ির বড় ছেলে। সেই সুবাদে বাড়ির প্রথম নাতি দেবপ্রিয়। দাদু-ঠাকুরমার তো বটেই , বাড়ির অন্যান্যদের কাছেও ভীষণ প্রিয় ছিল দেবপ্রিয়। সেইজন্য আদর করে তাকে প্রিয় বলে ডাকত সবাই। সেই থেকে তার ডাক নাম হয়ে যায় প্রিয়। তারপর তো মধুরিমা এল। সে এসে তার আদরে কিছুটা ভাগ বসায়। তবে তা নিয়ে অবশ্য প্রিয়র কোন অনুযোগ ছিল না। অভাবের সংসারে আদরেরই বা কি এমন ছিল ? সব বছর তো পুজোতে ওদের জামা-প্যান্টও কিনে দিতে পারতেন না। তাই খুব কষ্ট হত হরপার্ব্বতীর। অন্যান্য বাড়ির ছেলেমেয়েরা যখন নতুন পোশাক পড়ে ঘুরে বেড়াত তখন আঁচলের আড়ালে কান্না লুকোতেন তিনি। পরে অবশ্য মাথা খাটিয়ে একটা বুদ্ধি বের করেছিলেন।পয়লা মাঘ ঢেকায় একদিনের ব্রহ্মদৈত্যের মেলা হয়। ছেলেমেয়েকে সেই মেলা দেখাতে নিয়ে যান প্রভাতকুসুম।স্বামীকে সেই মেলা থেকে প্রতিবছর একটা করে লক্ষ্মীর ভাঁড় নিয়ে আসতে বলতেন। সেই ভাঁড়ে সারা বছর ধরে কিছু কিছু করে পয়সা জমাতেন।তারপর পুজোর সময় সেই ভাঁড় ভেঙে ছেলেমেয়েদের নতুন জামাপ্যান্ট কিনে দিতেন। সেইসময় তো বটেই , এখনও কাছাকাছির মধ্যে সেই আমোদপুর ছাড়া কাপড়ের দোকান নেই। গ্রামের মানুষের ভরসা মুনতাজ আলি। মুনতাজের বাড়ি মুর্শিদাবাদের কুলি। সে মাসে একবার জামা কাপড়ের গাঁট নিয়ে ফেরি করতে গ্রামে আসে। গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ তার কাছেই কেনাকাটা করে। মুনতাজের কাছে অল্পবিস্তর ধারও মেলে। সেই মুনতাজের কাছেই পুজোর সময় ভাঁড়ে জমানো পয়সা দিয়ে হরপার্ব্বতীও ছেলেমেয়েদের জন্য
জামাপ্যান্ট কিনতেন। মেয়েটা ফেরিওয়ালার জামা-প্যান্ট নিয়ে খুঁতখুঁত করত , কিন্তু প্রিয়র ওসবের বালাই ছিল না। ছোট থেকে ছেলেটা ওইরকমই। সাজ পোশাক নিয়ে কোন বাছবিচার ছিল না। বোতাম ছেঁড়া জামা কিম্বা রঙ জ্বলে যাওয়া প্যান্ট পড়ে দিব্যি স্কুলে চলে যেত। আজও সেই একই রকম রয়ে গিয়েছে। এই বয়সে সব ছেলেমেয়েরই সাজ পোশাকের দিকে ঝোঁক থাকে। কিন্তু প্রিয়র সেসব নিয়ে কোন আগ্রহই নেই। রোগী নিয়ে তো কত জায়গায় যেতে হয় তাকে। যা পায় তাই পড়েই চলে যায়। বাইরে পড়ে যাওয়ার মতো জামা প্যান্ট তো বিশেষ একটা নেই। টাকা পয়সার অভাবে কিনেও দিতে পারেন না। তাই খুব আক্ষেপ ছিল তার। কিন্তু এবার প্রিয়র রোজগারের টাকাটাই তার সেই আক্ষেপ দূর করতে সাহায্য করে।রাত পোহালেই মাঠপালুনি উৎসব।
পুজোর মতোই এই উৎসবে নতুন পোশাক কেনার চল রয়েছে। কয়েকদিন ধরেই সেই কেনাকাটা নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় ছিলেন হরপার্ব্বতী। মেয়েটাকে একটা কাপড় কিনে দেওয়ার মতোও টাকাকড়ি হাতে বিশেষ একটা ছিল না। কি করে কি হবে ভেবে পাচ্ছিলেন না। প্রিয়ই তার সেই দুর্ভাবনা দূর করে দিয়েছে। তাই কেনাকাটার জন্য ছেলেকে নিয়ে আমোদপুরের বাজারে যান। কাপড়ের দোকানে ঢুকে প্রথমে ছেলের জন্য একটা জামাপ্যান্ট বাছাতে শুরু করতেই প্রিয় একটা হলুদ রঙের তাতের শাড়ি এনে তার গায়ে জড়িয়ে বলে - মা এই শাড়িটা তুমি নাও। তোমাকে খুব ভালো মানাবে।
--- না -- না , আমার এখন লাগবে না। আমার শাড়ি আছে।
--- তাহলে আমারও লাগবে না। বলেই অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয় প্রিয়। অগত্যা সবার জন্যই পোশাক কিনতে হয় তাকে। মধুরিমার জন্যও একটা শাড়ি নেওয়া হয়।সব শেষে একটা সালোয়ার কামিজ পচ্ছন্দ করে প্রিয়কে বলেন -- দেখ তো এটা কেমন হবে ?
--- এটা আবার কার জন্য নেবে ?
---- এটা স্বাতীর জন্য নেব ভাবছি। মাঠপালুনিতে মধুরিমার সঙ্গে তো স্বাতীও আসবে। তাই ওকে এটা দেব ভাবছি।
স্বাতীর কথা শুনে কেমন যেন অস্বস্তির ছাপ ফুটে ওঠে প্রিয়র মুখে। চূড়ান্ত কিছু সিদ্ধান্ত না হলেও স্বাতীর সঙ্গে প্রিয়র বিয়ের ইচ্ছা উভয় পরিবারই পোষণ করে। স্বাতী এবারই উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে। দেখতে শুনতেও ভালো। ওরা একে অন্যকে পচ্ছন্দও করে। প্রিয় চাকরি বাকরি একটা কিছু পেলে বিয়ে নিয়ে কথা এগোবেন হরপার্ব্বতী।বাড়ির সবার জন্যই যেখানে কিছু না কিছু কেনা হচ্ছে সেখানে স্বাতীই বা বাদ যাবে কেন ? আজ না হলেও কয়েকদিন পরেই তো সে তাদের বাড়িরই একজন হয়ে উঠবে। সালোয়ার কামিজটা নিয়ে মতামতের জন্য ছেলের মুখের দিকে চেয়ে বলেন --- কই, কি করব কিছু বল ?
--- আমি সালোয়ার কামিজের কি বুঝি বলো ? তোমার যেটা ভালো মনে হচ্ছে সেটাই নাও।
প্রিয় যে লজ্জার কারণেই সরাসরি কোন মন্তব্য করতে পারছে না তা বুঝতে অসুবিধা হয় না হরপার্ব্বতীর। তবে ছেলের মুখের ভাবই বলে দেয় তার বাছাই করা পোশাকটা প্রিয়রও পচ্ছন্দ হয়েছে। সেটাই স্বাতীর জন্য নেন হরপার্ব্বতী। মুখে কিছু না বলতে পারলেও প্রিয়র অবশ্য ভালোই লাগে। মধুরিমার বিয়ের আগেই তো স্বাতীকে দেখে তার ভালো লেগে গিয়েছিল। সেই সময় নানা প্রয়োজনে তাকে এবাড়ি- ওবাড়ি করতে হত , তখন থেকেই স্বাতীর সঙ্গে আলাপচারিতা শুরু হয় তার। বিয়ের রাতে তারা অনেকক্ষণ গল্প - গুজব করে। তারপর কখন যেন স্বাতীর প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ে সে। সেই অনুরাগ বেড়েই চলছে। তারও মনে হয়েছিল মাঠপালুনি উপলক্ষ্যে স্বাতীর জন্যও একটা কিছু কেনা হোক। কিন্তু লজ্জায় তো সেটা মুখ ফুটে বলা যায় না। তাই মায়ের বিবেচনায় খুব খুশী হয় প্রিয়। ছেলের প্রথম রোজগারের টাকায় জীবনে প্রথমবার নিজের খুশী মতো কেনাকাটা করে খুশী মনে বাড়ি ফেরে হরপার্ব্বতী। এই প্রথম ছেলের দৌলতেই মাঠপালুনি উপলক্ষ্যেও পরিবারের সবার নতুন পোশাক হল।
বংশ পরম্পরা ধরে তাদের গ্রামে মাঠপালুনির উৎসবের খুব ধুম। এই একটা দিন গ্রামের সব পরিবার বিশেষ করে মহিলারা একাত্ম হয়ে যায়। সকাল থেকে উপোস করে থাকে সবাই। মহিলারা রান্নাবান্না করে দিয়ে দুপুরের পর চিঁড়ে, কলা , মিস্টি আর খাবারের জল নিয়ে চলে যায় গ্রামের বাইরে ঢেলাইচন্ডী তলায়। তারা বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার পর পুরুষ আর শিশুদের উপোষ ভাঙে। আর ঢেলাইচন্ডীতলায় মহিলারা গোল হয়ে বসে বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া খাবার ভাগ করে খায়। তারপর সারাদিন গল্প-গুজব করে পিকনিকের মেজাজে দিনটা কাটিয়ে বাড়ি ফেরেন মহিলারা। শ্বশুর -- শাশুড়ির মুখে হরপার্ব্বতী শুনেছে বর্ধমানের কোশিগ্রামে প্রথম মাঠপালুনির সূচনা হয়। বহু বছর আগে চৈত্র মাসে ওই গ্রামে মড়ক দেখা দেয়। এক ফকির নাকি গ্রামবাসীদের বলেন সবাই মিলে একদিন গ্রামের বাইরে কাটালে মড়ক দূর হয়ে যাবে। সেই থেকেই ওই গ্রামের বাসিন্দারা চৈত্র মাসে একদিন একত্রে মাঠে খাওয়া দাওয়া করে কাটান। পরে অন্যান্য গ্রামেও মড়ক দেখা দেয়। আর তখন কোশিগ্রামের মতো তাদের গ্রামেও মাঠপালুনির চল শুরু হয়ে যায় । আগে পুরুষেরাও যেতেন। এখন বাড়ি আগলানো এবং অন্যান্য সমস্যার কারণে পুরুষেরা অংশ নেন না। কিন্তু মেয়েদের কাছে মাঠপালুনি একটা উৎসবে পরিনত হয়েছে। একটা দিন নিজেদের মতো করে কাটানোর সুযোগ কেউই হাতছাড়া করতে চান না। আত্মীয়রাও এই উপলক্ষ্যে হাজির হন। এবারও তার অন্যথা হয় না। সকালেই মধুরিমা আর স্বাতীকে নিয়ে আসে প্রিয়। আসতে আসতে দাদাকে টিপ্পনী কাটে মধুরিমা -- কি ব্যাপার রে দাদা , আমাকে একা কখনও নিয়ে যেতে হলে তো তোর টিকিই দেখা যায় না। আজ যে দেখি একেবারে সক্কাল বেলাতেই এসে হাজির, আজ স্পেশাল কেউ যাবে বলে বুঝি ?
---- মোটেই না। তোকে কি আমি কখনো নিতে আসি না নাকি ? আর তাছাড়া আমার তো আর টিকি নেই যে দেখতে পাবি।
কথাটা যে সত্যের অপলাপ তা মানে মধুরিমা। বিয়ের পর থেকে দাদাই তাকে নিয়ে যাওয়া আসা করে। কিন্তু ননদ আর দাদার মধ্যে সেতু বন্ধনের অভিপ্রায়েই ঠেঁস দিয়ে কথাটা বলে সে। আর দুজনের মুখ দেখে তার অভিপ্রায় যে অভিষ্ট পথেই এগোচ্ছে তা বুঝেতে অসুবিধা হয় না তার। কিন্তু মনের ভাব গোপন করে বলে -- এখন নেই বটে , পরে আবার গজাবে না তো ? দেখব হয়তো তার হাতেই ধরা রয়েছে তোর টিকি ? কি বলিস রে স্বাতী ?
বলে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে ননদের দিকে তাকায় মধুরিমা। ইঙ্গিতটা বুঝতে স্বাতীরও অসুবিধা হয় না। লজ্জারুণ হয়ে ওঠে তার মুখ। সেটা চাপা দিতেই বলে --- আমি বাপু তোমাদের ভাইবোনের মাঝে নেই।
---- দেখব দেখব ,ভাইবোনের মাঝে না থাকলেও আর একজনের পাশে কতদিন না থেকে পারিস।
ওইভাবে রসালাপেই একসময় বাড়ি পৌঁছোয় তারা। ততক্ষণে হরপার্ব্বতী রান্না করে ফেলেছেন। স্নান করার পরই শুরু হয়ে যায় বেরনোর তোড়জোড়। সেই সময় হরপার্ব্বতী নতুন কেনা পোশাকগুলো ওদের হাতে তুলে দেন। প্রথমে স্বাতী তার জন্য কেনা সালোয়ার- কামিজটা নিতে মৃদু আপত্তি জানায় -- আমার জন্য আবার এসব কিনতে গেলেন কেন ?
মা বলেন , শোন মা এ আমার ছেলের প্রথম রোজগারের টাকায় কেনা। বাড়ির সবার জন্যই কেনা হয়েছে। তোমাকেও আমরা বাড়ির লোক বলেই মনে করি। তাই তুমি আর আপত্তি কোর না।
মায়ের কথা শেষ হতেই ফের টিপ্পনী কাটে মধুরিমা --- ভালো ভালো , পরের বাড়ির মেয়েটা বাড়ির মেয়ে হয়ে গেল আর বাড়ির মেয়েটা পর হয়ে গেল। তাই বুঝি ওর জন্য সুন্দর চুড়িদার আর আমার জন্য এই বিশ্রী রঙের শাড়ি ?
আবার সত্যের অপলাপ করল মধুরিমা। শাড়িটা তার খুবই পচ্ছন্দ , তবু মুখ চোখে কপট অভিমানের ভাব ফুটিয়ে তোলে।
সেটা লক্ষ্য করেই স্বাতী বলে , বৌদি তুমিই বরং চুড়িদারটা নাও। তোমায় খুব ভালো মানাবে।
--- না ভাই সেই কথাই আছে না , পরের সোনা নিও না কানে। টেনে নেবে হ্যাচকা টানে। তখন সোনাও যাবে , কানও যাবে।
তারপর হেসে ওঠে মধুরিমা। ননদকে কাছে টেনে নিয়ে বলে , মজা করছি তা বুঝিস না কেন ? বিয়ের পর আর আমি সালোয়ার কামিজ পড়ি ?
সেদিন অবশ্য ননদের আবদারে সালোয়ার কামিজই পড়তে হয় তাকে। আর বৌদির জন্য কেনা শাড়িটা পড়ে স্বাতী। সেদিকে চেয়ে দেবপ্রিয়র চোখ থেকে মুগ্ধতা ঝড়ে পড়ে। সেই দৃষ্টিতে স্বাতীর লজ্জা জড়ানো চোখ দুটোও আটকে যায়। মধুরিমার তা নজর এড়ায় না। সে মনে মনে বলে, হচ্ছে তোমাদের ফিরে আসি দাঁড়াও, তারপর দেখচ্ছি মজা। তার মাথায় তখন এক দুষ্টু বুদ্ধি খেলে যায়।
( ক্রমশ )
No comments:
Post a Comment