Short story, Features story,Novel,Poems,Pictures and social activities in Bengali language presented by Arghya Ghosh

অন্তরালে -- ৩



    অন্তরালে 

  

         অর্ঘ্য ঘোষ 


( ধারাবাহিক উপন্যাস ) 

মাঠপালুনি উৎসব  শেষে দাদাকে সে অপ্রস্তুত করে ছাড়বেই ছাড়বে। সেই মতো মনে মনে গুটিও সাজায়। সারাদিন পিকনিকের মেজাজে কাটিয়ে সন্ধ্যার মুখে বাড়ি ফিরেই দুষ্টুবুদ্ধিটা কাজে লাগায় মধুরিমা। মাঠপালুনির প্রচলিত নিয়ম কাজে  লাগিয়েই দাদা আর স্বাতীকে অস্বস্তিতে ফেলে দেয় সে। মাঠপালুনির নিয়মই হল , মাঠ থেকে ফেরার পর প্রতিটি পরিবারের গৃহিণীকে নিজ নিজ বাড়ির বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছড়া আউড়ানোর মতো প্রশ্ন ছুড়ে দিতে হয় -- " গিন্নি গিন্নি ঘরে কেন এত আলো" ? 
বাড়ির ভিতরের লোকেদেরও প্রত্যুত্তরে বলতে হয় --- " গিন্নি গিয়েছেন বনভোজনে , তাই সবাই আছে ভালো " ।
তারপর দরজা খুলে প্রশ্নকর্ত্রীর পা ধুইয়ে গাড়ুতে করে জলের ছড়া দিতে দিতে বাড়ির ভিতরে নিয়ে যেতে হয় উত্তরদাতাকে। অন্যান্যবার প্রশ্নটা মা'ই করে। আর বাবা কিম্বা দাদা উত্তর দিয়ে পা ধুইয়ে বাড়িতে বরণ করার কাজটা করে। মধুরিমা এবারে মাকে বলে -- ও মা এবারে স্বাতীই প্রশ্নটা করুক না। 
মেয়ের কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে যায় হরপার্ব্বতীর। এর পিছনে যে মেয়ের  কোন দুষ্টু বুদ্ধি কাজ করছে তা উপলব্ধি করতে অসুবিধা হয় না তার। ছোট থেকেই তো দেখে  আসছেন , যখনই কোন দুষ্টুবুদ্ধি ভর করে তখনই এইরকম আবদারের গলায় কথা বলে মেয়েটা। এমনিতেই বিবাহিত মেয়েদের বাপের বাড়িতে আবদারের গুরুত্ব অনেক। বিয়ের আগেই মেয়ের কোন আবদার কোনদিন ফেলতে পারেন নি হরপার্ব্বতী। আজও পারলেন না। কাউকে অপ্রস্তুতে ফেলা হবে জেনেও সম্মতি দিতে হয় তাকে। সম্মতি পাওয়ার পরই মধুরিমা কায়দা করে স্বাতীকে দিয়ে প্রচলিত প্রশ্নটা করায়। মায়ের পরিবর্তে স্বাতীকে প্রশ্ন করতে শুনে প্রথমে কিছুটা আশ্চর্যই হয় প্রিয়। তারপর ভাবে বিশেষ কোন কারণেই হয়তো মায়ের নির্দেশে কাজটা করছে স্বাতী। তাই সরল বিশ্বাসেই বাড়ির ভিতর থেকে উত্তরটা দেয় সে। যথারীতি দরজা খুলে স্বাতীর পা ধুইয়ে, বরণ করে ঘরেও তোলে।  তারপরই দাদা আর স্বাতীর পিছনে লাগে মধুরিমা। হরপার্ব্বতীকে স্বাক্ষী মেনে বলে --- মা দেখ দেখ দাদা গৃহিনী বলে কার পা ধুইয়ে ঘরে তুলল দেখো !
মধুরিমার চক্রান্তে ডাহা বেকুব বনে গিয়ে লজ্জায় লাল হয়ে উঠে স্বাতী। উল্টো দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলে -- তুমি না খুব, খুব দুষ্টু।
মধুরিমাও কাছে গিয়ে স্বাতীর মুখটা তুলে ধরে বলে -- কি  খুব দুষ্টু না ?  কিন্তু মুখ তো সে কথা বলছে না। মুখ দেখে মনে হচ্ছে মনে মনে কথাটা শুনে তুমি তো খুশিই হয়েছো। আর একজনের বুকে নিশ্চয় পাহাড় পতনের শব্দ শোনা যাচ্ছে। দেখি দেখি বুকখানা দেখি বলে দাদার বুকে কান লাগায় মধুরিমা। বোনের দিকে রাগী রাগী চোখ করে তাকায় প্রিয়। রেগে রেগে বলে, দেখছো মা দেখেছো বিয়ে হওয়ার পর তোমার মেয়েটা কি রকম যাচ্ছে তাই হয়ে উঠেছে দেখেছো।
---- ওমা তাই তাই ?  তা শুনি কি রকম যাচ্ছে তাই হয়ে গেলাম। বিয়ের পর তোমরা বুঝি এই রকমই হয়ে থাকবে ?
ছেলেমেয়ের খুনসুটি দেখে হাসি চাপতে পারেন না হরপার্ব্বতীও। হাসতে হাসতে বলেন , তোদের নিয়ে আর পারি না বাপু। সেই ছোট থেকেই তোদের পিছনে লাগা স্বভাব আর গেল না।


                       বলেই রান্নাঘরের দিকে চলে যান তিনি। সৌরভ আসবে , খাওয়া দাওয়া করে রাতেই বাড়ি ফিরে যাবে সব। সেইজন্য রান্না নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন হরপার্ব্বতী। নতুন জামাই বলে কথা। সাদামাটা খাবার তো আর পাতে দিতে পারবেন না। সেইসব যোগাড় করতে করতেই এসে পড়ে সৌরভ। তাকে দেখেই স্বাতী আনন্দে চেঁচিয়ে ওঠে --- দাদা চলে এসেছে , চারজন হয়ে গ্যাছে। এবার জমিয়ে লুডো খেলা হবে। গ্রামাঞ্চলে বিনোদন বলতে ঐ লুডো আর তাস। গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই রয়েছে তাস আর লুডো। পুরুষেরা বাড়ির বৈঠকখানা কিম্বা মাচানতলার বাঁশের মাচানে বসে তাস খেলেই সান্ধ্য আসর জমায়। লুডো মূলত মেয়েরাই খেলে। বাড়িতে কেউ এলেই লুডো পেতে বসে যাওয়ার চল রয়েছে 
প্রতিটি পরিবারে। কারও কারও অবশ্য বই পড়ার নেশাও রয়েছে। কিন্তু মনোহরপুরের মতো গ্রামে বই কোথাই ? বিয়ে কিম্বা অন্নপ্রাশনে উপহার হিসাবে পাওয়া শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র কিম্বা তারাশঙ্করের লেখা বই প্রায় প্রতিটি বাড়িতে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পড়া হয়। বাড়িতে আত্মীয় স্বজন এলে সময় কাটানোর জন্য অন্যদের বাড়ি থেকে সেইসব বই চেয়ে এনে পড়তে দেওয়া হয়। যারা কলেজে পড়াশোনা করে তাদের মাধ্যমেও লাইব্রেরী থেকে বই আনিয়ে পড়েন কেউ কেউ। তাতেও মনের খিদে মেটে না। তাই লুডোই সময় কাটানোর অন্যতম অবলম্বন গ্রামবাসীদের। সেই কথা ভেবেই বোধহয় বিয়ের সময় বর-কনের বাক্সে লুডো এবং তাস দেওয়া হয়। মধুরিমা - সৌরভের বিয়েতেও দেওয়া হয়েছিল। বিয়ের দিন তা বের করে খেলাও হয়েছিল। তারপর সেই লুডোটাই যত্ন করে রেখে দেওয়া হয়েছিল। সৌরভরা যখন আসে তখন বের করে খেলা হয়। আজও সেই লুডো খুলে তিন জনে বসে পড়ে। মধুরিমা তখন হেঁসেলঘরে। রান্নাবান্নায় সাহায্য করার জন্য সে মায়ের কাছে যায়। মেয়েদের এই এক স্বভাব। একবেলার জন্য বাপেরবাড়ি এলেও কিছুতেই বসে থাকতে পারে না। যে মেয়েকে বিয়ের আগে মা কোন কাজের জন্য ডেকে ডেকেও পান না, সেই মেয়েই বিয়ের পর বাপের বাড়ি এসে জোর করে মায়ের হাতে হাতে সব কাজ করে দিতে চায়। মায়েরাও মেয়েদের বাপেরবাড়িতে কোন কাজ করতে দিতে চান না। মা- মেয়ের মধ্যে একটা মনঃস্তত্ত্ব কাজ করে। মায়ের মনে হয়, আহারে বাছাকে আমার সারা বছর শ্বশুরবাড়িতে খেটে খেটে হাড়মাস কালি করতে হয়। বাপের বাড়িতে যে ক'টা দিন আছে , একটু তিষ্ঠোক। মেয়ের মনে হয় , 
সে চলে যাওয়ার পর না জানি মায়ের সবদিক একা সামাল দিতে কত না কষ্ট হচ্ছে। যে ক'টা দিন আছি, যতটা পারি মাকে একটু বিশ্রাম দিই। মধুরিমা আর হরপার্ব্বতীও চিরন্তনী সেই মানসিকতার বাইরে নয়। তাই মেয়ে যখন কোন কাজে হাত লাগানোর চেষ্টা করে তখন মা না-না করে  ওঠে। তখনই লুড়ো খেলার জন্য ডাক পাড়ে স্বাতী --- কই বৌদি হলো তোমার ? এবার এসো।  
হরপার্ব্বতীও বলে উঠেন -- যা মা যা ,  ওরা অনেকক্ষণ ধরে বসে রয়েছে। এক বেলার জন্য তো বাপের বাড়ি এসেছিস। তোকে কিছু করতে হবে না।  আমি এদিকটা সামলে নিতে পারব।
অগত্যা লুডোর সামনে গিয়ে বসতে হয় তাকে। এক দিকে সৌরভ আর মধুরিমা অন্যদিকে প্রিয়র সঙ্গে স্বাতীর জুটি বেঁধে খেলা শুরু হয়। দান কিম্বা গুটি চালতে গিয়ে স্বাতীর সঙ্গে প্রায়ই হাতে ছোঁওয়া লেগে যায় প্রিয়র। সেই ছোঁওয়ায় দু'জনেই রোমাঞ্চ অনুভব করে। মাঝে মধ্যে এক পলক চোখাচোখিও হয়।  মধুরিমার  সেটা নজর এড়ায় না। সে টিপন্নী কাটতে ছাড়ে না। দাদার চোখে চোখ রেখে বলে -- তোদের জুটি তো বেশ ভালোই রে। চোখে চোখে বেশ ভালোই বোঝাপড়া দেখছি। দিব্যি সুন্দর দান চালছিস।কথাটার অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে পারে না সৌরভ। সে বলে , তাইতো দেখছি। আমরা তো দাঁড়াতেই পারছি না।সৌরভ না বুঝলেও ওই কথার অর্থ অনুধাবন করতে অসুবিধা হয় না স্বাতীর। তাই লজ্জায় 
সে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। প্রিয়ও বোধহয় সৌরভের মতোই কিছু বুঝতে পারে না। মধুরিমা মনে মনে ভাবে ছেলেগুলো কি একটু বুদ্ধুরাম হয় ?
তাই সে আরও একটু খোলসা করে বলে -- আচ্ছা ওদের এই জুটিটা সব সময় থাকলে কেমন হয় 
কেউ কিছু বলার আগে সৌরভ বলে উঠে -- হবে আবার কি ? সব সময় আমরাই হারব।
---- হারবেই তো , সব সময় এই বুদ্ধি নিয়ে চললে হারবেই তো। আরে আমি সে জুটির কথা বলি নি।
---- তবে ? 
---- সে তোমাকে পরে বুঝিয়ে বলব।
---- বৌদি তুমি না ? 
---- কি আমি না ?
---- ভালো হবে না কিন্তু।
---- সত্যি বলছিস ভালো হবে না ? কিন্তু মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে তোমার পেটে খিদে 
মুখে লাজের মতো ব্যাপার। কি তাই তো ? 
---- জানি না যাও।
---- বেশ তোমাদের জেনেও কাজ নেই।


                            ততক্ষণে বিষয়টি আন্দাজ করে চুপচাপ হয়ে যায় দাদা। সৌরভটা কি এখনও বোঝে নি ? মধুরিমা মনে মনে ভাবে আজই বাড়ি গিয়ে ওকে বুঝিয়ে বলতে হবে। দাদা আর স্বাতীর মধ্যে সেতুবন্ধনের কাজটা তো তাদেরই করতে হবে। খুব দ্রুত সময়টা কেটে যায়। খাওয়া-দাওয়ার পর মধুরিমাদের ফেরার প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। সৌরভ সাইকেল নিয়ে এসেছিল। আর একটা সাইকেল নিয়ে প্রিয়ও যাবে ওদের সঙ্গে। মনোহরপুর থেকে কাঞ্চনা এমন কিছু বেশি দূর নয়। ওদের পৌঁছে দিয়ে দিব্যি বাড়ি ফিরে আসতে পারবে প্রিয়। সেইমতো সৌরভ আর প্রিয় দুজনেই বাড়ির বাইরে সাইকেল বের করে। দ্রুত বাবা-মাকে প্রনাম করে সৌরভের সাইকেলের হ্যান্ডেলে উঠে বসে মধুরিমা। সৌরভ যা ভোলেভালে গোছের , বলা যায় না হয়তো বোনকেই সাইকেলে তুলে নেবে। তখন তো সেতু বন্ধনের কাজটাই ব্যাহত হবে। হরপার্ব্বতী আর প্রভাতকুসুমকে প্রনাম করে অগত্যা প্রিয়র সাইকেলের হ্যান্ডেলই উঠতে হয় স্বাতীকে। এই সুযোগটুকু করে দেওয়ার জন্য মনে মনে সে বৌদিকে ধন্যবাদ দেয়। সেও চাইছিল প্রিয়দার সান্নিধ্য পেতে, খুশি হয় প্রিয়ও। সবাই সাইকেলে উঠতেই দাদা আর ননদকে আরও একটু ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ করে দিতে সৌরভকে তাড়া লাগায় মধুরিমা -- কই এগোও নাকি ? রাত হয়ে যাচ্ছে। আমাদের পৌঁচ্ছে দিয়ে দাদাকে আবার ফিরে আসতে হবে।
--- হ্যা - হ্যা , এই তো - বলেই সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দেয় সৌরভ। আগে আগে চলে তারা। পিছনে আসে প্রিয় আর স্বাতী।
চারদিকে তখন জ্যোস্নায় ফিং ফুটছে। গাছে গাছে জোনাকির টুনি জ্বলছে। সামনের দিক থেকে বয়ে আসছে মৃদুমন্দ বাতাস। সেই বাতাসে কেমন যেন বসন্ত বসন্ত গন্ধ । স্বাতী আর প্রিয়র  মন উচাটন করে উঠে। সৌরভ আর মধুরিমার মনটাও উতলা হয়ে পড়ে। হওয়ারই  কথা , এই পরিবেশে প্রতিটি নরনারীর হৃদয়ই রোমান্টিক হয়ে উঠে। সৌরভও আবৃষ্ট হয়ে পড়ে। স্বাভাবিক ভাবেই কমে আসে তার সাইকেলের গতি। প্রিয়র সাইকেলের সঙ্গে কমে আসে দুরত্বও। তখনই বরকে বকা লাগায় মধুরিমা। কিছু বুঝতে না পেরে হকচকিয়ে যায় সৌরভ। অবাক চোখে স্ত্রীর মুখের দিকে চেয়ে থাকে সে। অস্ফুটে বলে --- কি হলো ? 
সৌরভের কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে মধুরিমা চুপি স্বরে বলে -- বোঝ না কেন , ওরা একে অন্যের প্রতি অনুরক্ত। ভালোবাসার জন্য সবাই তো একটুক্ষণের জন্য হলেও একে অপরকে কাছে পেতে চায়। সেটা ওদের পেতে দাও। একটু জোরে চালাও।
--- অঃ, এই ব্যাপার! আগে বলবে তো।
--- তুমি যে এত বুদ্ধুরাম তা কি করে জানব।
ততক্ষণে প্রিয়র সাইকেলকে অনেকখানি পিছনে ফেলে এগিয়ে যায় সৌরভের সাইকেল। বাতাসে বসন্তের গন্ধের সঙ্গে তখন মিশে গিয়েছে স্বাতীর গায়ের , চুলের  গন্ধ। সেই গন্ধে প্রিয়র  বুক ভরে যায়। স্কুল জীবনেই প্রিয় দেখেছে সেন্ট না মাখলেও মেয়েরা পাশ দিয়ে পেরিয়ে গেলেই অদ্ভুত সুন্দর একটা গন্ধ পাওয়া যায়।  শ্বাস ভরে সেই গন্ধ নেওয়ার খুব ইচ্ছে হত তার। সেই গন্ধের খোঁজে স্বাতীর চুলে নাক ডুবিয়ে দেয় প্রিয়। আবেশ বিহ্বল হয়ে পড়ে স্বাতীও। কেউ কোন কথা বলতে পারে না। কিন্তু শুনতে পায় একে অন্যের হৃদস্পন্দন। স্বাতীকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে সাইকেল ঘোরাতেই চোখাচোখি হয় দু'জনের। দু'জনেরই মনে হয় রাস্তাটা যেন আজ খুব তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে গেল। এক বুক ভালো লাগা নিয়ে গ্রামের পথে সাইকেল ঘোরায় প্রিয়। সেই ভালোলাগার রেশ কাটতে না কাটতেই নেমে আসে শোকের ছায়া।
      ( ক্রমশ )

No comments:

Post a Comment