অন্তরালে
অর্ঘ্য ঘোষ
( ধারাবাহিক উপন্যাস )
তারপর চিতায় জল ঢেলে শেষরাতে বাড়ি ফেরে সবাই। কিন্তু বাড়ি ফিরে দীর্ঘক্ষণ দুচোখের পাতা এক করতে পারে না প্রিয়। শুধু এপাশ - ওপাশ করেই চলে। কেবলই তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে শিশুটির মুখ।মানুষ বিশেষ করে শিশুদের ওইভাবে পুড়ে যাওয়া খুব হৃদয় বিদারক। সেই জন্যই বোধ হয় এক সময় তাদের গ্রামে মৃত শিশুদের দাহ করার পরিবর্তে পুঁতে দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। গোয়ালসাহী কাঁদের ধারে হাঁড়িফেলার পাশেই ছেলেপোঁতা বলে একটা জায়গা রয়েছে। গ্রামের লোকেরা ' হলে - গেলে' হাঁড়িফেলায় হাঁড়িকুড়ি ফেলে।গ্রামের মানুষজন সন্তান প্রসবকে এবং মৃত্যুকে 'হলে-গেলে' বলেন। আত্মীয় স্বজন -জ্ঞাতিগুষ্ঠির মধ্যে কারও সন্তান প্রসব কিম্বা মৃত্যুর খবর পেলেই রান্না করা খাবার সহ মাটির হাঁড়িকুড়ি ওই হাঁড়িফেলায় ফেলে দিয়ে আসতে হত। আবার প্রসবের পর দাইমায়েরাও প্রসুতির নাড়ি সহ অন্যান্য দেহাংশ হাঁড়িতে ভরে নিয়ে চিৎকার করে ' আশপাশ কে কোথাই আছ সরে যাও। ঝুলফুলি নিয়ে যাচ্ছি। বাউর লাগলে শুকিয়ে যাবে। সব একপাশ যাও ' বলতে বলতে সেখানে ফেলে আসত।
আর দাই মায়ের সেই চিৎকার শুনে তারা ছুটে গিয়ে ঘরের ভিতর সেঁধিয়ে যেত। এখন অবশ্য অধিকাংশ পরিবারে মাটির হাঁড়িকুড়ির চল নেই। বাড়িতে প্রসবও কমে এসেছে। নির্ধারিত দিনের আগেই বাপের বাড়ির লোকেরা প্রসুতিকে নিয়ে গিয়ে নিকটবর্তী শহরের হাসপাতালে ভর্তি করান।সেখানেই তাদের সন্তান প্রসব হয়। প্রসবের একুশ দিনের মাথায় দাইমায়েরা অন্যান্য কাজকর্ম করে যান। কিন্তু হাঁড়িফেলার চল নেই বললেই চলে। তবু জায়গাটিকে গ্রামের মানুষ আজও হাঁড়িফেলাই বলেন। সেখানে পড়ে থাকা ভাঙা হাঁড়িকুড়ি জায়গাটির নামের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। হাঁড়িফেলার অদুরেই ছেলেপোঁতা। বছর দশেক আগেও বাচ্চা ছেলের মৃত্যু হলে দাহ করা হত না। ওখানেই গর্ত করে পুঁতে দেওয়া হত।
সেই সময় গ্রামের মানুষেরা বলাবলি করতেন ছেলেপোঁতায় নাকি বাচ্চা ছেলের কান্না শোনা যায়। সেই কথা শুনে সদ্য সন্তান হারা এক মা প্রায়ই রাতের অন্ধকারে চলে যেতেন ছেলেপোঁতায়। তারপর ছেলের সমাধির উপরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকতেন।তাছাড়াও চোখের সামনে সন্তানের সমাধি দেখে দীর্ঘদিন শোক ভুলতে পারতেন না বাবা-মায়েরা। অনেক সময় শিয়াল - কুকুরে গর্ত থেকে পচাগলা মৃতদেহ টেনে বের করে ছেঁড়াছিঁড়ি করে খেত। আর পরিবারের লোকেরা ফের শোকে কাতর হয়ে পড়ত। সেই থেকে গ্রামের মানুষ মিটিং ডেকে পোঁতার পরিবর্তে শিশুদের মৃতদেহও দাহ করার সিদ্ধান্ত নেন। আজ আর ছেলেপোঁতা হয় না।কিন্তু জায়গাটি আজও ছেলেপোঁতা হিসাবে পরিচিত হয়ে আছে।হাঁড়িফেলায় ভাঙা হাঁড়িকুড়ির মতোই ছেলেপোঁতায় পড়ে থাকা হাড়গোড় তার নামের ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেয়।
সেই হিসাবে প্রিয়র মনে হয় পোঁতার পরিবর্তে শিশুদেরও দাহ করাটাই শ্রেয়। দাহ করার ক্ষেত্রে শ্মশানবন্ধুদের কষ্ট হলেও পরিবারের লোকেরা শোক ভুলতে পারেন।কিন্তু পোঁতার ক্ষেত্রে বহুদিন পর্যন্ত পরিবারের লোকেদের মনে হয় তাদের প্রিয়জন যেন ওইখানে ঘুমিয়ে আছে। কোন একদিন ঘুম ভেঙে উঠে আসবে। দাহের ক্ষেত্রে তো সঙ্গে সঙ্গে সব শেষ হয়ে যায়। ওইসব কথা ভাবতে ভাবতেই একসময় ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসে প্রিয়র। ঘুম ভাঙে মায়ের ডাকে। চোখ মেলে চাইতেই মা বলেন , রাজু আর ঋজু এসে বসে রয়েছে। তোদের নাকি কোথায় যাওয়ার কথা আছে , যাবি না ?
মায়ের কথায় মনে পড়ে যায় আজ সকালেই তাদের ডাক্তারের বিষয়টি নিয়ে বোলপুরে সুশোভনবাবুর সঙ্গে আলোচনা করতে যাওয়ার কথা রয়েছে। রাতে ঘুম হয় নি বললেই চলে। গা-টা কেমন ম্যাচম্যাচ করছে। একটু ঘুমোতে পারলে ভালো হত। কিন্তু গ্রামের মানুষ ডাক্তারের বিষয়টি নিয়ে তাকে চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। তার কথা শুনে অজিতবাবুকে ছেড়ে দিয়েছে ওরা। স্বাস্থ্যকেন্দ্রেরও কোন ক্ষতি করে নি। ভবানী ডাক্তারের কাছে টাকা না নিয়ে চাঁদা তুলে সুবলের ছেলের সৎকারের ব্যবস্থা করেছে। সব থেকে বড়ো কথা সে নিজেও এইভাবে ভুল কিম্বা বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। সেইজন্য চ্যালেঞ্জটা তাকে জিততেই হবে। তাই সমস্ত আলস্য ছেড়ে ফেলে সে বিছানা থেকে লাফিয়ে নেমে পড়ে।
বাইরে বেরোতেই দেখে ঋজুদারা চা-বিস্কুট খাচ্ছে। সে ইশারায় তাদের অপেক্ষা করতে বলে দ্রুত তৈরি হয়ে নেয়। বেরনোর আগে তারা ডাক্তারের জন্য যেসব জায়গায় দরখাস্ত করে ছিল তার রিসিভ কপি , যেসব খবেরর কাগজে সংবাদ বেরিয়েছিল তার কাটিং ফাইলে গুছিয়ে নেয়। তারপর সেও চা বিস্কুট খেয়ে বোলপুরের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। স্টেশনে পৌঁচ্ছে নিজের নিজের পকেট থেকে টাকা বের করে টিকিট কাটে। তারা তো তিনজনেই বেকার , তাই কারও একার পক্ষে টাকাটা দেওয়া সম্ভব হয় না। তখন প্রিয়র মনে হয় এইসব কাজের জন্য প্রথমেই কিছু টাকার দরকার। ট্রেনে যেতে যেতে সেই প্রসঙ্গই তোলে প্রিয়। সে বলে , এইসব কাজে ঘোরাফেরা সহ অন্যান্য খরচের জন্য কিছু টাকার প্রয়োজন। আমাদের ভরসা তো সেই চাঁদা। কালই সুবলের ছেলের সৎকারে সবাই চাঁদা দিয়েছে। ফের চাঁদা দিতে হলে অনেকেই হয়তো এই আন্দোলনের ব্যাপারে উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে। গ্রামের বেশিরভাগ মানুষের হাতের অবস্থা তো তেমন ভালো নয়।
ঋজু প্রশ্ন তোলে -- তাহলে কি হবে ?
--- কোন একটা উপায় ভাবতে হবে , দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দেখায় প্রিয়কে।
রাজু বলে --- ইউরেকা, পেয়ে গিয়েছি।
প্রিয় আর ঋজু তার দিকে বিস্মিত হয়ে চেয়ে বলে --- কি পেয়ে গ্যাছিস ?
--- আর আমাদের ' মারিচা ' প্রথা আর মাঠ আগলানোর যে টাকা জমা আছে সেটা থেকে কিছু টাকা তো এই কাজে লাগানো যেতেই পারে।
প্রিয় মনে মনে ভাবে তাহলে বেশ ভালোই হয়। গ্রামের ছেলেরা ধান ওঠার মরসুমে মাঠ পাহারা দেয়। এজন্য তাদের পারিশ্রমিক বাবদ বিঘে প্রতি কয়েক আঁটি ধান দেয় জমির মালিক। তার মধ্যে যারা মাঠ পাহারা দেন তারা একটা অংশ পান। বাকিটা বিক্রি করে টাকা জমা থাকে গ্রাম কমিটির কাছে। আর 'মারিচা 'প্রথায় গ্রামের মেয়েদের বিয়েতে পণ বাবদ পাত্রপক্ষ যা টাকা পায় তা থেকে কমিশন বাবদ একটা টাকা বিয়ের দিন তাদের তুলে দিতে হয় গ্রাম কমিটির হাতে। দুটি ক্ষেত্রের টাকায় গ্রামের পুজো আর্চা , রান্নার বাসন কোসন, সামিয়ানা কেনা সহ অন্যান্য উন্নয়নের কাজে লাগানো হয়। গ্রামের মানুষজন বিনা ভাড়ায় ভোজ কাজে ওইসব জিনিসপত্র ব্যবহারের সুযোগ পান। শুধু তাই নয়, এজন্য গ্রামের লোকেরাই ভোজ কাজে বিনা পারিশ্রমিকে কাঠ চ্যালানো , রান্না , পরিবেশন সহ অন্যান্য কাজে কোমরে গামছা বেঁধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সমস্ত টাকা জমা থাকে প্রসাদ কাকার কাছে।প্রসাদকাকা গ্রাম কমিটির সম্পাদক, শাসক দলের সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে তার। গ্রামের দুর্গাপুজো আর ধর্মরাজ পুজোয় লাগানোর পর যে টাকা বাঁচে তা দিয়ে জিনিসত্র কেনা হয়। কিন্তু সেই টাকা কি এই কাজে দেবেন প্রসাদকাকারা ?
প্রিয় সংশয় প্রকাশ করতেই ঋজু বলে - না দেওয়ার কি আছে ? এটাও তো গ্রামের উন্নয়নেরই কাজ। তাছাড়া সব টাকাই তোর আর দিতে হচ্ছে না।
---- ঠিক বলেছিস। তাতে না হয় এবার পুজোয় ধুমধাম একটু কম করা হবে , ঋজুর কথায় সমর্থন যোগায় রাজু।
প্রিয় বলে , ফিরে এসে এ নিয়ে প্রসাদকাকাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে।
ঋজুরা বলে, প্রয়োজনে গ্রাম কমিটির মিটিং ডেকেই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করব। কিন্তু কোনক্রমেই পিছয়ে আসা চলবে না।
সেই অনমনীয় জেদ নিয়েই তারা পৌঁছোয় সুশোভনবাবুর চেম্বারে। চেম্বারের বাইরে তখনও ৪/৫ জন রোগী বসে রয়েছেন। প্রিয়র সঙ্গে ঋজুদের দেখে সুশোভনবাবু বলেন , কি ব্যাপার আজ আবার রোগী নিয়ে এসেছো নাকি ?
---- না না , আজ অন্য ব্যাপারে একটু কথা বলতে এসেছি।
হাতের ইশারায় তাদের বসতে বলেন সুশোভনবাবু। তারপর বলেন , একটু বসো রোগী ক'টা দেখে নিই। তারপর তোমাদের কথা শুনব। তোমার কথাই ভাবছিলাম , আমারও একটা কথা বলার রয়েছে তোমাকে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই রোগী দেখা শেষ করে সুশোভনবাবু চেম্বারে ডেকে নেন তাদের। তারপর বলেন , প্রথমে আমার কথাটা বলে নিই তারপর তোমাদের কথা শুনব। যে কথাটা বলার জন্য তোমার খোঁজ করছিলাম সেটা হল , সরকার ঠিক করেছে গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে প্যাথলজিকাল ল্যাবরেটরি , বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার মেশিন বসাবে। এজন্য চুক্তিতে কর্মী নিয়োগ করা হবে। অস্থায়ী হলেও যেহেতু সরকারি কাজ সেইজন্য বেতন খুব একটা মন্দ হবে না।
কাজটা স্থায়ী হওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। তাই তুমি আমার নার্সিং হোমের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে কাজ শেখার পাশাপাশি শর্টটাইম সার্টিফিকেট কোর্সটা করে রাখ। তারপর দেখা যাক কি হয়। সুশোভনবাবুর কথা শুনে আনন্দে ভরে যায় প্রিয়র মন। প্রিয় নিজে থেকে কোনদিন তাকে চাকরির কথা বলে নি। কিন্তু তার বাড়ির অবস্থার কথা শুনে সুশোভনবাবু নিজে থেকেই চাকরির কথা ভেবেছেন। আজকের দিনে এমনটা ভাবা যায় ? একটা চাকরি সত্যিই খুব দরকার। বাবাকে বিশ্রাম , মাকে একটু সুখী করতে চাকরিটা জরুরী। আর একজনের জন্যও চাকরি একটা তাকে পেতেই হবে। স্বাতীর কথা মনে মন পড়তেই কোথাই যেন হারিয়ে যায় প্রিয়।
( ক্রমশ )
No comments:
Post a Comment