অন্তরালে
অর্ঘ্য ঘোষ
( ধারাবাহিক উপন্যাস )
সুশোভনবাবুর কথায় বাস্তবে ফেরে সে। ততক্ষণে সবার জন্য চা আর টোষ্ট আনিয়েছেন তিনি। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলেন -- হ্যা, এবার বলো তোমাদের কথা।প্রিয় বলে , ডাক্তারবাবু আপনাকে এর আগেও বলেছি আমাদের গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডাক্তার নেই।সবার পক্ষে তো শহরে রোগী নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করানো সম্ভব নয়। সেই সুযোগ আর সময়ও পাওয়া যায় না। তাই বেশিরভাগ মানুষকে হাতুড়ে ডাক্তারের উপর নির্ভর করতে হয়।
সুযোগ বুঝে মুদিখানার দোকানদাররাও রোগের উপস্বর্গ অনুযায়ী ওষুধ বিক্রি করেন। এজন্য অনেক সময় ভুল কিম্বা বিনা চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু হয়। এইতো গতকালই সবার চোখের সামনে ফুটফুটে একটি শিশু মারা গেল। তাই আমরা ঠিক করেছি , যে করেই হোক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডাক্তারের ব্যবস্থা করবোই। কি করে সেটা সম্ভব হবে সেই পরামর্শের জন্যই আপনার কাছে এসেছি।
--- তাহলে তো দেখছি তোমরা আমার রুটিরুজিতেই বাগড়া দিতে চাইছ। দিব্যি রোগী নিয়ে আসছিলে। গ্রামে ডাক্তার পেলে আর তো আসবে না আমার কাছে। তখন তো আমাকে মাছি তাড়াতে হবে।বলেই হাসতে থাকেন ডাক্তারবাবু।
প্রিয়র বুঝতে অসুবিধা হয় না এটা ডাক্তারবাবুর মনের কথা নয়। উনি টাকার জন্য ডাক্তারি করেন না। মাত্র ১ টাকা ভিজিটে রোগী দেখেন। দুঃস্থদের স্যাম্পেলের ওষুধ দেন। অনেক সময় কিনেও দেন। কেউ টাকা দিতে চাইলে মজা করে বলেন , আরে কি বলে তার ঠিক নেই। সরকার আমাকে যা বেতন দেয় তাই খরচ করতে পারি না , তার উপরে উনি আবার আমাকে টাকা দিতে এসেছেন। যাও যাও , পারলে যাওয়ার সময় টাকা ক'টা দিয়ে রোগীর জন্য কিছু ফলমূল কিনে নিয়ে যেও। সেই সুশোভনবাবু যে তাদের সঙ্গে মজা করছেন সেটা বুঝতে পেরেই প্রিয় বলে -- ডাক্তারবাবু এটা মজার কথা নয়। সিরিয়াসলি বলছি ডাক্তারের জন্য আমরা যত দূর যেতে হয় যাব। আপনি আমাদের পরামর্শ দিন।
--- কিন্তু আমি তো তোমাদের এ ব্যাপারে কোন সাহায্যই করতে পারব না।
ডাক্তারবাবুর কথা শুনে চুপসে যায় প্রিয়। সে বড়ো মুখ করে ঋজুদাদের বলেছিল , ডাক্তারবাবুর কাছে গেলেই উনি উপায় একটা ঠিক বাতলে দেবেন। সেই আশায় বুক বেঁধে তারা ছুটে এসেছিল ডাক্তারবাবুর কাছে। কিন্তু সুশোভনবাবুর কথা শুনে তাদের চোখে মুখে হতাশার ছাপ ফুটে উঠে। সেটা লক্ষ্য করেই সুশোভনবাবু বলেন , আরে অত হতাশ হচ্ছো কেন ? আমি সরকারি হাসপাতালে চাকরি করি , সর্বোপরি একজন ডাক্তার , তাই এইসব দাবি আদায়ের ব্যাপারে আন্দোলনের যেসব গতিপ্রকৃতি আছে তা গ্রহণ করার পরামর্শ আমি দিতে পারি না।
--- তাহলে উপায় ?
--- সেটাই তো বলতে চাইছি। আমার কাছে এসেছো , আর কোন উপায় হবে না তাই কখনও হয় ? দাঁড়াও দেখছি।
বলেই কাকে যেন ফোনে তাদের দাবির বিষয়টি জানান। তারপর তাদের উদ্দেশ্য বলেন -- লালপুলের উল্টো দিকে যে নীলরঙা বাড়িটি আছে তোমরা সেখানে চলে যাও। ওখানে দৈনিক অন্তরালে পত্রিকার সাংবাদিক আর্য ঘোষ রয়েছেন। আমি যা বলার বলে দিয়েছি। তোমরা কি করতে চাও তা তাকে গিয়ে বলো। দেখবে উনিই তোমাদের কি করতে হবে না হবে সব বলে দেবেন।
সেই মতো তারা নীলবাড়িতে পৌঁছোয়। সাংবাদিক তখন অন্য দুজনের সঙ্গে কথা বলছিলেন। তারা চলে যাওয়ার পর প্রিয়দের ঘরে ডেকে নেন তিনি। তারপর সমস্ত কাগজপত্র দেখে বলেন , এভাবে কিছু হবে না। এই তো বার কয়েক কাগজেও বেরিয়েছে দেখছি খবরটা। তাতেও যখন কিছু হয় নি তখন আর শুধু খবর করে কিছু হবে না। দরখাস্ত লিখেও কিছু লাভ হবে না। প্রতিদিন এই রকম বহু দরখাস্ত জমা পড়ে। প্রশাসনের লোকেরা সব খুলেও দেখে না। বছরের শেষে অপ্রয়োজনীয় অন্যান্য কাগজপত্রের সঙ্গে ওজন দরে বিক্রি হয়ে যায়।
--- তাহলে ?
--- আপনাদের তো গ্রামাঞ্চলে বাড়ি। নিশ্চয় বাড়িতে ছাগল পোষার চল রয়েছে।
সাংবাদিকের কথা শুনে ভড়কে যায় প্রিয়রা। এ আবার কেমন কথা ? তারা এসেছে ডাক্তারের বিষয়ে কথা বলতে , আর উনি জানতে চাইছেন তারা ছাগল পোষে কিনা ?
তাই কিছুটা রেগে রেগেই প্রিয় বলে -- হ্যা পুষি বইকি , নাহলে আমাদের চলবে কি করে ?
প্রিয় লক্ষ্য করে সাংবাদিক কিন্তু তার রাগকে কোন রকম গুরুত্ব না দিয়ে বলতে শুরু করেন -- যে ছাগলের তিনটে বা চারটে বাচ্চা তাদের লক্ষ্য করেছেন ?
এবারে আর বিরক্তি চেপে রাখতে পারে না প্রিয়। সে বলে , ছাগলের সাধারনত দুটোই বাচ্চা হয়। তবে কখনও তিন চারটেও হয়। সে তো আমাদের বাড়িতেই আছে। তাতে লক্ষ্য করার আছেটা কি ?
---- আছে আছে। দুটো বাচ্চার ক্ষেত্রে তেমন কিছু তারতম্য না থাকলেও দেখবেন তিনটি বা চারটি বাচ্চার ক্ষেত্রে কোন একটিকে একটু শক্তিশালী দেখায়।
---- তা দেখায়।
---- যে বাচ্চাটি অন্যদের ঢুঁসিয়ে সরিয়ে দিতে পারে সে'ই সবসময় মায়ের দুধ পায়। তাই তাকে শক্তিশালী দেখায়। ওইরকম ভাবে অন্যান্যদের দাবিকে ঢুঁসিয়ে সরিয়ে দিতে হবে তবেই আপনাদের দাবি গুরুত্ব পাবে।
সাংবাদিকের কথা শুনে ' থ ' হয়ে যায় প্রিয়রা। সাধে কি আর বলে সাংবাদিক ! কোথাকার জল কোথাই গড়িয়ে দিলেন। তবে কথাটা তাদের বেশ মনে লাগে। তাই তারা বলে -- সেটা কি করে করা সম্ভব ? প্রশাসনের কর্তারা তো আর ছাগলের বাচ্চা নয় যে ঢুঁসিয়ে দেব।
--- একেবারেই নয় , বরং উল্টোটাই। প্রশাসনিক কর্তারা যখন নিজের দফতরে চেয়ার বসে থাকেন তখন সাধারণ মানুষকে তারাই ছাগল, গরু মনে করেন। তাই হয় গরু ছাগল তাড়ানোর মতো হঠিয়ে দেন , নয়তো ' দেখব--দেখছি , ' হচ্ছে- হবে' বলে ভোগা দেন। তাছাড়া আমি তো প্রশাসনিক আধিকারিকদের ঢুঁসোতে বলি নি , অন্য দাবিগুলিকে ঢুঁসিয়ে সরিয়ে নিজেদেরটাকে সামনে আনার কথা বলেছি।
---- সেটাই বা কি করে সম্ভব হবে ?
---- হবে হবে , সব হবে। তবে পদ্ধতিটা পাল্টাতে হবে। ওইভাবে দরখাস্ত লিখে জমা দিলে প্রশাসনিক আধিকারিকদের সামনে হাত কচলাতে কচলাতে ' হচ্ছে - হবে ' আশ্বাস শোনা ছাড়া কিছু হবে না। দাবি আদায়ের জন্য প্রশাসনের লোককেই টেনে নিয়ে যেতে হবে গ্রামে। আজ প্রশাসনের চেয়ার বসে যে আধিকারিক আপনাকে গরু ছাগল ভাবছে , কাল দেখবেন এক হাট লোকের মাঝে সেই আধিকারিকেরই সুর বদলে গিয়েছে। তখন নিজেদের দাবির ব্যাপারে একজোট হয়ে সোচ্চার হতে হবে। মৌখিক আশ্বাস নয় , লিখিত প্রতিশ্রুতি আদায় করে ছাড়তে হবে। তাহলে দেখবেন কাজ হলেও হতে পারে।কথাটা যুক্তিযুক্ত মনে হয় প্রিয়দের। এই তো কিছুদিন আগে কাঞ্চনা গ্রামেই সেই রকম ঘটনা ঘটেছে। বছরের পর বছর ওই গ্রামে মাঠের মাঝে বিপদজনক অবস্থায় মাথার উপর ঝুলে ছিল বিদ্যুৎবাহী তার। বিদ্যুৎ দফতরে বার বার জানিয়েও সেই তার টান করার কোন ব্যবস্থা হয় নি। একদিন ধান কাটার সময় সেই তারে কাস্তে লেগে বিদ্যুৎপৃষ্ট হয়ে মারা যায় স্বরূপ মন্ডলের মুনিস তপন বাগদি।
তপনের দিনমজুরির উপরেই নির্ভর করে চলত তাদের দিন এনে দিন খাওয়ার সংসার। নাবালক দুই শিশু সন্তানের মুখে কি করে কাল থেকে দুবেলা দুমুঠো খাবার তুলে দেবে সেই কথা ভেবেই নির্বাক হয়ে যায় তার স্ত্রী সুমিত্রা। কয়েকজন যুবক ক্ষতিপূরণের দাবি নিয়ে ছোটেন স্থানীয় বিদ্যুৎ দফতরে। কিন্তু দফতরের কর্তারা নাকি কোন কথা কানেই তোলেন নি। সেই কথা শোনার পরই ক্ষোভে ফেটে পড়েন গ্রামের মানুষ।
তারই বর্হ্বিপ্রকাশ ঘটে কয়েকদিন পর। বিদ্যুৎ দফতরের কর্তারা ভেবেছিলেন গ্রামের লোক সব ভুলে গিয়েছে। তাই গাড়ি নিয়ে সাবমার্শিবল পাম্পের মিটার রিডিং নিতে আসেন বিদ্যুৎ দফতরের স্টেশন ম্যানেজার। আর যাই কোথাই ? তাকে আটকে মারমুখী হয়ে উঠে গ্রামের মানুষ। তখন হাত জোড় করে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতে শোনা যায় বিদ্যুৎ দফতরের ওই আধিকারিককে। আর তাতে আরও বেশি খেপে যায় মানুষ। অনেকেই বলতে শোনা যায় , শালার এখন তো খুব মিস্টি মিস্টি কথা বেরোচ্ছে মুখ দিয়ে। অথচ অফিসে গিয়ে বার বার বলা স্বত্ত্বেও তার টান করার কথা কানে তোলা হয় নি। ক্ষতিপূরণ চাইতে গিয়েও গলা ধাক্কা খেতে হয়েছে। এখন যদি সম্মান নিয়ে ফিরতে চাস তাহলে আজই তার টান কর আর ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা কর। নাহলে ওই লাইনের তারেই তোকে ঝুলিয়ে দেব।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই খবর পৌঁছে যায় বিদ্যুৎ দফতরের উপরতলার কর্তাদের কাছে। আর তারপরই পুলিশ নিয়ে গ্রামে ঢোকেন বিদ্যুৎ দফতরের কর্তারা। তাদেরও ঘেরাও করে আটকে দেন ক্ষুব্ধ গ্রামবাসীরা। ওইসব কর্তারা তখন শীঘ্রই তার টান এবং ক্ষতিপূরণের আশ্বাস দিয়ে পরিস্থিতির সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু গ্রামবাসীরা তাদের কথা কানেই তোলেন না। তারা সাফ জানিয়ে দেন , তার টান এবং ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা না হলে গাড়ি ছাড়া হবে না। রাজনৈতিক নেতারা এসেও গ্রামবাসীদের দাবি থেকে একচুল সরাতে পারেন না। পুলিশের গাড়ি সহ সবাইকে অনিদ্দিষ্ট কালের জন্য আটকে রাখার হুমকি দেন গ্রামবাসীরা। অবশ্য আটকদের জন্য ঘন ঘন চা , জলখাবার এমন কি ভাতেরও ব্যবস্থা করা হয়। অগত্যা চাপে পড়ে সেইদিনই তার টান আর ক্ষতিপূরণের টাকা দিয়ে সন্ধ্যার মুখে ফিরে যান বিদ্যুৎ দফতরের কর্তারা। ঘটনা
শোনার পরই আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল প্রিয়। যে কাজটা তিন ঘন্টার নোটিশে করা যায় , সেটা কেন মাসের পর মাস ঝুলে ছিল তা বোধগম্য হয় না তার। ক্ষতিপূরণ দিয়েই কেন পার পেয়ে যাবে ওরা ? কেন ওদের গাফিলতির কোন শাস্তি হবে না ? ওরা কি পারবেন লোকটাকে ফিরিয়ে দিতে ? একদিন তো ক্ষতিপূরণের টাকা ফুরিয়ে যাবে তারপরে কি হবে ? আরও নানা প্রশ্ন ভীড় করে আসে তার মাথায়। তার মধ্যে কাঞ্চনা গ্রামের মানুষদের ওই দৃষ্টান্ত তাকে উদ্বুদ্ধ করে। কিন্তু তার মনে হয় কাঞ্চনা গ্রামের বাসিন্দারা না হয় বিদ্যুৎ দফতরের কর্তাকে আটকে তাদের দাবি আদায় করেছিলেন , কিন্তু তারা কি করবেন ? স্বাস্থ্য দফতরের কেউ তো তাদের গ্রামমুখো হন না , তাহলে তারা কাকে আটকে বড় কর্তাদের গ্রামে টেনে আনবেন ? প্রশ্নটা তুলতেই আর্যবাবু একটা উপায় বাতলান। কিন্তু সেটা শুনেই দোটানায় পড়ে যায় প্রিয়।
( ক্রমশ )
No comments:
Post a Comment