Short story, Features story,Novel,Poems,Pictures and social activities in Bengali language presented by Arghya Ghosh

অন্তরালে -- ৭


   
   

   অন্তরালে 

         অর্ঘ্য ঘোষ 


( ধারাবাহিক উপন্যাস ) 



তাদের সমস্যার কথা শুনে আর্য জিজ্ঞেস করে  -- আচ্ছা আপনাদের গ্রামে পাঁচ বছর পর্যন্ত বয়সের শিশুর সংখ্যা কত ? 
---- তা ত্রিশ জন তো হবেই ?
---- ওদের পালস পোলিও কোথাই খাওয়ানো হয় ? 
---- স্বাস্থ্যকেন্দ্রেই নির্ধারিত দিনে ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে একজন নার্স এবং একজন স্বাস্থ্যকর্মী পালস পোলিও খাওয়াতে আসে। আশেপাশের গ্রাম থাকে মায়েরা শিশুদের ওইদিন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পোলিও খাওয়াতে নিয়ে আসেন। 
--- শিশুদের ওই পালস পোলিও খাওয়ানো বয়কটের ডাক দিতে হবে। সবাইকে একজোট করে ওই বয়কটে সামিল করতে পারবেন ? 
সাংবাদিকের কথা শুনে যেন আঁতকে ওঠে প্রিয়। এতক্ষণে সে বুঝতে পারে কেন সুশোভনবাবু তাদের দাবির বিষয়টি এড়িয়ে গেলেন। কিন্তু এটা তো আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হয়ে যাবে। এ তো কিছুতেই মানা যায় না। সেই কথাই সে সাংবাদিককে বলে --- এটা আবার হয় নাকি ? মানুষের মৃত্যু ঠেকানোর জন্য শিশুদের জীবন বাজি রাখার কথা কিছুতেই মানা যায় না। তাছাড়া আমাদের গ্রামের হলেও কথা ছিল , কিন্তু পাশের গ্রামের লোকেরাও যে আমাদের সঙ্গে বয়কটে সামিল হবে তার কি নিশ্চয়তা আছে ? আর পাশের গ্রামের লোকেরা যদি ছেলেমেয়েদের পোলিও খাইয়ে নিয়ে যায় তাহলে গ্রামের লোকেদের আমরা কিভাবে আটকে রাখব ? 
তার আশঙ্কা দেখে আর্য বলে , অত ভয় পাচ্ছেন কেন ? আমার উপরে একটু ভরসা রেখেই দেখুন না। শিশুদের জীবন বাজি রাখতে হবে না , বাজি রাখার কথা প্রশাসনকে বলেই দেখুন না। তারপর তো আমি আছিই। যদি পিছিয়েই আসতে হয় , তখন না হয় বিকল্প পথ আমিই বাতলে দেব।  সুশোভনবাবু যখন আমার কাছে পাঠিয়েছেন তখন তিনি সব কিছু ভেবেই পাঠিয়েছেন। 
প্রিয় ভাবে সেটাও ঠিক। সুশোভনবাবু ভালো না বুঝলে নিশ্চয় তাদের এখানে পাঠাতেন না। তবুও সে ঋজু এবং রাজুদার মতামত জানতে প্রশ্ন করে -- কি করা যায় বলো ? তোমাদের কি মত ? 
ঋজু বলে , আমরা পাশের গ্রামের লোকেদের বোঝাব। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডাক্তার  এলে শুধু তো আমাদের গ্রামের মানুষই উপকৃত হবে না , এলাকার ১০/১২ টি গ্রামের মানুষ তার সুফল পাবে।
তাকে সমর্থন করে রাজু বলে , সেই কথা ভেবে ওরা আমাদের সঙ্গে সামিল হবে। ওদের কথা শুনে মনে জোর পায় প্রিয়। তাই সে জানতে চায় --- তাহলে আমাদের এখন কি করতে 
হবে ?
---- আজ তো শুক্রবার ,  কাল বাদ পরশু পোলিও খাওনোর দিন। আপনারা আজই ডি,এমের কাছে সেই মর্মে একটা স্মারকলিপি জমা দিয়ে রিসিভ করে নিন।  গ্রামে ফিরে গিয়ে সবাইকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলুন। রবিবার যেন কেউ শিশুদের পোলিও খাওয়াতে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে না যান। তারমধ্যেই আমরা গিয়ে পৌঁচ্ছে যাব। তারপর যা করার তা আমরাই করব।তবে ডি,এম অফিসে গিয়ে বেশি জলঘোলা করবেন না। জানাজানি হলে আর দরখাস্ত রিসিভই করবে না। চুপিচুপি রিসিভ সেকশনে দিয়ে রিসিভ করিয়ে নেবেন। রিসিভ হয়ে গেলে আমাকে ফোনে জানিয়ে দেবেন।তারপর ফোন নম্বর লেখা একটা কার্ড প্রিয়র হাতে তুলে দেয় আর্য। 


                     সেইমতো তারা ডি , এম অফিসে ডাক্তারের দাবিতে পালস পোলিও বয়কটের দরখাস্ত জমা দিয়ে রিসিভ করে নেয়। তারপর ফোনে সেই কথা আর্যকে জানিয়ে বাড়ি ফেরে। বিকালের দিকে মাচানতলায় গ্রাম কমিটির মিটিং ডেকে সবাইকে সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। বেশিরভাগ মানুষই বলেন , একেই বলে সাংবাদিকের মাথা। এবার ব্যাটাদের টনক নড়বে। শুধু প্রসাদকাকা আর সুরেনকাকার মতো  শাসকদলের  ঘনিষ্ঠ, হাতে গোনা কয়েকজন সংশয় প্রকাশ করে -- এতে হিতে বিপরীত কিছু হবে না তো ? পার্টির সঙ্গে একবার আলোচনা করে নিলে হত না ? বরাবর সব ব্যাপারেই প্রসাদকাকাদের বাগড়া আর জ্ঞান দেওয়া স্বভাব। এজন্য গ্রামের লোক আড়ালে তাদের সবজান্তা গামছাবালা বলেন। প্রাতঃকৃত করতে যাওয়ার আগেও তারা পার্টির নির্দেশ নিয়ে যান বলে গ্রামের অনেকে টিপ্পনী কাটেন। কিন্তু সাংবাদিকের পরিকল্পনা শোনার পর থেকে গ্রামের মানুষ উত্তেজনার আঁচে ফুটতে শুরু করেছেন। ডাক্তারের দাবিতে এককাট্টা হয়ে উঠেছেন সবাই। তাদের মধ্যে গ্রামে প্রশান্তকাকার ঠোঁটকাটা হিসাবে সুনাম - বদনাম দুই-ই আছে।তিনিই প্রসাদকাকাদের মুখের উপর বলে দেন , এতে হিত অহিতের কি আছে ? আর তোমাদের পার্টির সঙ্গে আলোচনা করারই বা কি আছে ? তোমাদের পার্টির নেতাদেরও তো কম বলা বলি নি আমরা। কই আমাদের কথা তো কানে তোলেন নি তারা। এখন আমরাই বা তাদের সঙ্গে আলোচনা করতে যাব কিসের জন্য ?
--- তাহলে তোমরা যা ভালো বোঝ কর। আমরা এর মধ্যে নেই। 
এবারে মুখ খোলে প্রিয়। সে বলে দেখুন , আমরা কারও কোন ব্যক্তিগত বিষয় কিম্বা রাজনৈতিক ব্যাপার নিয়ে আন্দোলন করতে যাচ্ছি না। আমাদের নায্য দাবি আদায়ের জন্য আমরা লড়তে যাচ্ছি।সাংবাদিকেরা বলেছেন এই লড়াইয়ে তারা আমাদের পাশে থাকবেন। তাহলে লড়তে আমাদের সমস্যা কোথাই ? 
প্রসাদকাকা বলেন ,  পার্টির নির্দেশ ছাড়া আমরা কিছু বলতে পারব না। পরশু আমাদের জেলা নেতা বীরেনদা আসবেন , তার সঙ্গে আলোচনার পরই আমরা এই আন্দোলনে থাকব কিনা তা বলতে পারব।
----  কিন্তু পরশু থেকেই তো আমাদের আন্দোলন শুরু হবে। তাহলে পরশু পর্যন্ত কি করে অপেক্ষা করা যাবে ?
প্রিয় জানে প্রসাদকাকাদের এই আন্দোলনে থাকার সম্ভাবনা খুব কম। এই আন্দোলনে তো শাসক দলই বিড়ম্বনায় পড়বে, তাই কিছুতেই দল প্রসাদকাকাদের আন্দোলনে থাকতে অনুমতি দেবে না। তার অনুমানই মিলে যায়। কথার পিঠে প্রসাদকাকা  বলে ফেলেন , এতে আমাদের দলের মুখ পুড়বে। তাই দলের সঙ্গে কথা না বলে আমরা তোমাদের সঙ্গে যেতে পারব না।
আর যাই কোথাই ? প্রশান্তকাকা ঠায় ঠায় বলে দেন -- তোমাদের দল মুখ পোড়ার মতো কাজ করে রেখেছে বলেই মুখ পুড়বে।  তোমরা না থাকলেও চলবে। আমরা পিছু হঠব না।
প্রিয় দেখে সমূহ বিপদ। এইভাবে বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়লে আন্দোলনটাই মাঠে মারা যেতে পারে। যে কোন বিষয়ে কেউ ভালো করতে না পারলেও তার পক্ষে খারাপ করাটা খুব কঠিন হয় না। তাছাড়া প্রসাদকাকার কাছে জমা থাকা গ্রাম কমিটির টাকাটাও প্রয়োজন। তাই সে খুব বিনীতভাবে বলে , ঠিক আছে প্রসাদকাকা দলীয় বাধ্যবাধকতার জন্য যদি  সরাসরি না'ই থাকতে পারেন তাহলে বাইরে থেকে সমর্থন জানাবেন। কিন্তু আমাদের তো আর পিছোনোর জায়গা নেই। সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে গিয়েছে।প্রশাসন আর সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন আমরা যদি পিছিয়ে যায় তাহলে আমরা খুব খেলো হয়ে যাব। তাই আপনাদেরও সাহায্য চায়। আপনি তো জানেন যে কোন আন্দোলন করতে গেলেই অর্থের প্রয়োজন। অর্থের সংস্থান বলতে গেলে তো সেই চাঁদা। কিন্তু গ্রামের মানুষের চাঁদা দেওয়ার মতো সামর্থ্য এখন নেই।তাই এই সময় গ্রাম কমিটির কাছে জমা থাকা টাকা থেকে যদি কিছু আমাদের দেন তাহলে খুব ভালো হয়।
--- কিন্তু সেই টাকাও তো আমি পার্টির সঙ্গে আলোচনা না করে এই কাজে দিতে পারব না।


                এবারে রে-রে করে ওঠেন অধিকাংশ গ্রামবাসী। সবাই সমস্বরে বলে উঠেন -- এ কথাটা বলা তোমার ঠিক হচ্ছে না প্রসাদ। টাকাটা তো তোমার পার্টি ফান্ডের নয় যে পার্টির সঙ্গে আলোচনা করে দিতে হবে। এতো আমাদের গ্রামের টাকা। এই টাকা গ্রামের উন্নয়নের কাজে লাগানোর কথা। গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডাক্তারের ব্যবস্থা করাও তো উন্নয়নেরই সামিল।
প্রশান্তকাকা এগিয়ে গিয়ে প্রসাদকাকার মুখের সামনে হাত নেড়ে বলেন -- এতদিন উন্নয়নের নামে কি করেছ তা তো আর জানতে বাকি নেই। যা হিসাব দিয়েছো মুখ বুঝে মেনে নিয়েছি। এখন ভালো চাও তো মানে মানে কিছু টাকা দাও।
প্রবল চাপের মুখে প্রসাদকাকা দু'হাজার টাকা প্রিয় হাতে ধরিয়ে দিয়ে  কয়েকজন অনুগামী নিয়ে মাচানতলা ছেড়ে বেরিয়ে যান। টাকাটা ঋজুর হাতে তুলে দিয়ে প্রিয় বলে , কাল কতক্ষণ আন্দোলন চলবে ঠিক নেই। সাংবাদিকরা সব আসবেন। দেরি হলে তাদের খাওয়া - দাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যান্য খরচও রয়েছে। এখান থেকে যা খরচ হবে 
এই টাকা থেকেই করবে। আর সমস্ত হিসাব নিখুঁত ভাবে লিখে রাখবে। শুরু হয়ে যায় আন্দোলনের প্রস্তুতি।



         ( ক্রমশ ) 

No comments:

Post a Comment