Short story, Features story,Novel,Poems,Pictures and social activities in Bengali language presented by Arghya Ghosh

অন্তরালে --৮



  অন্তরালে


     অর্ঘ্য ঘোষ




( ধারাবাহিক উপন্যাস )





রাতের মধ্যেই পুরনো খবরের কাগজে আলতা আর কাপড়ে দেওয়া নীল দিয়ে মোটা মোটা হরফে লিখে ফেলা হয় পোস্টার। ঠিক হয় সকাল থেকেই মাইকে পোলিও বয়কটের স্বপক্ষে আশপাশের গ্রামগুলিতে প্রচার করা হবে। এতে বিষয়টি সবাইকে জানানোর পাশাপাশি গ্রামবাসীদেরমনোভাবও জানা যাবে। সেইমতো রিক্সা - মাইক সব ঠিক করে সবার বাড়ি ফিরতে বেশখানিকটা রাত হয়ে যায়। বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রিয়র মনে হয় মা নিশ্চয় খুব দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। বিশেষ করে প্রসাদকাকাদের ব্যাপারটা কানে পৌঁছোলে তো আর কথাই নেই। প্রসাদকাকারা যে লোক বিশেষ সুবিধার নয় তা গ্রামের লোকের জানতে বাকি নেই। সবাই পারতপক্ষে তাদের এড়িয়েই চলে। নেহাৎ শাসকদলের ছত্রছায়ায় আছে বলে সবাই ভয়ে ভক্তি করতে বাধ্য হয়। কোনকালেই তো  শাসকদলকে চটিয়ে কিছু করা যায় নি।সেই জমি
--- কি করে খায় ? তোর বাবা মিতুনের দোকান থেকে শুনে এল প্রসাদ মোড়লরা নাকি তোদের উপরে বেজায় চটেছে। সবাইকে বলে বেড়াচ্ছে এর ফল ভালো হবে না। সেই থেকে তো আমরা দু'জনে ভেবে বাঁচি না। এইমাত্র তোর বাবাকে জোর করে খাইয়ে শোবার ঘরে পাঠিয়েছি। কিন্তু আমি কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছি না। হ্যা রে , ওরা তোর কিছু ক্ষতি করে দেবে না তো ?
---- ওঃ  মা তুমি অত দুশ্চিন্তা কোর না তো। আমরা গোটা গ্রামের লোক একদিকে রয়েছি। অন্যান্য গ্রামের লোকেরাও আমাদের সঙ্গে আসবে। তাই প্রসাদকাকারা চাইলেও আমার কিছু করতে পারবে না। কিন্তু তুমি যদি এরকম দুশ্চিন্তা করো তাহলে আমি তো মনের জোর হারিয়ে ফেলব। তুমি কোথাই আমাকে সাহস যোগাবে তা নয় , উল্টে ভয় ধরিয়ে দিচ্ছ। চলো চলো ভাত বাড়ো , খুব খিদে পেয়েছে। মা - বেটাতে এক সঙ্গে বসে খেয়ে নিই।
--- কি জানি বাবা , প্রসাদ মোড়ল তো লোক সুবিধার নয়। কি হয়ে যায় বলা যায় না।একটু  বুঝে শুনে চলিস বাবা।
---- মা তোমার আর্শিবাদ আছে না আমার সঙ্গে । দেখো তোমার ছেলের কেউ কিছু করতে পারবে না।
--- তাই যেন হয় ঠাকুর। বলে কপালে হাত জোড় করে ঠেকান হরপার্ব্বতী।


                          মায়ের দুশ্চিন্তা দূর করতে কথাটা বলল বটে ,  কিন্তু মায়ের আশঙ্কাটা একেবারেই অমূলক বলে উড়িয়ে দিতে পারে না প্রিয়।প্রসাদকাকারা যে তাদের পরিকল্পনা বানচাল করতে ইতিমধ্যেই ঘোঁট পাকাতে শুরু করেছে সে খবর মাচানতলায় বসে পোস্টার লিখতে লিখতেই পেয়েছিল তারা। কিন্তু সেটা জানার পর গ্রামের মানুষ মনোবল হারানোর পরিবর্তে আরও এককাট্টা হয়ে ওঠেন। সেই কথা ভেবেই প্রিয়কে মন শক্ত করতে হয়। সবাই তার কথায় গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে এসেছেন , তাই যাই হোক না কেন সে কিছুতেই পিছিয়ে যেতে পারবে না। আর এই মুহূর্তে পিছানোর কোন প্রশ্নই নেই। এখন শুধু এগিয়ে যেতে হবে। চরম উত্তেজনার মধ্যেই কেটে যায় রাতটা। সকাল থেকেই শুরু হয়ে যায় পোলিও বয়কট অভিযানের তোড়জোড়। একদল বেরিয়ে পড়ে পোষ্টার সাঁটাতে। রিক্সায় মাইকে বেঁধে ঋজু আর প্রিয় গ্রামে গ্রামে প্রচার করতে বেরিয়ে যায়। মাইক প্রচার শুনে প্রতিটি গ্রামেই লোকজন রিক্সা ঘিরে  ভীড় জমান। অধিকাংশই বলেন , এতদিন একটা কাজের মতো কাজ হচ্ছে। আমরা আছি তোমাদের সঙ্গে। এ গ্রাম - সে গ্রাম ঘোরার পরে প্রিয়রা রিক্সা নিয়ে পৌঁছোয় স্বাতীদের গ্রামেও।
তবু সংশয় যায় না ওদের। তাই প্রসঙ্গটাকে অন্যদিকে ঘোরানোর জন্য সে বলে , কি রে তোরা ? রোদে তেতে পুড়ে এলাম। টিফিন করাবি বলে ডেকে এনে এখনও পর্যন্ত এক গ্লাস সরবতও তো দিলি না। মধুরিমা লজ্জা পেয়ে বলে , ছিঃ ছিঃ বড়ো ভুল হয়ে গিয়েছে। এই এক্ষুনি আনছি। তোরা ততক্ষণে হাত মুখ ধুয়ে নে। ঋজুদাই বরং আগে এসো, হাতমুখ ধুয়ে যাও।বলে ঋজুদাকে কলতলার দিকে ডেকে নিয়ে যায় মধুরিমা। প্রিয়র বুঝতে অসুবিধা হয় না তাদের একান্তে কথা বলার সুযোগ করে দিতেই এটা করল মধুরিমা। সেই সুযোগে সেপরিপূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে স্বাতীর দিকে। স্বাতীও তার চোখে চোখ রেখে বলে ,মাইকে তোমার গলাটা অন্যরকম লাগছিল। খুব সুন্দর শোনাচ্ছিল।
প্রিয় স্বাতীর হাতটা ধরতে যাচ্ছিল কিন্তু সেই সময় মধুরিমা রান্নাঘর থেকে বলে-- স্বাতী একবার এদিকে আয়। খাবার গুলো নিয়ে যা।
--- যাই , বলে রান্নাঘরের দিকে ছোটে স্বাতী। কলঘর থেকে সেই সময় ঋজুদাও এসেপড়ে।টিফিন করে ফের তারা প্রচার করতে করতে নিজেদের গ্রাম অভিমুখে রওনা দেয়।দুটি চোখ যে তার দিকে চেয়ে আছে এক পলক পিছনে তাকিয়েই  সেটা টের পায় প্রিয়।


                    মনটা কেমন যেন উদাস হয়ে যায় তার। আবার কবে স্বাতীর সঙ্গে দেখা হবে কে জানে ? স্বাতীর কথা ভাবতে ভাবতেই তাদের রিক্সা গ্রামে ঢোকে। চোখ মেলে চাইতেই প্রিয়দেখতে পায় পোস্টারে পোস্টারে ছেয়ে গিয়েছে গোটা গ্রাম। মাচানতলায় তাদেরই ফেরারঅপেক্ষায় জটলা করে রয়েছে গ্রামের মানুষ। রিক্সা থেকে নামতেই তাদের ঘিরে ধরেসবাই জানতে চান অন্যান্য গ্রামের মানুষজন কি বলছেন ? প্রিয় তাদের ইতিবাচকমনোভাবের কথা জানাতেই যেন স্বস্তির নিস্বাস ছেড়ে বাঁচে মানুষগুলো।তারই মাঝেপ্রশান্তকাকা কেবল বলেন , এখনই অত স্বস্তির কিছু নেই। প্রসাদ মোড়লরাও আমাদেরসিদ্ধান্তের কথা জানাতে পার্টি অফিসে ছুটেছিল। পার্টির নেতারা নাকি বলেছেন , কোন ক্রমেই এটা হতে দেওয়া যাবে না।
ঘটনার গুরুত্ব অনুধাবন করে প্রিয় বলে , আমরা নিজে থেকে ঝামেলায় জড়াব না। গ্রামবাসীদের বোঝাব একটা দিন পরেও পোলি খেলে কোন সমস্যা হবে না আর্যবাবুআমাদের বলেছেন সে ব্যবস্থা উনিই করে দেবেন। সেই কথা সবাইকে খুলে বললে মনে হয়সবাই শুনবেন।
---- সেটা হলে তো ভালোই , তবু আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। কেউ পোলিও খাওয়াতে গেলেই আমরা আটকাব , দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন প্রশান্তকাকা।ঠিক হয় সকাল থেকে সবাই মাচানতলায় পাহারায় থাকবেন। মাচানতলার সামনে দিয়েইস্বাস্থ্যকেন্দ্র যাওয়ার রাস্তা। মাচানতলার অদুরেই ক্লাবঘর। সেখানেই সাংবাদিকদের তো বটেই , যারা পাহারায় থাকবেন তাদের জন্য খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থাকরা হবে। সেই জন্য বাড়ি বাড়ি ঘুরে চাল , মুড়ি আর সবজি তোলা হয়েছে। করার সরঞ্জাম নিয়ে এখানেই চলে এসেছে। গ্রামের ভোজকাজে বিনা পারিশ্রমিকে রান্না করে  আনন্দ আর সুকুমার। আজও তারাই রান্নার দায়িত্ব নিয়েছে। চায়ে চুমুক দিতে দিতেই তারা দেখতে পায় কাঁধে পোলিও ভ্যাকসিনের বাক্স ঝুলিয়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দিকে হেটে যাচ্ছেন একজন নার্স আর একজন স্বাস্থ্যকর্মী। তাদের দেখে কয়েকজন গ্রামবাসী বলে উঠেন -- আরে এদের আটকে দিলেই তো সব ল্যাঠা চুকে যায়।
সেই কথা শোনামাত্রই তাদের আটকানোর জন্য কয়েকজন ছুটে যায়। আর তাদের আটকাতে ছুটে যেতে হয় প্রিয়কে। স্বাস্থ্যকর্মীদের আটকাতে বাধা দেওয়ায় সবাই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায়। ঋজু বলে, আরে এদেরকে ক্লাবঘরে আটকে রাখলেই তো আর কাউকে পাহারা দিতে হত না।
--- কিন্তু আমরা তা করতে পারি না। সরকারি কাজে বাধা  সৃষ্টি করাটা বেআইনী। আমরা সরকারি পরিষেবা বর্জন করতেই পারি কিন্তু পরিষেবা দেওয়াটা আটকাতে পারি না।
প্রিয়র কথা খুব একটা মনোঃপুত হয় না ওদের। কিন্তু এই আন্দোলনের পুরোভাগে রয়েছে প্রিয়। তাই তার কথা শুনে মাচানতলায় ফিরতে হয় সবাইকে। সেই সময় তারা দেখতে পায় দুরের রাস্তায় যেন ধুলোর ঝড় উঠেছে।


       (  ক্রমশ ) 



       নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 


শীঘ্রই দেশ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হতে চলেছে আমার তৃতীয় উপন্যাস ------
  
                                  

 
                       ----০---

No comments:

Post a Comment