অন্তরালে
অর্ঘ্য ঘোষ
( ধারাবাহিক উপন্যাস )
কিছুক্ষণের মধ্যেই ধুলো উড়িয়ে একে একে গ্রামে ঢুকতে শুরু করে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের গাড়ি। সবার আগে আসে দৈনিক 'অন্তরালে' পত্রিকার সাংবাদিক আর্য ঘোষের গাড়ি। প্রিয়রা এগিয়ে গিয়ে তাদের মাচানতলায় নিয়ে আসে। ততক্ষণে চলে আসে চা- বিস্কুট। চা খেতে খেতেই সাংবাদিকরা গ্রামের মানুষের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে দেন। সাংবাদিকদের কথা মতো ক্লাবের টিভি'টা এনে ফিট করে দেওয়া হয় মাচানতলায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই টিভিতে বিভিন্ন চ্যানেলে চ্যানেলে সম্প্রচারিত হতে শুরু করে গ্রামের পোলিও বয়কটের খবর।ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ার সাংবাদিকেরা বুম হাতে প্রিয়র বক্তব্য নেওয়ার জন্য এগিয়ে আসেন। প্রিয় নিজের প্রচার চাই না , তাই গ্রামের বয়স্ক মানুষদের কথা বলার জন্য এগিয়ে দেয়। তাদের মধ্যে প্রশান্তকাকাই বেশ গুছিয়ে কথা বলেন -- পাঁচ বছর ধরে আমাদের এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডাক্তার নেই। গ্রামের অধিকাংশ মানুষই গরীর। বাইরে গিয়ে চিকিৎসার সামর্থ্য নেই। তাই ওঝা - তাবিজ - কবজ আর হাতুড়ে ডাক্তারের উপরে নির্ভর করেই আমরা মরে বেঁচে আছি। আসলে ভুল, কিম্বা বিনা চিকিৎসায় প্রায়ই কোন না কোন পরিবারে মৃত্যু হচ্ছে। প্রশাসনকে সব জানিয়েও কোন লাভ হয় নি বলে আমরা পোলিও বয়কটের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
তার কথা শেষ হতেই বিপুল হাততালিতে ফেটে পড়ে জনতা। কিছুক্ষণ পরেই টিভির খবরে শোনা যায় প্রশান্তকাকার গলা।আর গ্রামের মানুষ অত অল্প সময়ের মধ্যে টিভিতে নিজেদের দেখতে পেয়ে আরও উৎসাহিত হয়ে ওঠেন।উৎসাহের আতিশয্যে তারাই সাংবাদিকদের বিনা কিম্বা ভুল চিকিৎসায় এ যাবৎ যাদের যাদের প্রিয়জন হারিয়েছে তাদের বাড়ি নিয়ে যায়।টি,ভি ক্যামারায় তাদের বক্তব্য রেকর্ড করা হয়।ভবানী ডাক্তারের চেম্বার , স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পরিত্যক্ত কোয়ার্টার , সাংবাদিকদের সব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখান গ্রামের মানুষ। ভবানীডাক্তার অবশ্য সাংবাদিকরা তার চেম্বারের ছবি তোলা শুরু করতেই চম্পট দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু সাংবাদিকরা সেটা আঁচ করেই তার মুখের সামনে বুমটা এগিয়ে ধরে তার কোন ডাক্তারি ডিগ্রি আছে কিনা জানতে চান। প্রথমে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও সাংবাদিকদের সমবেত চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত এইট পাশ বিদ্যের দৌড়ের কথা স্বীকার করে নিয়ে কোন রকমে পালিয়ে বাঁচে সে। এরপর সাংবাদিকরা যান মিতুন দত্তের মুদিখানায়। সেখানে একজন সাংবাদিক ভালোমানুষের মতো মুখ করে পেট ব্যাথার ট্যাবলেট পাওয়া যাবে কিনা জানতে চান। মিতুনের দোকানের ছেলেটা কোনকিছু না ভেবেই একটা ট্যাবলেট বের করে এনে তুলে দেয় তার হাতে।সেই ট্যাবলেটের দাম নেওয়ার জন্য হাত বাড়াতে গিয়েই মিতুনের চক্ষু চড়ক গাছ হয়ে ওঠে। ততক্ষণে তার মুখের সামনে সাংবাদিকরা তুলে ধরেছেন বেশ কয়েকখানা বুম। তাদের মধ্যে আর্য প্রশ্ন করেন -- আপনার ড্রাগ লাইসেন্স আছে ?
হকচকিয়ে গিয়ে মিতুন না সূচক ঘাড় নাড়ে। তখন সাংবাদিকরা তাকে আরও চেপে ধরেন -- আপনি জানেন এভাবে মুদিখানায় ওষুধ বিক্রিটা বেআইনী ?
এবারে দুইদিকে ঘাড় নাড়ে মিতুন।
আর্য ফের প্রশ্ন করেন -- আচ্ছা যে ছেলেটি ওষুধ এনে দিল সে কতদুর পড়াশোনা করেছে ?
--- থ্রি পর্যন্ত।
---- তাহলে তো সে ইংরাজীতে লেখা ওষুধের নামও পড়তে পারে না।
--- দিতে দিতে অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। অসুবিধা হয় না।
--- ভাল বললেন তো , যদি ভিন্ন রোগের একই রকম দেখতে ওষুধ আসে তখন কি হবে ?
এবারে আর কথা সরে না মিতুনের মুখে। বেশ কিছুক্ষণ ক্যামেরার সামনে তো- তো করে সে। দফায় দফায় টিভি'র সংবাদে ওইসব ছবি দেখানো হয়। মাচানতলায় বসে চ্যানেল ঘুরিয়ে সেইসব ছবি দেখতে দেখতে স্বাস্থ্যকেন্দ্র পাহারা দেন গ্রামের মানুষ। বেলা ৯ পর্যন্ত স্বাস্থ্যকেন্দ্র চত্বরে কারও দেখা মেলে না। অজিতবাবুর সঙ্গে সেই নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মী দু'জন পোলিও খাওয়ানোর জন্য ছেলেমেয়েদের আসার প্রতীক্ষায় গেটের দিকে চেয়ে বসে থাকেন।
তারপরই একে একে স্বাস্থ্যকেন্দ্র অভিমুখে আসতে শুরু প্রধান, পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি , বি,ডি,ও, বি, এম,ও,এইচ সহ প্রশাসনের আধিকারিকরা।গ্রামের লোকেরা তাদের মাচানতলাতেই আটকে দেন।বি,ডি,ও মহ: নকি তাদের বোঝানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু গ্রামের মানুষ তার কথা কানেই তোলেন না। প্রিয় এগিয়ে গিয়ে বলে , আমরা আর আপনাদের শুকনো প্রতিশ্রুতিতে ভুলছি না। যতক্ষণ না ডি,এম সাহেব এসে আমাদের লিখিত প্রতিশ্রুতি না দিচ্ছেন ততক্ষণ আমরা একজন শিশুকেও পোলিও খাওয়াব না।
ফোনাফুনি চলতে থাকে। সেই সময় এক গাড়ি পুলিশ নিয়ে গ্রামে ঢোকেন বিধায়ক সদানন্দ দাস। পুলিশ দেখে গ্রামের মানুষ প্রথমে কিছুটা হকচকিয়ে যান। কিন্তু সাংবাদিকদের দেখে ফের মনোবল ফিরে পান তারা। বিধায়ককে দেখে প্রসাদকাকারাও মাঠে নামেন। দলের বিধায়ককে এসেও যদি শুধু শুধু ফিরে যেতে হয় তাহলে যে তাদের মুখ থাকে না। তাই তারা তাদের দলের সমর্থক দুটি পরিবার থেকে শিশু সহ দু'জন মা'কে নিয়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দিকে এগিয়ে আসতে থাকেন। তাদের দেখে আত্মপ্রসাদের হাসি ফুটে ওঠে বিধায়কের মুখে। সেটা লক্ষ্য করেই হাতের কাছে লাঠি, ডাং যে যা পায় নিয়ে রে-রে করে প্রসাদ মোড়লদের লক্ষ্য করে তেড়ে যায়।মহিলা দু'জন হাত জোড় করে বলেন -- আমাদের কোন দোষ নেই বাবা। আমরা আসছিলাম না। ওই প্রসাদ মোড়ল বাড়িতে গিয়ে বলল পোলিও খাওয়াতে নিয়ে না গেলে পঞ্চায়েত থেকে জন্ম সার্টিফিকেট দেবে না। সেই ভয়েই আমরা আসতে বাধ্য হয়েছি বাবা।
তখন উত্তেজিত জনতা প্রসাদ মোড়লদের দিকে লাঠি উঁচিয়ে তেড়ে যায়। আর তাদের হাত থেকে রক্ষা পেতে প্রসাদ মোড়লরা ছুটে পুলিশের গাড়ির কাছে গিয়ে আশ্রয় নেয়। ওই ঘটনায় বিড়ম্বনায় পড়েন সদানন্দবাবু। এর আগে কখনো এই রকম পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয় নি তাকে। তার মুখের উপরে কেউ মুখ তুলে কথা বলার সাহস পায় না। সব ক্ষেত্রে তিনিই যা চেয়েছেন তাই হয়েছে। সেই আত্মবিশ্বাসের জোরেই মুখ্যমন্ত্রীকে কথা দিয়ে এসেছিলেন সুস্থ সমাধান একটা কিছু করেই ফিরবেন তিনি। দফায় দফায় সংবাদ মাধ্যমে ডাক্তারের দাবিতে পোলিও বয়কটের খরব দেখে যথেষ্ট বিড়ম্বনার মধ্যে পড়েই মুখ্যমন্ত্রী বিষয়টি দেখার জন্য তাকে ফোন করেছিলেন। এখন মুখ্যমন্ত্রীকে কি জবাব দেবেন তিনি ? কি করে বলবেন গ্রামের মানুষ তার কথা শুনছে না।
তাহলে হয়তো পরের ইলেকশনে টিকিটই মিলবে না। তার রিড়ম্বনা রূপ নেয় ক্ষোভে। যত তাল গিয়ে পড়ে সংবাদ মাধ্যমের উপর। সরাসরি সংবাদ মাধ্যমের উপর ক্ষোভ উগড়ে দিয়ে বলেন --আপনাদের প্ররোচনাতেই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। নাহলে পোলিও বয়কটের কথা গ্রামের সরল সিধে মানুষের মাথায় আসত না। আপনারা গ্রামের মানুষগুলোকে জীবন নিয়ে খেলায় প্ররোচিত করছেন।
বিধায়কের কথা শুনে অন্যান্য সাংবাদিকরা চুপ করে যান। মুখ খোলে আর্য। বিধায়কের সামনে এগিয়ে গিয়ে সে বলে , আজকের এই পরিস্থিতির জন্য কারা দায়ি , আপনারা না আমরা ? আপনারাই তো এই প্ররোচনার পরিস্থিতি সৃষ্টি করছেন।আপনারা সরকারে রয়েছেন , আপনি এলাকার বিধায়ক তা স্বত্ত্বেও কেন গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পাঁচ বছর ধরে ডাক্তার নেই তা খোঁজ নিয়ে দেখেছেন ?
---- সারা রাজ্যে ডাক্তারের ঘাটতি চলছে।
---- মিথ্যা কথা। খোঁজ নিয়ে দেখুন শহরের হাসপাতালগুলিতে প্রয়োজনের অধিক ডাক্তার রয়েছেন। তারা আপনাদের দল নিয়ন্ত্রিত সংগঠনে নাম লিখিয়ে রেখেছে। আর তারই জোরে হাসপাতালে একবার করে মুখ দেখিয়ে চুটিয়ে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করছে। তাদের চাঁদায় হয় আপনারা কিম্বা আপনাদের দল ফুলে ফেঁপে উঠেছে। আপনারা তো শহরে বাস করেন , সরকারি টাকায় স্বাস্থ্য পরিষেবা পান, তাই গ্রামের এইসব তথাকথিত সরল সিধে মানুষের জীবন যন্ত্রণা আপনারা বুঝবেন না , বুঝবেন না আপনাদের সংগঠনের ডাক্তারও। কিন্তু গ্রামে যারা থাকেন তারাও মানুষ। একটি ছেলে কিম্বা মেয়েকে ডাক্তার তৈরী করতে তার পরিবারের যে পরিমাণ টাকা খরচ হয়, তার কয়েকগুন বেশি পরিমাণ টাকা খরচ হয় সরকারের। আর সরকারের টাকাটা কোন গৌরী সেনের নয় , মানুষের দেওয়া করের টাকা। সেইসব করদাতাদের মধ্যে যেমন শহরের মানুষ আছেন , তেমনি এইসব সরল সিধে গ্রামের মানুষেরাও রয়েছেন। তাহলে আপনাদের মতো শহরে বাস করা লোকেরা যদি শহরে বসে স্বাস্থ্য পরিষেবা পান তাহলে এইসব মানুষেরাই বা কেন গ্রামে সেটা পাবেন না , কেন তাদের সামান্য জ্বরজ্বালা হলেও শহরে ছুটতে হবে ?
গ্রামের মানুষ তো বটেই , আর্যর কথা প্রশাসনের আধিকারিকরাও মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছিলেন এতক্ষণ। যুতসই কথা খুঁজে পাচ্ছিলেন না বিধায়ক। তার চোখমুখই বলে দিচ্ছিল যথেষ্ট বেকায়দায় পড়েছেন তিনি। মিনমিনে স্বরে কেবল বলতে পারেন -- সাংবাদিক হিসাবে এসব কথা বলার এক্তিয়ার আপনার নেই।
---- আমার এক্তিয়ারের সীমাটা জানা আছে সদানন্দবাবু। সর্বোপরি আমি একজন মানুষ। সেই মানুষ হিসাবেই জানতে চাইছি কেন মানুষকে আজও ওঝা -কবিরাজ , তাবিজ - কবজের ভরসা আর হাতুড়ের ডিসপেনসারি কিম্বা মুদির দোকান থেকে ওষুধ কিনে খেতে হবে ? ডাক্তার দিতেই পারবেন না যদি তাহলে কেন গ্রামবাসীদের জমি নিয়ে এই কংক্রিটের জঙ্গল বানিয়ে ছিলেন ? আজ পোলিও বয়কটের খবর শুনে উপর মহলের গুঁতো খেয়ে জীবনবাজি রাখার কথা বলতে ছুটে এসেছেন , কিন্তু যেদিন সামান্য পেটের রোগে হাতুড়ের ভুল চিকিৎসায় ফুলের মতোএকটি শিশু মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিল সেদিন কোথাই ছিলেন ?
আর্যর কথা শেষ হতে না হতেই গ্রামবাসীরা হাততালিতে ফেটে পড়েন। ল্যাজেগোবরে হয়ে সদলবলে গ্রাম ছাড়েন বিধায়ক।
No comments:
Post a Comment