অন্তরালে
অর্ঘ্য ঘোষ
( ধারাবাহিক উপন্যাস )
তারা চলে যেতেই বাঁশের মাচানের উপরেই সাংবাদিকদের খাওয়া দাওয়ার তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। সেই সময় খবরাখবর চ্যানেলে সরাসরি লাইভ দেখানো শুরু হয়ে যায়। আর খবরাখবরের সাংবাদিক শৌভিক কানে হেডফোন লাগিয়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সামনে চলে যান। টিভিতে সঞ্চালিকাকে বলতে শোনা যায় -- ডাক্তারের দাবিতে যেভাবে প্রত্যন্ত একটি গ্রামে পোলিও বয়কটের মতো একটা আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়েছে সেই সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার জন্য আমরা আমাদের স্টুডিওতে বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ডেকেছি। তা
দের সঙ্গে আপনাদের আলাপ করিয়ে দিচ্ছি, আমার ডান পাশে রয়েছেন বিরোধীদলের নেতা সোমপ্রকাশ বসু এবং সদ্য অবসরপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য অধিকর্তা রমাপদ বসাক। উল্টো দিকে রয়েছেন শাসকদলের নেতা মিত্রকান্ত মিশ্র এবং বিশিষ্ট আইনজীবী সুমন ব্যানার্জী। বিস্তারিত আলোচনায় যাওয়ার আগে এক ঝলক দেখে নেব এখন পরিস্থিতি কি ? ঘটনস্থলে রয়েছেন আমাদের প্রতিনিধি শৌভিক ঘোষ। শৌভিক তুমি শুনতে পাচ্ছ?
--- হ্যা বলো নিবেদিতা।
--- এই মাত্র তুমি আমাদের দেখালে বিধায়ক গিয়েও পোলিও খাওয়াতে পারলেন না। গ্রামবাসীরা তার কথা শুনে কার্যত মারমুখী হয়ে উঠলেন। কেন এত ক্ষোভের বহ্বিপ্রকাশ ঘটল ? হঠাৎ করে তো এটা হতে পারে না।
---- একদমই , নিবেদিতা তুমি ঠিকই বলেছো। দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভের বহ্বিপ্রকাশই ঘটেছে আজ। আসলে গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে ডাক্তার নেই। গ্রামবাসীরা বার বার ডাক্তারের দাবি জানিয়েছেন। কিন্তু প্রশাসন তাদের কথা কানেই তোলা নি বলে অভিযোগ। তাই ক্রমেই ক্ষোভ জমা হচ্ছিল মানুষের মনে। কারণ গ্রামের বাসিন্দাদের চরম দুর্দশার মধ্যে থাকতে হয়। ইতিমধ্যে আমরা দর্শকদের দেখিয়েছি কিভাবে অসহায়তার সুযোগ নিয়ে হাতুড়ে কিম্বা মুদিখানার দোকানদারেরা মানুষের জীবন নিয়ে চুটিয়ে ব্যবসা করছে। সম্প্রতি হাতুড়ের হাতে একটি শিশুর মৃত্যু ক্ষোভের সেই যেন আগুনে ঘৃতাহুতি দেয়। তারপরই গ্রামবাসীরা পোলিও বয়কটের ডাক দেন। তারা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন জেলাশাসকের লিখিত প্রতিশ্রুতি ছাড়া ছেলেমেয়েদের পোলিও খাওয়াবেন না। নিবেদিতা।মনোহরপুর থেকে ক্যামেরায় কল্যাণের সঙ্গে শৌভিক ঘোষ। খবরাখবর।
---- ঠিক আছে শৌভিক , তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। তুমি সুন্দর ভাবে আজকের এই আন্দোলনের প্রেক্ষাপট আমাদের সামনে তুলে ধরলে।তুমি আমাদের সঙ্গে থাকো। পরে আবার আমরা তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করে নেব।এখন আমরা ফিরে যাচ্ছি আলোচনায়। হ্যা সোমপ্রকাশবাবু , বলুন আপনার মত।
--- গ্রামবাসীদের ক্ষোভ এ ব্যাপারে থাকাটাই স্বাভাবিক। এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার ব্যাপারে শাসকদল তার দায় এড়িয়ে যেতে পারে না।
--- আপনারাও কি দায় এড়াতে পারেন ?
--- যাঃ বাবা , আমরা আবার কি করলাম ? আমরা তো বিরোধীদল।
---- মানুষের দাবি আদায়ের ক্ষেত্রে বিরোধী দলেরও একটা ভূমিকা থাকে।ওই এলাকায় আপনাদের তো ভালোই সংগঠন রয়েছে। কই তাহলে কেন ওই দাবির ব্যাপারে আপনারা সোচ্চার হন নি ? কিন্তু দিল্লীর সংসদভবনে কে কাকে গালাগালি করল তাই নিয়ে বনধ ডেকে ওইসব গ্রামেরও জনজীবন বিপর্যস্ত করে টি,ভি মিডিয়ার সামনে লম্বা চওড়া বক্তৃতা দিতে তো আপনাদের জুড়ি মেলা ভার।
সোমপ্রকাশবাবু কি যেন বলতে যাচ্ছিলেন , তাকে থামিয়ে দিয়ে সঞ্চালিকা প্রাক্তন স্বাস্থ্য অধিকর্তা রামপদ বসাককে জিজ্ঞেস করেন -- আচ্ছা রমাপদবাবু, একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ৫ বছরের বেশি ডাক্তার নেই। আপনি কি বলবেন ?
--- এটা সত্যিই লজ্জাজনক ঘটনা।
--- আপনি কতদিন আগে অবসর নিয়েছেন ?
---- পাঁচ মাস আগে।
---- তাহলে রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা হিসাবে সেই সময় আপনার লজ্জা কোথাই ছিল ?
রমাপদবাবু জবাব দেওয়ার আগে আইনজীবি সুমন ব্যানার্জীর দিকে ফেরেন সঞ্চালিকা --- আচ্ছা সুমনবাবু একজন আইনজীবি হিসাবে আপনি বলুন এভাবে পোলিও বয়কট কতটা আইন সিদ্ধ ?
--- দেখুন , যে কোন পরিষেবা বয়কট করার স্বাধীনতা মানুষ মাত্রেরই আছে। কিন্তু সেই পরিষেবা আটকে রাখাটা বেআইনী।
এবারে সঞ্চালিকা নিবেদিতা বলেন -- আমরা সব পক্ষের কথা শুনে নিলাম। এবার শুনব শাসকদলের নেতা কি বলেন। হ্যা বলুন মিত্রকান্তবাবু আপনি কি বলবেন ?
---- আমি বলতে চাই , এই পরিস্থিতি আজকেই সৃষ্টি হয় নি। আমরা সবে মাত্র বছর দশেক হলো ক্ষমতায় এসেছি। বিগত সরকারের আমল থেকেই ডাক্তারের ঘাটতি রয়েছে। আমরা তা একে একে মেটানোর চেষ্টা করছি। একদিনে সব সমস্যা মেটানো সম্ভব নয়। মনে রাখতে হবে উন্নয়ন একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া।
শাসকদলের নেতার কথা শেষ হয় না , রিমোটে অন্য চ্যানেল ধরায় আর্য। এক রাশ বিরক্তি ঝরিয়ে বলে , যত্তসব , ভাট বকতে এসেছে ব্যাটারা। আসার আগে বাড়ি থেকে মুখস্ত করে আসা বুলি কপচাচ্ছে। ব্যাটাদের ধরে এনে কিছুদিন করে এই গ্রামে আটকে রাখা হয় তাহলে বুকনি ঝাড়া বেরিয়ে যায়। আরে শৌভিক , তোরা কি এই দম দেওয়া মালগুলো ছাড়া আর কাউকে পাস না ? বুকনি ছাড়ার জন্য কত করে দেয় রে মালগুলোকে ?
শৌভিক বলে , গুরু আমরা আদার ব্যাপারী। জাহাজের খবর কি করে বলি বলো ?
ওই ভাবে হাসি ঠাট্টার মধ্যেই খাওয়া দাওয়া হয়ে যায় আর্যদের। যারা পরিবেশন করছিল প্রিয় তাদের বলে , তিনজনের মতো খাবার স্বাস্থ্যকেন্দ্রে দিয়ে আসতে হবে।
গ্রামবাসীরা জানতে চান -- কেন ?
--- আরে নার্স , অজিতবাবু আর ওই স্বাস্থ্যকর্মী রয়েছেন না।
--- না , ওদের খাবার দেওয়ার দরকার নেই। ওদের জন্যই তো আমাদের দূরাবস্থা।
--- না না , তোমরা ভুল ভাবছ। এই পরিস্থিতির জন্য ওদের কোন ভূমিকাই নেই। তাছাড়া আমাদের আন্দোলনের জন্যই তো ওদের এতক্ষণ আটকে থাকতে হয়েছে। না হলে তো পোলিও খাইয়ে ওরা কখন বাড়ি ফিরে যেতে পারতেন। তাই ওদের অভুক্ত রেখে আমাদের খাওয়াটা অমানবিক।
অগত্যা নিমরাজি হয়ে তিনজনের খাবার স্বাস্থ্যকেন্দ্রে দিয়ে আসে ওরা। সেটা লক্ষ্য করে আর্য এগিয়ে গিয়ে বলে-- আপনাদের এই মানবিকতা আমাদের অভিভূত করেছে। দেখবেন একদিন আপনাদের এই আন্দোলন সফল হবেই। খাওয়া দাওয়া চুকতেই দিনের আলো মরে আসে। সেই সময় সাংবাদিকদের মোবাইলে খবর আসে , গ্রামে আসছেন জেলাশাসক। সেটা শোনার পর সাংবাদিকদের মধ্যে ব্যস্ততা শুরু হয়ে যায়। সেই ব্যস্ততার মাঝেই বিরাট পুলিশ বাহিনী নিয়ে গ্রামে ঢোকে জেলাশাসক জলিল আহমেদের কনভয়। মাচানতলার সামনেই গাড়ি থেকে নেমে গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলেন জেলাশাসক। প্রিয় এগিয়ে গিয়ে তাদের দাবিপত্র তার হাতে তুলে দেয়। জেলাশাসক সেই দাবিপত্রে একটা সই করে দেন। সেটা দেখে প্রিয় আর্যর দিকে তাকায়। আর্য জানে দাবিপত্রে সই করে দেওয়া আর লিখিত প্রতিশ্রুতি দেওয়া এক নয়। কিন্তু
আর বেশি গোঁ ধরে থাকাটাও ঝুঁকির হয়ে যাবে। সে অভিজ্ঞতায় দেখেছে , একটা সময় পর্যন্ত প্রশাসনকে আটকে রাখা যেতে পারে। কিন্তু বেশিক্ষণ গোঁ ধরে থাকাটা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ নয়। জেলাশাসক প্রস্তুতি নিয়েই এসেছেন। এরপর হয়তো লাঠিচার্জ করে নিজেদের কার্যসিদ্ধি করবেন। সেক্ষেত্রে তারা তো সেই লাঠিচার্জের ছবি তুলে খবর করা ছাড়া গ্রামবাসীদের কোন ভাবেই রক্ষা করতে পারবে না। খবর করলে কিছুটা নিন্দামন্দ হবে। কিন্তু লাঠি চালিয়ে কে আর কবে নিন্দামন্দের ধার ধেরেছে। সেটা হলে তো লাঠিচার্জই হত না। একদিনে আন্দোলন অনেকখানিই সফল হয়েছে। খোদ জেলাশাসককেও তো শেষ পর্যন্ত ছুটে আসতে হল গ্রামে। সেই কথা ভেবেই প্রিয়কে ইশারায় সে জেলাশাসকের কথা মেনে নিতে বলে। সেই মতো অন্যান্য গ্রামবাসীদের সঙ্গে আলোচনা করে মাইকে বয়কট প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত ঘোষনা করা হয়। শিশুদের পোলিও খাওয়ানোর জন্য স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আনার অনুরোধও জানানো হয়। সেই ঘোষণা শোনার পর একে একে ছেলেমেয়ে কোলে মায়েদের স্বাস্থ্যকেন্দ্র অভিমুখে আসতে দেখা যায়। তারই মধ্যে একটি শিশুকে কোলে নিয়ে পোলিও খাওয়ান খোদ জেলাশাসক। প্রশাসন এবং গ্রামের লোকেরা হাততালি দিয়ে ওঠেন।
পটাপট ক্যামেরায় সেই ছবি ওঠে। তারপরই একে একে পুলিশ , প্রশাসন এবং সংবাদমাধ্যমের গাড়ি গ্রাম ছাড়তে শুরু করে। পরে যোগাযোগ করার কথা বলে গ্রামবাসীদের কাছে বিদায় নিয়ে গাড়িতে ওঠে আর্যও। গ্রামবাসীরা হাত জোড় করে সবাইকে বিদায় জানায়। মাচানতলায় টিভিতে তখন ভেসে ওঠে বাচ্চা কোলে জেলাশাসকের পোলিও খাওয়ানোর ছবি। শোনা যায় ঘোষিকার গলা --- শেষ পর্যন্ত গ্রামবাসীদের অনমনীয় জেদের কাছে পিছু হঠল প্রশাসন। সাত দিনের মধ্যে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডাক্তার নিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়ে পোলিও খাওয়ালেন জেলাশাসক জলিল আহমেদ। এখন সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ হয় কিনা সেটাই দেখার।
( ক্রমশ )
No comments:
Post a Comment