অন্তরালে
অর্ঘ্য ঘোষ
( ধারাবাহিক উপন্যাস )
খবর শেষ হওয়ার পর টিভি সহ অন্যান্য জিনিসপত্র গোটাতে গোটাতে বেশ খানিকটা রাত হয়ে যায়। সেদিন যেন গল্পই শেষ হতে চায় না। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ধারাবিবরণীর মতো ঘুরে ফিরে কথার পিঠে আসে নানা কথা। আসবে না'ইবা কেন দিনভর যা হলো! তদের নিস্তরঙ্গ গ্রামের ইতিহাসে এমন উত্তেজনাময় ঘটনা ঘটে নি বললেই চলে। সেই সব কথা আলোচনা করতে করতেই সবাই বাড়ির পথ ধরার উপক্রম করতেই ঋজুদারা প্রশ্ন তোলে , যদি সাতদিন পরেও ডাক্তার না আসে তখন কি আবার পোলিও বয়কট করতে হবে নাকি ? কিন্তু পরের পোলিও হতে তো অনেক দেরি ?
প্রশ্নটা প্রিয়র মাথাতেও আসে নি তা নয়। সাতদিন পরেও যদি ডাক্তার না আসে তাহলে মানুষের মনে এই উন্মাদনা আর থাকবে না।মাস তিনেক পরে যখন পোলিও হবে তখন অনেকেই হয়তো ফের পোলিও বয়কটের আন্দোলনে সামিল হতে গাঁইগুই করবে। সেক্ষেত্রে তাদের দোষও দেওয়া যাবে না। আন্দোলন করেও যদি কোন ফল না হয় তাহলে কেন বার বার একই পথে হাঁটবেন গ্রামের মানুষ ? কিন্তু সেই আশঙ্কার কথাটা এখনই সবার সামনে প্রকাশ করতে চায় না প্রিয়।
কারণ যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তারা হতাশ হয়ে মনোবল হারিয়ে ফেলবেন। তাহলেই থমকে যাবে তাদের আন্দোলন। তাই সে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বলে -- এখন থেকেই এ নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করে লাভ নেই। হাতে তো সাতটা দিন সময় আছে। কিছু কাজ না হলে তখন আবার সাংবাদিকদের পরামর্শ মতো এগনো যাবে। কাল থেকে আমি তো এখন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ট্রেনিং নিতে প্রতিদিনই বোলপুর যাব।সময় মতো একদিন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলে নেব।তারপর মিটিং ডেকে তাদের পরামর্শ মতো পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করে নেব।
---- হ্যা -- হ্যা, সেটাই ঠিক হবে , মত প্রকাশ করে সবাই।
সেদিনকার মতো যে যার সবাই বাড়ি ফেরে। প্রিয় বাড়ি ফিরে দেখে আজও মা না খেয়ে তার প্রতীক্ষায় রয়েছেন।নিজেকে খুব অপরাধী বোধ হয় তার।সারাদিন খাটাখাটুনির পর তার জন্যই মা এখনও ঘুমোতে যেতে পারে নি। কতবার মা'কে তার ফিরতে দেরি দেখলে খাবার ঢাকা দিয়ে রেখে খেয়ে শুয়ে পড়তে বলেছে। কিন্তু মা সে কথা কানেই তোলে না। তাকে না খাইয়ে নাকি মায়ের গলা দিয়ে ভাত নামে না।তাই আর কথা না বাড়িয়ে বলে , খুব খিদে পেয়েছে। তাড়াতাড়ি দু'জনের ভাত বাড়। একসঙ্গে বসে খেয়ে নেব।
--- তুই হাত মুখ ধুয়ে আয়। তার মধ্যেই সব হয়ে যাবে।
দ্রুত হাত পা ধুয়ে মায়ের পাশে ভাতের থালা টেনে বসে পড়ে প্রিয়। খেতে খেতে অবধারিত ভাবেই ওঠে পোলিও
বয়কটের প্রসঙ্গ। মা বলেন , তোদের নিয়ে প্রথমদিকে খুব দুঃশ্চিন্তা হচ্ছিল জানিস।তাই সারাদিন শুধু ঘর বার করেছি। তারপর যখন সন্ধ্যার মুখে ডি,এমের প্রতিশ্রুতি দেওয়া কথা শুনলাম তখন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বাঁচলাম।
---- হ্যা আমরাও প্রথমদিকে কিছুটা দুঃশ্চিন্তায় ছিলাম। কিন্তু গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ এগিয়ে আসায় সেই দুঃশ্চিন্তা দূর হয়।
---- সব থেকে বড় কথা কি জানিস , মেয়েরাও তোদের সমর্থন যুগিয়েছে। তারা ছেলেমেয়েদের পোলিও খাওয়াতে চাইলে তোরা আটকাতে পারতিস না। পুকুর ঘাটে গিয়ে শুনে এলাম মহিলারা বিশেষ করে যারা সন্তান হারিয়েছে তারা বলাবলি করছে , দিদি তোমার প্রিয় কাজের কাজ একটা করছে। আরও আগে এটা করার দরকার ছিল। হ্যা রে , এত মায়ের আশা ভরসা , শেষ পর্যন্ত পূরণ করতে পারবি তো তোরা ? ডাক্তার আনতে পারবি তো ?
ততক্ষণে খাওয়া হাত ধোওয়া হয়ে গিয়েছে দুজনের। প্রিয় গিয়ে মায়ের হাতটা নিজের মাথায় রেখে বলে -- তুমি আর্শিবাদ করো মা , আমরা যেন ওইসব মায়েদের আশা ভরসা পূরণ করতে পারি।
---- পারবি রে পারবি। শুধু আমি কেন , আরও কত মায়ের আর্শিবাদ তোদের সঙ্গে আছে তা জানিস। সেই আর্শিবাদ না থাকলে আজকের আন্দোলনও তোদের সার্থক হত না। যা সারাদিন আজ খুব ধকল গিয়েছে , কাল সকালেই আবার বোলপুর ছুটতে হবে , যা এবার গিয়ে শুয়ে পড়।
সত্যিই খুব ক্লান্ত লাগছিল প্রিয়র। শরীর যেন বিছানার দিকে টানছিল। তাই মায়ের কথা মতো শুয়ে পড়ে সে। কিন্তু দীর্ঘক্ষণ ঘুম আসে না। মায়ের কথাগুলো মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে। সত্যিই তো মহিলারা যদি এককাট্টা হয়ে ছেলেমেয়েদের নিয়ে পোলিও খাওয়াতে যেতেন তাহলে তারা আটকাতে পারত না। যেভাবে পুরুষদের তাড়া করে হঠিয়েছে , সেভাবে তারা কিছুতেই মহিলাদের তাড়া করতে পারত না।
সে নিজে তো পারতই না , সেটা কাউকে করতেও দিতে পারত না। মায়ের কথা শুনে সে বুঝতে পারছে মহিলারাও পরোক্ষে তাদের আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছে। কথাটা ভেবে মনের মধ্যে জেদটা আরও বেড়ে যায় প্রিয়র। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে , এর শেষ দেখেই ছাড়বে সে। যে করেই হোক ওইসব মহিলাদের পরোক্ষ সমর্থনের মর্যাদা তাকে রাখতেই হবে। কিন্তু এখন সাতদিন অপেক্ষা করা ছাড়া তো আর কিছু উপায়ও নেই। কাল থেকেই তাকে সুশোভনবাবুর ডায়াগনস্টিক সেন্টারে কাজ শেখার পাশাপাশি টেকনিশিয়ানের কোর্স করার কাজ শুরু করে দিতে হবে। সুশোভনবাবু বলেছেন কোর্সটা হয়ে গেলে তার একটা চাকরির সম্ভবনা আছে। চাকরির কথা মনে পড়তেই চোখের সামনে স্বাতীর মুখটা যেন ভেসে ওঠে।স্বাতীকে ঘিরে একটা মিস্টি স্বপ্নের আবেশ মিশে যায় তার ঘুমে।
পরদিন সকালে চেম্বারে পৌছোতেই রোগী দেখা থামিয়ে তাকে নিয়ে পড়েন সুশোভনবাবু।চেম্বারের বাইরে তখন জনা পাঁচেক রোগী।তাদের মধ্যে দু'জনকে তার মুখ চেনা মনে হয়।তাদের দেখিয়েই সুশোভনবাবু বলেন , আরে এসো এসো। এতক্ষণ এদের সঙ্গে তোমাদের কালকের ব্যাপারটা নিয়েই কথা হচ্ছিল। তুমি তো হিরো হয়ে গেলে হে। টিভিতে টিভিতে তোমার নাম। কাগজেও তো দেখছি ছবি সহ তোমার বক্তব্য ছাপা হয়েছে।
একটানা নিজের প্রশংসা শুনে খুব অস্বস্তি হয় প্রিয়র। সেটা কাটতেই সে -- সবই আপনার জন্য সম্ভব হয়েছে।
---- এই দেখ , আমি আবার কি করলাম। আমি তোমাদের কোন পরামর্শই দিতে পারি নি। সাংবাদিকের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। সেইজন্য তখন তোমাদের আমার উপরে খুব রাগ হয়েছিল। সে আমি তোমাদের মুখ দেখেই বুঝেছিলাম। কিন্তু কেন পরামর্শ দিতে পারি নি সেটা জান ?
---- আমরা পরে সেটা আন্দাজ করেছিলাম।
---- আসলে কি জানো একজন ডাক্তার হিসাবে আমি তোমাদের পোলিও বয়কটের পরামর্শ দিতে পারতাম না। তাই সাংবাদিকের কাছে পাঠিয়েছিলাম। সাংবাদিকদের পরামর্শ মতো তোমাদের আন্দোলন তো এলাকার মানুষের মনে ভালোই রেখাপাত করেছে। সেই কথাই তো এদের সঙ্গে এতক্ষণ হচ্ছিল। এদের চেন তুমি ? তোমাদের এলাকাতেই কুলিয়াড়া , লোকপাড়াতে সব বাড়ি। তুমি এদের সঙ্গে কথা বলে সেন্টারে চলে যেও। আমি রোগী ক'টা দেখে নিই।
সুশোভববাবু চেম্বারের ভিতরে চলে যেতেই সে লোকগুলোর সঙ্গে আলাপ জমানোর চেষ্টা করে। কিছুক্ষণ তাদের মুখের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। লোকগুলোর মুখ চেনা মনে হলেও নামধাম কিছু জানা নেই তার। তাই লোকগুলোর পরিচয় জানতে চায় সে। কিন্তু তারা নিজেদের পরিচয় দেওয়ার পরিবর্তে ঘুরিয়ে তাকেই প্রশ্ন করে , আচ্ছা আপনার নামই কি প্রিয় ?
সে ঘাড় নেড়ে হ্যা বলতেই লোকগুলোর মধ্যে একজন বলে , আমরা সবাই পার্টির লোক। পার্টি অফিসেও কাল বিষয়টি নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। তখনই আপনার নাম শুনি। দলের জেলা নেতা বীরেনদা ছুটে এসেছিলেন সদর থেকে। এম , এল,এ আর প্রসাদ মোড়েলকে সমানে ঝাড়লেন। রীতিমতো দাবড়ে বললেন, কি করেন কি আপনারা ? মানুষের সঙ্গে আপনাদের কোন জনসংযোগই নেই মনে হচ্ছে, লোকে আপনাদের কথার কোন গুরুত্ব না দিয়ে কোথাকার কে প্রিয় না অপ্রিয় তার কথাই উঠবোস করে ? এরপর তো বিরোধীদল ওকে ভোটে প্রার্থী করলে ড্যাংড্যাং করে জিতে যাবে। আর আপনারা আঙুল চুষবেন।আপনাদের উপরে ভরসা করাটাই ভুল হয়েছে।নিজেদের সঙ্গে সঙ্গে পার্টির মুখও পুড়িয়েছেন। যান , গ্রামে গিয়ে যে কোন মূল্যে পরিস্থিতি নিজেদের কন্ট্রোলে আনুন।
লোকগুলোর কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে যায় প্রিয়। ভেবে পায় না বীরেনবাবুই বা কেমন নেতা ? কোথাই নিজেদের ব্যর্থতার দায় স্বীকার স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডাক্তার নিয়োগের ব্যবস্থা করবেন তা নয় , বিরোধীদল তাকে প্রার্থী করলে কি হবে তা নিয়ে ভেবে মরছেন। আচ্ছা এইসব রাজনৈতিক নেতারা রাজনীতি ছাড়া কি আর কিছুই বোঝেন না নাকি ? এরা কবে বুঝবেন মানুষের সুবিধা অসুবিধার কথা যারা ভাবে না , তাদের কথাও মানুষ একসময় ভুলে যায়। বীরেনবাবুর কথা ভেবে তার খুব হাসিও পায়। সে রাজনীতির ধারে পাশে নেই , কোনদিন থাকার ইচ্ছাও নেই। অথচ এরই মধ্যে তাকে নিয়ে কতদুর ভেবে নিয়েছেন উনি। অবশ্য বীরেনবাবুকে খুব একটা দোষ দেওয়া যায় না। এখন তো রাজনীতির জ্ঞান থাক বা না'ই থাক বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিচিতি অথবা টাকা পয়সা রয়েছে এমন লোকেদের ভোটে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়।
আর বছরের পর বছর যারা দলের জন্য জানপ্রাণ লড়িয়ে দেন তারা বীরেনবাবুর কথা মতো আঙুল চোষেন। সে যে যা করবে করুক গে , তা নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই প্রিয়র। তার দুঃশ্চিন্তা হয় ওদের পরিস্থিতি কন্ট্রোলের কথা শুনে। কি করতে চায় ওরা ? সেই আভাস পাওয়ার জন্য সে খুব কায়দা করে লোকগুলোকে প্রশ্ন করে , আচ্ছা আমাদের এই আন্দোলন নিয়ে আপনাদের এলাকার লোকজনের কি প্রতিক্রিয়া ?
--- দেখুন বেশিরভাগ লোকই আপনাদের আন্দোলন মনে মনে সমর্থন করেন। কিন্তু বোঝেনই তো সব, পার্টির ভয়ে সরাসরি কেউ আপনাদের আন্দোলনে সামিল হতে পারবে না। তারপর পার্টি অফিসে কাল যা হোল , তারপর তো কেউ আর মৌখিক সমর্থনের সাহস ও পাবে না।
--- কেন, তারপর আবার কি হোল পার্টি অফিসে ?
---- বীরেনদা চলে যাওয়ার পর এম,এল,এ আর প্রসাদ মোড়ল রাগ সামলাতে না পেরে সবার সামনেই বলে ফেললেন , যে শালারা আমাদের মুখ পোড়াল সে শালাদের তো ভাতে মারব , পালের গোদাটাকে হাতে-ভাতে দুদিকেই মারব।শালাটাই তো সাংবাদিকদের ডেকে এনে কান্ডটা করল। শালার নেতা হওয়ার শখ ঘুচিয়ে দেব।
তারপরই লোকগুলো চুপ করে যায়। কথাটা শুনে দুশ্চিন্তার ছায়া ঘনিয়ে আসে প্রিয়র মনে। সেই সময় সুশোভনবাবু দেখার জন্য তাদের ডেকে নেন।
যাওয়ার আগে সেই লোকটা বলে যান , দেখেন ভাই কথাটা পাঁচকান করবেন না। বোঝেনই তো ছেলেপুলে নিয়ে সংসার করি। উড়ো আগুনে ঘর পুড়লে আফশোসের শেষ থাকবে না। তাকে আশ্বস্ত করে সুশোভনবাবুর কাছে বিদায় নিয়ে সে সেন্টারে প্রশিক্ষণ নিতে চলে যায়। প্রশিক্ষণ চলাকালীন তারা মাথা থেকে লোকগুলোর কথা বেরিয়ে যায়। কিন্তু প্রশিক্ষণ শেষে সেন্টার থেকে বেরোতেই চিন্তাটা ফের মনের মধ্যে ফিরে আসে। সন্ধ্যের মুখে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মন নিয়ে বাড়ি ফেরে সে।
No comments:
Post a Comment