Short story, Features story,Novel,Poems,Pictures and social activities in Bengali language presented by Arghya Ghosh

অন্তরালে -- ১২


    
  অন্তরালে 


            অর্ঘ্য ঘোষ 


( ধারাবাহিক উপন্যাস ) 



কিন্তু কাউকে কিছু আভাস পেতে দেয় না। বিশেষ করে বাবা-মা'কে কোন ক্রমেই জানতে দিয়ে চাই না সে।  তাহলে দুশ্চিন্তায় রাতে ঘুমোতে পারবেন না তারা। কিন্তু মায়ের কাছে সে লুকোতে পারে না। মায়ের চোখে তার চোখ মুখের দুশ্চিন্তার ছাপ ধরা পড়ে যায়। রাতে খেতে বসে মা বলে -- কি ব্যাপার রে প্রিয় ? বোলপুর থেকে ফেরার পর তোকে কেমন যেন অন্যমনস্ক লাগছে ?
মনে মনে এই আশঙ্কাটাই করছিল প্রিয়। ছোট থেকেই সে মায়ের কাছে কিছুই  লুকিয়ে রাখতে পারে না। মা ঠিক ধরে ফেলেন। তাই আর কিছু লুকানোর চেষ্টাই করে না। সেই প্রয়োজনও হয় না। বরং মা'কে বলে সে বেশির সময় দিগদর্শন পেয়েছে।  কিন্তু এই বিষয়টা বললে মায়ের দুশ্চিন্তাই বাড়বে। তাই সে বলে, কই কিছু না তো।
---- কেন মিথ্যা লুকানোর চেষ্টা করছিস বাবা ? তার চেয়ে খুলে বল আমাকে  ,  দু'জনে মিলে আলোচনা করলে তো সমস্যার সমাধানও হতে পারে। 
অগত্যা মাকে সব খুলে বলে প্রিয়। শোনার পর মা বলেন , শোন কথায় আছে রাখে হরি মারে কে ? হাতেই বল আর ভাতেই বল , মারতে একমাত্র ঠাকুর পারেন। আর যারা অন্যের ভালোর জন্য লড়াই করে ঠাকুর স্বয়ং দু'হাত  দিয়ে তাদের আগলে রাখেন। ভাতের যোগানও তিনিই দেন। প্রসাদ মোড়লের মতো একটা দুর্নীতিবাজ মানুষের সাধ্য কি তোদের অনিষ্ট করে ?  আর যদি করেও জানবি সেটা সাময়িক।
মায়ের কথা শুনে খুব ভালো লাগে তার। মনে শক্তি ফিরে পায়। সে মাকে দু'হাতে তুলে ধরে পাকে পাকে ঘুরতে ঘুরতে বলে --- মা , সোনা মা আমার। তুমি দুশ্চিন্তা করবে বলেই কিছু বলি নি।
---- দূর বোকা ছেলে। আমি মা , তুই না বললেও আমি যদি না বুঝতে পারি তাহলে আমি কিসের মা ? 
মায়ের সেই আশ্বাসে তখনকার মতো প্রিয়র দুশ্চিন্তা দূর হয়ে যায়। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই ফের দুঃশ্চিন্তায় পড়তে হয় তাকে। ততদিনে শুরু হয়ে যায় ভাতে মারার প্রক্রিয়া। গ্রামবাসীদের মধ্যে ফাটল ধরানোর জন্য সেদিন যারা বাড়িতে ডাকতে যাওয়া স্বত্ত্বেও ছেলেমেয়েদের নিয়ে পোলিও খাওয়াতে আসেনি তাদের নানা ভাবে  হেনস্থা করতে শুরু করে প্রসাদ মোড়লরা। আর তাদের আজ্ঞাবহদের ঢালাও সরকারি সাহায্য দেওয়া শুরু হয়ে যায়। ওদের আক্রোশের প্রথম শিকার হয় ভানুমতি দাস। প্রসাদ মোড়লরা সেদিন ভানুমতীর নাতিকে পোলিও খাওয়ানোর জন্য বাড়িতে বলতে গিয়েছিল। ভানুমতী হাত জোড় করে বলেছিল ,  দোহাই তোমাদের কিছু মনে কোর না। গোটা গ্রামের লোক যেখানে পোলিও খাওয়াতে যাচ্ছে না সেখানে আমিই বা যায় কি করে বলো ? 
ওই কথা শোনার পরেও আরো কয়েকবার প্রসাদ মোড়লরা বলে কয়ে বোঝানোর চেষ্টা করে। কিন্তু ভানুমতীকে টলানো যায় নি। শেষে রেগে মেগে প্রসাদ মোড়ল শাসিয়ে যায় , বেশ থাকো তাহলে গ্রামের লোকেদের নিয়ে।  কেমন থাকতে পারো দেখি। তারপরই দেখা যায় অন্যান্য সবার পাশ বইয়ে বার্ধক্য ভাতার টাকা পৌঁছোলেও ভানুমতির পৌঁছোয় না। খুব বিপাকে পড়ে যায় ভানুমতী। ভানুমতীর হাঁফের টান। নিয়মিত ওষুধ খেতে হয়।  তার ছেলে লক্ষণ দিনমজুরী করে। তাতে সংসারেরই সবদিক সংকুলান হয় না। ভানুমতীর বার্ধক্য ভাতার টাকাটুকু দিয়েই ওষুধ কেনা এবং সংসারে জোড়াতালি দিতে কাজ চলে। তাই ছেলেকে নিয়ে তিনি ছুটে যান পঞ্চায়েতে। 



                     অফিসে ঢোকার মুখেই দেখা হয়ে যায় প্রসাদ আর সুরেন মোড়লের সঙ্গে। তাদেরই সমস্যার কথা জানান ভানুমতী। সবটুকু শোনার আগেই প্রসাদ বলে ওঠে , এখন আমাদের কাছে এসেছো কেন ? যাও তোমার সেই গ্রামের লোকের কাছে।
ব্যাপারটা কি ঘটছে এবারে আর আন্দাজ করতে অসুবিধা হয় না ভানুমতীর। কিন্তু প্রসাদ মোড়লকে সেটা বুঝতে না দিয়ে ভানুমতী বলে , বাবা তোমরাই গরীবের মা-বাপ। তোমাদের কাছে যাব না তো কার কাছে যাব ? লক্ষ্মীবাবা আমার টাকাটার ব্যবস্থা করে দাও। হাঁফের ওষুধ ফুরিয়েছে। ওষুধ না হলে যে রাতে ঘুমোতে পারব না। সারা রাত হাঁফিয়ে মরতে হবে। 
বলেই  প্রসাদ মোড়লের হাত জড়িয়ে ধরে ভানুমতী। প্রসাদ মোড়ল হাত ছাড়িয়ে দিয়ে দাঁত মুখ খিচিয়ে বলে , তোমাদের মতো ছোটলোকদের কি বাপমায়ের ঠিক থাকে ? এখন তো তোমাদের অনেক বাবা-মা। যাও সেইসব বাবা-মাকে গিয়ে বলো। আমাকে জ্বালিও না তো আর। 
প্রধানকে জানিয়েও যে কিছু লাভ হবে না তা ভালোই বুঝতে পারে ভানুমতী। তবুও এসেছিই যখন একবার দেখা করেই যায় , এই মনোভাব থেকে দোতলায় প্রধান সাবিরুদ্দিন মোল্লার সঙ্গে দেখা করেন। কিন্তু প্রধানও সমস্যার কথা শোনার আগে সাফ জানিয়ে দেন , ওই ব্যাপারে আমাদের কিছু করার বা বলার নেই। যা  বলার বি,ডি,ও অফিসই বলতে পারবে।  সমস্যার কথা শোনার আগেই প্রধানের সমাধান বাতলে দেওয়ার ওই তৎপড়তা দেখেই ঘোঁটটা যে পঞ্চায়েতই পাকিয়েছে তা ভানুমতীর মতো নামসাক্ষর জ্ঞান সম্পন্ন বিধবারও বুঝতে অসুবিধা হয় না। তাই আর কিছু না বলে হতাশ হয়ে বাড়ি ফেরেন তিনি। সেদিন সন্ধ্যায় টেনিং সেরে বোলপুর থেকে ফিরে মাচানতলায় পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে বৈঠকে বসেছিল প্রিয়রা। সেই সময় ছেলেকে নিয়ে ভানুমতী সেখানে গিয়ে সমস্যার কথাটা খুলে বলেন তাদের। সেই কথা শুনে সুশোভনবাবুর চেম্বারে শোনা সেই লোকগুলোর কথা মনে পড়ে যায় প্রিয়র। সে বুঝতে পারে প্রসাদকাকারা ভাতে মারার প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছেন। পরদিন ভানুমতীকে নিয়ে প্রিয়রা বি,ডি,ও অফিসে পৌঁছোয়। সবকিছু শোনার পর বি,ডি,ও মহঃ নাকি বলেন , এব্যাপারে ব্লক অফিসের তো কিছু করণীয় নেই। পঞ্চায়েতের পাঠানো উপভোক্তার জীবিত থাকার রিপোর্টের ভিত্তিতেই ওই ভাতা পাঠানো হয়। কিন্তু পঞ্চায়েত ভানুমতীর মৃত্যু হয়েছে বলে রিপোর্ট পাঠিয়েছে। তাই ভাতা পাঠানো বন্ধ হয়ে গিয়েছে। 
প্রিয় জানতে চায় -- তাহলে কি হবে স্যার ? 
---- এই মুহুর্তে কিছু করার নেই। উপরমহলেও ওই রিপোর্ট পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাই খুব সহজে আর ওই ভাতা চালু করা সম্ভব নয়। সরকারি রিপোর্টে একটা মানুষকে যত সহজে মেরে ফেলা যায় , তাকে বাঁচানোটা তত সহজ কাজ নয়।
--- তাহলে যাদের গাফিলতিতে  এমনটা ঘটল তাদের বিরুদ্ধে কেন কোন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না ? 
---- দরখাস্ত দিয়ে যান , তদন্ত করে গাফিলতি প্রমাণ হলে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হবে।


                       বাঁধা গতে কথাটা বলেই কাজের অজুহাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন বি,ডি,ও। প্রিয় জানে কোন লাভ হবে না , তবু মন বোঝাতে একটা দরখাস্ত লিখে জমা দিয়ে বেরিয়ে আসে বি,ডি,ও অফিস। বাইরে আসতেই ভানুমতী প্রিয়র হাত ধরে বলে -- হা,  বাবা কি হবে এবার ? ওই প্রশ্নের মুখে অসহায় হয়ে পড়ে প্রিয়। তার সেই সামর্থ্য নেই , নাহলে যতদিন ভাতা চালু না হয় ততদিন সে সাহায্যের চেষ্টা করত। তাই সে বৃদ্ধার হাত দুটো ধরে বলে -- অত চিন্তা কোর না জ্যেঠি। আমরা তো সবাই আছি। ব্যবস্থা একটা কিছু হয়ে যাবে। সন্ধ্যেবেলায় মাচানতলায় এসো। সবার সঙ্গে আলোচনা করে দেখি কি করা যায় দেখি। সেই মর্মে ঋজুদাদের সন্ধ্যাবেলায় মাচানতলায় সবাইকে আসতে বলে। তারপর তাদের  গ্রামে পাঠিয়ে দিয়ে প্রশিক্ষণ নিতে বোলপুরে অভিমুখে রওনা দেয় প্রিয়। কিন্তু কিছুতেই প্রশিক্ষণে মন বসাতে পারে না।কেবলই মনে হয় আন্দোলনটা করতে গিয়েই সে ভানুমতীজ্যেঠিকে কঠিন সমস্যার মধ্যে ফেলে দিল। না জানি আরও কতজনকে ওইভাবে সবক শেখাবেন প্রসাদকাকারা। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয় তার। যে করেই হোক ভানুমতীজ্যেঠিদের পাশে দাঁড়াতেই হবে। কিন্তু সেটা কি ভাবে সম্ভব ? মনে মনে সেই উপায়ের কথা ভাবতে গিয়েইএকের পর এক  ভুলভাল করে বসে সে। সেটা লক্ষ্য করে টেকনিশিয়ান আভাসদা বলেন , কি ব্যাপার বলো তো , আজ কি হয়েছে তোমার ? 
--- গ্রামে একটা সমস্যা হয়েছে আভাসদা। সমস্যাটা নিয়ে একবার আর্যদার সঙ্গে আলোচনা করতে হত। আজ আমাকে একটু ছুটি দেবে ?
ঘটনার গুরুত্ব অনুধাবন করে আভাসদা বলেন -- হ্যা হ্যা নিশ্চয়ই। বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে কাজে মনও বসবে না। যাও তুমি।  
ছুটি নিয়ে আর্যর বাড়িতে যায় প্রিয়। সব কথা শোনার পর আর্য বলে , আচ্ছা নোংরামি শুরু করেছে তো এরা। আমি ডি,এম সাহেবের সঙ্গে কথা বলব। প্রেস কাউন্সিলেও জানাচ্ছি। দেখি একটা খবরও করা যায় কিনা। তবে খবর করে বিশেষ লাভ বলে মনে হয় না। বর্তমানে শাসকদল এবং প্রশাসনের চামড়া গন্ডারকেও হার মানায়।
---- তাহলে উপায় ?
--- আচ্ছা ওই বৃদ্ধা মাসে কত করে যেন ভাতা পেতেন ? 
--- পাঁচশ টাকা করে।
কথাটা শুনেই ভিতর ঘরে গিয়ে ৫ টা একশ টাকার নোট প্রিয়র সামনে এগিয়ে ধরে আর্য। 
অবাক হয়ে তার মুখের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে প্রিয়। সেটা লক্ষ্য করে আর্য বলে -- এটা ওই বৃদ্ধাকে দিয়ে দেবেন। আপতত একমাস তো চলে যাবে। তারমধ্যেই একটা কিছু ব্যবস্থা হয়ে যাবে আশাকরি।
তীব্র আপত্তি জানিয়ে প্রিয় বলে -- না , না আপনি কেন দেবেন ? আমরা যারা আন্দোলন করছি তারাই যে করে হোক কিছু একটা ব্যবস্থা করব।
--- আমি বুঝি আপনাদের আন্দোলনের বাইরে ? আমিই তো আপনাদের এই আন্দোলন করতে পরামর্শ দিয়েছিলাম। তাই খারাপ কিছু হলে তার দায় তো সর্বাগ্রে আমার উপরেই বর্তায়। নিন ধরুন , আর আপত্তি করবেন না। বলেই প্রিয়র হাতে নোটগুলো ঢুকিয়ে দিয়ে মুঠো বন্ধ করে দেয় আর্য। আর অভিভূত হয়ে কথা হারিয়ে ফেলে প্রিয়। সে শুনেছিল সাংবাদিকরা নাকি খবর করা এমন কি ঘটনাস্থলে যাওয়ার জন্য  টাকা দাবি করে।কিন্তু এ কেমন সাংবাদিক ?  আজকের এই মহানুভবতার কথা সে জীবনে ভুলতে পারবে না। সুদিন এলে টাকাটা ফিরিয়ে দেবে আর্যদাকে ।টাকাটা পেয়ে মনটা ভালো হয়ে যায় তার। আসার সময় সে ভানুমতী জ্যেঠির অসহায় মুখ দেখে কিছু একটা করার আশ্বাস দিয়ে এসেছিল। কিন্তু কি করবে তা ভেবে উঠতে পারছিল না। সেই দুঃশ্চিন্তাটা দূর হয়ে গেল। কতক্ষণে টাকাটা সে ভানুমতীজ্যেঠির হাতে তুলে দিয়ে মুখে হাসি ফেরাবে সেই আনন্দে আর্যদার কাছে বিদায় নিয়ে উৎফুল্ল মন নিয়ে বাড়ি ফেরে সে। কিন্তু মাচানতলায় পৌঁছোতেই ফের বিষণ্ণতায় ভরে যায় তার মন।


         ( ক্রমশ ) 



       নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 


শীঘ্রই দেশ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হতে চলেছে আমার তৃতীয় উপন্যাস ------
  
                                  


                       ----০---

No comments:

Post a Comment