অন্তরালে
অর্ঘ্য ঘোষ
( ধারাবাহিক উপন্যাস )
আর্যদার দেওয়া টাকাটা ভানুমতীজ্যেঠির হাতে তুলে দেবে বলে সে দ্রুত মাচানতলায় পৌঁছোয়। সেখানে তখন অনেক লোক। ছেলেকে নিয়ে হাজির হয়েছেন ভানুমতীজ্যেঠিও। টাকাটা দেওয়ার জন্য পকেটে হাত ঢোকাতে যাবে এমন সময় মাচানতলায় এসে পৌঁছোন সুরোপিসি। তার গলায় আক্ষেপের সুর -- দেখ দেখি বাপু , আমি বিধবা মানুষ। কারও
সাতেপাঁচে নেই।আমার সঙ্গে এমন করার কি মানে ? তোমরা এখানে পাঁচজন আছো , তোমরাই এর একটা বিহিত কর।
সুরোপিসির কথা শুনে সবাই তার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। সুরোপিসি বিধবা মানুষ। পরের বাড়িতে মুড়ি ভেজে, ধান সিদ্ধ করে একমাত্র ছেলে মানিককে মানুষ করেছেন। কিন্তু ছেলের সংসারে ঠাঁই হয় নি তার। স্ত্রী ছেলেমেয়ে নিয়ে তার আলাদা সংসার। তাই দুঃখ ঘোচে নি সুরোপিসির। এই বয়সেও পেটের দায়ে তাকে সেই পরের বাড়িতেই মুড়ি ভাজতে কিম্বা ধান সিদ্ধ করতে হয়। কিন্তু তাতেও পেট ভরে না। এখন অনেকেই বাড়িতে মুড়ি ভাজার পাট তুলে দিয়েছেন। গ্রামে গ্রামে মুড়ির ভাজার মেশিন বসেছে।লোকে সেইমেশিনে মুড়ি ভেজে কিম্বা বাজার থেকে ওজন দরে মুড়ি কিনে নেন।ধান সিদ্ধ করে চাল তৈরির পরিবর্তে দোকান থেকে কিনে নেওয়ার চল শুরু হয়েছে। অথচ এক সময় ওই কাজ করেই ছেলেমেয়েদের মানুষ করেছেন সহায় সম্বলহীন কত বাল্য বিধবা। কিন্তু এখন জীবিকা হারিয়ে বিপন্ন হয়ে পড়েছেন তারা। সু
রোপিসির অবস্থা আরও শোচনীয়। সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরনোর হাল হলেও বি,পি,এল তালিকায় তার নাম ওঠেনি। তাই তার বিধবা কিম্বা বার্ধক্য ভাতাও জোটে নি। শাসক দলের নেতাদের হাতে পায়ে ধরে একটা সরকারি ত্রানের ব্যবস্থা হয়েছিল। পঞ্চায়েতের শ্লিপ নিয়ে রেশন দোকানে দিলেই মাসে বিনামুল্যে ১২ কে,জি করে গম কিম্বা চাল মিলত। কিন্তু গতকাল সেই শ্লিপ আনতে গিয়ে খালি হাতে ফিরে আসতে হয়েছে তাকে। প্রধান সাফ জানিয়ে দিয়েছেন তোমার নাতি পোলিও খেতে আসে নি , তাই পার্টি নির্দেশ দিয়েছে আর তোমাকে শ্লিপ দেওয়া হবে না।
ছেলে-বৌমায়ের সঙ্গে তেমন সম্পর্কই নেই সুরোপিসির। তাই নাতির পোলিও খাওয়া-না খাওয়া তার উপরে নির্ভরই করে না। সুরোপিসি সেই কথা বললেও প্রধান তা কানেই তোলেন নি। বরং কার্যত গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া হয়েছে। সেই কথা বলতে বলতেই কেঁদে ফেলেন সুরোপিসি। প্রিয়র নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয়। তাদের আন্দোলনের জেরে এভাবে হতদরিদ্র মানুষগুলোকে রাজনৈতিক আক্রোশের মুখে পড়তে হবে তা সে ভাবতে পারে নি। সে সুরোপিসিকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে , ভেব না পিসি আমরা সবাই তোমার পাশে আছি। আমরা যদি এক বেলা খেতে পাই , তাহলে তুমিও পাবে।বাকিরাও প্রিয়কে সমর্থন জানিয়ে বলেন , হ্যা পিসি তুমি ভেব না। আমরা দুঃখের ভাত সুখের করে খাব দেখ তুমি।
প্রশান্ত কাকা বলেন , এ ব্যাপারে আমার একটা প্রস্তাব আছে। তোমরা যদি শুনতে চাও তাহলে বলতে পারি।
সবাই সমস্বরে বলেন ---- বলুন কি প্রস্তাব ?
প্রশান্তকাকা বলতে শুরু করেন , গ্রামে আমরা ৩৫ টি পরিবার বাস করি। তার মধ্যে ধরে নিলাম , প্রসাদদের সঙ্গে রয়েছে পাঁচটি পরিবার। বাকি তিরিশটি পরিবারে দুবেলা দুমুঠো রান্না হয়। আর প্রতিটি পরিবারের হাড়িতেই কম-বেশি ভাত তরকারি উদ্বৃত্ত হয়। যতদিন বিকল্প কিছু না হয় ততদিন যদি তাতেই আমরা একদিন করে সুরোদিদির খাওয়ার দায়িত্ব নিই তাহলে কেমন হয় ?
কথাটা শোনার পরই সবাই বলে , হ্যা হ্যা এটা তো হতেই পারে।
ওই কথা শুনে সুরোপিসি কেঁদে ফেলেন। কান্না জড়ানো গলায় বলেন , নিজের বলোকের বাড়িতে ভাত জোটে নি।তোমরা আমার জন্য যেভাবে ভেবেছ তা তো কেউ এতদিন ভাবে নি। ভাবলে পোড়া পেটের জন্য এভাবে ছুটে আসতে হত না।
প্রস্তাবটা প্রিয়রও খুব মনে ধরে । সে জানে এভাবে বেশিদিন চালানো যাবে না। কিন্তু সামান্য কয়েকদিনও যদি চালানো যায় তাহলে মানুষ ভরসা পাবে , গ্রামের লোক পাশে রয়েছে ভেবে মনোবলও ফিরে পাবে। বাড়ি বাড়ি খাওয়া দাওয়ার সুবাদে একটা একাত্মতা বোধও গড়ে উঠবে।সুরোপিসির কান্নার রেশ মেলাতে না মেলাতেই মাচানতলায় ছুটে আসেন জীতেন কাকা।
তার গলাতেও অনুযোগের সুর শোনা যায়।জীতেনকাকা দিনমজুরী করে খান। কিছুদিন আগে পঞ্চায়েত জাতীয় কর্মসংস্থান সুনিশ্চিতকরণ প্রকল্পে গ্রামে পুকুর কাটার কাজ করায়।অন্যান্যদের সঙ্গে জীতেনকাকাও সেখানে সাত দিন কাজ করেছিলেন। ওই প্রকল্পে কাজের পরিমাপ অনুযায়ী পারিশ্রমিক দেওয়ার নিয়ম হলেও রাজনৈতিক স্বার্থে এতদিন হাজিরা অনুযায়ী দৈনিক দেড়শো টাকা হারে বেতন দেওয়া হত। সেইমতো অন্যান্য মজুরদের পাশ বইয়ে টাকা ঢুকলেও দেখা যায় জীতেনকাকার পাশবইয়ে অর্ধেকেরও কম টাকা ঢুকেছে। তাই খুব দুশ্চিন্তায় পড়েন তিনি। অনেক সময় ভুলক্রমেও এমন ঘটনা ঘটে। পঞ্চায়েতে জানানোর পর ফের সমহারে টাকা পাঠিয়ে দেওয়া হয় পাশ বইয়ে। সে রকমই একটা কিছু হয়েছে ভেবে ভুল সংশোধনের জন্য পঞ্চায়েতে ছুটে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাকেও গলা ধাক্কা খেয়ে আসতে হয়েছে। কথাগুলো বলেই রীতিমতো ফুঁসে ওঠেন জীতেনকাকা -- প্রসাদ মোড়লই নাটের গুরু। ব্যাটা বলল তুই যতটুকু কাজ করেছিস ততটুকু টাকা দেওয়া হয়েছে।
---- আপনি কি বললেন ?
----- আমি বললাম , সবাই যতদিন কাজ করেছে , আমিও ততদিন করেছি। তাহলে সবার সমান টাকা পেলাম না কেন ? তা জবাবে কি বলল জান ?
---- কি বলল ?
---- বলল সেদিন যখন তোকে মেয়েটাকে নিয়ে পোলিও খাওয়ানোর জন্য ডাকতে যাওয়া হয়েছিল তখন আমাদের কথা কানে নিয়েছিলি ?
--- তারপর ?
--- আমি বললাম সে তো অনেকেই যায় নি। তাহলে শুধু আমার বেলাতেই কেন টাকা কাটা হবে ? শুনে শয়তানটা সাফ জানিয়ে দিল , আমরা ভালো বলে তাই এবার টাকা পেলি। এরপর আর তোকে কাজেই নেওয়া হবে না। কি বিপদ বলো তো ? আমি গরিব মানুষ , আর আমার উপরেই যত তাল! কাজ না পেলে আমার চলবে কি করে ?
জীতেন কাকার প্রশ্নের মুখে খুব অসহায় বোধ করে প্রিয়। সে জানে , ওই প্রকল্পে প্রতিটি মজুর পরিবারকে বছরে একশো দিন কাজ দেওয়ার কথা সরকারের। সে তো অনেক কিছুই করার কথা সরকারের। স্বাস্থ্য পরিষেবা নিশ্চিত করারও কথা। সেটা হলে তো আজ এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হত না। আসলে প্রশাসন ভালো কিছু করতে পারুক বা না'ই পারুক , চাইলে খারাপ অনেক কিছু করতে পারে। সেটাকে হাতিয়ার করেই এই ভাবে তাদের আন্দোলন রুখতে গ্রামবাসীদের মধ্যে ফাটল ধরাতে প্রসাদকাকারানোংরামি শুরু করেছে। সেদিন তো সবাই পোলিও বয়কটে সামিল হয়েছিলেন , সবাইকে একসঙ্গে ওইভাবে দেখে নিতে চাইলে যে হিতে বিপরীত হতে পারে , মানুষ গণবিক্ষোভে ফেটে পড়তে পারে তা রাজনীতির কারবারি প্রসাদকাকা ভালোই জানেন। তাই সবার মনোবলে চিড় ধরানোর উদ্দেশ্যে বেছে বেছে দু'চারজনকে ওইভাবে সমঝে দেওয়া শুরু করেছে তারা।
প্রসাদকাকাদের চক্রান্ত যে করেই হোক রুখতেই হবে , মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে প্রিয়। কিন্তু তার একার প্রতিজ্ঞাতে তো কিছু হবে না। সবাই এককাট্টা হলে তবেই তারা প্রসাদকাকাদের চক্রান্ত রুখতে পারবে। তাই গ্রামবাসীদের মনোভাব জানাটাও জরুরী। সে উপস্থিত গ্রামবাসীদেরমতামত যাচাইয়ের উদ্দেশ্যে বলে -- তাহলে আমরা এখন কি করব ? আমাদের মধ্যে ফাটল ধরানোর জন্য প্রসাদকাকারা যে ভাবে নোংরামি শুরু করেছে তাতে আমার মনে হয় এই মুহুর্তে আমাদের নিজেদের অবস্থানটা স্পষ্ট হয়ে যাওয়া দরকার।তার প্রশ্নে কিছুটা গুঞ্জন শোনা যায়। কয়েকজনের মধ্যে দোটানা ভাবও লক্ষ্য করে প্রিয়। কিন্তু সেটা কাটিয়ে উঠতেও দেরি হয় না। প্রশান্তকাকাই দৃপ্ত গলায় বলেন , আমরা
যদি সবাই এক থাকি তাহলে ওরা কতজনকে দেখে নেবে দেখুক না ?
---- আজ ভানুমতীজ্যেঠি , সুরোপিসি এবং জীতেন কাকার পেটে লাথি মেরেছে। কাল যদি আরও কারো পেটে লাথি মারে তাহলে কি করব ?
--- আমরা সামর্থ্য মতো তাদের পাশে দাঁড়াব -- সমবেত ভাবে বলে সবাই।
কথাটা শুনে মনে খুব জোর পায় প্রিয়। এই সহমর্মিতা বোধ থাকলে প্রসাদকাকাদের চক্রান্ত রুখে দেওয়া অসম্ভব হবে না। সবাই পাশে থাকলে মনোবলও অটুট থাকবে। কিন্তু প্রসাদকাকারা যদি এভাবে একের পর এক অন্যান্যদের পেটে লাথি মারতে শুরু করে তাহলে তারা ক'জনের পাশে দাঁড়াতে পারবে ? সেই সামর্থ্য কোথাই তাদের ? সম্বল বলতে তো আর্যদার দেওয়া ওই পাঁচশো টাকা আর যদি গ্রাম কমিটির দু হাজার টাকা থেকে খরচখর্চার পর কিছু বেঁচে থাকে তো সেটা।
সেটা জানার জন্যই ঋজুদাকে সে জিজ্ঞেস করে -- গ্রাম কমিটির টাকা কি কিছু বেঁচেছে ?
---- পাঁচশো টাকা মতো আছে। হিসাবটা কি এখনই বলে দেব ?
---- না না, হিসাবটা পরে দিলেও হবে। টাকাটা যদি এনে থাকো তো দাও।
---- হ্যা হ্যা, সঙ্গেই আছে।
ঋজু টাকাটা তার হাতে তুলে দিতেই প্রিয় পকেট থেকে আর্যদার টাকাটাও বের করে। তারপর সবাইকে বলে , ভানুমতীজ্যেঠির ব্যাপারটা আমি আর্যদাকে বলেছিলাম। শুনেই উনি জ্যেঠিকে দেওয়ার জন্য পাঁচশো টাকা দিয়েছেন। আমাদের হাতে এখন এক হাজার টাকা রয়েছে। আমরা কি টাকাটা ৩ জনকে ভাগ করে দিতে পারি না ?
তার প্রস্তাবে সবাই সম্মতি জানায়।অসম্মতি প্রকাশ করেন খোদ জীতেনকাকা। তিনি বলেন , টাকাটা সুরোদিদি ভানুদিদিকেই দেওয়া হোক। আমি তো খেটে খেতে পারি। আপাতত আমার চলে যাবে। তোমরা যে পাশে রয়েছো সেটা জানার পর বুকে বল পেলাম। সমস্যায় পড়লে্তরখন তোমরা তো রয়েছোই।
জীতেনকাকার উদারতায় সবাই অভিভূত হয়ে যায়। তার মতো দিন এনে দিন খাওয়া মজুরেরপক্ষে এই প্রলোভন জয় করা কম কথা নয়। প্রিয় তাই টাকাটা তার হাতে তুলে দিয়ে বলে , গ্রামবাসীদের পক্ষ থেকে আপনিই টাকাটা ওদের হাতে তুলে দিন। প্রিয়র কথা শুনে যেন অবরুদ্ধ যায় জীতেনকাকার গলা।
No comments:
Post a Comment