Short story, Features story,Novel,Poems,Pictures and social activities in Bengali language presented by Arghya Ghosh

অন্তরালে -- ১৪



    অন্তরালে 


         অর্ঘ্য ঘোষ  



( ধারাবাহিক উপন্যাস ) 




তিনি ভেবে পান না এরা বলছে কি ? গ্রামের সভা সমাবেশে হোমরা- চোমরা লোকেদেরই কাউকে কিছু তুলে দিতে দেখেছে সে। তার তো হাত আর পা , খাট আর খা। একটা মুনিস বই তো নয়। তাকে দিয়েই এরা টাকা তুলে দিতে চাইছে ? ততক্ষণে প্রিয় টাকাটা দু'ভাগ করে জীতেনকাকার হাতে তুলে দিয়েছে। সুরোপিসি আর ভানুমতিজ্যেঠিকে সামনে ডেকেও নেওয়া হয়েছে। সঞ্চালকের মতো প্রিয় ঘোষণা করে , এবারে আপনাদের সামনে আমাদেরই দুই নিকটজনের হাতে কিছু করে অর্থ তুলে দিচ্ছেন আমাদের আর এক প্রিয়জন জীতেনকাকা। ঘোষণা শেষে কাঁপা কাঁপা হাতে দু'জনের হাতে টাকাটা তুলে দেন জীতেনকাকা। সবাই হাততালি দিয়ে ওঠেন। দাতা - গ্রহীতা উভয়পক্ষের চোখ আনন্দাশ্রুতে ভরে ওঠে।টাকা দেওয়ার পর্বটা চুকতেই সুরোপিসি সহ বেশ কয়েকজন বাড়ি ফিরে যান। প্রিয়রা পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা শুরু করে। প্রথমেই যে সমস্যাটা প্রিয়দের সামনে মাথা চাড়া দেয় সেটা হলো অর্থ। খুব তাড়াতাড়ি কিছু অর্থের সংস্থান করা দরকার। প্রসাদকাকারা সুরোপিসিদের মতো যদি আরও কাউকে বিপাকে ফেলে তাহলে তার পাশে দাঁড়ানোর জন্য তো হাতে কিছু টাকা থাকা প্রয়োজন। সেই কথা উপস্থিত গ্রামবাসীদের সামনে তুলে ধরে প্রিয়। তার কথা শুনে সবাই বলেন , হ্যা প্রসাদ মোড়ল এইটুকুতেই থেমে যাবে বলে মনে হয় না। ফের কারও পেটে ঠিক লাথি মারবে।সেক্ষেত্রে পাশে দাঁড়ানোর জন্য টাকা তো লাগবেই।কিন্তু কি করে টাকার সংস্থান হবে তা কেউ বলতে পারেন না। তারই মধ্যে প্রশান্তকাকাই অর্থ সংস্থানের একটা পথ দেখান। তিনি বলেন , আমাদের  গ্রাম কমিটির টাকা বছরের পর বছর ধরে প্রসাদ মোড়লের কাছে জমা আছে। ও নিজের ইচ্ছে মতো খরচ করে আমাদের মন গড়া একটা হিসাব দেখিয়ে দেয়। আর আমাদের মেনেও নিতে হয়। প্রসাদ মোড়ল তো এখন আর গ্রামের উন্নয়ন চান না। বরং গ্রামের মানুষকে বিভিন্ন ভাবে বিপাকে ফেলতে উঠে পড়ে লেগেছে। তাই আমার মনে হয় গ্রামের মানুষের টাকা আর ওর কাছে রাখা উচিত নয়। তাকে আর গ্রাম কমিটির সম্পাদকের পদে রাখাটাও কাম্য নয়। কমিটি ভেঙে দিয়ে আজই নতুন গ্রাম কমিটি গড়ে ওর কাছে থেকে  হিসাব সহ সব টাকা হস্তান্তর করে নেওয়া উচিত বলে আমার মনে হয়। তাহলে অর্থের কিছুটা সুরাহা হতে পারে।প্রশান্ত কাকার কথাটা প্রিয়র যুক্তিযুক্ত মনে হয়। অন্যান্যরাও সমর্থন করেন ওই প্রস্তাব। নতুন কমিটি গড়ার জন্য সেই রাতেই ঋজু আর রাজুকে দিয়ে প্রসাদ মোড়ল আর তার চেলা সুরেন মোড়লকে ডাকতে পাঠানো হয়। কিন্তু ঋজুদের কথা শুনে প্রসাদ মোড়ল তাচ্ছিল্যের সুরে বলে ,  যখন যার ইচ্ছে মিটিং ডাকলেই আমাকে সেখানে যেতে হবে তার কিছু মানে আছে নাকি ?
শেষ চেষ্টা হিসাবে তবু ঋজু বলে , মাচানতলায় গ্রামের সবাই আছেন।সবারই প্রস্তাব মেনেই আপনাকে মিটিংয়ে যাওয়ার জন্য ডাকতে আসা হয়েছে।
এবারে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে প্রসাদ মোড়ল বলে , যাও যাও , তোমরা মিটিং করছো করে গে। কি হোল না হোল জানিয়ে যেও। ইচ্ছা হলে মানব , না হলে মানব না।
প্রসাদ মোড়লের সুরে সুর মিলিয়ে প্রায় একই কথা বলে তার চেলা সুরেন মোড়লও। 


                           ঋজুদের মুখে সেই কথা শুনে ক্ষোভে ফেটে পড়েন গ্রামের মানুষ। এতদিন সরাসরি প্রসাদ মোড়লের বিরুদ্ধে কথা বলছিলেন প্রশান্তকাকা। আজ প্রসাদ মোড়লের ওই ধরণের অবজ্ঞার কথা শুনে বাকিরাও মুখ খুলতে শুরু করেন। তারই মধ্যে সদানন্দ মন্ডলের গলাই বেশি শোনা যায়। তিনি বলেন , বেশ ওর যদি আমাদের ডাকে আসতে এতই অপত্তি থাকে তাহলে ওকে বাদ দিয়েই নতুন কমিটি করে ওকে জানিয়ে দেওয়া হোক। সেই কমিটির হাতেই খুব তাড়াতাড়ি ওকে হিসাব সহ টাকা বুঝিয়ে দিতে হবে। তারপর নতুন কমিটি মিটিং ডেকে তা আমাদের বুঝিয়ে দেবে।
সবাই বলে -- হ্যা হ্যা , সেটাই করা হোক। ওকে বুঝিয়ে দেওয়া উচিত কারও জন্য কিছু আটকে থাকে না।
প্রিয় চেয়েছিল কমিটি যাদের নিয়েই গড়া হোক না কেন , তা অন্তত প্রসাদকাকাদের উপস্থিতিতেই হোক। তাই সে পরে একটা দিন ঠিক করার কথা তুলেছিল। কিন্তু প্রসাদকাকার তাচ্ছিল্যের কথা শুনে গ্রামের লোক এতই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল যে প্রিয়র সেই কথা কেউ কানেই তুলতে চায় নি। অগ্যতা গ্রামের লোকের মতেই মত দিতে হয় তাকে। সেই মতো 'জীবন সুরক্ষা ' কমিটি নামে নয় সদস্যের একটি কমিটি গড়া হয়। সর্বসম্মতি ক্রমে প্রশান্ত কাকাকে সেই কমিটির সভাপতি করা হয়। সম্পাদক হিসাবে গ্রামবাসীরা প্রিয়র নাম প্রস্তাব করেন। প্রিয় তীব্র আপত্তি জানিয়ে বলে -- না -- না , আমি কেন ? কমিটিতে আমার থেকে আরও বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য রয়েছেন। তাদের কাউকেই সম্পাদক করা হোক। আমি একজন সাধারণ সদস্য হিসাবেই থাকতে চাই।
তার কথা কেউ মানতেই চান না। সবাই একযোগে বলে ওঠেন , তুমি থাকতে চাও না বললে তো হবে না, আমরা যা চাইব তাই তোমাকে মানতে হবে। তুমিই এই আন্দোলনের হোতা। তাই তোমাকেই সম্পাদকের দায়িত্ব নিতে হবে। এবারে আর না করতে পারে না প্রিয়। সবার আবদার তাকে মানতেই হয়। কোষাধ্যক্ষ হিসাবে যৌথভাবে ঋজু এবং রাজুর নাম প্রস্তাব করেন প্রশান্তকাকা।  সবাই বলেন , সেটাই ভাল হবে। এই আন্দোলনের শুরু থেকেই  হিসাব রাখার কাজ করেছে ওরা। তাই ওরাই কাজটা করুক।রাতেই সবকিছু লেখাজোখা হয়ে  যায়। ঠিক হয় রাতেই প্রসাদ মোড়লের বাড়িতে গিয়ে তাদের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেওয়া হবে। সেই রাতে আর প্রসাদকাকাকে বিরক্ত করতে মন চাইছিল না প্রিয়র। তাই সে কিছুটা দোনামোনা  করছিল। কিন্তু বাকিরা সবাই সেই রাতেই একটা হেস্তনেস্ত করতে এককাট্টা হয়ে ওঠেন। অগত্যা সবার কথা মেনে সেই রাতেই প্রসাদকাকার বাড়ি পৌঁছোয় তারা। ঋজুর ডাকে দরজা খুলেই একসঙ্গে অতগুলো লোককে দেখে যেন কিছুটা হকচকিয়ে যান প্রসাদ মোড়ল। তার মুখের ভাবই বলে দিচ্ছিল তাদের দেখে ভয় পেয়েছেন। কিন্তু রাজনীতি করা ঘাগু লোক , তাই দ্রুত সেটা মুছে ফেলে বলেন ---  কি এমন জরুরী দরকার পড়ল যে দলবল নিয়ে রাতেই বিরক্ত করতে আসতে হল ? সবারই কি ঘরসংসার নেই  নাকি ? 
কথাটা গাম্ভীর্যের সঙ্গে বলে সবাইকে দপকে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নিজের গলার স্বরই নিজের কাছে কেমন যেন মিনিমিনে শোনায় প্রসাদ মোড়লের। সেই সময়ই তার মুখের উপর প্রশান্তকাকা বলে দেন --  তোমার চিন্তা নেই প্রসাদ। আর রাতের পর রাত তোমাকে গ্রামের বিষয় নিয়ে বিরক্ত হতে হবে না। সেই সুসংবাদটা দেওয়ার জন্যই শেষবারের মতো তোমাকে বিরক্ত করতে এলাম। আমরা আজ পুরনো কমিটি ভেঙে দিয়ে ' জীবন সুরক্ষা ' নাম দিয়ে নতুন একটা কমিটি করেছি। তোমার মত ব্যস্ত মানুষকে সেই কমিটি থেকে অব্যহতি দেওয়া হয়েছে। তাই তোমার কাছে জমা থাকা টাকা হিসাব সহ ৭ দিনের মধ্যে নতুন কমিটির হাতে তুলে দেওয়ার জন্যই বলতে আসতে হল। না হলে আসতাম না। আর হ্যা ,  আমাদেরও ঘর সংসার আছে।



                         ওই কথা শুনে প্রসাদ মোড়লের গলায় যেটুকু তেজ ছিল তা'ও উবে যায়।তবুও দাঁত মুখ খিচিয়েই বলে --- মামার বাড়ির আবদার আর কি ? বললেই যেন ওদের হাতে ভুতের বাবার শ্রাদ্ধ করার জন্য টাকাগুলো তুলে দিতে হবে। টাকাগুলো হাতানোর জন্য অমনি নিজেদের মনোমত কমিটি গড়ে নিলেই হয়ে গেল ? তোমাদের ওই 'জীবন সুরক্ষা' না টুরক্ষা কমিটি আমি মানি না।
এবারে মুখ খুলতে হয় প্রিয়কে। সে শান্ত অথচ দৃঢ় স্বরে বলে , মানি না বললে তো চলবে না প্রসাদকাকা। গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ একসঙ্গে থেকেই কমিটি গড়া হয়েছে।  আপনাকেও ডেকে পাঠানো হয়েছিল। আপনি তাচ্ছিল্য করে যান নি। গেলে হয়তো আপনিও কমিটিতে থাকতেন। এখন টাকা দেব না বললে তো হবে না। টাকাটা তো আপনার ব্যক্তিগত নয় , গ্রামের লোকের। তাই গ্রামের বেশিরভাগ লোক  যদি তাদের টাকায় ভুতের বাবার শ্রাদ্ধ করতে চায় তো আপনি আমি একা তো না বলতে পারি না।  
প্রিয়র কথা শুনে কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন প্রসাদ মোড়ল। তিনি যেন ভাবতেও পারেন না যে গ্রামে তার মুখের উপর কারও কথা বলার সাহস ছিল না , সেই গ্রামেই সেদিনের সেই ছেলেটা গোটা গ্রামের লোকের সামনে তাকে সরাসরি ওইভাবে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেবে !  প্রসাদকাকার মুখটা কেমন যেন ভাবলেশহীন মনে হয় প্রিয়র।



       ( ক্রমশ )





       নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 


শীঘ্রই দেশ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হতে চলেছে আমার তৃতীয় উপন্যাস ------
  
                                  


                       ----০---

No comments:

Post a Comment