Short story, Features story,Novel,Poems,Pictures and social activities in Bengali language presented by Arghya Ghosh

অন্তরালে -- ১৫



   
    
   অন্তরালে 


       অর্ঘ্য ঘোষ 



( ধারাবাহিক উপন্যাস ) 




কিন্তু প্রসাদকাকার মতো মানুষেরা সহজে হাল ছাড়ার পাত্র নন।দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় থাকতে থাকতে ক্ষমতায় থাকাটা তাদের একটা নেশা হয়ে দাঁড়ায়। সব জায়গায় দাদাগিরি করতে না পারলে যেন তাদের ঘুম হয় না।তাই ক্ষমতা হারাতে হলে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। প্রসাদকাকার মধ্যেও সেই লক্ষণ দেখা যায়। দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বলে ওঠেন , মরবি মরবি তোরা নির্ঘাত মরবি। সেই একটা কথা আছে জানিস তো , "পিপিলিকার পাখা হয় মরিবার তরে।" তোদেরও সেই পাখা গজিয়েছে।
প্রসাদকাকার চোখ মুখের ভঙ্গিই বলে দিচ্ছিল এবার তিনি মরণ কামড় দেবেন। কিন্তু সেটা যে এত তাড়াতাড়ি শুরু করবেন তা ভাবতে পারে নি প্রিয়। সেদিন খুব ভোর ভোর সে বোলপুরের উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিল।ট্রেনিং শেষে আর্যদার সঙ্গে দেখা করাটা খুব জরুরী ছিল।গ্রামের সামগ্রিক পরিস্থিতির পাশাপাশি আন্দোলনের পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে তার সঙ্গে আলোচনা করা দরকার।সেই জন্য সকাল সকাল ট্টেনিং শেষ করে সে আর্যর বাড়ি পৌঁছোয়।তা কে দেখেই আর্যদা বলেন , আসুন আসুন , আপনার কথাই ভাবছিলাম।ওই বিধবার খবরটা আজ কাগজে বেরিয়েছে। আপনাকে দেওয়ার জন্য কয়েক কপি কাগজ নিয়ে রেখেছি।বলে সেদিনের কয়েকখানা কাগজ এনে তার হাতে তুলে  দেন। প্রিয় দ্রুত খবরটায় চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলে -- ক'জন ভানুমতীর খবর করবেন ? 
--- মানে ? আবার কিছু হয়েছে নাকি ? 
---- আবার দু'জন ওদের আক্রোশের শিকার হয়েছে।
তারপর সে সুরোপিসি আর জীতেনকাকার কথা আর্যকে বলে।শোনার পর আর্য বলে , এরা তো আচ্ছা গ্রাম্য রাজনীতি শুরু করে দিল।এতে তো গ্রামের মানুষের মনোবল ভেঙে যাবে। কি বলছেন সবাই ? 
--- এখনও পর্যন্ত সবাই এক জোট আছেন। ওই ঘটনার পর আমরা গ্রাম কমিটি ভেঙে দিয়ে ' জীবন সুরক্ষা ' কমিটি নামে একটা কমিটি গড়েছি। 
-- এটা খুব ভালো কাজ হয়েছে।কমিটির নামটাও সুন্দর হয়েছে।ওই কমিটির ব্যানারে আন্দোলনটা অর্থবহ হয়ে উঠবে।
--- আমরা ঠিক করেছি গ্রাম কমিটির টাকা দিয়ে আন্দোলনের পাশাপাশি যারা শাসকদলের আক্রোশের শিকার হবে তাদের পাশে দাঁড়াব। আপাতত আপনার দেওয়া ৫০০ টাকা আর গ্রাম কমিটির ৫০০ টাকা বিধবা দুজনকে দিয়েছি। আমরা তিনজনকেই ভাগ করে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু জীতেনকাকা ভাগ না নিয়ে ওদের দুজনের হাতে তুলে দিয়েছেন।
--- বাহঃ একজন দিনমজুরের এই ত্যাগ সত্যিই শ্রদ্ধার যোগ্য। অর্থশালী মানুষের এদের দেখে শেখা উচিত। 
--- কিন্তু এরপর আমরা কি করব ? কালই তো ডি , এমের দেওয়া প্রতিশ্রুতির ৭ দিন পূর্ণ হতে চলেছে। কিন্তু ডাক্তার নিয়োগের কোন ব্যবস্থা হল না।তাই গ্রামের লোকেরা আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে তা আপনার কাছে জেনে যেতে বলেছেন।
--- আপনারা কি কিছু ভেবেছেন ? 
---- না, সে রকম কিছু ভাবা হয় নি। তবে সেদিন টিভিতে সেই আইনজীবির কথা শুনে আমার একটা ভাবনা মাথায় এসেছে।
---- কি ভাবনা ? 
---- আইনজীবি সেদিন বলেছিলেন মানুষ স্বেচ্ছায় সরকারি পরিষেবা নিতে অস্বীকার করতেই পারেন। কাউকে পরিষেবা নিতে বাধা না দিলে প্রশাসনের কিছু বলার নেই। তাই আমি ঠিক করেছি পোলিও বয়কটের মতোই একের পর এক সরকারি পরিষেবা বয়কটের মাধ্যমেই আন্দোলন জিইয়ে রাখব।
--- খুব ভালো ভাবনা। কিন্তু কি করবেন কিছু ভেবেছেন ? 
--- আপাতত আমরা সরকারি শিক্ষা বয়কটের চেষ্টা করব। সেটা আমাদের পক্ষে করা সহজ হবে। আমাদের গ্রামে তো প্রাইমারি স্কুল রয়েছে। সেখানে আমাদের গ্রামের ছেলেমেয়েরাই শুধু পড়ে। সেখানে প্রসাদকাকাদের মতো আন্দোলন বিরোধী কোন পরিবারের ছেলেমেয়েও পড়ে না। তাই বিরোধীরা নিজেদের ছেলেমেয়ে পাঠিয়ে শিক্ষা বয়কট ব্যর্থ করতেও পারবে না।
---- কিন্তু দিনের পর দিন স্কুলে না গেলে তো ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার ক্ষতি হবে। তারপর মিড-ডে- মিল থেকেও তারা বঞ্চিত হবে। একবেলা খাওয়াটাও তো অনেক পরিবারের কাছে যথেষ্ট দামি। 
---- তার জন্য আমি ঠিক করেছি যতদিন আমাদের আন্দোলন চলবে ততদিন আমরা গ্রামে যারা শিক্ষিত বেকার আছি তারাই স্বেচ্ছাশ্রমে মাচানতলায় সমান্তরাল ভাবে স্কুল চালাব। বাড়ি বাড়ি চাল-ডাল তুলে মিড-ডে মিলেরও ব্যবস্থা করব। এতে আমাদের এক ঢিলে দুই পাখি মারা হবে। 
---- মানে ? 
---- এখন প্রাইমারি স্কুলের পড়াশোনা আর খাওয়ার মান নিয়ে নানা ক্ষোভ রয়েছে। আমরা যদি তুলনামূলক বিচারে দুটি ক্ষেত্রে ভালো কাজ করতে পারি তাহলে শিক্ষকরা চাপে পড়ে যাবেন। তখন আমাদের অনুসরণ করে তারাও ভালো করার চেষ্টা করবেন। সেক্ষেত্রে যদি তারা আমাদের সহযোগিতা চান তাহলে আমরাও হাত বাড়িয়ে দেব। তাহলে আর ক্ষোভ-বিক্ষোভ থাকবে না।পরিবেশটাই পাল্টে যাবে। 



                    প্রিয়র কথা শুনে মুগ্ধ হয়ে যায় আর্য। সে বলে , বাহ , সত্যিই খুব ইতিবাচক ভাবনা।  আমিও এমন করে ভাবতে পারতাম না। দেখছেন পরিস্থিতিই মানুষের মধ্যে নেতৃত্বগুণ আর চিন্তা চেতনার বিকাশ ঘটায়। কাল থেকেই আপনারা ওই কর্মসূচি শুরু করে দিন। আমি স্কুল বোর্ডের চেয়ারম্যানকে আপনাদের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেব। আর আমরাও ঠিক সময়ে হাজির হয়ে যাব। তবে আমাদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে না। আমরা খাওয়া-দাওয়া করেই যাব।
আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর খবরের কাগজটা নিয়ে উৎফুল্ল মনে গ্রামে ফেরে প্রিয়। শিক্ষা বয়কটের কর্মসূচি চূড়ান্ত করার জন্য সে সরাসরি মাচানতলায় যায়। কিন্তু সেখানে পৌঁছেই সবার মুখ দেখে তার উৎফুল্লতা হারিয়ে যায়। মাচানতলায় তখন অনেকেই হাজির রয়েছেন। কিন্তু সবাই যেন কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন। সে প্রশান্তকাকাকেই জিজ্ঞেস করে --- কি হয়েছে ? আপনাদের মুখ চোখের অবস্থা এমন কেন ?
--- আজ ভোরবেলায় ঋজুদের পুকুরের মাছ মরে ভেসে ওঠে। পুকুরপাড়ে পাওয়া যায় একটা বিষের শিশি।ব্যাপারটা কি ঘটেছে বুঝতে অসুবিধা হয় না প্রিয়র। ফের নিজেকে বড়ো অপরাধী মনে হয় তার। সে'ই তো আন্দোলন করার কথা বলেছিল। তার কথা শুনেই তো আজ সবার এই অবস্থা। দুরে ঋজু বিষন্ন মুখে বসেছিল। সে কাছে গিয়ে পিঠে হাত রেখে বলে -- খুব খারাপ লাগছে। আমার জন্যই এমনটা হল।
--- আরে না-না , এরজন্য তুই কি কববি।ও ঠিক আছে। কেবল বোনের বিয়ের জন্য রাখা বড় বড় মাছগুলো মরে গেল বলেই খারাপ লাগছে। সামনের মাসেই বোনটার বিয়ে।
প্রশান্তকাকা বলেন -- চিন্তা করিস না। তেমন হলে গ্রাম কমিটির যে পুকুরে মাছ চাষ হয় সেখান থেকেই তোর বোনের বিয়ের মাছ দেওয়া হবে।
কথাটা শুনে ঋজুর মুখের বিষন্নতা কেটে যায় , জেগে ওঠে প্রত্যয়। সে বলে -- তাহলে খুব ভালো হয়। তার জন্য অবশ্য আমি সময় সুযোগ মতো দাম দিয়ে দেব।
সবাই বলে , সে যখন সুদিন আসবে তখন দিলেই হবে। গ্রামের ভালোর জন্য তোমাদের এই অবস্থা হল , আর আমরা সবাই থাকতে তোমার বোনের বিয়ে আটকে যাবে তাই হয় কখনও ?
গ্রামের লোকের মুখে এই সহমর্মিতার কথা শুনে অভিভূত হয়ে যায় প্রিয়। এভাবেই যদি সবাই মন থেকে একে অন্যের পাশে থাকার আশ্বাস দিতে পারে তাহলে অনেক দুশ্চিন্তা দূর হয়ে যাবে। হয়তো সব ক্ষেত্রে সাহায্যের দরকারও হবে না , এই সহমর্মিতাটাই অনেককে নিজের প্রয়োজন নিজেই মিটিয়ে নিতে উদ্বুদ্ধ করবে। তাই এই সহমর্মিতা বোধটাকে বড়ো দামি মনে হয় প্রিয়র।
সেইসময় জীতেনকাকা প্রিয়কে জিজ্ঞেস করে -- আচ্ছা , থানায় একটা অভিযোগ জানিয়ে রাখলে হত না? 
--- কোন লাভ হবে না। পুলিশ প্রথমেই কাউকে সন্দেহ হয় কিনা  জানতে চাইবে। যে এই কাজটা করেছে বলে সন্দেহ করছি তার নাম বললে তো অভিযোগই নেবে না। মাঝখান থেকে থানায় ছোটাছুটি আর হয়রানিটাই সার হবে। 
প্রশান্তকাকা বলেন , প্রিয় ঠিকই বলেছে। আমারও তাই মনে হয়। তবে আমাদের তক্কে তক্কে থাকতে হবে। ওদের হাত পুকুরে বিষ দিয়েই থামবে না। আমাদের হাতেনাতে ধরার চেষ্টা করতে হবে।



              সেইমতো ঠিক হয় গোপনে প্রসাদ মোড়লদের গতিবিধির উপর পালাক্রমে নজরদারি চালানো হবে। ততক্ষণে কাগজে ভানুমতিজ্যেঠির খবরটা অনেকেরই পড়া হয়ে গিয়েছে। প্রশান্তকাকা বলেন , জব্বর লিখেছে খবর খানা। নেতা আর প্রশাসনের যাকে বলে একেবারে নাকে ঝামা ঘষে দিয়েছে। তা হ্যারে , উনি আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে কিছু বলেছেন ? 
সঙ্গে সঙ্গে প্রশান্তকাকার প্রশ্নের কোন জবাব দিতে পারে না প্রিয়। অথচ কথাটা বলার জন্যই সে বাড়ি না গিয়ে সরাসরি এখানে চলে এসেছিল। কিন্তু পরিস্থিতি তাকে ভাবিয়ে তোলে। কি করে সে ফের আন্দোলনের কথা বলবে ? যদি এভাবে একের পর এক প্রসাদ মোড়লদের আক্রোশের খাড়া নেমে আসে অন্যান্যদের ঘাড়েও ? তাকে চুপ করে থাকতে দেখে প্রশান্তকাকা বলেন -- ঋজুদের পুকুরে বিষ দেওয়ার কথা শুনে তুই কি ভয় পেয়ে পিছিয়ে যেতে চাইছিস ? 
--- ভয় আমি পাচ্ছি ঠিকই , তবে সেটা নিজের জন্য নয়। আন্দোলন করতে গিয়ে যদি আবার কেউ আক্রোশের মুখে পড়ে তাহলে আমরা কি করে  আন্দোলন ধরে রাখব সেটাই ভেবে পাচ্ছি না।
---- সে তো আক্রোশের শিকার যে কেউ হতেই পারে। কিন্তু ভানুমতিদিদি, সুরো , জীতেন যদি সব তুড়ি দিয়ে উড়িয়ে দিতে পারে তাহলে আমরাই বা পারব না কেন ?
প্রশান্তকাকার মুখে ভানুমতীজ্যেঠিদের কথা শুনে চমকিত হয়ে যায় প্রিয়। সে ভাবে ক্ষেত্রবিশেষে কত ছোট ছোট উদাহরণ কত বড়  অনুপ্রেরণা হয়ে যায়। সেও অনুপ্রাণিত হয়ে , পরবর্তী পরিকল্পনার কথা খুলে বলে সবাইকে।



    ( ক্রমশ ) 

        

       নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 


শীঘ্রই দেশ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হতে চলেছে আমার তৃতীয় উপন্যাস ------
  
                                  


                       ----০---


No comments:

Post a Comment