Short story, Features story,Novel,Poems,Pictures and social activities in Bengali language presented by Arghya Ghosh

অন্তরালে -- ১৬





 অন্তরালে 


      অর্ঘ্য ঘোষ 



( ধারাবাহিক উপন্যাস ) 



তার কথা শুনে উছ্বসিত হয়ে ওঠেন গ্রামবাসীরা। শঙ্করকাকা , অশ্বিনী মাস্টার আর রাজুদার মধ্যে সব থেকে বেশি উৎসাহ দেখা যায়।  তিনজনেই ভালো ছাত্র ছিল। কিন্তু খুঁটির জোরের অভাবে কোন চাকরি পায় নি।শুধু টিউশানি করেন। গ্রামের সব ছেলেমেয়েই তাদের কাছে টিউশানি পড়ে। তাদের পড়ানোর সুনামও রয়েছে। তারাই জানায় তিরিশ জন ছেলেমেয়ে স্কুলে যায়। সবাই তাদেরই কাছে টিউশানি পড়ে। সরকারি শিক্ষা বয়কটের কথা শুনে তারা তো পড়ানোর জন্য এক পায়ে খাড়া। তিনজনের মধ্যে সব থেকে প্রবীণ অশ্বিনী দও। দুই প্রজন্মকে টিউশানি পড়িয়েছেন তিনি। লোকে বলে, ছোট ছেলেমেয়ে মানুষ করতে অশ্বিনী মাস্টারের জুড়ি মেলা ভার। সেই অশ্বিনী মাস্টারের গলায় ঝড়ে পড়ে উচ্ছাস। আবেগ মিশ্রিত গলায় বলেন , টিউশানি পড়াতে পড়াতেই চুলে পাক ধরে গেল। সরকারি স্কুলে শিক্ষকতা করার খুব ইচ্ছে ছিল। সেটা তো আর এ জীবনে হলো না।  'জীবন সুরক্ষা' কমিটির স্কুলে পড়িয়ে তবু মনটা বুঝবে। শঙ্করকাকা আর রাজুদা বলে , আমরা মাচানতলায় পড়ালে একটা ছেলেমেয়েও আর স্কুলে যেতে চাইবে না। সেক্ষেত্রে পোলিও বয়কটের মতো কাউকে আর আটকা আটকি করতে হবে না। সবাই বলে , একেবারে খাঁটি কথা। জোর করে বেশিদিন কাউকে কোন কিছুতেই আটকে রাখা যায় না। তাতে নিজেদের মধ্যেই বিভেদ সৃষ্টি হতে বাধ্য। প্রিয়ও সেটা উপলব্ধি করে। সেই জন্যই তো সে ভেবে ভেবে শিক্ষা বয়কটের ব্যাপারটা ঠিক করেছে। সেই মতো রাতের মধ্যেই তারা সমস্ত কর্মপদ্ধতি ঠিক করে নেয়। অশ্বিনীকাকা বলেন , পড়ানোর জন্য আরও দু'জন শিক্ষক দরকার। 
ঋজু আর প্রিয়কে সেই দায়িত্ব নিতে হয়। প্রিয়র এখন টেনিংএর খুব চাপ চলছে। ক'দিন এভাবে স্কুল চলবে তার ঠিক নেই। কিন্তু বৃহত্তর স্বার্থের কথা ভেবে বিশেষ করে যেখানে সবাই তার সব কথাকে মান্যতা  দিচ্ছে সেখানে সে ট্রেনিং--এর কথা ভেবে দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারে না। যে ক'দিন তাদের স্কুল চালাতে হবে সে ক'টা দিন সে ট্রেনিং থেকে ছুটি নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।  প্রশান্তকাকা মিড-ডে - মিল পরিচালনার ভার নিজের কাঁধে তুলে নেন। সেই সময় ভানুমতীজ্যেঠি আর সুরোপিসিরা বলেন , রান্নার দায়িত্বটা যদি আমাদের দেওয়া হয় তাহলে খুব ভালো লাগবে। মনে হবে আমরাও এই কর্মযজ্ঞে জড়িয়ে আছি।
প্রিয় বলে - এ তো খুব ভালো কথা। এতদিন মহিলারা আমাদের পরোক্ষে সমর্থন যোগালেও সরাসরি কেউ এগিয়ে আসে নি। তোমাদের দেখাদেখি অন্যরাও এগিয়ে আসতে উৎসাহিত হবে। 
ঠিক হয় মিড-ডে-মিলের জন্য সকালবেলায় জীতেনকাকাকে নিয়ে বাড়ি বাড়ি চাল-ডাল-সবজি তুলবে প্রশান্তকাকারা। আর স্কুলের দিকটা দেখবে প্রিয়রা। পোলিও বয়কটের মতোই লিখে ফেলা হয় সরকারি শিক্ষা বয়কট সংক্রান্ত কিছু পোস্টার। সবদিক সামলে সবাই যখন বাড়ি ফেরে তখন খাওয়ার সময় পেরিয়ে গিয়েছে। তবু খাওয়া হয় নি হরপার্ব্বতীর। স্বামীকে খাইয়ে দিয়ে ছেলের প্রতীক্ষায় বসেছিলেন তিনি। প্রিয় ঘরে পা রাখতেই বলেন , গ্রামে ফিরেছিস সেই খবরটা দিবি তো। আমি চরম দুঃশ্চিন্তায় পড়েছিলাম। যা সব শুরু হয়েছে , কখন কি হয় কে জানে ? আজ  পুকুরে বিষ দিয়ে মাছ মেরে দিচ্ছে ,কাল না জানি আর কার কি ক্ষতি করবে ? 
প্রিয় এগিয়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে বলে , ওঃ মা , তুমি আবার আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা শুরু করলে ? সেদিন বললাম না, তোমার আর্শিবাদ আমার মাথায় আছে ,  কেউ কিছু করতে পারবে না।
 --- মায়ের মন , ছেলে ঘরে ফেরা পর্যন্ত উতলা হয়ে থাকে , কিছুতেই শান্তি পায় না। তোর দেরি দেখে কতবার যে ঘরবার করেছি তার ঠিক নেই। শেষে খবর পেলাম তোরা মাচানতলায় মিটিং করছিস। তারপরই তোর বাবা খেয়ে শুতে গেল। যা বাবা , রাত হয়ে গিয়েছে অনেক, হাত মুখ ধুয়ে খেতে আয়। আমি ভাত বাড়ছি।



                            হাত মুখ ধুয়ে এসে মায়ের মুখোমুখি খেতে বসে প্রিয়। খেতে খেতে মাকে সে তাদের শিক্ষা বয়কট কর্মসূচীর কথা বলে। শুনে খুব উৎসাহিত হয়ে ওঠেন মা। ছেলেকে বলেন -- হ্যা রে , আমিও যদি তোদের ওই কর্মযজ্ঞে সামিল হই কেমন হয় ? ধর যদি সুরোবালাদের সঙ্গে আমিও মিড-ডে-মিল রান্নার কাজে হাত লাগায় ?
--- খুব ভালো হবে। তুমি যাবে মা ? 
--- দেখ আমি না গেলেও তোদের কাজ আটকে থাকবে না আমি জানি।কিন্তু গেলে তোদের কাজের অনেক সুবিধা হবে। সুরোবালাদের অংশগ্রহণের অন্য একটা মানে করবে মানুষ। মনে হবে যে ওরা সাহায্য পেয়েছে বলেই রান্না করে দিয়ে সেই ঋণ শোধ করতে চাইছে। কিন্তু আমি যোগ দিলে সেই ধারণাটা পাল্টে যাবে। তখন দেখবি আরও অনেকে তোদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। তাতে তোদের পরবর্তী আন্দোলন করাটা অনেকটাই সহজ হবে। 
প্রিয় এতক্ষণ আশ্চর্য হয়ে মায়ের কথা শুনছিল। মায়ের চিন্তাভাবনা কত সুদুর প্রসারী।   সত্যিই মা তাদের সঙ্গে যোগ দিলে ঋজুদা, রাজুদার মা , প্রশান্তকাকার স্ত্রী অতসীকাকীর মতো অনেকেই হয়তো এগিয়ে আসবেন।তাদের আন্দোলনটা তখন সর্বাত্মক হয়ে উঠবে। মা--বাবারা সাধারনত এই ধরনের ঝামেলা  ঝঞ্ঝাটের কাজ থেকে নিজের ছেলেমেয়ের দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করেন। তার মা ব্যতিক্রম। বিছানায় শুয়েও কিছুতেই ঘুম আসে না প্রিয়র। কত কি দুশ্চিন্তা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে। মা'কে আশ্বস্ত করতে কেউ কিছু করতে পারবে না বললেও আশঙ্কা একেবারেই উড়িয়ে দিতে পারে না। বিশেষ করে তাদের কোনও ভাবে ভাতে মারার চেষ্টা হলে কি করে সামাল দেবে তা ভেবে পায় না প্রিয়। ওই তো বিঘে খানেক জমির ফসলের উপর নির্ভর করেই চলে তাদের পেট। আগে তবু চেম্বারে রোগীর নাম লেখার জন্য কিছু টাকা পেত। এখন আন্দোলন আর টেনিং এর চাপে ডাক্তারবাবুর চেম্বারে যেতে পারে না। অন্য চেম্বারের ছেলেটিকে নিয়ে কাজ চালাতে হচ্ছে সুশোভনবাবুকে। প্রিয় জানে , সে ডাক্তারবাবুর সঙ্গে দেখা করতে গেলেই তিনি কিছু টাকা তার হাতে তুলে দেবেন। কিন্তু কোন কাজ না করে সে টাকা নিতে চায় না। তাই ডাক্তারবাবুর সঙ্গে সে দেখা করতেও যেতে পারে না। প্রসাদকাকারাও তাদের কোন ক্ষতি করলে সে কিছুতেই কমিটির সাহায্য নিতে পারবে না। কি করবে তাহলে সে ? কোন উত্তর খুঁজে পায় না প্রিয়।



                       একসময় ঘুমিয়ে পড়ে সে। সকাল হতেই প্রশান্তকাকারা চাল তুলতে চলে আসে। মা তাদের চাল - ডাল - সবজি আর ১০টাকা দেয়। প্রশান্তকাকাদের সঙ্গেই বেরিয়ে যেতে হয় প্রিয়কে।  গ্রামের অন্যান্য পাড়া ঘুরে তারা সব শেষে মোড়ল পাড়া পৌঁছোয়। সেখানে পৌঁছোতেই  সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি শুরু করেন। ওই পাড়াতেই প্রসাদ মোড়ল , সুরেন মোড়ল সহ তাদের অনুগামীদের বাড়ি। জীতেন জিজ্ঞাসা করে -- ওদের বাড়ি যাওয়া কি উচিত হবে ?
প্রশান্তকাকা বলেন , যাওয়ার কোন মানে হয় না। শুধু শুধু গাল বাড়িয়ে চড় খেতে হবে। প্রিয়রও তাই মনে হয়। বাকিরাও একই মত পোষণ করেন। তাই ওই পাঁচ বাড়ি বাদ দিয়ে তারা চাল-ডাল তুলতে শুরু করে। তারা ওইসব বাড়ি না গেলে কি হবে ? অন্যান্য বাড়িতে তাদের চাল ডাল তোলা দেখে ওইসব বাড়ি থেকে উঁকিঝুঁকি শুরু হয়ে যায়। কিন্তু প্রিয়রা কোন দিকে ভ্রুক্ষেপ করে না। চাল তোলা শেষ করে তারা যখন মাচানতলায় পৌঁছোয় তখন স্কুলে শিক্ষক - শিক্ষিকারা আসতে শুরু করে দিয়েছেন। অন্যান্যদিন তারা পৌঁছোনোর আগে ছেলেমেয়েরা পৌঁছে যায়। কিন্তু সেদিন  ক্লাস শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত কোন ছেলেমেয়েকে দেখতে না পেয়ে অবাক হয়ে যান শিক্ষক - শিক্ষিকারা। তাই স্কুলে থেকে বেড়িয়ে আসেন তারা। সেখান থেকেই মাচানতলায় জড়ো হওয়া ছেলেমেয়েদের দেখতে পান তারা। তখনও পর্যন্ত তাদের ঘটনার বিন্দুবিসর্গ জানা ছিল না। তাই স্কুলের গেট থেকেই ছেলেমেয়েদের হাত উসকে ডাকতে থাকেন তারা। ছেলেমেয়েগুলো তখন দোটানায় পড়ে। কি করবে ভেবে পায় না তারা। একবার স্কুলের শিক্ষক - শিক্ষিকাদের দিকে তাকায় , আর একবার তাদের গৃহশিক্ষকদের দিকে তাকায়। এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। প্রিয়র মনে হয় তাদের কর্মসূচির ব্যাপারটা স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের খুলে বলা উচিত। নাহলে ছেলেমেয়েগুলো তাদের উপেক্ষা করছে মনে হতে পারে। সেটা কিছুতেই কাম্য নয়। ' জীবন সুরক্ষা ' কমিটি তো অনন্তকাল স্কুল চালাবে না। ছেলেমেয়েগুলোকে তো সেই স্কুলেই যেতে হবে। অভিভাবকদের মুখে বিভিন্ন সময় শিক্ষক -- শিক্ষিকাদের সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য শুনে শুনে এই প্রেক্ষাপটে যদি সত্যি সত্যি ছেলেমেয়েগুলোর মনে অবজ্ঞার জন্ম হয় তাহলে খুব খারাপ হবে। শিশুমনে  ওই ধরণের মনোভাবের জন্ম হলে পরবর্তীকালে শিক্ষাক্ষেত্রে কুপ্রভাব পড়তে পারে। সেটা আটকাতেই স্কুলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সে। সর্বোপরি স্কুলের শিক্ষক - শিক্ষিকাদের মাধ্যেম তাদের আন্দোনের কথাটা শিক্ষা দফতরে দ্রুত পৌঁচ্ছে যাওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। তাই সে স্কুলে গিয়ে বিষয়টি প্রধান শিক্ষিকা অর্চনা ব্যানার্জীকে খুলে বলে। তার কথা শুনেই কার্যত কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন তিনি। প্রিয়কেই জিজ্ঞেস করে বসেন --- তাহলে এখন আমরা কি করব ? মিড-মিল-রান্নার লোকেরা চলে এসেছেন , তাদেরই বা কি বলব ?
--- দেখুন এ ব্যাপারে আমরা কি বলি বলুন ? সরকারি উদাসীনতার বিরুদ্ধে আমাদের আন্দোলন। আর আপনারা সরকারি কর্মী। তাই আপনাদের কোন পরামর্শ দেওয়া এই মুহুর্তে আমাদের  উচিত হবে না। তবে বিষয়টি আপনাদের শিক্ষা দফতরকে জানানো উচিত বলেই আমার  মনে হয়।
বলেই স্কুলে থেকে বেরিয়ে আসে। মাচানতলার আসতে আসতে তার  হাসি পায়। প্রধান শিক্ষিকাকে কোন পরামর্শ দেওয়া উচিৎ নয় বলার পরও সে কেমন শিক্ষা দফতরের দৃষ্টি আর্কষণের পরামর্শটা কায়দা করে বলে দিয়ে এল। মাচানতলায় ততক্ষণে পঠনপাঠন শুরু হয়ে গিয়েছে। মা'ও এসে সুরোপিসিদের সঙ্গে কোমরে কাপড় জড়িয়ে রান্নার তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছেন। মা'কে দেখে আরও কয়েকজন মহিলা এগিয়ে এসেছেন। সমস্ত কর্মযজ্ঞটাকে তখন একটা পরিবারের মতো মনে হচ্ছিল প্রিয়র।


     


    ( ক্রমশ ) 



        

       নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 


শীঘ্রই দেশ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হতে চলেছে আমার তৃতীয় উপন্যাস ------
  
                                  


                       ----০---



No comments:

Post a Comment