অন্তরালে
অর্ঘ্য ঘোষ
( ধারাবাহিক উপন্যাস )
সময় যত গড়াচ্ছিল ততই জমায়েত বাড়ছিল মাচানতলায়। কেউ ভাতের হাড়িতে চাল দিচ্ছিলেন , তো কেউ সবজি কাটছিলেন। কাজে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে সবার যে এতদিন সদ্ভাব ছিল তা নয়। বরং বৈষয়িক কিম্বা পারিবারিক কারণে অনেকের মধ্যেই আকচা - আকচি ছিল। আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সেই বিবাদ দূরে সরিয়ে সবাই একাত্ম হয়ে গিয়েছেন। আন্দোলন কতটা ফলপ্রসূ হবে তা সময় বলবে। কিন্তু আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এই নৈকট্যের বাতাবরণ কম বড়ো পাওনা নয়। আচমকা থালা বাজানোর শব্দে সচকিত হয়ে ওঠে প্রিয়। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে প্রশান্তকাকার নির্দেশ মাফিক ক্লাস শুরুর ঘন্টা দিচ্ছেন জীতেনকাকা। ঘন্টা দেওয়ার পদ্ধতি দেখে বেশ মজা লাগে প্রিয়র। ঘণ্টা শুনে সে'ও পড়ুয়াদের পাঠদানের প্রস্তুতি নেয়। সেই সময় একে একে গ্রামে ঢুকতে শুরু করে সংবাদ মাধ্যমের গাড়ি। প্রিয় তার ক্লাসটা রাজুদাকে দেখতে বলে সে এগিয়ে গিয়ে সাংবাদিকদের মাচানতলায় নিয়ে আসে। মহিলারা ততক্ষণে চা তৈরি করে ফেলেছেন। জীতেনকাকা হাতে হাতে সবাইকে চা দেন। চা খাওয়ার পর সাংবাদিকরা সংবাদ সংগ্রহের কাজ শুরু করে দেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই টিভিতে সম্প্রচারিত হতে শুরু করে সেই খবর
। ছেলেমেয়েদের পড়ার ক্ষতি হবে বলে সেদিন অবশ্য মাচানতলায় আর টিভি লাগানো হয় নি। ক্লাবঘরেই টিভি ছিল। অনেকে সেখানেই খবর শুনছিল। আর সেই খবর পৌঁচ্ছে দিচ্ছিল মাচানতলায়। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে প্রিয়রা টিভিতে সংবাদ শুনে আসছিল। টিফিনের সময় ছেলেমেয়েদের যখন মিড-ডে-মিল খাওয়ানো চলছিল তখনই একটানা আধ ঘণ্টা টিভি দেখার সুযোগ পায় প্রিয়রা। সেইসময় খবরাখবর টিভিতে সে দিনের সেই সংবাদ পাঠিকার গলা শোনা যায়।পাঠিকা বলতে শুরু করেন -- জেলাশাসক কথা রাখেন নি। তাই পোলিও বয়কটের পর এবার সরকারি শিক্ষা বয়কেটের ডাক দিলেন মনোহরপুরের গ্রামবাসীরা। ওই গ্রামের সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পাঁচ বছরের অধিক সময় ধরে কোন ডাক্তার নেই। প্রশাসনের সকল স্তরে জানিয়েও কোন কাজ না হওয়ায় সাতদিন আগে পোলিও বয়কটের ডাক দিয়েছিলেন গ্রামবাসীরা। সেই সময় জেলাশাসক সাত দিনের মধ্যে ডাক্তার নিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় পোলিও বয়কট প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। কিন্তু সাতদিন অতিক্রান্ত হওয়ার পরও ডাক্তার নিয়োগ হয় নি। তাই গ্রামবাসীরা সরকারি শিক্ষা বয়কটের ডাক দিয়েছেন। ছেলেমেয়েদের তারা সরকারি স্কুলে পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছেন। ওইসব ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার ক্ষতি যাতে না হয় তারজন্য সমান্তরাল স্কুল খোলা হয়েছে।গ্রামের বেকার যুবকেরা অনিদ্দিষ্ট কালের জন্য সমান্তরাল স্কুলে পড়ানোর দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। পাশাপাশি বাড়ি বাড়ি চালডাল তুলে মিড-মিলের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। গ্রামবাসীদের দাবি , জেলা স্কুল বোর্ডের চেয়ারম্যান এসে ডাক্তার নিয়োগের প্রতিশ্রুতি না দেওয়া পর্যন্ত তারা ছেলেমেয়েদের সরকারি স্কুলে পাঠাবেন না। আন্দোলনকারীদের দাবি মেনে স্কুল বোর্ডের চেয়ারম্যান গ্রামে পৌঁচ্ছোন কিনা সেটাই এখন দেখার। আপনারা দেখছেন খবরাখবর। দিনে-রাতে। খবরের সাথে।আপনাদের সঙ্গে আমি নিবেদিতা।
খবর পড়ার ফাঁকে ফাঁকে কখনও দেখানো হয় ভগ্নপ্রায় স্বাস্থ্যকেন্দ্র , ছাত্রছাত্রীহীন সুনসান সরকারি স্কুল , মাচানতলার স্কুলে পাঠদান , কখনও মহিলাদের মিড-ডে-মিল রান্না। নিজেদের টিভিতে দেখতে পেয়ে মহিলারা মহা খুশী। সিরিয়ালে মহিলাদের কত কি করতে দেখেছেন , কিন্তু তাদের রান্না করাও যে টিভিতে দেখা যাবে তা ছিল তাদের কল্পনার অতীত।তাই টিভির সামনে থেকে তারা নড়তেই চান না। তারই মধ্যে অতসীকাকীর মুখে থেকে আক্ষেপ ঝড়ে পড়ে -- ইস , কপালের টিপটা কেমন লেপটে গিয়েছে দেখেছো। আগে যদি জানতাম আমাদেরও এভাবে টিভিতে দেখাবে তাহলে একটু সেজেগুজে আসতাম। আত্মীয় স্বজনরা সব দেখবে।
অতসী কাকীর কথা শেষ হতেই অরুণা বৌদির গলাতেও আক্ষেপ শোনা যায় -- আমি তো বৌদিকে দেখেই যে কাপড়ে ছিলাম তাতেই চলে এসেছি। আমার বাপের বাড়ির লোকেরাও টিভিতে খবর দেখবে। বাপের বাড়ি গেলেই সবাই বলবে, তোর আর কাপড় ছিল না। রংচটা কাপড় পড়েই ক্যামেরার সামনে চলে গেলি ?
ওদের কথা শুনে মৃদু মৃদু হাসতে থাকেন হরপার্ব্বতী।
সেটা লক্ষ্য করে ওরা বলে , তুমি হাসছো দিদি ? টিভিতে মুখ দেখানোর এই সুযোগ আর আসবে ? আচ্ছা তুমি তো প্রিয়র কাছে সবই জানতে পেরেছিলে , তাহলে তুমিও তো একটু সেজেগুজে আসতে পারতে ?
--- তোরা বলেছিস ভালো। আর কয়েকদিন পরে ছেলের বৌ আসবে ঘরে। আর আমি টিভিতে মুখ দেখানোর জন্য সেজেগুজে ভাতের হাড়িতে খুন্তি নাড়ি আর কি ? তোরাও শোন , আমরা এখানে রান্না করতে এসেছি তো , না কি ? নিশ্চয় বিয়ে বাড়ির অনুষ্ঠানে আসি নি। তাহলে রান্না করার মতো সাজপোশাক আমাদের ঠিকই ছিল। টিভিতে সিরিয়ালেও দেখবি যারা রান্নাবান্না করে তাদেরও সাজপোশাক আমাদেরই মতো থাকে।
--- তা অবশ্য ঠিক বলেছো দিদি।
ছেলেমেয়েদের পড়াতে পড়াতেই মহিলাদের কথোপকথন শুনতে পাচ্ছিল প্রিয়। হঠাৎ সেই কথোপকথন চাপা পড়ে যায় কিছু লোকের উগ্র চিৎকারে। মুখ ফেরাতেই প্রিয় দেখতে পায় কয়েকজন লোককে নিয়ে মাচানতলার দিকে আঙুল উচিয়ে উত্তেজিত স্বরে কিছু বলতে বলতে এগিয়ে আসছেন প্রসাদকাকারা। তারা মাচানতলার কাছে পৌঁছোতেই লোকগুলোর মধ্যে একজনকে ভালো ভাবে চিনতে পারে প্রিয়। বিভিন্ন সভা সমাবেশে তাকে উত্তেজক বক্তৃতা দিতে শুনেছে। লোকটির নাম বীরেন সেন।
শাসকদলের জেলা কমিটির নেতা। সেদিন ডাক্তারবাবুর চেম্বারে পাশের গ্রামের লোকগুলির মুখে এই বীরেনবাবুরই কথা শুনেছিল সে। তাদের পোলিও বয়কট বানচাল করতে না পারায় এম,এল,এ আর প্রসাদকাকাকে নাকি খুব বকাবকি করেছিলেন বীরেনবাবু। সেই বীরেনবাবুকে মাচানতলায় দেখে কিছুটা অবাকই হয় প্রিয়। তাহলে কি প্রসাদকাকাদের উপরে ভরসা হারিয়ে তাদের আন্দোলন রুখতে দলবল নিয়ে নিজেই চলে এলেন বীরেনবাবু ?
তার ধারণাই সত্যি হয়। বীরেনবাবু তার সামনে এসে সরাসরি প্রশ্ন করেন , আপনার নামই তো প্রিয় ? বলি এসব কি বুজরুকি শুরু করেছেন আপনারা ?
---- বুজরুকি মানে ? কি বলছেন আপনি ?
---- বুজরুকি নয় ? আন্দোলনের নামে একের পর এক শিশুদের জীবন - শিক্ষা বাজি রাখাটা বুজরুকি ছাড়া আর কি ? শুনুন , শিশুদের জোর করে আটকে রেখে এইসব বুজরুকি করা আমরা মানব না।
--- আপনাকে এ বিষয়ে দুটো কথা বলার আছে। প্রথমত , আমরা জোর করে কাউকে আটকে রাখি নি। দ্বিতীয়ত আপনাদের মানা না মানার উপরে কিছু নির্ভর করে না। ডাক্তারের দাবিতে আমাদের এই আন্দোলন চলছে -- চলবে।
প্রিয়র সঙ্গে গলা মিলিয়ে গ্রামবাসীরাও সমস্বরে বলে ওঠেন , চলছে - চলবে।
ওই শ্লোগান শুনে মেজাজ হারিয়ে বীরেনবাবু বলে ওঠেন --- চলাচ্ছি।
ততক্ষণে সাংবাদিকেরা তাদের ঘিরে ধরেছেন। তাদের অগ্রাহ্য করে বীরেনবাবু দুটি ছেলেমেয়ের হাত ধরে স্কুলের দিকে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। ছেলেমেয়ে দুটি ভয়ে আতঙ্কে চিৎকার করতে শুরু করে। ছেলেমেয়ে দুটি সুদাম আর বসন্তের।সুদাম আর বসন্তের স্ত্রী মমতা তখন মাচানতলাতেই ছিলেন। তারা গিয়ে নিজের ছেলেমেয়েদের অন্য হাত টেনে ধরেন।
সেই টানাটানি দেখে অন্যান্য ছেলেমেয়েরাও ভড়কে গিয়ে চিলচিৎকার শুরু করে দেয়। সে এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ক্যামেরাতে দু'পক্ষের টানাটানির ছবি উঠতে থাকে।ছেলেমেয়ে দুটিকে স্কুলে নিয়ে যেতে গিয়ে ওইভাবে বাধা পেয়ে আরও ক্ষিপ্ত হয় ওঠেন বীরেনবাবু। সুদাম আর মমতাকে মেজাজের সঙ্গে জিজ্ঞেস করে বসেন -- কে আপনারা , এদের আটকাচ্ছেন কেন ?
আর যায় কোথা ? আগুনে যেন ঘি পড়ে। সুদাম আর মমতা বীরেনবাবুর মুখের সামনে হাত নেড়ে বলেন , তার আগে বলুন তো আপনি কে ? বলা নেই , কওয়া নেই , ভদ্রলোকের পোশাক পড়ে আমাদের ছেলেমেয়েদের ছেলেধরার মতো ধরে নিয়ে যাচ্ছেন ? তাড়াতাড়ি ওদের হাত ছেড়ে দিন না হলে ঝেঁটিয়ে বিষ ছেড়ে দেব তখন বুঝবেন।
ওই কথা শুনে বিড়ম্বনায় পড়েন বীরেনবাবু। তার সুর নরম হয়ে আসে। তিনি বলেন , এরা আপনাদের ছেলেমেয়ে ? সরকারি স্কুলে না পাঠিয়ে এখানে আটকে রেখেছেন কেন ?
-- কেন এরা আমাদের ছেলেমেয়ে কি না সন্দেহ আছে নাকি ? সার্টিফিকেট এনে দেখাতে হবে ? আর আমাদের ছেলেমেয়েদের আমরা কোথাই পাঠাব না পাঠাব তা আপনি বলার কে ? এর আগে তো কোনদিন এ গাঁয়ে পা পড়েছে বলে মনে হয় না। ডাক্তার দেওয়ার মুরোদ নেই , আবার বড়ো বড়ো কথা বলতে এসেছেন। যান আগে ডাক্তারের ব্যবস্থা করুন। তারপর আপনার কথা শুনব।
বীরেনবাবুর মুখ দিয়ে আর কথা সরে না। ততক্ষণে সাংবাদিকেরা ছেঁকে ধরেছে তাকে। একের পর এক প্রশ্নে নাজেহাল হয়ে পড়েন তিনি। শেষে সাংবাদিকদেরই ধমকাতে শুরু করেন। সাংবাদিকেরা অবশ্য তার কথা হেসেই উড়িয়ে দেন। হেসেই আর্য তাকে বলে , আপনি অযথাই আমাদের উপর রাগ করছেন। আপনি তো শুনেছেন ডাক্তারের দাবিতে এ গ্রামের লোকেরা সরকারি পরিষেবা বয়কটের আন্দোলন করছেন। আপনি শাসক দলের দন্ডমুণ্ডের কর্তা। আপনি ইচ্ছা করলেই গ্রামবাসীদের দাবি পূরণ করে দিতে পারেন। তাহলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়। সংবাদ মাধ্যমে ডাক্তার দেওয়ার কথাটা বলে দিন না।
--- না , আমি তা পারি না। আমি তো প্রশাসনের লোক নই। তাই ডাক্তার দেওয়ার কাজও আমার নয়।
---- তাহলে সরকারি পরিষেবা সচল রাখার কাজও আপনার নয় , সেটাও প্রশাসনের কাজ। আপনি কেন অযথা ছেলেমেয়েদের হাত ধরে টানাটানি করতে এসেছেন ?
--- আসলে আমাদের পার্টির লোকেরা বলেছিল রাজনৈতিক স্বার্থে বিরোধীরা জোর করে ছেলেমেয়েদের স্কুলে যেতে দিচ্ছে না। তাই শাসকদলের নেতা হিসাবে বিরোধীদের সেই চক্রান্ত রুখতে এসেছিলাম।
---- এই তো বীরেনবাবু ভাবের ঘরে চুরি করার স্বভাবটা আপনাদেরও এখনও গেল না। বেকায়দায় পড়লেই বিরোধীদের চক্রান্ত দেখার ধারাবাহিকতাটা আপনারা ছাড়তে পারলেন না।
দলের লোকেরাই বা কেমন আপনাদের ? পাঁচ বছর ধরে গ্রামে ডাক্তার নেই সেই খবরটা আপনাকে দেওয়ার প্রয়োজনই মনে করে নি। কিন্তু গ্রামবাসীদের স্বতঃস্ফুর্ত বয়কটের খবরটা বিকৃত করে ঠিক পৌঁছে দিয়েছে আপনার কানে। আর আপনি কান কানের জায়গায় আছে কিনা না দেখেই ছুটে এসেছেন কাকের সন্ধানে। আর কোন কথা বলতে পারেন না বীরেনবাবু। সদলবলে হন হন করে গ্রাম ছাড়ার রাস্তা ধরেন তিনি। তখন সমবেত গ্রামবাসী চিৎকার করে বলে ওঠেন - আমাদের আন্দোলন চলছে-চলবে।
( ক্রমশ )
----০---
No comments:
Post a Comment