Short story, Features story,Novel,Poems,Pictures and social activities in Bengali language presented by Arghya Ghosh

অন্তরালে - ১৮



   অন্তরালে 


        অর্ঘ্য ঘোষ 



 ( ধারাবাহিক উপন্যাস ) 




বীরনেবাবুদের যতক্ষণ দেখা যায় ততক্ষণ পর্যন্ত চলে ওই শ্লোগান। মহিলারাও গলা মেলান শ্লোগানে। তারা চলে যাওয়ার পর সেদিন আর পঠনপাঠনের পরিবেশ বজায় থাকে না। তাই সেদিনকার মতো  বাচ্চাদের ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়। সংবাদ সংগ্রহের কাজ শেষ করে সাংবাদিকেরা ফেরার উপক্রম করেন। কিন্তু গ্রামবাসীরা তাদের কিছুতেই না খেয়ে যেতে দেন না। সেদিন আর্যদা প্রিয়কে বলেই দিয়েছিলেন এদিন তারা খাবেন না। গ্রামের লোকেদেরও প্রিয় সেই কথাই বলেছিল। কিন্তু কেউ তা কানেই তোলেন নি। প্রশান্তকাকা বলেন -- তাই হয় নাকি ? ওনারা খাব না বলতেই পারেন , কিন্তু আমরা তো তা মানতে পারি না। সবাই কতদুর থেকে আসবেন , না খাইয়ে কি ছাড়া যায় ? গাঁয়ের নিন্দা হয়ে যাবে না ?
বাকিরাও প্রশান্তকাকার কথায় সায় দেন। জীতেনকাকা বলেন , ধরতে গেলে ওরা আমাদের অতিথি। বাপ-ঠাকুদার মুখ থেকে শুনে আসছি অতিথি অভুক্ত হয়ে  ফিরে গেলে গৃহস্থের অকল্যাণ হয়। প্রথমদিন যখন শুধু ওদের জন্য রান্না করে দিতে পেরেছিলাম , আর আজ তো বাচ্চাদের জন্য মিড-ডে-মিল রান্না করতেই হচ্ছে, তখন একই সঙ্গে রান্না করে দিতে পারব না ? 
সেইমতো মিড-ডে -মিলের সঙ্গেই সাংবাদিকদের জন্যও রান্না করা হয়। সেটা বলতেই আর খেতে আপত্তি করেন না সাংবাদিকেরা। ক্লাবঘরেই তাদের খেতে বসানো হয়।খেতে খেতেই খাসবার্তা চ্যানেলে ফের গ্রামের সরকারি শিক্ষা বয়কটের খবর শোনা যায় টিভিতে। সংবাদ পাঠিকাকে বলতে শোনা যায় -- শান্তিপূর্ণ ভাবেই  ডাক্তারের দাবিতে সরকারি শিক্ষা বয়কটের একদিন সম্পূর্ণ হল। মনোহরপুর প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডাক্তারের দাবিতে গ্রামবাসীরা পোলিও বয়কটের ডাক দিয়েছিলেন। সে সময় জেলাশাসক সাতদিনের মধ্যে ডাক্তার নিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় পোলিও বয়কট প্রত্যাহার করে নেন গ্রামবাসীরা। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ডাক্তার নিয়োগ না হওয়ায় এদিন থেকে সরকারি শিক্ষা বয়কটের ডাক দেওয়া হয়।ছেলেমেয়েদের সরকারি স্কুলে পাঠানোর পরিবর্তে নিজেরাই সমান্তরাল স্কুল খুলে পঠনপাঠন এবং মিড-মিলের ব্যবস্থা করেন। গ্রামবাসীরা এ ব্যাপারে জেলা স্কুল বোর্ডের চেয়ারম্যানের হস্তক্ষেপ আশা করেছিলেন। কিন্তু তিনি গ্রামে যান নি। মাঝখান থেকে জোর করে বয়কট বানচাল করতে গিয়ে গ্রামবাসীদের ক্ষোভের মুখে পড়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে আসতে হয় শাসক দলের নেতা বীরেন সেনকে। এখন আমরা শুনে নেব গ্রামবাসীরা কি বলছেন --তারপরই টিভিতে ভেসে ওঠে প্রশান্তকাকার মুখ। তার পিছনে দেখা যায় আরও অনেকেই। 
প্রশান্তকাকার গলায় রীতিমতো ক্ষোভ ঝড়ে পড়ে -- আমাদের এতদিন স্বাস্থ্য পরিষেবা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এবার প্রতারনাও করা হল। জেলাশাসক কথা দিয়েও কথা রাখলেন না। তাই আমরা ঠিক করেছি , যে সরকার আমাদের সঙ্গে বঞ্চনা করেছে সেই সরকারের সমস্ত পরিষেবাও আমরা বয়কট করব।প্রশান্তকাকার বক্তব্য শেষ হতেই টিভিতে গ্রামবাসীদের হাততালির শব্দ শোনা যায়। আর সেটা দেখে ক্লাবঘরে যারা ছিলেন তারাও হাততালি দিয়ে ওঠেন। ফের শোনা যায় সংবাদ পাঠিকার গলা -- সমবেত এই হাততালিই প্রমাণ করে দেয় গ্রামবাসীরা নিজেদের দাবির বিষয়ে কতটা এককাট্টা হয়ে উঠেছেন। আমাদের প্রতিনিধি সৌমী মজুমদার জেলাশাসক জলিল আহমেদের প্রতিক্রিয়া জানতে তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। কিন্তু তিনি সংবাদ মাধ্যমে মুখ খুলতে রাজী হন নি। তবে জেলা স্কুল বোর্ডের চেয়ারম্যান উত্তম ঘোষ আগামীকাল আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা বলতে গ্রামে যাচ্ছেন বলে আমাদের প্রতিনিধিকে জানিয়েছেন।গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলে উত্তমবাবু কোন সমাধান সূত্র বের করতে পারেন কিনা সেটাই এখন দেখার। খবর এখনকার মতো এ পর্যন্তই। আপনাদের সঙ্গে আমি মধুছন্দা।  খাসবার্তা।



                                     খবর শেষ হতেই সাংবাদিকরা ফের পরদিন আসার কথা বলে বিদায় নেন। প্রিয়রা পরবর্তী কর্মপদ্ধতি নিয়ে আলোচনায় বসে। প্রশান্তকাকা প্রশ্ন তোলেন , কাল যদি স্কুল বোর্ডের চেয়ারম্যান ডি , এম সাহেবের মতো শুকনো প্রতিশ্রুতি দেন তাহলে আমরা কি করব ? 
প্রিয় বলে , তাকে বিশ্বাস করা ছাড়া আমাদের কোন উপায় ও তো নেই। 
---- কেন , উপায় নেই কেন ? সমস্ত ছেলেমেয়ের বাবা-মা আমাদের সঙ্গেই আছেন।তাহলে ডাক্তার না আসা পর্যন্ত শিক্ষা বয়কট চালিয়ে যেতে অসুবিধা কোথাই ?
--- সেই অর্থে অসুবিধা নেই ঠিকই। কিন্তু আমরা তো খুব বেশিদিন এইভাবে স্কুল চালাতে পারব না। বিশেষ করে ৩০ জন ছেলেমেয়ের মিড-ডে মিল যোগানো সম্ভব হবে না। তখনই ছেলেমেয়েদের সরকারি স্কুলে পাঠানোর প্রবণতা দেখা দেবে অভিভাবকদের মধ্যে। কারণ গ্রামে অনেক পরিবারেই তো একবেলা বিনা খরচে ভর পেট খাবার পাওয়াটা কম কথা নয়।
---- সেটা অবশ্য ঠিক। তাহলে উপায় , আমরা কি আন্দোলন প্রত্যাহার নেব ? 
---- না -- না , এতদুর এগিয়ে আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেওয়ার কোন প্রশ্নই ওঠে না। আমি কেবল কাল আমাদের অবস্থানের কথা বলতে চাইছি। যেখানে খোদ জেলাশাসক প্রতিশ্রুতি দিয়েও ডাক্তার দিতে পারেন নি , সেখানে স্কুল বোর্ডের চেয়ারম্যানেরও প্রতিশ্রুতি ছাড়া ডাক্তার দেওয়ার ক্ষমতা নেই। 
---- তাহলে আমরা স্কুল বয়কটের সিদ্ধান্ত নিতে গেলাম কেন ? 
----  এটা খুব ভালো প্রশ্ন করেছেন। আসলে এভাবেই আমরা আমাদের দাবির বিষয়টি সর্বস্তরে পৌঁচ্ছে দিতে চাইছি। সংবাদ মাধ্যম আমাদের পাশে রয়েছে। তাই আমরা এই ব্যাপারে অনেকটাই সফল হয়েছি।আমাদের গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পাঁচ বছর ধরে ডাক্তার না থাকার বিষয়টি আজ আর কারোরই অজানা নেই। অনেক সময় প্রশাসন তাদের এইসব গাফিলতিগুলি চেপে রাখে। কিন্তু ধারাবাহিক ভাবে এইরকম আন্দোলনের ফলে তা সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়ে।দাবির স্বপক্ষে জনমত গড়ে ওঠে।সমালোচনার মুখে পড়ে সরকার। তখন মুখরক্ষা করতে দাবি পূরণ করতে বাধ্য হয়। সেই হিসাবে আমাদের এই আন্দোলনের যথেষ্ট যৌক্তিকতা রয়েছে বলেই আমার মনে হয়।
এতক্ষণ সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো প্রিয়র কথা শুনছিল। তাদের মুখ চোখের ভাব দেখেই প্রিয় বুঝতে পারে তার যুক্তি অন্যদের মনে ধরেছে। প্রিয়র নিজেরই খুব আশ্চর্য লাগে। সে যে এমন সুন্দর ভাবে গুছিয়ে বিষয়টি বুঝিয়ে বলতে পারবে তা ভাবতে পারে নি। সেদিন আর্যদা একটা কথা বলেছিলেন -- পরিস্থিতিই মানুষের মধ্যে নেতৃত্ব গুণের জন্ম দেয়। তার মধ্যে কি সেই গুণের উন্মেষ ঘটেছে ? কথাটা মনে জাগতেই তার হাসি পায়। সে কোনদিন নেতা হওয়ার কথা ভাবেই নি। নেতা হতেও চায় না। কিন্তু তাকেই এখন গ্রামের আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে হচ্ছে। সেই সময় জীতেনকাকা জিজ্ঞেস করেন , তাহলে স্কুল বয়কটের পরই কি আমাদের আন্দোলন থেমে যাবে ? 
--- তা কেন ? ডাক্তার না আসা পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে।
--- কিন্তু এরপর আর কি সরকারি পরিষেবা বয়কট করার আছে আমাদের ?
---- এটা নিয়ে এখনই অতটা উতলা হওয়ার দরকার নেই। কাল তো চেয়ারম্যান সাহেব আসছেন। তিনি কি বলছেন শুনি। কিছুই যে হবে না তাও তো নয়। হয়তো পোলিও বয়কটে জেরেই ডাক্তার নিয়োগের কথা ভাবা হয়েছিল। শিক্ষা বয়কটে সেই ভাবনাটা বাস্তবায়িত হল।  তারপরেও যদি কোন কাজ না হয় তখন আমরা বসে আলোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করে নেব।
সবাই বলে , সেটাই ঠিক হবে। কালকের দিনটা তো আগে দেখা যাক।




                     তারপর সবাই বাড়ি ফিরে যায়। বাড়ি ফিরেতেই মা জিজ্ঞেস করেন -- হ্যা রে , কালও কি তোদের শিক্ষা বয়কট চলবে ? আমাকে কি আর যেতে হবে ?
---- কালকের দিনটা তো চলবেই। মিড-ডে-মিল রান্নাও হবে। কালকের দিনটা তুমি গেলেই ভালো হয়। তোমাকে দেখে অন্যান্য পরিবারের মহিলারাও এগিয়ে এসেছেন। সাংবাদিকরাও তোমাদের রান্নার খুব সুখ্যাতি করছিলেন।
---- সে না হয় আমি যাব। আমি ভাবছি এভাবে দিনের পর দিন তোর ট্রেনিং কামাই হলে কি হবে ?  অবশ্য কিছু করারও তো নেই। সবাই তোকে কত ভরসা করে তা তো আজ নিজের চোখে দেখলাম। এই অবস্থায় ওদের ফেলে ট্রেনিং করতে যাওয়া স্বার্থপরের মতো মনে হবে। 
 ---- তুমি অত দুঃশ্চিন্তা কোর না। স্কুল বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাল আসার কথা রয়েছে। দেখি উনি কি বলেন। মনে হয় কালকে শিক্ষা বয়কট আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে।না হলে আমি দু'টো শিফটে ট্রেনিং নিয়ে ৬ মাসের মধ্যেই কোর্স সম্পূর্ণ করে নেব। সুশোভনবাবু আমাকে স্নেহ করেন। তাকে বললে তিনি সেই সুযোগ আমাকে করে দেবেন। 
---  তাই যেন হয় বাবা। তোর চাকরিটা হয়ে গেলে আমার একটা মনোবাসনা পূর্ণ হয়।
প্রিয় জানে এরপর মা কি বলবেন। তবুও সে না বোঝার ভান করে বলে , তুমি বলোই না মা কি তোমার মনোবাসনা। চাকরি না পেয়েই সেটা পূরণ করতে পারি কিনা দেখি। ডাক্তারবাবুর কাছে না হয় অগ্রিম হিসাবে কিছু টাকাই চেয়ে নেব।
--- ওরে পাগল এ মনোবাসনা সেই মনোবাসনা নয়।
--- তবে ? 
--- আমি স্বাতীকে তোর বউ করে ঘরে আনতে চাই। মধুরিমা চলে যাওয়ার পর থেকে বাড়িটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। সেই শুন্যতাটা আমি পূরণ করতে চাই।
--- ওরে বাবা তোমার তো খুব বড়ো পরিকল্পনা। ডাক্তারবাবুর ধারের টাকায় ওই পরিকল্পনা রূপায়িত করা সম্ভব নয়। আমি যাই বাবা।বলে নিজের ঘরে দিকে চলে যায় প্রিয়।
আর হরপার্ব্বতী সেদিকে চেয়ে মৃদু  হেসে বলেন -- পাগল একটা।
বিছানায় শুয়ে শুয়ে স্বাতীর কথাই ভাবে প্রিয়। সেই পোলিও বয়কটের প্রচারের দিন দেখা হয়েছিল স্বাতীর সঙ্গে। তারপর আন্দোলনের চাপে আর দেখা করার সুযোগ হয়নি। স্বাতীকে দেখতে খুব ইচ্ছে করে তার। আন্দোলনের চাপে সেটা সম্ভব হয় না। কালকের পর সেই চাপ কিছুটা কমে যাবে বলে মনে হয় প্রিয়র। তারপরই একবার স্বাতীর সঙ্গে দেখা করবে বলে মনে মনে ভাবে সে।  কিন্তু মানুষ ভাবে এক , আর বাস্তবে হয় আর এক। এ ক্ষেত্রেও সেটার অন্যথা হয় না।  ফের নতুন করে চাপের মুখে পড়ে তারা।


          
               ( ক্রমশ )  




       নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 


শীঘ্রই দেশ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হতে চলেছে আমার তৃতীয় উপন্যাস ------
  
                                  


                       ----০---

        

No comments:

Post a Comment