Short story, Features story,Novel,Poems,Pictures and social activities in Bengali language presented by Arghya Ghosh

অন্তরালে -- ১৯




     অন্তরালে 

  

           অর্ঘ্য ঘোষ 



( ধারাবাহিক উপন্যাস )



সেদিন একটু বেশি রাতেই ঘুমিয়েছিল প্রিয়। তাই অন্যান্য দিনের চেয়ে ঘুম ভাঙতেও একটু দেরিই হয়ে যায় তার। ঘুম ভাঙে মায়ের ডাকে। চোখ মেলে চাইতেই মা বলেন , তাড়াতাড়ি ওঠ ,সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে।
মায়ের কথা শুনেই বুকটা ধ্বক করে ওঠে প্রিয়র। দ্রুত বিছানা ছেড়ে দরজার দিকে এগোতেই কান্নার রোল কানে আসে তার। সে মায়ের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। মাবলেন , তাড়াতাড়ি মুখ হাত ধুয়ে প্রশান্ত ঠাকুরপোর বাড়িতে যা।
--- কেন কি হয়েছে ?
--- জোড়া বলদ মরেছে। প্রশান্ত ঠাকুরপো একেবারে ভেঙে পড়েছে।
আর শুনতে পারে না প্রিয়। দ্রুত তৈরি হয়ে সে প্রশান্তকাকার বাড়ির দিকে দৌড়োয়। সে যখন প্রশান্তকাকার গোয়ালঘরের কাছে পৌঁছোয় তখন সেখানে গ্রামের লোক ভেঙে পড়েছে। গোয়াল চালায় পড়ে রয়েছে দশাসই দুটি বলদ।প্রশান্তকাকা মাথায় হাত দিয়ে বসে রয়েছেন। অতসীকাকী সন্তান হারানোর মতোই শোকে কপাল চাপাচ্ছেন। কপাল চাপড়ানোরই কথা। চাষিরা বলদকে নিজের সন্তানের চোখেই দেখেন , সন্তানের মতোই ভালোবাসেন। প্রিয় প্রশান্তকাকার পাশে গিয়ে বসে। সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষাটুকুও খুঁজে পায় না সে।কিছুটা সামলে ওঠার পর প্রশান্তকাকাই ঘটনার কথা খুলে বলেন। তা শুনে স্তম্ভিত হয়ে যায় প্রিয়। তাদের গ্রামে অনেকের মতোই প্রশান্তকাকারও বসতবাড়ি থেকে কিছুটা দুরে গোয়ালবাড়ি রয়েছে। রয়েছে গোয়ালবাড়ি লাগোয়া গোয়ালচালাও।সব পরিবারেই দিনের বেলায় গোয়ালচালাতে গরু বাঁধা থাকে। সন্ধ্যেবেলায় গরু গোয়ালে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। তারপর গোয়ালচালা পরিস্কার করে পাতনায় জল দিয়ে ,  খড় কেটে খোল ছিটিয়ে রেখে দেন চাষিরা। সকালে পাতনায় তৈরি করে রাখা সেই খাবার খাওয়ানোর পর চাষিরা হাল জুড়ে নিয়ে মাঠে চলে যান।সেই মতো গতকাল রাতে মাচানতলা থেকে ফিরে প্রশান্তকাকাও গোয়ালে গরু বেঁধে নিজে হাতে পাতনায় খড় কেটে খাবার ঠিক করে রেখেছিলেন। আজ সকালে ঠিকে মুনিস গরু বের করে চালায় বেঁধে দেয়। তারপর চা খেয়ে  হাল জুড়তে গিয়ে দেখে ছটফট করতে করতে বলদ দুটো শুয়ে পড়ে , আর ওঠে না। খবর পেয়েই বাড়ির ভিতর থেকে ছুটে আসেন প্রশান্তকাকা। ততক্ষণে সব শেষ। মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা যায় পাতনার আশে পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে ইউরিয়া। তারপর আর বুঝতে বাকি থাকে না মৃত্যুর কারণ।ইউরিয়া মিশ্রিত জল খেলেই গবাদি পশুর মৃত্যু অবধারিত।গোয়ালঘর তালাবন্ধ থাকলেও গোয়ালচালা সবার খোলাই থাকে। প্রশান্তকাকারও বাইরের দিকেই খোলা চালা। কাল খাবার তৈরি করে রাখার পরই কেউ এসে পাতনার জলে ইউরিয়া মিশিয়ে দিয়ে গিয়েছে। সেটা বুঝিয়ে দিতেই ঋজুদের পুকুর বিষ দেওয়ার সময় যেমন পুকুর পাড়ে বিষের বোতল ফেলে রাখা হয়েছিল, এখানেও ইচ্ছাকৃত ভাবে পাতনার পাশে ইউরিয়া ছড়িয়ে রেখে সমঝে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। কাজটা যে কাদের তা বুঝতে অসুবিধা হয় না প্রিয়র। কিন্তু প্রমাণ না থাকলে কিছু করার নেই। এইসব কাজ তো কেউ তথ্য প্রমাণ রেখে করে না। প্রিয়র মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। আন্দোলন করতে গিয়ে এইভাবে যদি একের পর এক মাসুল গুনতে হয় তাহলে আর ক'জন মনোবল ধরে রাখতে পারবে ?  অতসীকাকী তখনও সন্তানের মতোই বলদ দুটোর গলা জড়িয়ে ধরে কেঁদেই চলেছেন। ভানুমতীজ্যেঠি , সুরোবালা পিসিরা তাকে সান্ত্বনা দেয় -- কি করবে বলো? দেখো যারা অবলা জীবগুলো এইভাবে মেরে মহাপাতকের কাজ করল ভগবান তাদের ঠিক শাস্তি দেবেন।
ক্রমে বেলা বাড়তে থাকে। প্রশান্তকাকার বাড়ির সামনে জমায়েতও বাড়তে থাকে। স্কুলের সময় হয়ে আসে। 'জীবন সুরক্ষা' কমিটির সকলেই সেই সময় প্রশান্তকাকার বাড়িতে হাজির ছিল। প্রিয় তাদের জিজ্ঞাসা করে --- তাহলে আজ স্কুল ছুটি করে দেওয়া হোক না কি ? 
কেউ কিছু বলার আগে প্রশান্তকাকাই বলেন ওঠে , না না, ছুটি করতে হবে না। তাহলে শত্রুরা ভাববে আমরা ভয় পেয়ে পিছিয়ে যাচ্ছি।  আমি এসবের পরোয়া করি না। নেমেছি যখন , তখন এর শেষ না দেখে ছাড়ব না। যদি আরও কিছু করার থাকে তো করে নিক। বিঘে তিনেক তো মোটে জমি। গরু কিম্বা হাল কিনে তো আর চাষ করতে পারব না।জমি সব ভাগে দিয়ে দেব। খাচ্ছিলাম ডাল ভাত , এবার থেকে না হয় শাকভাতই খাব।



                                      প্রশান্তকাকার কথা শুনে জীতেনকাকা বলেন , দাদা তুমি অত ভাবছ কেন ? আমরা এখানে এত জন আছি। অনেকের বাড়িতেই হাল গরু আছে। আমাদের যদি জমি চাষ হয় , তাহলে তোমারও হবে। আমরা যদি পালা ক্রমে একদিন করেও হাল গরু দিই,  তাহলে তোমার জমি চাষ হয়ে যাবে। তোমাকে জমি ভাগে দিতে হবে না। যতদিন না তোমার নিজের হাল গরু হয় ততদিন আমরাই তোমার জমি চাষ করে দেব। কি বলো সবাই ?
উপস্থিত সবাই একবাক্যে বলে ওঠে -- হ্যা হ্যা নিশ্চয় , এখন তো আমরা একটা পরিবারের মতো হয়ে গিয়েছি।একে অন্যের বিপদে পাশে না দাঁড়ালে চলবে কেন ? 
প্রশান্তকাকা কিছুটা আশ্বস্ত হন। কিন্তু তার বিপদের উপরে বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে এই মৃত্যু। এভাবে গলায় দড়ি দেওয়া অবস্থায় গরুর মৃত্যু হলে গৃহকর্তাকে পাঁচবাড়ি মুষ্টিভিক্ষা করে এনে সৎকার কর্মীদের মিষ্টি মুখ করানোর পাশাপাশি পাঁচ দিনের মাথায় পুরোহিতের বিধান অনুযায়ী মাথা নেড়া করে গোবর মুখে প্রায়শ্চিত্তের বিধি রয়েছে।সে সব জেনেও গ্রামবাসীদের কথা শুনে  প্রশান্তকাকা বলেন , তোমাদের কথা শুনে বড়ো বল ভরসা পেলাম। খুব দুশ্চিন্তায় পড়েছিলাম।
জীতেনকাকা বলেন , আর দুশ্চিন্তা করতে হবে না। এখানেও আর সবার থাকার দরকার নেই। আমি আর কয়েকজন গরু দুটোকে সৎকারের ব্যবস্থা করি। বাকিরা সবাই মাচানতলায় চলে যাক। তার আগে প্রশান্তদা পাঁচবাড়ি থেকে মুষ্ঠি ভিক্ষাটা বরং নিয়ে আসুক। 
প্রিয় প্রশান্তকাকাকে নিয়ে গিয়ে গ্রামের পাঁচ বাড়ি থেকে মুষ্ঠিভিক্ষা সংগ্রহ করে আনে। তারপর দশজনকে রেখে বাকিরা মাচানতলা অভিমুখে রওনা দেয়। প্রশান্তকাকাও আসতে চেয়েছিলেন। প্রিয়ই জোর করে তাকে রেখে এসেছে।মাচানতলার কাজ মিটলে তারাও প্রশান্তকাকার বাড়িতেই চলে আসবে। কাজের লোক দু'জায়গায় ভাগ হয়ে যাওয়ায় আজ মিড-ডে-মিল সহ অন্যান্য কাজ সামলাতে একটু সমস্যা হবে। কিন্তু কিছু করারও নেই। দশ জনের কমে দুটি গরুর সৎকার সম্ভবও নয়। আগে গরু-ছাগল মারা গেলে গ্রামের বাইরে ভাগাড়ে ফেলে দিয়ে আসা হত। চিল শকুনে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেত। অনেক সময় চামড়া ব্যবসায়ীরা রাতের অন্ধকারে ওইসব মৃত গবাদি পশুর চামড়া ছাড়িয়ে নিয়ে চলে যেত। কখনও কখনও হাড়ও।  আস্ত চামড়া ছাড়ানো গরু-ছাগল বীভৎস দেখাত। চাষিরা গরুকে দেবতা জ্ঞান করে। তাই তাদের মৃত্যুর পর মৃতদেহের ওই অধোগতি চাষিদের মনে রেখাপাত করে। ঠিক হয় ভাগাড়ে ফেলার পরিবর্তে গবাদি পশুর মৃতদেহ গর্ত করে পুঁতে দেওয়া হবে। তারপর থেকেই রাস্তার মাঝখানে মৃত গবাদি পশু পোঁতার চল শুরু হয়। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই প্রিয় বরাবর দেখে আসছে রাস্তার মাঝখানেই চৌবাচ্চার আকারে ৭/৮ ফুট গর্ত করে গবাদি পশুর মৃতদেহ পোঁতা হয়। তারপর উপরে ভেজা মাটি আর কাঁটা বিছিয়ে দেওয়া হয়। মাটি শুকিয়ে গেলে কাঁটা সরিয়ে দিয়ে তার উপর দিয়েই শুরু হয় চলাচল। রাস্তার মাঝেই কেন এভাবে গবাদি পশুর মৃতদেহ পোঁতা হয় তা নিয়ে খুব কৌতুহল ছিল প্রিয়র।সে একবার মহাদেব আচার্যের কাছে কারণটা জানতেও চেয়েছিল। আচার্য মশাই তাদের গ্রামে পুজো পাঠ করেন। গলায় দড়ি বাঁধা অবস্থায় গরুর মৃত্যু হলে প্রায়শ্চিত্তের বিধান দেন। তার প্রশ্ন শুনে আচার্য মশাই বলেছিলেন , এর নিদ্দিষ্ট কোন কারণ বলা সম্ভব নয় বাবা।তবে আমার ধারণা দুটি কারণে এমনটা করা হয়ে থাকতে পারে। একটা কারণ হচ্ছে , গরুর হাড় আমাদের বাড়ি বা লোকালয়ে অশুভ বিবেচনা করা হয়। সেই হিসাবে অন্য জায়গায় পোঁতা হলে পরবর্তীকালে বাড়ি তৈরি বা অন্য কোন কারণে খোঁড়াখুঁড়ির ফলে হাড় উঠে আসার আশঙ্কা থাকে। কিন্তু রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করার সম্ভাবনা অনেক কম। তাই হাড় বের হয়ে পড়ার আশঙ্কাও কম। দ্বিতীয় কারণটি হল , একটি প্রচলিত বিশ্বাস।বংশ পরম্পরা ধরে আমাদের প্রচলিত বিশ্বাসই হল , মনুষ্য পদধুলিতে গোজন্ম খালাস হয়। গরুর জীবন খুব কষ্টের। তাই মনুষ্য পদধুলির স্পর্শে আর যাতে তাকে গরু হয়েই জন্মাতে না হয় তার জন্যই রাস্তার মাঝে তার মৃতদেহ পোঁতা হয়। সেই মৃতদেহের উপর হেটে যাওয়ার সময় মানুষের পদধুলিতে তাদের প্রিয় গবাদি পশুটি যেন অধিকতর উন্নততর জীব হয়ে জন্মলাভ করতে পারে সেই প্রার্থনা করে সবাই। আচার্য মশাইয়ের ব্যাখ্যাটা আজও মনে আছে প্রিয়র।


                              
                                        প্রায়শচিত্তের বিধান আনতে প্রশান্তকাকাকে নিয়ে সেই আচার্য মশায়ের কাছে ২/৩ দিনের মধ্যে যেতে হবে তাদের। সেই কথা ভাবতে ভাবতেই প্রিয় মাচানতলায় পৌঁছোয়। ততক্ষণে ছেলেমেয়েরা আসতে শুরু করে দিয়েছে। মহিলারাও মিড-ডে-মিল রান্নার তোড়জোড় শুরু করেছেন। প্রিয়রাও ক্লাস শুরুর উদ্যোগ নেয়। সবই ঠিক আছে , কিন্তু সবার মন যেন আজ বড়ো ভারাক্রান্ত। অত বড়ো বড়ো দুটো বলদের মৃত্যু কিছুতেই যেন মন থেকে মুছে ফেলতে পারছেন না কেউ। আর্থিক ক্ষতির চেয়েও যেন প্রিয়জন হারানোর মতো বিয়োগ ব্যাথা সবাইকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। প্রিয়র কেবলই অতসীকাকীর কান্না , প্রশান্তকাকার দুশ্চিন্তাগ্রস্থ মুখ মনে পড়ে যাচ্ছিল। কিছুতেই সে পড়ানোয় মনোযোগ দিতে পারছিল না।তাই সে রেখাকে ডেকে তার ক্লাসটা নিতে বলে। সেদিন প্রশান্তকাকার জায়গায় অনুভাকে একটা ক্লাসের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এবারে রেখা আর অনুভা উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে। পড়ানোর দায়িত্ব পেয়ে তারা খুব খুশী। তার পরেও দুশ্চিন্তা পিছু ছাড়ে না প্রিয়র। টিফিনের সময় অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পরও স্কুল বোর্ডের চেয়ারম্যান এমনকি সাংবাদিকদেরও দেখা নেই। তাহলে তাদের পরবর্তী কর্মপদ্ধতি কি হবে সে ভেবে উঠতে পারে না। গ্রামের এই পরিস্থিতিতে আর স্কুল চালানো হবে কিনা সেটা নিয়ে আলোচনায় বসা দরকার। কিন্তু প্রশান্তকাকার ওদিকের কাজটা না মিটলে সেটাই বা কি করে সম্ভব হবে ? তাই দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত মন নিয়েই প্রিয় রাস্তার দিকে চেয়ে থাকে।


               (  ক্রমশ ) 



       নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 


শীঘ্রই দেশ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হতে চলেছে আমার তৃতীয় উপন্যাস ------
  
                                  


                       ----০---

        

No comments:

Post a Comment