অন্তরালে
অর্ঘ্য ঘোষ
( ধারাবাহিক উপন্যাস )
সেই সময় কয়েকটা গাড়িকে গ্রামে আসতে দেখে দুশ্চিন্তা দুর হয় তার।গাড়িগুলো এসে মাচানতলার সামনে থামে। প্রথমে গাড়ি থেকে নেমে আসে আর্য। প্রিয় এগিয়ে যায় গাড়ির কাছে। তাকে দেখে আর্য বলে , চেয়ারম্যান সাহেব আমাদের সঙ্গেই আসবেন বললেন , তাই আসতে একটু দেরী হয়ে গেল।
---- উনি কি আপনাদের সঙ্গেই এসেছেন ?
--- হ্যা , ওই তো উনি আসছেন।
প্রিয় চেয়ে দেখে গাড়ি থেকে পাজামা-পাঞ্জাবী পড়া মধ্যবয়স্ক এক ভদ্রলোক নেমে হাত জোড় করে এগিয়ে আসছেন মাচানতলার দিকে। আর তাকে ঘিরে ক্যামেরা তাক করে আসছেন সাংবাদিক-চিত্র - সাংবাদিকেরা। ওই ভদ্রলোকই যে স্কুল বোর্ডের চেয়ারম্যান উত্তম ঘোষ তা বুঝতে আর অসুবিধা হয় না প্রিয়র।সেও হাত জোড় করে নমস্কার করে এগিয়ে যায়। ততক্ষণে মাচানতলায় সমান্তরাল স্কুলের সামনে পৌঁচ্ছে গিয়েছেন তিনি। স্কুলে তখনও ছেলেমেয়েদের পড়াচ্ছিল ঋজুরা। সেটা দেখেই উত্তমবাবু বলেন , আপনাদের দাবির কথা আসতে আসতে সাংবাদিকদের মুখে শুনেছি। দাবির যৌক্তিকতাও অস্বীকার করছি না। জেলাশাসক তো নিজেই সব দেখে গিয়েছেন। তবুও আমি জেলা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলব। এখন আমার অনুরোধ ছেলেমেয়েদের আপনারা এবার
সরকারি স্কুলে পাঠান।
সেইসময় প্রিয় বলে , স্যার আমাদের একটা দাবি আছে। ---- আবার কি দাবি ?
---- আমাদের এই দাবিপত্রে একটা সাক্ষর করে দিন।
বলে সেদিন জেলাশাসকের স্বাক্ষর করা দাবিপত্রটা সে তুলে দেয় চেয়ারম্যানের হাতে। সেটা দেখে চেয়ারম্যান বলেন, যেখানে জেলাশাসক স্বাক্ষর করেছেন সেখানে আমার সই করা না করা সমান। তবু আপনারা যখন চাইছেন , তখন আপনাদের দাবি মেনে সই করে দিচ্ছি।
বলে কাগজটা সই করে ফিরিয়ে দেন প্রিয়র হাতে। প্রিয় সকলের সঙ্গে আলোচনা করে সরকারি শিক্ষা বয়কট প্রত্যাহারের ঘোষণা করে। তারপর ছেলেমেয়েদের হাত ধরে তারাই পৌঁচ্ছে দেন সরকারি স্কুলে। তাই দেখে হাততালি দেন খোদ চেয়ারম্যানও। চিত্র সাংবাদিকেরা সেই ছবি ক্যামেরা বন্দী করেন। তারপর তার বক্তব্য নেওয়ার জন্য মুখের সামনে বুম এগিয়ে ধরেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে চেয়ারম্যান বলেন - গ্রামবাসীদের ডাক্তার নিয়োগের দাবির যৌক্তিকতা নিয়ে কোন দ্বিমত নেই। কিন্তু
বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলা ছাড়া আমার কিছু করণীয় নেই। তাই আমি জেলা প্রশাসনের কাছে গ্রামবাসীদের দাবির বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করার অনুরোধ জানাব। গ্রামবাসীদের অনেক ধন্যবাদ।ধন্যবাদ আমার অনুরোধে সরকারি শিক্ষা বয়কটের আন্দোলন প্রত্যাহার করার জন্য নয় , বরং আন্দোলন করার জন্য।
সঙ্গে সঙ্গে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন --- আন্দোলন করার জন্য ?
---- ঠিকই শুনেছেন , এক অন্য ধরণের আন্দোলন করার জন্য গ্রামবাসীদের ধন্যবাদ প্রাপ্য।
---- অন্য ধরণের আন্দোলন ?
---- হ্যা , অন্য ধরণের আন্দোলন। সাধারণত দেখা যায় হঠাৎ করে কেউ মাঝ রাস্তায় পথ অবরোধ করে বসেন , ভেবেও দেখেন না যাত্রীদের কি হবে। কিম্বা ছেলেমেয়েরা ঢোকার আগেই স্কুল- কলেজের গেটে তালা ঝুলিয়ে দেন। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার ক্ষতির কথা ভেবেও দেখেন না। কিন্তু এই গ্রামের বাসিন্দারা তা ভেবেছেন। সমান্তরাল পঠনপাঠনের পাশাপাশি মিড-ডে মিলের ব্যবস্থা করেছেন। সবাই যদি এমন করে ভাবতেন তাহলে বোধ হয় সাধারণ মানুষ আন্দোলনের প্রতি এত বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠতেন না।বরং সমর্থনই যোগাতেন।ব্যতিক্রমী ভাবনার জন্য গ্রামের মানুষকে আবারও ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
তার কথা শেষ হতেই গ্রামবাসীরা হাততালিতে ফেটে পড়েন। আর তাই দেখে হাসিমুখে হাত নাড়তে নাড়তে গাড়িতে গিয়ে ওঠেন উত্তমবাবু। তার গাড়ি গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার পথ ধরে। মানুষটাকে ভদ্রলোক বলেই মনে হয় প্রিয়র।উত্তমবাবু চলে যেতেই গ্রামবাসীদের পক্ষে বক্তব্য নেওয়ার জন্য প্রশান্তকাকার খোঁজ করেন সাংবাদিকেরা। প্রিয় তাদের ঘটনার কথা খুলে বলে। কথাটা শুনেই চমকে উঠেন সাংবাদিকেরা। বিস্ময় মিশ্রিত গলায় আর্য জিজ্ঞেস করে -- আজকের দিনেও এই সব ঘটনা ঘটে নাকি ? এসব তো সেই জমিদারি আমলে ঘটত বলে শুনেছি। আক্রোশ মেটাতে এখনও যে মানুষ এত নীচে নামতে পারে তা জানা ছিল না তো !
সাংবাদিকরা সবাই প্রশান্তকাকার বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তারাও মাচানতলার সব কিছু গুছিয়ে রেখে সাংবাদিকদের সঙ্গ নেয়। ঠিক হয় আজ প্রশান্তকাকার বাড়িতেই তাদের পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা হবে।তাছাড়া আজ সবার প্রশান্তকাকার পাশে থাকাটা দরকার। তাহলে পাঁচজনের সঙ্গে পাঁচটা কথা বলে সে শোক ভুলে থাকতে পারবে। সেইজন্য সবাই তারা প্রশান্তকাকার বাড়িতে গিয়ে পৌঁছোয়। জীতেনকাকারাও তখন তাদের কাজ শেষ করে খাওয়া দাওয়া করছে। সাংবাদিকরা গিয়ে প্রশান্তকাকার সঙ্গে কথা বলেন , সান্ত্বনা দেন। তাদের হাত জড়িয়ে ধরে কথা হারিয়ে ফেলেন প্রশান্তকাকা, তার চোখে দেখা যায় জলের আভাস। সাংবাদিকরাও তার পাশে থাকার আশ্বাস দেন। তারপর তাদের কাছে বিদায় নিয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে যান তারা। আর গ্রামবাসীরা প্রশান্তকাকার বাড়ির বৈঠকখানা ঘরে টিভির সামনে ভীড় জমায়।
খবরাখবর টিভিতে তখন তাদের আন্দোলনের খবর পড়তে শুরু করেছেন নিবেদিতা। তিনি বলেন --- ডাক্তারের দাবিতে সরকারি পরিষেবা বয়কটের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে হিংসা ছড়িয়ে পড়ল মনোহরপুর গ্রামে। এদিন রাসায়নিক সার দিয়ে ওই আন্দোলনের এক অন্যতম মুখ প্রশান্ত মন্ডলের দুটি গরুকে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। কিছুদিন আগেই আন্দোলনের আর এক মুখ ঋজু মণ্ডলের পুকুরে বিষ দিয়ে মাছ মারার ঘটনা ঘটেছিল। দুটি ক্ষেত্রেই অভিযোগের আঙুল উঠেছে শাসকদলের বিরুদ্ধে। এই ঘটনায় জনমানসে তীব্র বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতেই কি শাসকদল হিংসার পথ বেছে নিয়েছে ? তবে এই ঘটনার পর গ্রামবাসীরা আরও এককাট্টা হয়ে উঠেছেন। ডাক্তার নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত সরকারি পরিষেবা বয়কটের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা। যদিও এদিন জেলা স্কুল বোর্ডের চেয়ারম্যান উত্তম ঘোষের আশ্বাসে সরকারি শিক্ষা বয়কট প্রত্যাহার করে নেন গ্রামবাসীরা। গতকাল থেকে ছেলেমেয়েদের সরকারি স্কুলে পাঠানো বন্ধ করে সমান্তরাল স্কুল এবং মিড-ডে-মিল চালু করেন তারা। সেই খবর পেয়ে এদিন গ্রামে যান উত্তমবাবু। ডাক্তার নিয়োগের ব্যাপারে তিনি জেলা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলার আশ্বাস দেন।
তারপরই সরকারি শিক্ষা বয়কট প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। তবে সাতদিনের মধ্যে ডাক্তার নিয়োগ না হলে ফের নতুন ভাবে অন্য কোন সরকারি পরিষেবা বয়কট করা হবে বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। এদিকে সরকারি শিক্ষা বয়কট আন্দোলনকে ঘিরে গ্রামবাসীদের ব্যতিক্রমী ভাবনার প্রশংসা করেছেন জেলা স্কুলবোর্ডের চেয়ারম্যান উত্তম ঘোষ। ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন , পথ অবরোধ কিম্বা কোন দফতরে বিক্ষোভ সমাবেশ করার সময় আন্দোলনকারীরা যাত্রী কিম্বা সংশ্লিষ্ট মানুষজনের ক্ষতি কিম্বা ভোগান্তির কথা ভাবেন না। এক্ষেত্রে সরকারি শিক্ষা বয়কটের পাশাপাশি আন্দোলনকারীরা ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার ক্ষতির কথা ভেবে সমান্তরাল পাঠদান এবং মিড-ডে-মিলের ব্যবস্থা করে অনন্য নজির সৃষ্টি করেছেন।খবর এখন এই পর্যন্ত। আপনাদের সঙ্গে আমি নিবেদিতা।
খবর শেষ হতেই আক্ষেপ ঝড়ে পড়ে অতসীকাকীর গলায়। অদুরে গোয়াল চালার দিকে চেয়ে তিনি বলেন -- কাল এতক্ষণ গরু দুটো ওইখানে বাঁধা ছিল। মাড়-ভাত দিয়ে এলাম।
দুটোতেই জিভ বের করে আমার গা চেটে দিল। আজ চালাটা খাঁ খাঁ করছে। মালিকের প্রতি আক্রোশ ওরা অবলা পশুর উপরে মিটিয়ে নিল ! মানুষ যে এতো নিষ্ঠুর হতে পারে তা ভাবতে পারছি না।
অতসীকাকীর আক্ষেপ নাড়িয়ে দেয় প্রিয়কে। গবাদি পশু নয় , যেন কোন প্রিয়জন হারানোর বিয়োগ ব্যাথায় কাতর হয়ে পড়েছেন অতসীকাকী। প্রিয়জনই তো , সেই ছোটবেলা থেকে লালন পালন করেছেন। খাবার খাইয়েছেন , মশা, মাছির উৎপাত থেকে বাঁচাতে ঘুঁটে পুড়িয়ে ধোঁওয়া দিয়েছেন। ভালোবেসে গলায় হাত বুলিয়ে , আদর করেছেন। গরু দুটোও হয়তো আদর খাওয়ার জন্য গলা উঁচু করে তুলে ধরেছে। চলে আসতে চাইলে মুখে করে কাপড়ের আঁচল টেনে ধরেছে। তারপর আদর খাওয়ার জন্য ফের গলা উঁচু করে তুলে ধরেছে। সেইসব স্মৃতি মনে পড়লে মন খারাপ তো হবেই। অনুভূতিপ্রবণ মানুষদের কাছে মন খারাপ খুব সংক্রামক ব্যধির মতো। প্রিয়দেরও খুব মন খারাপ হয়ে যায়। তারাও মন খারাপ নিয়ে যে যার বাড়ি ফেরে।
No comments:
Post a Comment