Short story, Features story,Novel,Poems,Pictures and social activities in Bengali language presented by Arghya Ghosh

অন্তরালে -- ২১






     অন্তরালে 


           অর্ঘ্য ঘোষ 



( ধারাবাহিক উপন্যাস ) 





মায়ের সঙ্গে কথা বলে মনটা কিছুটা হালকা হয় প্রিয়র। মা তাকে সাহস যোগান , সবাই সবার পাশে থাকলে সব ক্ষতিই পুষিয়ে যায় , মায়ের কথা শুনে মনে জোর পায় প্রিয়। কথায় কথায় মা বলেন , কাল ঋজুর বোনের বিয়েতে মধুরিমারা আসবে। নাপিত গিয়ে নাকি কার্ড দিয়ে নিমন্ত্রণ করে এসেছে। প্রিয় শুনে কিছুটা অবাক হয়। বিকালেই তো ঋজুদার সঙ্গে কথা হল।  পুকুরে বিষ দেওয়ার সময়ই ঋজুদার বোনের বিয়েতে ক্লাবের পুকুর থেকে মাছ দেওয়ার কথা হয়েছিল। সেই বিষয়েই ঋজুদার সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা হল। কই তখন তো ওদের বাড়িতে নিমন্ত্রণের কথা কিছু বলল না ঋজুদা। হয়তো বোনের বিয়ের নানান কাজের চিন্তায় মধুরিমাদের নিমন্ত্রণ করার কথাটা বলতে ভুলে গিয়েছে। আসলে সেই প্রচারের সময় সৌরভদের বাড়িতে তো তারা টিফিন করে এসেছিল , হয়তো সেই সৌজন্যের খাতিরেই নিমন্ত্রণ করেছে। কিন্তু কাকে কাকে নিমন্ত্রণ করেছে তা জানতে খুব ইচ্ছে করছে তার। শুধুই কি সৌরভ আর মধুরিমাকে , নাকি গোটা পরিবারকে নিমন্ত্রণ করা হয়েছে ? তাহলে মধুরিমাদের সঙ্গে কি স্বাতীও আসবে? মনটা খুব উশখুশ করে ওঠে তার। ঋজুদার উপর রাগও হয় তার। নিমন্ত্রণের কথাটা তাকে বলবে তো। তাহলেই তো সব জেনে নেওয়া হত। মা'ও যেন কি ?  মধুরিমারা আসবে বলার কি দরকার ছিল ?  তার পরিবর্তে স্বাতীরা আসবে বললেই তো সব পরিস্কার হয়ে যেত। কিন্তু মধুরিমারা আসবে বললে স্বাতীর আসাটা তো নিশ্চিত হয় না।  আর লজ্জার মাথা খেয়ে সেটা মাকে জিজ্ঞেসও করতে পারে না সে। স্বাতীর আসাটা মনে মনে কামনা করে প্রিয়। শেষ পর্যন্ত অবশ্য তার আশাটাই পূর্ণ হয়। সন্ধ্যার মুখে এসে পৌঁছোয় স্বাতীরা। এক পলক স্বাতীকে দেখে চেয়ে থাকতেই ইচ্ছে হয় তার। খুব সুন্দর দেখাচ্ছে স্বাতীকে। কিন্তু বেশিক্ষণ চেয়ে থাকতেও পারে না। আড় চোখে লক্ষ্য করে মধুরিমার চোখ দুটো গোপন ক্যামেরার লেন্সের মতো চেয়ে আছে তার দিকে।তাই সে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। সেটা লক্ষ্য করেই মধুরিমা বলে, কি রে কখন বেরোবি? একটু সাজুগুজি করবি না ? 
---- না , না আমার তোমাদের মতো সাজুগুজু না করলেও চলবে।
---- তোমাদের মতো মানে আর কে রে ?
মধুরিমার কথায় লজ্জায় মুখ নামিয়ে নেয় স্বাতী। প্রিয়ও লজ্জায় পড়ে। সে বলে , জানি না যা।
বলে জামা প্যাণ্ট বদলাতে ঘরে ঢুকে যায় প্রিয়। আর বেরনোর আগে শেষ রূপটান দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে মধুরিমারা। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যেই বেরিয়ে পড়ে তারা। বিয়েবাড়ির আলোয় আরও সুন্দর দেখায় স্বাতীকে। সানাইয়ের সুরে উদাস হয়ে যায় প্রিয়র মন। টিফিন খাওয়ার পর সৌরভ আর মধুরিমা ঋজুর বোন রীতার আর তার বান্ধবীদের সঙ্গে গল্পগুজবে মেতে ওঠে। সেই সুযোগে স্বাতীকে চোখের ইশারায় ডেকে নিয়ে চুপিসারে বিয়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসে প্রিয়। দু'জনে নির্জন রাইভবাণী দীঘির বাঁধানো ঘাটে গিয়ে বসে। চন্দ্রকিরণ  দীঘির জলে প্রতিফলিত হয়ে আরও মায়াময় করে তোলে স্বাতীর মুখ। চাঁদের আলোয় খসে পড়া নক্ষত্রের মতো লাগে স্বাতীর নাকের নোলক।তার হাত দুটি নিজের হাতে তুলে নিয়ে সেই মুখের দিকে অপলকে চেয়ে থাকে প্রিয়। স্বাতীও মুখ তুলে পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে চায়। তার কাজল কালো দীঘল চোখে যেন দীঘির অতল জলের আহ্বান।সেই আহ্বানেই প্রিয়র ঠোঁট নেমে আসে স্বাতীর ঠোঁটে। থরো থরো কেঁপে উঠে স্বাতী , প্রিয়র গলা জড়িয়ে ধরে সেও তার ঠোঁটে ছোঁওয়ায় নিজের ঠোঁট। এক ঘোরলাগা আবেশে স্বাতীকে নিজের বুকে টেনে নেয় প্রিয়। নির্জন দীঘির পাড়ে কেটে যায় কথাহীন সময়। একসময় স্বাতী মুখ তুলে বলে -- ফিরবে না ? 
---- ইচ্ছা করছে না।
---- তাই ?
---- ইচ্ছে করছে এভাবেই তোমায় জড়িয়ে বসে থাকি অনন্তকাল।
---- সে তো আমারও করছে। কিন্তু মশাই এরপর বসে থাকলে সবাই খোঁজাখুঁজি শুরু করে দেবে। তখন দু'জনকে একসঙ্গে দেখলে লজ্জার শেষ থাকবে না। এমনিতেই বৌদি যা বোঝার বুঝে যাবে , কিন্তু বাকিরাও সন্দেহের চোখে তাকালে আমি যে মুখ দেখাতে পারব না। 
অগত্যা হাত ধরাধরি করে জ্যোৎস্না মাড়িয়ে বিয়ে বাড়ির দিকে এগিয়ে যায় তারা। স্বাতীর পায়ের নুপুরের রুনুঝুনু শব্দ আবেশে ভরায়  নির্জন পথ। অনাস্বাদিত এক ভালো লাগায় ভরে যায় দুটি মন। সেই ভালো লাগা তাদের ঘিরে থাকে অনুক্ষণ।সেই ভালো লাগা প্রিয়কে নতুন  করে  কাজের প্রেরণা যোগায়। টেনিং আর আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচী নির্ধারণে মনোনিবেশ করে সে। দেখতে দেখতে জেলাশাসকের মতোই পেরিয়ে যায় স্কুল বোর্ডের চেয়ারম্যানের প্রতিশ্রুতির সাতটা দিন। কিন্তু ডাক্তার আসে না। তাই আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচি ঠিক করতেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে। 



                                        তারই মাঝে একদিন ট্রেনিং-এ যাওয়ার পথে দেখা করে আসে সুশোভনবাবুর সঙ্গে। তাকে দেখেই সহাস্যে তিনি বলেন  - আরে তোমরা তো কামাল করে দিয়েছো। তোমাদের ওই সমান্তরাল স্কুল আর মিড-ডে- মিলের ব্যাপারটা তো এখন জেলা সদরে সবার মুখে মুখে ফিরছে। সেদিন আমাদের ডাক্তার মহলেও উঠেছিল কথাটা। সবাই তোমাদের ভাবনার প্রশংসাই করেছেন। আচ্ছা ভাবনাটা কি তোমার মাথা থেকেই বেরিয়েছিল ?
সহসা প্রিয় কোন জবাব দিতে পারে না।চিন্তা ভাবনাটা তার হলেও সেটা বললেই তো ডাক্তারবাবু তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠবেন। সামনাসামনি নিজের প্রশংসা শোনা খুব অস্বস্তির ব্যাপার। তাই সে চুপ করেই থাকে।তাকে চুপ করে থাকতে দেখেই ডাক্তারবাবু বলেন , ও নিজে মুখে নিজের কৃতিত্বের কথা বলতে চাও না তাই তো ?  তোমাকে বলতে হবে না। আমি আন্দাজই করেছিলাম এ তোমারই মস্তিক প্রসূত।তা পরবর্তী কর্মসূচি কিছু ঠিক করেছো ?
সে বলে , না ডাক্তারবাবু। এখনও কিছু ভাবা হয়নি। আসলে এই ক'টা দিন দুটো শিফটে ট্রেনিং নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম তো তাই চিন্তাভাবনা করার ফুরসৎ পাই নি।
--- তাও বটে। ট্রেনিংটা যত্ন করে নাও। ট্রেনিংটা হয়ে গেলে সরকারি চাকরির পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাতেও কাজের সুযোগ পাবে। 
ডাক্তারবাবুর কথা শুনে মনটা খুশীতে ভরে ওঠে প্রিয়র।একটা চাকরি হলেই স্বাতীকে নিজের করে পাবে সে। সেই কথা ভেবেই ভালো লাগায় ভরে যায় তার মন। মনে পড়ে যায় সেদিনের সেই চন্দ্রালোক শোভিত নির্জন দীঘির বাঁধানো ঘাটের কথা। আর আশ্চর্যজনক ভাবেই সেইসব কথা ভাবতে ভাবতেই তার মাথায় খেলে যায় আন্দোলনের পরবর্তী পদক্ষেপের কথা। গ্রামে ফিরে সেটাই সে গ্রামবাসীদের কাছে তুলে ধরে। আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচি ঠিক করতে সেদিন মাচানতলায় মিটিং ডাকা হয়েছিল। সভাপতি হিসাবে হাজির ছিল প্রশান্তকাকাও। ততদিনে গরু হারানোর শোক কিছুটা সামলে উঠেছে সে। এ সময় সবারই মাঠ থেকে ধান ঘরে তোলার চাপ রয়েছে।তা স্বত্ত্বেও গ্রামবাসীরা পালা করে গরু দিয়ে মাঠ থেকে প্রশান্তকাকার ধান ঘরে তুলে দিয়েছে। প্রিয়দের গরু দিয়েও একদিন পল মাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। গ্রামবাসীদের এই সহযোগিতাই প্রশান্তকাকাকে শোক ভুলতে সাহার্য করেছে। সেটা তার কথা থেকেই বুঝতে পারে প্রিয়। তাকে উদ্দেশ্য করেই প্রশান্তকাকা প্রশ্নটা ছুড়ে দেন -- সাতদিন তো হয়ে গেল। চেয়ারম্যান সাহেবের প্রতিশ্রুতিতেও ডাক্তার এল না। এরপর তাহলে আমরা কি করব ?  আমাদের আন্দোলন কি এখানেই থেমে যাবে ?
জবাবে প্রিয় বলে , থামবে কেন ? ডাক্তার না আসা পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে।
--- কিন্তু এরপর আর কি সরকারি পরিষেবা বয়কট করার আছে আমাদের ? 
--- আমি আরও দু'টি সরকারি পরিষেবা বয়কটের কথা ভেবেছি। যদি সবার মত হয় ,  তাহলে সেই বিষয় দুটির পথে এগোনো যেতে পারে।
---- কি সেই পথ ? 
---- একটা হল রেশন বয়কট , অন্যটা সরকারী টিউবওয়েলের জল বয়কট।
--- কিন্তু এই দু'টি পরিষেবা কি আমরা বয়কট করতে পারব ?  
-- পোলিও আর শিক্ষার মতো এই দুটি সরকারি পরিষেবা বয়কট অতটা জোরদার এবং সহজ হবে না তা ঠিক। তাই এই দুটি ক্ষেত্রে আমাদের একটু কৌশলের আশ্রয় নিতে হবে।
--- মানে ? 
---- মানেটা খুব সহজ। আমাদের গ্রামের বেশিরভাগ মানুষের পক্ষে বেশিদিন কেন , এক সপ্তাহও রেশন বয়কট করা সম্ভব নয়।
---- তাহলে ? 
---- আমাদের সেই পদ্ধতিটা অবলম্বন করতে হবে।" সাপ মরবে অথচ লাঠিও ভাঙবে না।" 
---- সেটা কি করে সম্ভব হবে ?
---- এখানে সপ্তাহে তিনদিন রেশন দেয়। কেউ তুলতে না পারলে পরের সপ্তাহেও দেয়। কালই তো রেশন দেওয়া শুরু হবে। আমরা যদি কাল পরশু রেশন না তুলি তাহলে সংবাদ মাধ্যমের দৌলতে সেই বয়কটের কথা সবাই জেনে যাবে। তাতেই আমাদের কাজ হয়ে যাবে। আমাদের তো ধারাবাহিক ভাবে সরকারি পরিষেবা বয়কটের খবরটা সর্বস্তরে পৌঁচ্ছে দেওয়াই মুল উদ্দেশ্য। তাহলে তিনদিনের মাথায় কিম্বা পরের সপ্তাহে রেশন সামগ্রী তুলে নিলেই হবে। এজন্য রেশন ডিলার উত্তম ঘোষের সঙ্গে আগে থেকে একটু কথা বলে রাখতে হবে।





                     যুক্তিটা মনোপুত হয় উপস্থিত গ্রামবাসীদের। তাদের মধ্যে থেকে জীতেনকাকা বলেন ,  তোমার পরবর্তী পদক্ষেপের কথাটাও একটু বলো শুনি।
---- রেশন বয়কটেও কোন কাজ না হলে তখন আমরা সরকারি টিউবওয়েল থেকে পানীয় জল নেওয়া বয়কট করব।
---- সেটা কি করে সম্ভব হবে ? আমাদের গ্রামে তো প্রসাদ মোড়লের ছাড়া আর কারও বাড়িতে টিউবওয়েল নেই। ওর  চ্যালাচামুণ্ডারা সরকারি কল থেকে জল নিতে আসে না। প্রসাদ মোড়লের কল থেকেই জল নেয়। কিন্তু আমরা তো আর তা পারব না।তাহলে দিনের পর দিন জল নেওয়া বন্ধ রাখলে যে ছেলেপুলে নিয়ে শুকিয়ে মরতে হবে।কথায় আছে জলই জীবন।
---  প্রথমেই কেন সবাই ধরে নিচ্ছেন আমাদের অনন্তকাল সরকারি কলের জল না খেয়ে থাকতে হবে ? তেমন হলে নিজেরাই বয়কট প্রত্যাহার করে নেব। কিন্তু ২/৩ দিন তো আমরা বয়কট চালাতেই পারি।
---- অসম্ভব। একবেলা খেতে না পেলেও চলবে। কিন্তু জল না পেলে একঘন্টাও চলবে না। বিশেষত ছেলেমেয়েদের তো চলবেই না।
---- জল না খেয়ে থাকতে কে বলেছে আপনাদের ? 
----- সেক্ষেত্রে তো পুকুরের জল খেতে হয়। তাহলে তো দেখতে হবে না। কিসে থেকে কি রোগ বেঁধে যাবে তার ঠিক আছে ?
--- আরে না না , পুকুরের জল খেতে হবে কেন ?
--- তবে ? 
--- বয়কটের সময় সরকারি কল থেকে জল না নিলেই হোল। তার আগে আমরা যদি যার বাড়িতে যত পাত্র আছে , এমন কি ক্লাবের বড় বড় ড্রাম , রান্নার পাত্রগুলোতে জল ধরে রাখি তাহলেই আমাদের ৩/৪ দিন চলে যাবে। তারমধ্যেই আমরা পানীয় জল বয়কটের খবর পৌঁচ্ছে দিতে পারব সবার কাছে।
প্রিয়র কথা শেষ হতেই প্রশান্তকাকা বলে ওঠে  -- সাবাস। সাংবাদিকদের সঙ্গে ওঠা বসা করতে করতে দেখছি তোমার মাথাটাও ওদের মতোই খেলতে শুরু করেছে।
সেই মতো শুরু হয়ে যায় পরবর্তী আন্দোলনের প্রস্তুতি।


         ( ক্রমশ ) 




       নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 


শীঘ্রই দেশ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হতে চলেছে আমার তৃতীয় উপন্যাস ------
  
                                  


                       ----০---

        


No comments:

Post a Comment