অন্তরালে
অর্ঘ্য ঘোষ
( ধারাবাহিক উপন্যাস )
পাড়া একটু নিশুতি হতেই 'জীবন সুরক্ষা' কমিটির কয়েকজন সদস্যকে চুপিচুপি প্রসাদকাকদের গতিবিধি লক্ষ্য করে আসার জন্য মোড়লপাড়া পাঠানো হয়। তারা ফিরে এসে খবর দেয় প্রসাদকাকা আর তার অনুগামীরা সব ঘুমিয়ে পড়েছে। সারা পাড়া সুনসান। কেউ কোথাও নেই। ততক্ষণে টিউবওয়েলের কিঁচকাঁচ শব্দ যাতে ছড়িয়ে না তার জন্য বিভিন্ন জায়গায় গ্রীজ আর মোবিল লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারপরই শুরু হয়ে যায় নিঃশব্দে জল সংগ্রহের কাজ। সবার বাড়ি থেকে নিয়ে আসা হয় ছোট ছোট বালতি। মানব শৃঙ্খল তৈরি করে সেইসব বালতিতে প্রতিটি বাড়িতে হাতে হাতে পৌঁছে যায় জল। ওইভাবে জল সংগ্রহের লাইনে দাঁড়িয়ে স্কুলবেলার কথা মনে পড়ে যায় প্রিয়র। তখন স্কুলে কোন টিউবওয়েল ছিল না। স্কুল শুরু হওয়ার আগে এভাবেই তাদের একটা বড় পাত্রে খাওয়ার জল সংরক্ষণ করে রাখতে হত। স্কুলের ফুলবাগানেও এভাবেই জল দেওয়া হত। তবে সেই জল তাদের বইতে হত না। গ্রামের লোকেরাই নিজেদের কাজের ফাঁকে ফাঁকে গাছের পরিচর্যার পাশাপাশি এভাবেই পুকুর থেকে জল দিয়ে যেন।সেই দিন গুলো আস্তে আস্তে কোথায় যেন হারিয়ে গেল। স্কুল জীবনের কথায় অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল প্রিয়।
জীতেনকাকার তাড়া খেয়ে সম্বিৎ ফেরে তারা। দ্রুত কাজে মন দেয় সে। ওইভাবে একসময় যেখানে যত পাত্র ছিল সে সব তো বটেই, প্রশান্তকাকার বাড়িতে গ্রামের গুড় তৈরির দুটো বড় বড় লোহার কড়াইয়েও জল ভরে নেওয়া হয়। সমস্ত পাত্র ঢেকে দেওয়া হয় পরিস্কার কাপড় দিয়ে। হিসাব করে দেখা যায় সংগৃহিত জলে প্রায় সাতদিন চলে যাবে। তারপরই টিউবওয়েলটি বস্তা জড়িয়ে দড়ি দিয়ে ভালো করে বেঁধে দেওয়া হয়। আর তার মাথায় লাঠি দিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় পানীয় জল বয়কটের পোস্টার। সমস্ত কাজ শেষ করতে করতেই ভোরের আলো ফুটে ওঠে। তাই দেখে প্রশান্তকাকা বলেন , এখন আর বাড়ি গিয়েই বা কি হবে ? তার থেকে চলো সবাই ক্লাবে গিয়ে চা করে খায়। তারপর সকাল হলে বাড়ি যাওয়া যাবে। কিন্তু চা- চিনি - দুধ কোথাই পাওয়া যাবে ? চা খাওয়ার কোপটেও তো আর নেই। সেই পোলিও বয়কটের সময় থেকেই তো চা - চিনি- যা বেঁচেছিল তা সমান্তরাল স্কুল চালানোর সময় শেষ হয়ে গিয়েছে। সমস্যার কথা শুনে ঋজু বলে , কোন চিন্তা নেই। বোনের বিয়ের চা-চিনি-কোপটে সবই বেঁচে আছে। এক্ষুনি নিয়ে আসছি।
বলেই রাজুকে নিয়ে বাড়ির দিকে ছোটে ঋজু। আর সবাই পৌঁছোয় মাচানতলায়। তারই মধ্যে চা-চিনি আর কোপটে নিয়ে ফিরে আসে ঋজুরা। দুধ পায় নি বলে কয়েকটা লেবু আর বিট নুন নিয়ে এসেছে ওরা। তা দেখে সবাই বলে , বাহ্ বাসি মুখে লেবু চা খুব ভালো লাগাবে।তাড়াতাড়ি বানিয়ে ফেল। জীতেনকাকা আর রাজু ক্লাবঘরে চা করতে চলে যায়। মাঝে ঋজুদার মোবাইল ফোন থেকে আর্যদাকে তাদের পানীয় জল বয়কটের কথাটা জানিয়ে দেয় প্রিয়। তাদের সিদ্ধান্তের কথা শুনে সন্তোষ প্রকাশ করলেও সংশয় প্রকাশ করেন আর্যদা। তিনি জিজ্ঞাসা করেন , তাহলে কি সবাই পুকুরের জল খাবে ?
প্রিয় বলে , না না। সে অন্য ব্যবস্থা করা হয়েছে।
তারপর তাদের জল ধরে রাখার কথাটা জানায় তাকে। সব শুনে আর্যদা বলেন , এ কথাটা সবাইকে জানালে চলবে না। তাহলে প্রশাসন ব্যাপারটিকে কোন গুরুত্বই দেবে না। বরং সংবাদমাধ্যম গ্রামে পৌঁছোনোর সময় মহিলাদের যেন পুকুরঘাট থেকে জল আনতে দেখা যায়। আর সবাই যেন সংবাদ মাধ্যমের কাছে পুকুরের জল খাওয়ার কথাই বলেন। সেই সময় পুকুরে কাপড় কাচা , বাসন ধোওয়া আর গরু মোষকে স্নান করানো হলে আরও ভালো হয়।
আর্যদার কথা শুনে চমকিত হয়ে যায় প্রিয়। সত্যিই তো শুধু সরকারি কলের জল বয়কট করে পুকুরের দুষিত জল খাওয়ার কথা ছড়িয়ে পড়লে প্রশাসন চাপে পড়ে যাবে। ঋজুদাকে ফোনটা ফিরিয়ে দিয়ে সে অন্যান্যদের চুপিচুপি আর্যদার কথাটা খুলে বলে। শুনে প্রশান্তকাকা বলেন , এই দিকটা তো আমরা ভেবে দেখি নি। তাহলে তো সবাইকে দ্রুত বাড়ি ফিরে দিয়ে মহিলাদের সব শিখিয়ে পড়িয়ে দিতে হবে। বাকি ব্যবস্থাগুলোও ঠিক করে রাখতে হবে।
সবাই বলেন , ঠিক কথা। চলো চা খেয়েই সবাই তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যায়। তারপর সাংবাদিকরা আসার আগে আবার চলে আসব।
কেউ কেউ বলেন , বাকি ব্যবস্থা আর কি ? পুকুর ঘাটে তো কাচাকাচি, গরু-মোষ স্নান করানো এমনিতেই চলে। আজ সাংবাদিকদের সামনেই না হয় সেটা করতে হবে।
কেউ কেউ প্রশ্ন তোলেন, সংবাদিকরা কতক্ষণ থাকবেন , তাদের খাওয়া-দাওয়ার কি হবে কিছু ঠিক করতে হবে না ?
সেই কথা শুনে ঋজু বলে , সাংবাদিকদের তো আপ্যায়ণের ব্যবস্থা করতেই হবে। তার জন্য খরচপাতি আছে। কিন্তু আমাদের কাছে সামান্য কয়েকটি টাকা পড়ে আছে মাত্র। এখনই কিছু টাকা-পয়সা না হলেই চলবে না।
প্রিয় বলে , আর্যদা বলে দিয়েছেন আজ অবশ্য সাংবাদিকরা বেশিক্ষণ থাকবেন না। ছবি-টবি করেই চলে যাবেন। তাই চা-বিস্কুটের ব্যবস্থা করলেই হয়ে যাবে।
তারপরেই তার মনে পড়ে যায় বেশ কয়েকদিন হয়ে গেল গ্রাম কমিটির টাকাটা তো আজও পাওয়া যায় নি। তাই সে প্রশান্তকাকাকে জিজ্ঞেস করে , আচ্ছা প্রসাদকাকার টাকা আর হিসাব দেওয়ার দিন পেরিয়ে গেল না ? আজ তাকে টাকা আর হিসাবটা চাইলে কেমন হয় ?
--- আজ চাপ দিয়ে ওর কাছে টাকা আর হিসাব আদায় করতেই হবে। বাড়ি থেকে ফিরেই ওর কাছে যাব সবাই দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন প্রশান্তকাকা। সেই সময় চা নিয়ে আসেন জীতেনকাকারা। চা খেতে খেতে তারা মাচানতলা থেকেই দেখতে পায় প্রসাদ মোড়লের অনুগামীরা মাঝে মধ্যে সরকারি কলের কাছে এসে উঁকিঝুঁকি মেরে চলে যাচ্ছে।আর একে একে প্রসাদ মোড়লের বাড়িতে গিয়ে জড়ো হচ্ছে।
প্রসাদ মোড়লদের অনুগামীদের অবশ্য কেউই সরকারি কলে জল নিতে বারণ করে নি , কিন্তু কেউই কলের বাঁধন খুলে জল নেওয়ার সাহস দেখায় না।বরং হাওয়ায় মন্তব্য ভাসিয়ে দেয় , এবার নিজেদের কাটা খালে ওদের ডুবে মরতে হবে। এতো বাবা পোলি কিম্বা স্কুল বয়কটের ব্যাপার নয়। থাক না দেখি কতদিন জল না খেয়ে থাকতে পারিস। এবার আর প্রশাসনের লোক মান ভাঙাতে আসবে বলে মনে হয় না। আমাদের আর কি ? প্রসাদ মোড়লের কল তো রয়েছে। বেশিরভাগ সময় তো আমরা সেখান থেকেই জল নিতাম , এখনও নেব।
ওই টিপন্নী শুনে মনে মনে হাসে প্রিয়রা। তাদের জল সংগ্রহ করে রাখার বিষয়টা যে ওরা কেউ টের পায় নি তা ওদের ছুড়ে দেওয়া টিপ্পনী থেকেই পরিস্কার হয়ে যায়।চা খাওয়া হতেই সবাই বাড়ি থেকে ঘুরে আসার উপক্রম করে। কিন্তু প্রশান্তকাকা বলেন , উহু সবাই চলে গেলে হবে না। প্রসাদ মোড়ল চলে গেলে আজ আর টাকাটা আদায় করা হবে না। পাঁচজন এখানে থাক। ও বেরিয়ে গেলেই ওকে আটকে আমাদের খবর দেবে। তারপর আমরা ফিরলে ওরা যাবে।
সেই মতো পাঁচজনকে রেখে যে যার বাড়ি ফিরে যায়। কিন্তু বাড়িতে গিয়ে কারও মন টেকে না। মাচানতলা যেন সবাইকে টানতে থাকে। তাই দ্রুত প্রাত্যহিক কর্ম সেরে মহিলাদের কি করতে হবে তা ভালোভাবে শিখিয়ে পড়িয়ে দেন পুরুষেরা। তারপরই ফের সবাই হাজির হন মাচানতলায়। ঠিক হয় যেটুকু টাকা আছে তাই দিয়েই সাংবাদিক আর আন্দোলনকারীদের জন্য মুড়ি আর আলুর দমের ব্যবস্থা করা হবে। সেই মতো কয়েক জন তার যোগাড়ে লেগে যায়।
বাকিরা প্রসাদ মোড়লের বাড়ি অভিমুখে রওনা দেয়।কিন্তু একসঙ্গে এত লোককে তাদের বাড়ি অভিমুখে আসতে দেখেই মুখের উপরে দরজা বন্ধ করে দেয় প্রসাদ মোড়লের স্ত্রী পূর্ণিমা।কিন্তু প্রিয়রা গিয়ে ঘন ঘন দরজার কড়া নাড়তে থাকে। শেষ পর্যন্ত দরজা খুলে বাইরে আসতে বাধ্য হন প্রসাদ মোড়লের স্ত্রী। বাইরে বেরিয়েই তীব্র ঝাঁঝের সঙ্গে বলেন -- ধাক্কা দিতে দিতে দরজাটা কি শেষ পর্যন্ত ভেঙে ফেলবে নাকি ? কি চাই কি তোমাদের ?
প্রিয় সামনে গিয়ে বলে -- আমরা প্রসাদকাকাকে চাই।
---- কেন সাত সকালে তাকে কি দরকার শুনি ?
---- সেটা আপনাকে বলে কি কোন লাভ হবে ?
---- শুনিই না আগে।
---- প্রসাদকাকার কাছে গ্রাম কমিটির টাকা জমা আছে। হিসাব সহ সেই টাকা দেওয়ার দিন পেরিয়ে গিয়েছে। তাই আজ আমাদের হিসাব সহ টাকা চাই।
---- আজ চাই বলতেই তো আর হবে না। ও তো বাড়িতেই নেই। বাড়ি ফিরলে বরং আমি তোমাদের কথা বলে দেব।
---- কেন মিথ্যা কথা বলছেন ? আমরা সকাল থেকেই আপনাদের বাড়িতে নজর রেখেছি। প্রসাদকাকা বাইরে যায় নি বাড়িতেই কোথাও লুকিয়ে রয়েছেন।
--- আমার কথা বিশ্বাস না করলে তো কিছু বলার নেই। তাহলে তোমরা যা ভালো বোঝ কর।
---- বেশ তাহলে বরং আমরা প্রসাদকাকার ফেরার অপেক্ষায় এখানেই বসে থাকি।
বলেই প্রিয়রা বাড়ির উঠোনে বসে পড়ে। আর সেটা দেখে যথেষ্ট বিড়ম্বনায় পড়তে হয় প্রসাদ মোড়লের স্ত্রীকে।
বাড়ির কাজকর্ম সব পড়ে রয়েছে। তার উপরে মানুষটা উপরে ঢুকে রয়েছে , এই অবস্থায় লোকগুলো যদি মাটি কামড়ে এভাবে পড়ে থাকে তাহলে খুব সমস্যা হবে। অগত্যা একসময় উপরে উঠে যান তিনি। কিছুক্ষণ পরেই একটা খাতা আর পাঁচ
হাজার টাকা এনে প্রিয়র হাতে তুলে দেন প্রতিভা। প্রিয় টাকা ক'টা গুনে ঋজুর হাতে তুলে দিয়ে বলে , এই যে বললেন প্রসাদকাকা বাড়িতে নেই। তাহলে এইসব আপনি কোথাই পেলেন ?
--- উনি রেখে গিয়েছিলেন। তাছাড়া কোথাই পেলাম তা জেনে তোমাদের লাভ কি ? তোমাদের যা চাওয়ার ছিল তা পেয়েই গেছ। এখন মানে মানে বিদায় হও তো দেখি।
---- সে না হয় বিদায় আমরা আজকের মতো হচ্ছি। কিন্তু প্রসাদকাকাকে বলে দেবেন হিসাব না মিললে আবার কিন্তু আমরা এসে এভাবে ধর্নায় বসব।
তারপর প্রসাদকাকার স্ত্রীকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মাচানতলায় ফেরে তারা। সেই সময় ঋজুর মোবাইলটা বেজে ওঠে।
( ক্রমশ )
No comments:
Post a Comment