Short story, Features story,Novel,Poems,Pictures and social activities in Bengali language presented by Arghya Ghosh

অন্তরালে -- ২৩



     
     অন্তরালে 



            অর্ঘ্য ঘোষ 



 ( ধারাবাহিক উপন্যাস ) 





ফোনটা রিসিভ করে ' আর্যদার ' বলে সেটা প্রিয়র হাতে তুলে দেয় ঋজু। প্রিয় কিছুক্ষণ কথা বলে ফোনটা ফিরিয়ে দিয়ে বলে - সাংবাদিকরা কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁচ্ছে যাবেন। বি,ডি,ও সাহেবও নাকি আসতে পারেন।সকালের কথা মতো সব ব্যবস্থা করে রাখতে বললেন। সেই কথা শোনার পরই কয়েকজন বাড়ির দিকে হাঁটা লাগায়। আর তার কিছুক্ষণ পরই ভানুমতীজ্যেঠি আর সুরোপিসিকে ময়লা কাপড়-চোপড় নিয়ে পুকুরঘাটের দিকে যেতে দেখা যায়। হালের বলদ জোড়াকে ডাকিয়ে পুকুর ঘাটের দিকেই নিয়ে যেতে দেখা যায় জীতেনকাকাকেও। ঘড়া কিম্বা কলসী কাঁখে যেতে দেখা যায় হরপার্ব্বতী , অতসীকাকী , সবিতাকাকী  সহ কয়েকজন মহিলাকে। এক দঙ্গল কচিকাঁচা তো অনেকক্ষণ আগে থেকেই পুকুর দাপিয়ে স্নান করছিল। প্রিয় একবার মনে মনে আর্যদার কথা মতো সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা মিলিয়ে দেখে নেয়। সব ঠিকঠাকই আছে বলে মনে হয় তার।এবার সময় মতো সব কিছুর তাল মিলটা হলেই হয়। সাংবাদিকরা পৌঁছোনোর আগেই যদি মহিলারা জল নিয়ে বাড়ি ফিরতে শুরু করে তাহলে পুরো পরিকল্পনাটাই মাঠে মারা যাবে।কারণ সাংবাদিকদের ছবি তোলার জন্য তো তাদের মাঝপথে আটকানো যাবে না। কোথাও প্রসাদ মোড়লের চররা ঘাপটি মেরে রয়েছে কিনা তার ঠিক নেই।তাহলে পুরো বিষয়টা যে সাজিয়ে করা হচ্ছে তা ধরা পড়ে যাবে ওদের কাছে। তখন ব্যাপারটা খুব খেলো হয়ে যাবে। বিশেষ করে প্রশাসনের উপর চাপটা হালকা হয়ে যাবে। যদিও সবাইকে পাখি পড়া করে শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে তবুও কাজটা ঠিকঠাক না হওয়া পর্যন্ত উদ্বেগ কাটে না প্রিয়র। পালাক্রমে একবার পুকুরঘাট আর একবার রাস্তার দিকে চেয়ে থাকে সে।এক সময় গ্রামে ঢুকতে শুরু করে সংবাদ মাধ্যমের গাড়ি। গ্রামে ঢুকেই গাড়িগুলি শিবপুকুরের পাড়ে থেমে যায়। পুকুরে তখন কাপড় কাচা , বাসন মাজা,  গরুকে স্নান করানো , বাচ্চাদের পুকুর দাপানো সবই চলছিল। এমনকি স্নান সেরে ঘড়া ভর্তি জল নিয়ে ভেজা কাপড়ে ফিরছিলেন মহিলারা। ফটোগ্রাফার বেশ কিছুক্ষণ ধরে সেইসব ছবি তোলার পর ঘরমুখী মহিলাদের মুখের সামনে বুম ধরে জিজ্ঞেস করেন - আপনারা যে এই জল নিয়ে যাচ্ছেন , তা দিয়ে  কি করবেন ? 
মহিলারা উত্তর দেন --- রান্না খাওয়া সবই করতে হবে।
---- কেন , আপনাদের গ্রামে পানীয় জলের কল নেই ? 
---- একটাই সরকারি টিউবওয়েল আছে , কিন্তু আজ থেকে আমরা ডাক্তারের দাবিতে সরকারি কলের জল বয়কটের ডাক দিয়েছি। তাই সবেতেই আমরা পুকুরের জলই ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
---- আপনারা জানেন পুকুরের জল খেলে পেটের রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে ? মৃত্যুর আশঙ্কা পর্যন্ত রয়েছে। 
---- ডাক্তারের অভাবে এমনিতেই তো বিনা চিকিৎসায় বহু মায়ের কোল খালি হয়ে যায়। তাতেও টনক নড়ে না সরকারের। দূষিত জল খেয়ে আর কত জনের মৃত্যু হলে সরকারের ঘুম ভাঙে আমরা সেটাই দেখতে চাই।
পর্যায়ক্রমে হরপার্বতী ,  অতসীকাকী, সুরোবালাপিসি , ভানুমতীজ্যেঠি সহ অন্যান্য মহিলারা কথাগুলো বলেন। কথাগুলো শুনে চমকিত হয়ে যায় প্রিয়। কি সুন্দরভাবে গুছিয়ে কথাগুলো বলল ওরা। সাংবাদিকরাও একই কথা বলেন। মহিলাদের বক্তব্য নিয়ে মাচানতলায় এসে তারা বলেন , আজ মহিলারা তো ফাটিয়ে দিলেন। ওদের বক্তব্যেই পুরো বিষয়টা কভার হয়ে যাবে। তারপরই টিভি চ্যানেলের লোকেরা খবর পাঠাতে শুরু করে দেন। আজ আবার মাচানতলাতেই টিভিটা এনে ফিট করা হয়েছে। সবাই আগ্রহ নিয়ে টিভির পর্দার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। খবর পাঠানোর পর সাংবাদিকদের হাতে হাতে মুড়ি আর আলুর দমের ঠোঙা তুলে দেওয়া হয়। সবার খাওয়া হয়েছে কি হয়নি , এমন সময় খবরাখবর টিভিতে ভেসে ওঠে নিবেদিতার মুখ। মুড়ি খাওয়ার ঠোঙা ফেলে কানে হেডফোন লাগিয়ে প্রস্তুত হয়ে যায় সাংবাদিক শৌভিক ঘোষ। বাকিরাও তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে কেউ টিভির সামনে  দাঁড়িয়ে , কেউবা বসে পড়েন।


                                     
                                    নিবেদিতা সংবাদ পাঠ করতে শুরু করেন ---জেলাশাসক কথা রাখেন নি। কথা রাখেন নি স্কুলবোর্ডের চেয়ারম্যানও। ক্ষুব্ধ গ্রামবাসীরা তাই পোলিও , শিক্ষা বয়কটের পর এবার ডাক্তারের দাবিতে সরকারি টিউবওয়েলের পানীয় জল বয়কটের ডাক দিলেন। প্রসঙ্গত, দিন পনেরো আগে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডাক্তারের দাবিতে মনোহরপুর গ্রামের বাসিন্দারা পোলিও বয়কটের ডাক দিয়েছিলেন। সেই সময় জেলাশাসক সাতদিনের মধ্যে ডাক্তার নিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় পোলিও বয়কট প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। কিন্তু প্রতিশ্রুতি পূরণ না হওয়ায় গ্রামবাসী সরকারি শিক্ষা বয়কটের ডাক দেন।জেলা স্কুলবোর্ডের চেয়ারম্যানও গ্রামে গিয়ে ডাক্তার নিয়োগের ব্যাপারে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলার আশ্বাস দেন। তারপর পেরিয়ে গিয়েছে সাতটা দিন। কিন্তু ডাক্তার নিয়োগ হয় নি। গ্রামবাসীরা তাই সরকারি টিউবওয়েলের জল বয়কটের ডাক দিয়েছেন। ঘটনাস্থলে রয়েছেন আমাদের প্রতিনিধি শৌভিক ঘোষ। তার কাছেই আমরা জেনে নেব কেন গ্রামবাসীরা এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিলেন। শৌভিক তুমি শুনতে পাচ্ছ ?
---- হ্যা নিবেদিতা বলো ?
----- শৌভিক , আমরা জানি গ্রামাঞ্চলে এমনিতেই পেটের রোগ লেগেই থাকে। তা স্বত্ত্বেও গ্রামবাসীদের  টিউবওয়েলের জল বয়কটের বিষয়টি তো বলা যেতেই পারে এক ধরণের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।
---- একদমই নিবেদিতা , আমরা যখন গ্রামে পৌঁছোলাম তখনও দেখলাম যে পুকুরে স্নান , কাপড় কাচা , বাসন ধোওয়া , গরু মোষকে স্নান করানো এমন কি বিভিন্ন বাড়ির নর্দমার জল এসে মিশেছে সেই পুকুর থেকেই রান্না এবং খাওয়ার জন্য জল নিয়ে যাচ্ছেন মহিলারা। আমি আমাদের ফটোগ্রাফার মমতাকে সেই ছবি তুলে ধরতে বলব।
তারপরই টিভির পর্দায় একে একে ফুটে ওঠে কচিকাঁচাদের পুকুর দাপানো থেকে সুরোপিসির কাপড় কাচার দৃশ্য। সব থেকে মারাত্মক দেখায় নর্দমার ছবি। বিভিন্ন বাড়ি থেকে নর্দমার কালো জল এসে পুকুরে মিশেছে।একপাল হাঁস সেখানে মুখ ডুবিয়ে আরও কালো করে তুলছে জল। সেই ছবি দেখতে দেখতে প্রিয় ভাবে , নর্দমার বিষয়টি তো তাদের মাথাতেই ছিল না। কিন্তু সাংবাদিকদের চোখ এড়ায় নি। সত্যি সত্যি এ জল খেতে হলে কি হত বলা যায় না।
সেই সময় ফের শোনা যায় নিবেদিতার গলা --- তাহলে গ্রামবাসীরা এই ধরণের আত্মঘাতী  সিদ্ধান্ত নিলেন কেন ? 
---- নিবেদিতা সেই গানের সুরেই বলা যেতে পারে , " আমি জেনে শুনে বিষ করেছি পান "। গ্রামের মহিলাদের সঙ্গে কথা বলে আমাদের সে রকমই মনে হয়েছে। আমাদের দর্শকদের সামনে সেই বক্তব্য তুলে ধরার জন্য আমি আমাদের চিত্র সাংবাদিককে অনুরোধ করছি।



                                         টিভির পর্দায় এবারে ফুটে ওঠে মহিলাদের ক্ষোভ ফেটে পড়ার ছবি। তাদের বক্তব্য শেষ হওয়ার পর নিবেদিতা বলে --- মহিলাদের কথা শুনে বোঝাই যাচ্ছে দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভের বহ্বিপ্রকাশ ঘটেছে।ঠিক আছে শৌভিক , তোমাকে ধন্যবাদ। তুমি ঘটনার গতিপ্রকৃতির উপর নজর রাখো। আমরা পরে আবারও তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করে নেব। খবর আপাতত এ পর্যন্তই। খবরাখবর। আপনাদের সঙ্গে আমি নিবেদিতা।
খবর সম্প্রচারিত হওয়ার ঘন্টা দেড়েক পরই গ্রামে ঢোকে বি.ডি.ও'র গাড়ি। বি.ডি.ও সাহেবের সঙ্গে গাড়ি থেকে নামেন ব্লক স্বাস্থ্য অধিকর্তা মইদুল হকও। মাচানতলার কাছে এগিয়ে এসে গ্রামবাসীদের উদ্দেশ্য করে বি.ডি.ও সাহেব বলেন , একের পর এক কি শুরু করেছেন কি আপনারা ? আপনাদের নিয়ে তো আর পারা যায় না।
প্রশান্তকাকা সঙ্গে সঙ্গে  বলে ওঠেন , আপনাদের নিয়েও আমরা আর পারছি না। এক জনের পর একজন এসে প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু কোন কাজ হচ্ছে না।
---  এত অধৈর্য হলে চলবে ? ডাক্তার তো আর টিউবওয়েল কিম্বা ডাস্টবিন নয় যে বাজার থেকে কিনে এনে দিয়ে দেবে প্রশাসন।
এবারে মুখ খোলে প্রিয় - বাঃ ভালো বললেন তো আপনি। পাঁচ বছরেও বেশি সময় ধরে ডাক্তার দিতে পারেন নি। সেই লজ্জায় কোথাই মুখ লুকোবেন তা নয় , উল্টে আমরা কি করছি না করছি তা নিয়ে চোটপাট করতে এসেছেন। যান, আপনাদের কোন কথা শুনব না যান।
প্রিয়র কথা শুনে খুব বিব্রত হয়ে পড়ে বি. ডি.ও  সাহেব। সহসা তিনি আর কোন কথা বলতে পারেন না। পরিস্থিতির সামাল দিতে মাঠে নামতে হয় মইদুল হককে। তিনি বলেন , কিন্তু আপনারা যেটা করছেন সেটা করতে পারেন না। ওইভাবে পুকুরের জল খেয়ে পেটের রোগ ছড়িয়ে পড়লে তখন কি হবে ? 
---- যা হয় হবে। বড়ো জোর মারা পড়ব , এর থেকে বেশি  কিছু তো হবে না ? সরকারের কাছে আমাদের জীবনের মুল্যই বা কি আছে ? থাকলে নিশ্চয় এতদিন ডাক্তার দিয়ে দিত।
---- ভুল করছেন আপনারা। বাঁচাটা আপনাদের হাতে, মরাটা নয় কিন্তু। আত্মহত্যা করাটাও বেআইনী। ধরা পড়লে জেলে ঢুকতে হবে। অনশন করলে প্রশাসন  জোড় করে তুলে নিয়ে গিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করে দিতে পারে।
ওই কথা শুনেই মেজাজ হারিয়ে ফেলেন জীতেনকাকা। প্রিয় কিছু বলার আগেই  একেবারে মেঠো ভাষায় বলে ওঠেন , আপনারা তো ভালো লোকমশাই। সেই যে বলে না -"ভাত দেওয়ার ভাতার নয়, কিল মারার গোঁসাই।" মানুষ যখন পেটের জ্বালায় কাঁদে তখন শুনতে পান না। কিন্তু অনশন করলে হাসপাতালে ভর্তি করতে ছোটেন। যখন বিনা চিকিৎসায়  মানুষ মরে তখন দেখতে পান না। কিন্তু তিলে তিলে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচতে যখন আত্মহত্যা করতে যায় তখন তাকে জেলে ভরে কর্তব্য পালন করেন। কর্তব্যে গাফিলতির জন্য আপনাদেরই জেলে ভরা উচিত।
জীতেনকাকার কথা শুনে অবাক হয়ে যায় প্রিয়। মাঠে হাল ঠেঙানো, নাম স্বাক্ষর শিক্ষা সম্পন্ন একজন মানুষ কি করে নগ্ন বাস্তব কথাটা স্বতঃস্ফুর্তভাবে বলেফেলল তা ভেবে পায় না সে। পরিস্থিতিই যে মানুষকে জীবনবোধ শেখায় তা জীতেনকাকার কথায় আরও একবার প্রমাণিত হল।


    
            ( ক্রমশ ) 




       নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 


শীঘ্রই দেশ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হতে চলেছে আমার তৃতীয় উপন্যাস ------
  
                                  


                       ----০---



        

No comments:

Post a Comment