Short story, Features story,Novel,Poems,Pictures and social activities in Bengali language presented by Arghya Ghosh

অন্তরালে -- ২৪





     অন্তরালে 



            অর্ঘ্য ঘোষ 



( ধারাবাহিক উপন্যাস ) 






মইদুল সাহেব অবশ্য তার কথার অন্তর্নিহিত অর্থই অনুধাবন করতে পারেন না । তাই জ্ঞানগর্ভ উপদেশ দিয়েই যান। তার কথা শুনে এবারে মেজাজ হারিয়ে ফেলেন প্রশান্তকাকা। তার মুখের সামনে হাত নেড়ে বলে ,  যান যান মেলা বকেছেন, আর বকেন না। কি বলতে কি বলে ফেলব তখন মান -- সম্মান নিয়ে পালানোর পথ পাবেন না। অবশ্য সেটা যদি থাকে।
---- কি উল্টো পাল্টা বলছেন ?  
---- আমি উল্টো পাল্টা বলছি ?  আচ্ছা আপনি তো ব্লক স্বাস্থ্য অধিকর্তা। এই ব্যর্থতার দায় আপনি অস্বীকার করতে পারেন ? নিজে একজন ডাক্তার হয়ে ঘন্টা খানেক হাসপাতালে ডিউটি করে সারাদিন সরকারি কোয়ার্টারে বসে প্রাইভেট প্র‍্যাকটিস করেন। আপনি  প্রাইভেট প্র‍্যাকটিস একটু কম করে সেই সময়টুকু আমাদের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে দিতে পারেন তো।
----- আমি কি করব না করব তা কি আপনারা ঠিক করে দেবেন না কি ? 
----- একদমই নয়। আমরা ঠিক করতে যায়ও নি। নেহাৎ আজ আমরা কি করব না করব তা আপনি ঠিক করতে এসেছেন বলেই কথাগুলো বললাম। 
ক্রমেই দু'পক্ষ তীব্র বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। বচসা থেকে হাতাহাতি হওয়ার উপক্রম দেখা দেয়। তা সামাল দিতে সামনে এগিয়ে যেতে হয় প্রিয়কে। মইদুল হককে উদ্দেশ্য করে বলেন , এই বুদ্ধি নিয়ে আপনারা প্রশাসন সামলান ? দেখেছেন মানুষ খেপে আছেন , সান্ত্বনা দিয়ে  কোথাই তাদের শান্ত করবেন তা নয় , আইনের ফ্যাকড়া তুলে দিচ্ছেন তাদের আরও তাতিয়ে। কবে বুঝবেন দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের কাছে খিদেই একমাত্র কথা , যে কোনও ভাবে পেট ভরানোটাই লক্ষ্য হয়ে ওঠে। তখন পাপাচার কোন বিচার্য্য বিষয়ই নয়। 
প্রিয়র কথা শুনে হাত জোড় করে বি,ডি,ও বলেন, আমি আপনাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আপনাদের আবেগ - অনুভুতিকে সম্মান জানিয়েই বলছি , আপনার যে পদক্ষেপ নিয়েছেন তার কুফল সুদুর প্রসারী। পুকুরের জল খেয়ে যদি পেটের রোগ ছড়ায় তাহলে তা কোন একজন ব্যক্তি, পরিবার বা শুধু এই গ্রামের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে এমনটা নয়। গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তখন গ্রামের পর গ্রাম উজার হয়ে যাবে। আপনাদের কথা অনুযায়ী যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নিই নিজের জীবন নিয়ে যা খুশি করার অধিকার রয়েছে ,  তাহলে বলতে হয় পরের জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনার অধিকার তো কারো নেই। বরং তা হত্যা  অপরাধের সামিল। তাই আবার অনুরোধ করছি দয়া করে আত্মঘাতী এই সিদ্ধান্ত থেকে আপনারা সরে আসুন।আমি কথা দিয়ে যাচ্ছি , এরপর আপনারা যাই করুন না কেন, ডাক্তার না আসা পর্যন্ত আপনাদের আর কোন অনুরোধ জানাতে আসব না।
বি,ডি,ও সাহেবের কথা শুনে সবাই একটু নরম হয়। পাশে সরে গিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে বয়কট প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। আর্যদাকে তাদের সেই সিদ্ধান্তের কথা জানায় প্রিয়। আর্যদাও সহমত পোষণ করে জানান, আপনাদের উদ্দেশ্য তো যোল আনার জায়গায় আঠারো আনা সফল হয়েই গিয়েছে। এতক্ষণ গোটা পৃথিবীর লোক আপনাদের এই আন্দোলনের কথা জেনে গিয়েছে। এবারে বি,ডি,ও সাহেবের কথায় বয়কট প্রত্যাহার করা হলে সব পক্ষেরই মুখরক্ষা হবে।  সেইমতো প্রশান্তকাকা  বি,ডি,ও সাহেবকে বলেন , ঠিক আছে আপনারা যখন এত করে বলছেন তখন এবারের মতো আমরা এই বয়কট প্রত্যাহার করে নিচ্ছি। কিন্তু এরপর আর কারও কোন কথাই শুনব না।
---- বেশ , আমরাও আর আপনাদের অনুরোধ করতে আসব না। এবারের মতো টিউবওয়েলটা খুলে দিন ভাই।
বি,ডি,ও সাহেবের অনুনয়ে জীতেনকাকা গিয়ে টিউবওয়েলটা খুলে দিয়ে এক বালতি জল টিপে নিয়ে আসেন। তারপরই বি,ডি,ও সাহেবরা চলে যাওয়ার উপক্রম করতেই জীতেনকাকা বলেন , একটু দাঁড়িয়ে যান স্যার , আমি চট করে আসছি।



                            বলে ইশারায় ঋজুকে ডেকে নিয়ে ক্লাব ঘরের দিকে চলে যান।কেউ কিছু বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে তাদের দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা থালার উপরে  কয়েকটা গ্লাস সাজিয়ে নিয়ে হাজির হন তারা। বি,ডি,ও, বি,এম,ও,এইচ, আর সাংবাদিকদের হাতে হাতে ধরিয়ে দেন গ্লাসগুলো। তারপর বি,ডি,ও আর বি,এম,ও,এইচের দিকে চেয়ে জীতেককাকা বলেন , ঝগড়া করে আমাদের সম্পর্কে, আমাদের গ্রামের সম্পর্কে খারাপ ধারণা নিয়ে চলে যাবেন তা হবে না।বকাবকি করে তো মাথা গরম হয়ে আছে। নিন , একটু করে সরবত খেয়ে ঠাণ্ডা হয়ে নিন। এর বেশি আপ্যায়ণের তো আমাদের সামর্থ্য নেই। রাগের মাথায় উল্টোপাল্টা কিছু বলে থাকলে মনে রাখবেন না। আমরা গাঁয়ের চাষাভুষো ,  মুখ্যু সুখ্যু মানুষ ওইরকম। ওই মুখে যা আসে বলেই দিই , কিন্তু কিছু মনে রাখি না।জীতেনকাকার কথা শুনে বি,ডি,ও আর বি,এম,ও,এইচ দুজনে এগিয়ে এসে তার দুই হাত ধরে বলেন , এই আতিথেয়তার কথা আমরা কোনদিন ভুলতে পারব না। ডাক্তার নিয়োগের ব্যাপারটা আমাদের হাতে নেই। তবে আমরা উর্ধ্বত্বন কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ জানাব।তারপরই গ্রাম থেকে বেরিয়ে যায় তাদের গাড়ি। টিভিতেও তাদের বয়কট প্রত্যাহারের খবরও সম্প্রচারিত হয়। দেখানো হয় হাতজোড় করে বি,ডি,ও'র বয়কট প্রত্যাহারের জন্য অনুরোধ , বি,এম,ও,এইচের সঙ্গে গ্রামবাসীদের বাদানুবাদের ছবিও। খবর শেষ হওয়ার পর সাংবাদিকেরাও বিদায় নেন। প্রিয়রা বৈঠকে বসে। জীতেনকাকা বলেন , যাই বলো না কেন এই বয়কটে কিন্তু একটা লাভ হল। 
---- কি লাভ , জিজ্ঞাসা করেন প্রশান্তকাকা।
---- কাল রাতে বাড়ি বাড়ি যা জল ভরে দিয়েছি তাতে দু'চারদিন বাড়ির মেয়ে--বৌদের আর জল বইতে হবে না।  
---- তা যা বলেছো ,  সহাস্যে বলেন সবাই।
প্রশান্তকাকা বলেন , কিন্তু আমি কি করব ? আমার বাড়িতে তো দু কড়াই জল ভরা আছে। আমরা দু'টি তো মাত্র প্রাণী। ফেলে ছড়িয়ে ওই জল ছ'মাসের মধ্যে শেষ হবে বলে মনে হয় না। তাহলে তো কড়াই দু'টো তুলে রাখতেও পারব না।
---- তাহলে বরং মেয়েদের বৌদের বলে দেব আমাদের বাড়ির জল শেষ হলে তারা যেন সরকারি কলের পরিবর্তে তোমার বাড়ি থেকেই জল আনতে যায়।
---- তা বলেছো ভাল , বলে হেসে ওঠেন প্রশান্তকাকা।
কিছুক্ষণ হাসিঠাট্টার পর শুরু হয় আসল আলোচনা। ঠিক হয় সাত দিন দেখার পরও কোন কাজ না হলে রেশন বয়কটের ডাক দেওয়া হবে। সেক্ষেত্রে কারও যদি খুব সমস্যা হয় তাহলে গ্রামরক্ষা কমিটির তহবিলের টাকা থেকে তাদের সাহায্য করা হবে। গ্রাম কমিটির টাকার প্রসঙ্গে প্রসাদ মোড়লের কথাও আলোচনা হয়। প্রিয় বলে , কাল সময় করে একবার প্রসাদ কাকার হিসাবটা মিলিয়ে দেখে নিতে হবে। গরমিল থাকলে বাকি টাকার জন্য চাপ দিতে হবে। 
---- সে তো হবেই। কিন্তু আমার মনে হয় আমাদের আবার রাতপাহারা চালু করা উচিত। কারণ টাকা ফেরত  দিতে হয়েছে বলে প্রসাদ মোড়ল ক্ষোভে ফুঁসছে। মরণ কামড় একবার কামড়াবেই। সেটা কোনদিক থেকে আসবে তার ঠিক নেই। তাই আমাদের খুব সজাগ থাকতে হবে , আশঙ্কিত ভাবে বলেন প্রশান্তকাকা। জবাবে জীতেনকাকা বলে , ঠিক কথা। ওদের বিশ্বাস নেই।  রাত পাহারা তো ছিল। প্রসাদ মোড়লের জন্যই সেটা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। নিজে পালি দিত না, আবার খবরদারি করত। 




                                    তখনই রাত পাহারা দেওয়ার সদস্য তালিকা তৈরি করে ফেলা হয়। প্রসাদ মোড়ল আর তার অনুগামীদের পাঁচটি পরিবার বাদ রেখে প্রতি বাড়ি থেকে এক জন করে নিয়ে চার সদস্যের একজন করে দল করা হয়। পরিবারে কোন পুরুষমানুষ নেই বলে সুরোপিসি আর ভানুমতীজ্যেঠিকে ছাড় দেওয়া হয়। সপ্তাহে একদিন করে পালি পড়ে সবার। ঠিক হয় পরের রাত থেকেই চালু হয়ে যাবে রাতপাহারা। প্রিয়র মনে হয় , এই ব্যাপারটা তাদের আরও আগে ভাবা উচিৎ ছিল। বাড়ি ফিরে মাকে রাত পাহারার কথাটা বলে প্রিয়। মা'ও একই মত প্রকাশ করে বলেন , এটা আরও আগে চালু হলে হয়তো  ঋজুদের পুকুরের মাছ , প্রশান্ত ঠাকুরপোর হালের বলদ দুটো বাঁচানো যেত। দেরিতে হলে তাও মন্দের ভাল। ওরা আর কারও ক্ষতি করতে পারবে না। তবে আজ রাতের মধ্যেই আবার কারও কিছু ক্ষতি করে ফেলবে কিনা দেখ।
---- তা বোধহয় পারবে না। ওদেরও তো ভয় আছে। আর আজকের রাতটা কোন রকমে পেরিয়ে গেলেই হয়। কাল থেকে তো রাত পাহারা শুরু হয়ে যাবে।
--- তাই যেন হয়।
কিন্তু মায়ের আশঙ্কাটাই সত্যি হয়। সেদিন ভোরে চিৎকার চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙে প্রিয়। কান খাড়া করে চিৎকারটা কোনদিক থেকে আসছে তা  আন্দাজ করার চেষ্টা করে সে। তাদের খামারবাড়ির দিক থেকেই আওয়াজটা আসছে মনে হয় তার। মনের মধ্যে একটা যেন কুডাক শুনতে পায় প্রিয়। খামারবাড়িতেই তো বাঁধা রয়েছে ধানের পালুই।কয়েকদিন পরেই ধান ঝড়ানোর কথা ছিল। সেখানেই কিছু হল না তো ? দরজা খুলে বাইরে বেরোতেই দেখতে পায়  আগুনের লেলিহান শিখা। বাবা-মা'কে ডাকারও সময় পায় না , ছুটে যায় খামারবাড়ির দিকে। সেখানে গিয়ে দেখে  দাউ দাউ করে জ্বলছে তাদের ধানের পালুই।  তাদের সারা  বছরের ভাত -কাপড়ের সম্বল। বাবার রক্তজল করা পরিশ্রমের ফসল ওইভাবে পুড়তে দেখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে সে। ততক্ষণে বালতি - ঘড়া নিয়ে আগুন নেভাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন গ্রামের মানুষ। তাদের দেখেই যেন সাড় ফেরে প্রিয়র। আগুন নেভাতে সে'ও ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়।চোখের সামনেই পুড়ে যায় তাদের জমির সমস্ত ধান। ওই ধান ঝড়িয়ে চাল তৈরি করার কথা ছিল মায়ের। এখন কি করে তাদের খাওয়া পড়া জুটবে তা ভেবে পায় না প্রিয়। ততক্ষণে বাবা-মা'ও এসে পড়েছেন। নিজের পরিশ্রমের ফসলের পরিনতি দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন বাবা। আর মা অতসীকাকীর মতোই সমানে কপাল চাপড়াতে থাকেন। প্রিয় মাকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দেয় -- অত ভাবছ কেন মা ? আর তো কয়েকটা মাস। ডাক্তারবাবু বলেছেন ট্রেনিংটা হয়ে গেলেই আমার একটা চাকরি হয়ে যাবে। দেখো তখন আমরা সব সামলে নিতে পারব।তবু হরপার্ব্বতীর চোখের জল বাঁধ  মানে না। সমানে কেঁদেই চলেন আর বলেন , কে আমার এত বড়ো সর্বনাশ করল গো ? স্বামী-সন্তানের পাতে এবার আমি কি করে ভাত দেব ?
শোভনাকাকী , অতসীকাকীরা বলেন -- দিদি তুমি অত ভেঙে পড়ো না। আমরা তো সবাই আছি। আমদের স্বামী-সন্তান ভাত পেলে তোমারও পাবে। আর যারা পুকুরে কিম্বা অবলা জীবের খাবারে বিষ মেশায় , মানুষের মুখের আহার এভাবে কেড়ে নেয় তাদের ধরা ছোঁওয়া না গেলেও  ভগবানের চোখকে তারা ফাঁকি দিতে পারবে না। ভাগবানের বিচারে তারা ছাড় পাবে না।
হরপার্ব্বতীও বলে ওঠেন -- এর বিচার তুমি কোর ঠাকুর।



        (  ক্রমশ ) 




       নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 


শীঘ্রই দেশ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হতে চলেছে আমার তৃতীয় উপন্যাস ------
  
                                  


                       ----০---



        

No comments:

Post a Comment