Short story, Features story,Novel,Poems,Pictures and social activities in Bengali language presented by Arghya Ghosh

অন্তরালে -- ২৫




    অন্তরালে 


         অর্ঘ্য ঘোষ 



   ( ধারাবাহিক উপন্যাস ) 



তবু মন মানে না তার। সব সময় চোখের সামনে ভেসে উঠেছে ধানের পালুই পোড়ার দৃশ্য। ধান তো নয় ,  যেন সোনার বরণ মা লক্ষ্মী।তাই ভিতরটা যেন সবসময় কচ কচ করে ওঠে। জ্ঞানত তারা তো কোন পাপ করে নি , তাহলে কেন এমন হল ? কিছুতেই উত্তর খুঁজে পান না হরপার্ব্বতী। মনে মনে বলে , যদি কিছু অপরাধ করে থাকি ক্ষমা করে দিও মা। আবার আমার ঘর আলো করে এসো। ওই প্রার্থনার মধ্যে দিয়েই সান্ত্বনা খোঁজার চেষ্টা করেন তিনি। কিছুক্ষণ আগেই আগুন নিভিয়ে গ্রামের লোকেরা বাড়ি ফিরে গিয়েছেন। ফিরে গিয়েছেন আত্মীয় স্বজনরাও। কাছে পিঠে আত্মীয় স্বজন বলতে তো রয়েছে একমাত্র মধুরিমার শ্বশুররা। খবর পেয়ে ছুটে এসেছিলেন সৌরভ আর মধুরিমার শ্বশুরমশাইও। তারাও ফিরে গিয়েছেন। যাবার আগে মধুরিমার শ্বশুরমশাই প্রভাতকুসুমের হাত ধরে বলে গিয়েছেন , বেয়াই মশাই কোন দুশ্চিন্তা করবেন না। যখন যা প্রয়োজন হবে বলতে কোন রকম সংকোচ করবেন না যেন। মাকেও একই আশ্বাস দিয়ে গিয়েছেন তিনি। কিন্তু প্রিয় জানে মায়ের প্রকৃতিই আলাদা। পেটে গামছা বেঁধে পড়ে থাকবেন। কিন্তু কারও সাহায্য নেবেন না। বিশেষ করে মেয়ের শ্বশুরবাড়ি থেকে তো নয়ই। 'জীবন সুরক্ষা' কমিটির সদস্যরাও গ্রাম কমিটি থেকে টাকা ধার দেওয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু প্রিয়ও সেই টাকা নিতে চায় না। সে 'জীবন সুরক্ষা' কমিটির পদে রয়েছে। তাই সেই টাকা নিলে কথা উঠতে পারে। বিশেষ করে প্রসাদ মোড়লের কানে গেলে তো কথাই নেই।গ্রামের মানুষকে ভুল বুঝিয়ে ফাটল সৃষ্টি করতে মাঠে নেমে পড়বে। তাছাড়া গ্রামে তাদের চাইতে আরও গরীব মানুষ রয়েছেন। তাদেরকেও একই ভাবে বিপাকে ফেলতে পারে প্রসাদ মোড়লরা। তখন তার কাছে টাকা আটকে থাকলে তো ওইসব বিপন্ন মানুষেরা টাকা না'ও পেতে পারেন। সেক্ষেত্রেও নানা রকম কথা উঠতে পারে। কিন্তু টাকা যে কিছু যোগাড় করতেই হবে, না হলে ভাতের হাঁড়ি চড়বে না। কোথাই পাবে টাকা ? সেই মুহুর্তে দুটি নাম মনে পড়ে তার। একজন সুশোভনবাবু   অন্যজন আর্যদা। দুজনেই তাকে না করতে পারবেন না। কিন্তু আর্যদাকে সে চাইতে পারবে না। কয়েকদিন আগেই আর্যদা ভানুমতীজ্যেঠির জন্য ৫০০ টাকা দিয়েছিলেন। একজনের কাছে বারে বারে সাহায্য নেওয়াটা ঠিক নয়। তাহলে দাতা একসময় অনিচ্ছাস্বত্ত্বেও হাত গুটিয়ে নিতে বাধ্য হন। সুশোভনবাবুকেই বলবে সে।  অগ্রিম হিসাবেই তার কাছে কিছু টাকা চেয়ে আনবে। তারপর না হয় ট্রেনিংয়ের পাশাপাশি চেম্বারে আবার নাম লেখার কাজ শুরু করবে।সেই মতো পরদিনই সুশোভনবাবুর চেম্বারে যায় সে। ঘটনার কথা খুলে বলে তাকে। অর্থনৈতিক সমস্যার কথাও বলে। সব শুনে সুশোভনবাবু এক হাজার টাকা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলেন -- হবে এতে ?  
---- হ্যা - হ্যা, আমি এতটাও আশা করি নি। চেম্বারে কাজ করে টাকাটা শোধ করে দেব।
---- সে হবে ক্ষণ। ও নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।  আগে ট্রেনিংটা ভালো ভাবে শেষ করো , চাকরি বাকরি একটা কিছু পাও তারপর ধার শোধের কথা ভেব। হ্যা , পরেও কিছু জানাতে ইতস্তত কোর না। আর কি বলি তোমাকে ? একটাই কথা বলার আছে, মনে জোর রাখো , কিছুতেই পিছিয়ে যাবে না। মনে রেখ চিরকালই যারা সমাজের ভালো করতে চেয়েছে তাদের নিজের ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু সেই ক্ষতি সাময়িক। মানুষের জন্য কিছু করতে পারার মতো আনন্দ আর কিছুতেই নেই। সেই আনন্দ সমস্ত ক্ষতিকে ছাপিয়ে যায়। আর্শিবাদ করি তুমিও যেন সেই আনন্দেরই সন্ধান পাও। যাও সব কিছু ভুলে মা-বাবার মনে ভরসা যোগাও।
ডাক্তারবাবুকে প্রনাম করে চেম্বারের বাইরে আসে প্রিয়। ডাক্তারবাবুর কথা শুনে সে ফের মনোবল ফিরে পায়। চোখের সামনে আস্ত ধানের পালুইটা পুড়ে যাওয়ায় কিছুটা হলেও মুসড়ে পড়েছিল সে।  বাবা-মায়ের মুখের দিকে  তাকাতে পারছিল না। আর্থিক ক্ষতির চেয়েও কি করে সন্তানের মুখে অন্ন তুলে দেবেন সেই চিন্তাই তাদের গ্রাস করে নিয়েছিল। সেও কোন ভরসা যোগাতে পারে নি। অক্ষমতার গ্লানি তাই তাকেও কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়েছে। এবার মায়ের হাতে টাকাটা তুলে দিতে পারলেই স্বস্তি ফিরবে পরিবারে। বাবাও নতুন করে চাষে নামতে পারবেন।



        
                                ট্রেনিং শেষে আর্যদার কাছেও যায় প্রিয়। তাকেও ঘটনার কথা বলে। শুনে আর্যদা বলেন , এরা নামতে নামতে আর কত নীচে নামবে কে জানে ? থানা-পুলিশ করে কিছু লাভ হবে না। আমি ওদের নেতাদের সঙ্গে একবার কথা বলে দেখি। তাতেও বিশেষ লাভ হবে বলে মনে হয় না। সব জেনেও না জানার ভান করে দায় এড়িয়ে যাবেন। তবু একবার জানিয়ে রাখি। পরে বাড়াবাড়ি কিছু হলে ধরা যাবে। আর একটা খবরও করে দেওয়া যায় কিনা দেখছি।ফেরার আগে আর্যদাও তার হাতে পাঁচশো টাকা দিতে এসেছিলেন। সে এখন দরকার নেই , লাগলে চেয়ে নেব বলে এসেছে। সেদিন আর ফেরার পথে মাচানতলা  যায় না প্রিয়। যাওয়ার সময় মায়ের দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মুখ দেখে এসেছে। দুশ্চিন্তা দূর করে মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে চায় সে। তাই দ্রুত মায়ের হাতে টাকাটা তুলে দেওয়ার জন্য সরাসরি বাড়িতে ফেরে। মা তখন বাবার সঙ্গে বসে কিছু আলোচনা করছিলেন। তাকে দেখেই চুপ করে যান।আলোচনাটা যে উদ্ভুত সংকটজনক পরিস্থিতি নিয়েই হচ্ছিল তা বুঝতে অসুবিধা হয় না প্রিয়র। আসলে তাকে দুশ্চিন্তার আঁচ পেতে দেবেন না বলেই মাঝপথে আলোচনা থামিয়ে দিলেন। সে গিয়ে মায়ের হাতে টাকাটা তুলে দিয়ে বলে -- আপাতত এটা রাখো। তারপর দেখছি কি করা যায়।
--- তুই টাকা কোথাই পেলি ? 
--- ডাক্তারবাবুর কাছে অগ্রিম নিয়ে এলাম। চেম্বারে কাজ করে শোধ দিয়ে দেব।
--- তোর তো খুব চাপ পড়ে যাবে । ট্রেনিং -- চেম্বারের কাজ একসঙ্গে সামলাবি কি করে ?
 --- ও নিয়ে তুমি ভেব না তো। আমি ঠিক সামলে নেব। 
ছেলের কথায় প্রসন্ন হয়ে ওঠে হরপার্ব্বতীর মুখ। সেটা প্রকাশ পায় তার কথায়।  
কোনরকম রাখঢাক না করেই বলে ফেলেন --- এতক্ষণ তো তোর বাবার সঙ্গে সেই কথাই হচ্ছিল। সত্যি বাপু খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম। হাত পেতে কারও কাছে থেকে সাহায্য নিতে একেবারেই মন চাইছিল না।
কথাটা শুনেই দুহাত দিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে প্রিয় বলে , আমি থাকতে তোমাকে কোন দিন কারও কাছে হাত পাততে হবে না মা। 
ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে হরপার্ব্বতীর বলেন , সে তো জানি রে বাবা। 
মা-ছেলের কথাবার্তায় এক লহমায় বাড়িতে হারিয়ে যাওয়া পরিবেশটা ফিরে আসে। প্রিয় মনে মনে ভাবে , ক্ষতির তুলনায় হাজার টাকা নগন্য। কিন্তু সেই টাকাটাই যেন প্রাণ ফিরিয়ে দিল গোটা পরিবারের। আসলে নিজেদের নুন্যতম প্রয়োজনের বেশি আকাঙ্ক্ষা যাদের নেই , একমাত্র তারাই বোধহয় সর্বস্ব হারিয়েও খুব অল্পে এভাবে সব ক্ষতি সইয়ে নির্ভেজাল হাসি হাসতে  পারে। হাসি ফেরে বাবার মুখেও। মায়ের উদ্দ্যেশ্যে বলেন , সম্ভব হলে ওই টাকা থেকে আমাকে কিছু দিও। তাহলে বোরো ধান চাষ করব। খরচটা কিছুটা বেশি পড়লেও ভাতের চাল, গরুর খাবারটা তো হয়ে যাবে।
মা উৎসাহের সঙ্গে বলেন , হ্যা-হ্যা খুব হবে। আর বোরো চাষ তো করতেই হবে। নাহলে ভাত কাপড়ের সংস্থান হবে কি করে ? 
--- তাহলে কাল থেকেই সার বইতে শুরু করে দেব।



               বলেই গোয়ালচালার দিকে চলে যান প্রভাতকুসুম। মহা উৎসাহে সরষের তেলের কাট আর পাট দিয়ে গাড়ির ' জোতান ' করতে শুরু করে দেন । প্রিয় গিয়ে সাহায্য করার উপক্রম করতেই হা-হা করে উঠেন বাবা। দ্রুত বলে উঠেন , যা-যা তোকে কিছু করতে হবে না। তেতেপুড়ে এলি , মায়ের কাছে যা বরং। 
এই এক মুশকিল হয়েছে প্রিয়র। নিজে কষ্ট করবেন কিন্তু তার কষ্ট হবে ভেবে কিছুতেই তাকে চাষের কাজ করতে দেন না বাবা। বেশি জোরাজুরি করলে কাজটাই বন্ধ রেখে দেবেন। অগত্যা বাড়িতেই ফেরে প্রিয়। মা'ও ততক্ষণে গৃহস্থালির কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। আকস্মিক বিপর্যয়ে ছন্দ হারিয়ে ফেলা সংসারটা যেন কোন যাদু কাঠির ছোঁওয়ায় ফের ছন্দ ফিরে পায়। জামা প্যান্ট পাল্টে সে বেরনোর উপক্রম করতেই মা বাটিতে করে চাট্টি চালভাজা আর এককাপ চা এনে তার হাতে দিয়ে বলেন , একবার প্রশান্তর বাড়ি হয়ে যাস। সকালে জীতেনকে দিয়ে ডাকতে পাঠিয়েছিল। 
--- হ্যা প্রশান্তকাকার বাড়িই যাচ্ছিলাম। আজ গরুর শ্রাদ্ধ উপলক্ষ্যে প্রশান্তকাকা 'জীবন সুরক্ষা' কমিটির সদস্যদের খাওয়ার নিমন্ত্রণ করেছেন। সকাল থেকে থাকার কথা ছিল। কিন্তু সুশোভনবাবুর সঙ্গে দেখা করার জন্য চলে যেতে হল।
 --- তাহলে কি খাওয়া-দাওয়া করে আসবি ? 
--- হ্যা , তোমরা খাওয়া-দাওয়া করে শুয়ে পড়ো। আজ থেকে গ্রাম পাহারা শুরু হবে। প্রথমদিন সবাই থাকবে। আমিও একেবারে গ্রাম পাহারা দিয়েই ফিরে আসব ।
---- বেশ সাবধানে ফিরবি।
---- ঠিক আছে , দুশ্চিন্তা কোর না।
প্রশান্তকাকার বাড়িতেই 'জীবন সুরক্ষা' কমিটির সবাইকে পেয়ে যায় প্রিয়। তাই সেদিন মাচানতলার পরিবর্তে প্রশান্তকাকার বাড়িতেই বৈঠক বসে তাদের। আলোচনা শুরুর আগেই ঋজু জানিয়ে দেয় প্রসাদ মোড়লের হিসাবে গড়মিল ধরা পড়েছে। প্রসাদ মোড়ল ডাইনে বাঁয়ে হিসাব মিলিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তার কাছে আরও এক হাজার টাকা পাওয়া যাবে। 
সেটা শোনার পরই জীতেন কাকা বলেন -- এখনই ওকে ধরব। ওকে আর কোন ছাড় নেই। সবার সর্বনাশ করবে আর ওকে ছেড়ে দেব ?
প্রিয় বলে , রাতের বেলা ওর বাড়ি যাওয়া উচিত হবে না। মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দিতে পারে।
প্রশান্তকাকা বলেন , সে ও পারে। ওকে বিশ্বাস নেই।
সবাই মেনে নেয় কথাটা। ঠিক হয় দিনের বেলায় ধরা হবে ওকে। সেইদিনই আন্দোলনের পরবর্তী পদক্ষেপ হিসাবে সাতদিন পর রেশন বয়কটের সিদ্ধান্তও চূড়ান্ত হয়ে যায়। খাওয়া-দাওয়ার পর রাতপাহারা দিতে বেরিয়ে পড়েন সবাই। পাহারা শেষে যখন তারা বাড়ি ফেরার উপক্রম করে তখন ভেসে আসে ' নিশি পোহাইল - রাই জাগো রাই জাগো  ' গানের সুর।



      ( ক্রমশ ) 




       নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 


শীঘ্রই দেশ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হতে চলেছে আমার তৃতীয় উপন্যাস ------
  
                                  


                       ----০---



        



1 comment:

  1. খুব ভালো।
    পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।

    ReplyDelete