অন্তরালে
অর্ঘ্য ঘোষ
( ধারাবাহিক উপন্যাস )
গলাটা চিনতে পারে সবাই। ছোটবেলা থেকে অনেকেই বিছানায় শুয়ে শুয়ে ওই গলায় শুনেছেন ভোরাই গান।গলাটা যে রামসায়রের পাড়ের গঙ্গাধর বাবাজীর তা চিনতে অসুবিধা হয় না কারও। বাবাজী বৈষ্ণব মানুষ।এমনিতে গ্রামে গ্রামে ভিক্ষা করেন। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে তাদের গ্রামে এক সঙ্গীকে নিয়ে খোল - করতাল বাজিয়ে ভোরাই গান করেন। গ্রামের লোকেরা অবশ্য বলেন টহল দেন। ছোটবেলায় কতদিন টহল শুনে ঘুম ভেঙে গিয়েছে তার ঠিক নেই। জানলা খুলে দেখেছে একটা টিমটিমে লন্ঠন ঝুলিয়ে নিয়ে ভোরাই গাইতে গাইতে বাবাজীরা চলে যাচ্ছেন গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। কার্তিক মাস থেকে শুরু হয় টহল , চলে নবান্নের দিন পর্যন্ত। ওইদিন সকালে সঙ্গীকে নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘোরেন বাবাজী। টহল দেওয়ার পারিশ্রমিক বাবদ চাল, ডাল, তেল, সবজি যে যা দেন তাই সংগ্রহ করেন।
তাতেই ধামা ভরে যায়। আসলে গ্রামের অধিকাংশ মানুষ গরীব হলেও নবান্নে সবাই সাধ্যের বাইরে গিয়ে খরচ করেন। তাই এদিন কাউকে কিছু দিতে কার্পণ্য করেন না। বাবাজী অবশ্য সংগৃহিত সামগ্রী নিজেদের ভোগে লাগান না। সংগৃহিত সামগ্রী দিয়ে নিজের আখড়ায় মহোৎসবের আয়োজন করেন। সেই মহোৎসবে তাদের গ্রামের লোকেরাও গিয়ে প্রসাদ পেয়ে আসেন। প্রিয়ও বেশ কয়েকবার গিয়েছে। বাবাজীর মতো মা'জীও খুব ভালোমানুষ। কপালে - নাকে রসকলি আঁকেন। তখন তাকে আলাদা জগতের মানুষ মনে হয়। উনি খুবই অতিথি বৎসল।সবাইকে এসো বাবা, বসো বাবা করেন। বাবাজীর গলার আভাসে মা'জীর কথা মনে পড়ে যায় প্রিয়র। তাদের রাত পাহারার মতোই আজ তাহলে বাবাজীরও টহল শুরু হল। কিছুক্ষণের মধ্যেই করতাল বাজিয়ে ভোরাই গান গাইতে গাইতে তাদের কাছে এসে পৌঁছোন বাবাজী। তাদের দেখে অবাক হয়ে বলেন --- কি গো বাবারা সব , তোমরা সবাই এত ভোর ভোর ?
প্রিয় তাদের রাত পাহারা দেওয়ার বিষয়টা খুলে বলে বাবাজীকে। শুনে খেদ ঝড়ে পড়ে বাবাজীর গলায় --- একি হোল বলো তো বাবারা। বহুদিন ধরে তোমাদের গ্রামে টহল দিচ্ছি , কই এমন তো কখনও শুনি নাই। লোকে চুরি-ডাকাতি আটকাতে রাত পাহারা দেয় শুনেছি , কিন্তু ক্ষতি আটকাতে কোথাও রাত পাহারা দিতে হয় বলে শুনি নি। মানুষের মনে এ কি বিষ ঢুকলো গো। তবে মানুষ আর মানুষের কতটুকু ক্ষতি করবে ? "রাখে হরি তো মারে কে ?" সবই তো সেই গোবিন্দর ইচ্ছা গো বাবারা। মানুষের সাধ্যি কি তার বাইরে যায় ? আমি ভিখারি মানুষ, তবু যদি তোমাদের কর্মযজ্ঞে আমার কাজে লাগার কোন সুযোগ ঘটে তাহলে যেন বোল। আসি গো বাবারা।
ভোরাই গাইতে গাইতে গ্রামান্তরে চলে যান বাবাজী। প্রিয় ভাবে, একজন ভিক্ষাজীবি বৈষ্ণব মানুষও তাদের পাশে এসে দাঁড়াতে চাইছেন এর চেয়ে বড় পাওনা আর কিছু হয় না। এইসব মানুষের সমর্থন থাকলে প্রসাদ মোড়লরা বিরোধিতা করে সাময়িক ক্ষতি হয়তো করতে পারবে কিন্তু তাদের পথ চলা থামাতে পারবে না। প্রয়োজনে বাবাজীকেও তাদের চলার পথে সামিল করবে তারা।
বাবাজীর গান শুনতে শুনতে বাড়ির পথ ধরে সবাই। সকালেই তারা প্রসাদ মোড়লের বাড়ি যায়। সেদিন আর লুকিয়ে পড়ার সুযোগ পায় না প্রসাদ মোড়ল। গোয়ালচালায় তাকে ধরে ফেলে প্রিয়রা। সে তখন পরম যত্নে গরুর পরিচর্যা করছিল। প্রিয় ভেবে পায় না যে মানুষ নিজের গরুর প্রতি এত যত্মবান হয় সেই মানুষ কি করে অন্যের গরুর খাবারে বিষ মেশায় ?
গ্রামের লোককে ওইভাবে সদলবলে হাজির হতে দেখে প্রসাদ মোড়লকে কিছুটা যেন ভীতসন্ত্রস্ত দেখায়। আসলে অপরাধীদের মনোভাবটা এমনই হয়। তারাও সব সময় পাল্টা ক্ষতির আশঙ্কায় ভোগেন। প্রসাদ মোড়লও যে সেই আশঙ্কাতেই ভুগছে তা তার চোখ মুখই বলে দেয়। তাই সহসা কোন কথা বলতে পারে না সে। গ্রামবাসীদের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। সেটা দেখেই রাগ সামলাতে পারেন না প্রশান্তকাকা। তার মুখের সামনে হাত নেড়ে বলেন -- অমন করে দেখছো কি ? আজ তোমার ধড়িবাজি ছাড়িয়ে দিচ্ছি দাঁড়াও। এই ভাবে হিসাবে গোঁজামিল দিয়ে দিয়ে ভেবেছো পার পেয়ে যাবে ? তোমার ডানে-বাঁয়ে মিলিয়ে দেওয়া আমাদের বোকা বানানোর হিসাব আমরা ধরে ফেলেছি।
--- মানে , কি বলতে চাইছো তোমরা ?
---- মানেটা যে কি , আর আমরা কি বলতে চাইছি তা তো তোমার মতো ধুরন্ধর লোকের না বোঝার কথা নয়। তবু যখন আমাদের মুখে শুনতে চাইছো তখন বলছি, ভালো করে শুনে নাও হিসাব মতো আমরা এখনও তোমার কাছে এক হাজার টাকা পাব। সেটা এখনই এই মুহুর্তে আমাদের দিতে হবে।
---- অসম্ভব , আর একটি পয়সাও আমি দেব না।
---- দেবে না ? বেশ নগদ টাকা দিতে না চাও দিও না। আমরা তাহলে তোমার হালের বলদ খুলে নিয়ে চললাম। পারলে তুমি আটকে নাও দেখি।
বলেই জীতেনকাকা প্রসাদ মোড়লের হালের বলদ দুটো গোঁজ থেকে খোলার উপক্রম করেন।তা দেখেই প্রসাদ মোড়ল দ্রুত বাড়ির ভিতর গিয়ে দুটো পাঁচশ টাকার নোট এনে তাদের সামনে মাটিতে ছুড়ে ফেলে দেয়।তা দেখে এবার খেপে ওঠেন প্রশান্তকাকা। কড়া গলায় বলে ওঠেন , ওহে শোন তুমি এমন কিছু রাজাধিরাজ নও, আর আমরাও তোমার কাছে ভিক্ষা চাইতে আসি নি যে ওইভাবে ভিক্ষা দেওয়ার মতো টাকাটা ফেলে দেবে। গ্রামের উন্নয়নের টাকাটা তো মেরে দিতে চেয়েছিলে , এখন ধরা পড়ে ফেরত দিতে বুঝি খুব গায়ে লাগছে। টাকাটা ভালো করে তুলে হাতে দাও।
---- যদি না দিই ?
---- আবার কথা ? এবারে সবাই গর্জে উঠেন।
সেই দাবড়ানিতে টাকাটা তুলে প্রশান্তকাকার হাতে দিয়ে প্রসাদ মোড়ল বলেন --- তোমরা খুব বাড়াবাড়ি আরম্ভ করে দিয়েছ কিন্তু। এর ফল তোমাদের ভুগতে হবে। দেখছি তোমাদের ----।
----- আর কি দেখবে ? সব রকম করেই তো দেখলে। এরপর বেশি বাড়াবাড়ি করলে তুমিও বাদ যাবে না। সেদিন বুঝতে পারবে দেখতে তুমি একাই জানো না , আমরাও জানি। চলো সবাই।
সবাইকে ডেকে নিয়ে প্রসাদ মোড়লের বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসেন প্রশান্তকাকা। প্রসাদ মোড়ল আগুন ঝড়া দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে তাদের দিকে। প্রসাদ মোড়লের বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্রশান্তকাকাকে কিছুটা যেন বিমর্ষ লাগে প্রিয়র। প্রসাদ মোড়লের বলদ দুটো দেখে নিজের বলদ হারানোর শোক প্রশান্তকাকার বিমর্ষতার কারণ বলে মনে হয় তার। তবে মাচানতলায় পৌঁছোতেই সেই বিমর্ষতা উধাও হয়ে যায়। বরং উৎফুল্ল গলায় বলে ওঠে , টাকাটা যে এতো সহজে আদায় হবে ভাবতে পারি নি। শয়তানটা তো না করেই দিয়েছিল। নেহাৎ জীতেন হালের বলদ খুলে নেওয়ার হুমকিটা দিল বলে কাজ হল।
জীতেনকাকা বলেন , হুমকি কি গো ? টাকা না দিলে আজ ওর গরু খুলেই ছাড়তাম। তারপর রাতারাতি পাঁচুন্দির হাটে বিক্রি করে আমাদের টাকাটা নিয়ে বাকিটা ওর মুখের সামনে ফেলে দিয়ে আসতাম।
---- বাকিটাও ওকে না দিলে কোন দোষের হত না। গ্রামের মানুষের বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে কতদিন ধরে ও কত টাকা মেরেছে তার তো কোন ঠিক নেই , বলেন প্রশান্তকাকা।
প্রিয় বলে , শেষ ভালো যার , সব ভালো তার। শেষপর্যন্ত ভালোয় ভালোয় টাকাটা আদায় হয়েছে এখন পুরনো হিসাবের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে বরং পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে ভাবা হোক।
প্রিয়র কথার প্রেক্ষিতেই সেইদিনই রেশন বয়কটের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়ে যায়। ঠিক হয় পানীয় জল বয়কটের পর থেকে সাত দিন অতিক্রান্ত হলেই রেশন বয়কটের ডাক দেওয়া হবে।সেই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে সেদিনের মতো সবাই বাড়ি ফিরে যায়। দেখতে দেখতে পোলিও এবং শিক্ষা বয়কটের মতোই পানীয় জল বয়কট প্রত্যাহার পরও সাতদিন পেরিয়ে যায়। কিন্তু এবারেও যথারীতি ডাক্তার আসে না। তাই পূর্ব নির্ধারিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সবার মত অনুসারে পরদিনই রেশন বয়কটের ডাক দেওয়া হয়। প্রিয় কিছুটা দোটানায় পড়ে। এর আগে প্রতিটি কর্মসূচি সে আর্যদার মত নিয়ে চূড়ান্ত করেছে। কিন্তু এক্ষেত্রে সেটা সম্ভব হল না। কালই বয়কটের ডাক না দিলে এক সপ্তাহ অপেক্ষা করত হত। কারণ তাদের এলাকায় সপ্তাহে সাধারণত তিনদিন রেশন দেওয়া হয়।
তার মধ্যে শুক্রবার তাদের গ্রামের জন্য নির্ধারিত। কালই শুক্রবার , তাই বাধ্য হয়েই গ্রামবাসীদের প্রস্তাব মতো তাকে মত দিতে হয়েছে। তাদের সিদ্ধান্তের কথা শুনে আর্যদা মনঃক্ষুণ্ণ হবেন কিনা সেই দুশ্চিন্তা পেয়ে বসে তাকে। পরক্ষণেই মনে হয় এ নিয়ে কোন সমস্যা হবে না বলেই মনে হয় তার। বিষয়টা আর্যদাকে বুঝিয়ে বললেই হবে। তাই সে ফোন করে আর্যদাকে। সব শুনে আর্যদা বলেন , ঠিকই আছে। কিন্তু কাল তো আমাদের অন্যত্র প্রোগ্রাম রয়েছে। তাই আমরা হয়তো যেতে পারব না। তবে খবরটা কভার করে দেব। তেমন হলে না হয় পরশু যাব।
এই আশঙ্কাটাই করছিল প্রিয়। সে জানত হঠাৎ করে প্রোগ্রাম হলে সাংবাদিকরা নাও আসতে পারেন। ওদের তো বিভিন্ন জায়গায় প্রোগ্রাম থাকে। আর সাংবাদিকরা না থাকলে প্রশাসন তাদের এই বয়কটকে আদৌ গুরুত্ব দেবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। এর আগে প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রশাসনের কর্তারা এসে অনুরোধ জানানোর পর তারা বয়কট প্রত্যাহার করেছে। তাই তাদের মুখ রক্ষা হয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সাংবাদিকরা আসে নি জেনে যদি প্রশাসন কোন গুরুত্বই না দেয় তাহলে কি হবে ? অন্যান্য বয়কটের তুলনায় রেশন বয়কটে অবিচল থাকাটা কিছুটা কঠিন। কিন্তু কোন প্রশাসনিক আশ্বাস ছাড়া বয়কট থেকে সরে আসতে হলে পুরো ব্যাপারটাই খুব খেলো হয়ে যাবে। সাংবাদিকরা আসবে না শুনে বাকিরাও মুষড়ে পড়ে। তাদের চোখে মুখে ঘনিয়ে আসে দুশ্চিন্তার কালো ছায়া। কিছুক্ষণের মধ্যেই অবশ্য টিভির খবরে তাদের দুশ্চিন্তা দূর হয়ে যায়।
খবরাখবর চ্যানেলে জেলাশাসক জলিল আহমেদ গ্রামবাসীদের রেশন বয়কট প্রত্যাহারের অনুরোধের পাশাপাশি ডাক্তার নিয়োগেরও আশ্বাস দেন। খবরটা শোনার পর সবার মত জানতে চাই প্রিয়। প্রশান্তকাকা বলেন , আমার মনে হয় এব্যাপারে একবার আর্যবাবুর সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নিলেই ভালো হয়। কথাটা প্রিয়ও ভেবেছিল। তাই ফোনে আর্যকে ধরে সে। তার কথা শোনার আগেই আর্যদা বলে উঠেন , আপনাকেই ফোন করতে যাচ্ছিলাম। আমার মনে হয় জেলাশাসকের আশ্বাসের পর রেশন বয়কট আপনাদের প্রত্যাহার করে নেওয়াই উচিৎ। কারণ অন্যান্য বয়কটের মতো রেশন বয়কটের বিষয়টা প্রশাসনকে খুব একটা চাপে ফেলতে পারে না। তাই প্রশাসন কোন গুরুত্ব না দিলে সাপের ছুঁচো গেলার মতো অবস্থা হতে পারে। সেইজন্যই তো আমি কায়দা করে জেলাশাসকের বক্তব্যটা ধরিয়েছি। জেলাশাসকের ওই বক্তব্যের পর আর রেশন বয়কট প্রত্যাহার করলে অসম্মানের কিছু থাকবে না। জনসমক্ষে বলা যাবে জেলাশাসকের আশ্বাসে বয়কট প্রত্যাহার করা হয়েছে। এই সুযোগ আর নাও মিলতে পারে।
প্রিয় জানায় , আমরাও সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আপনার সঙ্গে আলোচনা করেই তা চূড়ান্ত করা হবে।
---- খুব ভাল কথা। আমিও সংবাদ মাধ্যমে জানিয়ে দেব জেলাশাসকের আশ্বাসে গ্রামবাসীরা রেশন বয়কট প্রত্যাহার করে নিলেন। এতে সবদিক রক্ষা পাবে।
তারপর গ্রামবাসীদের মত নিয়ে আর্যদাকে বয়কট সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের কথা জানিয়ে দেয় প্রিয়। সংবাদ মাধ্যমেও তা প্রচারিত হয়। ডাক্তারের জন্য প্রশাসনের সদিচ্ছার প্রতীক্ষায় দিন গোনেন গ্রামবাসীরা।
( ক্রমশ )
----০---
No comments:
Post a Comment