Short story, Features story,Novel,Poems,Pictures and social activities in Bengali language presented by Arghya Ghosh

অন্তরালে -- ২৭


   

     অন্তরালে 


            অর্ঘ্য ঘোষ 




   ( ধারাবাহিক উপন্যাস ) 




সেই প্রতীক্ষাতেই কেটে যায় ৬ মাস। তবুও ডাক্তার আসে না গ্রামে। আন্দোলনে কিছুটা ভাঁটা পড়লেও ডাক্তারের দাবি থেকে সরে আসেন নি গ্রামের মানুষ। ততদিনে আরও অনেককে ছোট-বড়ো ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে। কিন্তু কেউ মনোবল হারান নি।  বিচ্ছিন্ন হয়েও পড়েন নি। সেক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে রাত পাহারা।  রাত পাহারা তাদের একসূত্রে বেঁধে রেখেছে। দিনের বেলায় সবদিন সবার সঙ্গে দেখা নাহলেও রাত পাহারা দিতে  গিয়ে রোজ দেখা হয়। সবার সবদিন পালি থাকে না, তবুও মাচানতলায় সবাই একবার করে মিলিত হয় তারা। তখন পারস্পরিক সুখ-দুঃখের কথা হয় , সমস্যার কথা জানতে পারে সবাই। সেই মতো বিপন্ন পরিবারের পাশে দাঁড়ায় তারা। বয়কট আন্দোলন তাদের ডাক্তার দিতে না পারলেও সেই যে তাদের একসূত্রে বেঁধে দিয়েছে সেই বাঁধন আজও অটুট রয়েছে। আজও তারা ডাক্তারের আশা ছাড়ে নি। বরং নতুন ভাবে আন্দোলন শুরু করার কথা ভাবে। কিন্তু এরপর কি আন্দোলন করবে সেটাই ভেবে পায় না। আর নতুন করে বয়কট করার মতো সরকারি কোন পরিষেবাও নেই। তাই আলাপ - আলোচনার স্তরে থমকে থাকে পরবর্তী আন্দোলন। কিন্তু সেদিন ক্লাব ঘরে টিভি দেখতে দেখতেই তারা খুঁজে পায় পরবর্তী আন্দোলনের পথ। খবরাখবর চ্যানেলের খবরে, নদীয়া জেলার একটি খবর তাদের ফের আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করে তোলে। ওই খবরে দেখা যায় একদল ভাগচাষি এবং খেতমজুরের আন্দোলনের চাপে তাদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয় প্রশাসন। ওইসব খেতমজুর এবং ভাগচাষিরা কাঠা প্রতি ১ টিন হারে ধান দেওয়ার চুক্তিতে অন্যের জমিতে বোরো ধান চাষ করেছিলেন। কিন্তু ধান ওঠার মুখে শিলাবৃষ্টিতে সব শেষ হয়ে যায়। সেইজন্য সরকার ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করে। নিয়মানুযায়ী সেই ক্ষতিপূরণ সরাসরি জমি মালিকের পাশবইয়ে পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরুও হয়ে যায়। সেটা জানার পরই ওইসব ভাগচাষি আর খেতমজুরেরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। তারা প্রশ্ন তোলেন , ওই ধান চাষের জন্য তাদেরই সমস্ত খরচ করতে হয়েছে , তাদেরই পরিশ্রম দিতে হয়েছে,  তাহলে মালিকানার শর্তে শুধু জমির মালিকই কেন ক্ষতিপূরণ পাবেন ? আসল ক্ষতি তো তাদেরই হয়েছে , তাহলে তাদের কেন বঞ্চিত হতে হবে ? সিঙ্গুরে কারখানা গড়ার সময় যদি মালিকদের সঙ্গে যারা জমি চাষ করতেন তারাও ক্ষতিপূরণ পান তাহলে এক্ষেত্রে কেন ওই নীতি অনুসৃত হবে না ? প্রশাসনের সকল স্তরে দাবি জানিয়ে ক্ষতিপূরণের আশ্বাস দুরের কথা কোন সদুত্তরই মেলে নি।ওইসব খেতমজুর , ভাগচাষিরা তাই ক্ষুব্ধ হয়ে স্ত্রী - ছেলেমেয়ে নিয়ে বি,ডি,ও অফিসের সামনে অনিদ্দিষ্ট কালের জন্য অনশনে বসেন। প্রথমদিকে প্রশাসন তাদের কোন গুরুত্বই দেয় নি। কিন্তু বেলা  বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলো খিদের জ্বালায় চিৎকার শুরু করে দেয়। মায়েরা তাদের জোর করে চুপ করানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তাতে তাদের কান্না আরো বেড়ে যায়। সেই সময় বি,ডি,ও সহ সরকারি কর্মীরা নিজ নিজ চেম্বারে টিফিন খাচ্ছিলেন। সংবাদ মাধ্যমে একদিকে খিদের জ্বালায় অভুক্ত বাচ্চাদের কান্না , অন্যদিকে প্রশাসনিক আধিকারিকদের আয়েস করে  টিফিন  খাওয়ার ছবি তুলে ধরা হয়। তারপরই চারিদিকে ছি-ছিকার ওঠে। সরাসরি বিভিন্ন স্তরের মানুষের বক্তব্য সম্প্রচার করা হয়। কেউ বলেন -- কসাই নাকি ওরা ? বাইরে বাচ্চাগুলো খিদের জ্বালায় কাঁদছে আর ওরা ভিতরে মুরগির ঠ্যাং চিবুচ্ছে।কেউ বা বলেন , ওদেরকেই ঠান্ডাঘর থেকে ঘাড় ধরে বার করে নিয়ে গিয়ে রোদে লাঙ্গল চালাতে বাধ্য করা দরকার। তবেই ওদের যন্ত্রণাটা টের পাবে কসাইগুলো।



                    মুহুর্তের মধ্যে ওইসব কথাবার্তা সারা অফিসময় ছড়িয়ে পড়ে। চরম অস্বস্তিতে পড়ে যান বি,ডি,ও এবং অন্যান্য আধিকারিকরা। তারা অনশনকারীদের কাছে গিয়ে অনশন প্রত্যাহার করার জন্য অনুনয় বিনয় করতে থাকেন। কিন্তু অনশনকারীরা তা কানেই তোলেন না। এমন কি বাচ্চাদের জন্য খাবার আনা হলেও তা কাউকে খেতে দেন না। ওই ঘটনার জেরে শিকেয় ওঠে বি,ডি,ও অফিসের কাজ কর্ম। দফায় দফায় সংবাদ মাধ্যমে সেই সংবাদ সম্প্রচারিত হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত বি,ডি,ও অফিসে ছুটে আসতে বাধ্য হন ডি,এম। সরাসরি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে ফোন করে বিষয়টি জানান তিনি।অনশনকারীদের দাবির যৌক্তিকতা স্বীকার করতে বাধ্য হন মুখ্যমন্ত্রী। জেলাশাসককে বরাদ্দ ক্ষতিপূরণের অর্ধেক অনশনকারীদের দেওয়ার নির্দেশ দেন তিনি। তারপরই অনশন প্রত্যাহার করে নেন অনশনকারীরা। এতক্ষণ চ্যানেল ঘুরিয়ে ওই খবরেই ডুবেছিলেন 'জীবন সুরক্ষা' কমিটির সদস্যরা। খবর শেষ হতেই প্রিয় বলে -- আচ্ছা আমরা যদি ওইসব চাষিদের মতোই বি,ডি,ও অফিসে অনশনে বসি কেমন হয় ? 
তার কথা শেষ হতে না হতেই প্রশান্তকাকা বলে ওঠেন -- আমিও সেই কথাই বলতে যাচ্ছিলাম। ওরা যদি পারে তাহলে আমরাই বা পারব না কেন ? একবার শেষ চেষ্টা করেই দেখা যাক।
জীতেনকাকা বলেন -- অবশ্যই। কিছু একটা করতেই হবে। প্রসাদ মোড়ল আর তার চামচেদের টিটকারি আর সহ্য হয় না।
একই মত প্রকাশ করে অন্যরা। ঠিক হয় কালই একবার আর্যর সঙ্গে আলোচনা করে দিনক্ষণ সব পাকা করে ফেলা হবে। সেইমতো পরদিনই সকাল সকাল বোলপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় প্রিয়। আজ অবশ্য তার বোলপুরে যাওয়ার কথা ছিল না। আজ তো রবিবার।চেম্বার খোলা থাকলেও রবিবারে ডাক্তারবাবুর ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধ থাকে।সে এখনও ওই সেন্টারেই কাজ করে।তার ট্রেনিংয়ের কোর্স সম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছে , তবু ডাক্তারবাবুই তাকে সরকারি চাকরি-বাকরি  না পাওয়া পর্যন্ত ডায়াগনস্টিক সেন্টারেই কাজ করতে বলেছেন। চেম্বারের কর্মীদের থেকে ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কর্মীদের বেতন কিছুটা বেশি। তাদের সংসারে ওই বর্ধিত বেতনে অনেকটা সুসার হবে বলেই যে ডাক্তারবাবু তাকে সেন্টারে কাজ দিয়েছেন তা বোঝে প্রিয়। ডাক্তারবাবুর জন্যই তো ধানের পালুই পুড়ে যাওয়ার ধাক্কাটা তারা সামলাতে পেরেছে। সেই দুঃসময়ে দেওয়া হাজার টাকাটা কতবার ফেরত দিতে গিয়েছে প্রিয়।ডাক্তারবাবু কানেই তোলেন নি। হাত নেড়ে বলেছেন , সে  হবে ক্ষণ। ওটা নিয়ে অত না ভাবলেও চলবে। তুমি এখন সেন্টারের কাজে হাতটা পাকাও আর চাকরির চেষ্টা চালিয়ে যাও। ডাক্তারবাবুর মতো মানুষ হয় না। সেই দুঃসময়ে সাহায্যের  হাত বাড়িয়ে না দিলে বাবা-মায়ের দুশ্চিন্তা সে কিছুতেই দুর করতে পারত না। সেই ঋণ এ জীবনে শোধ করতে পারবে না প্রিয়। সেই চেষ্টাও করবে না। কিছু কিছু মানুষের কাছে ঋণী থাকতেও ভালো লাগে। কিছু কিছু ঋণ শোধ করাও যায় না। কারণ সব ঋণ তো আর অর্থমূল্যে নির্ধারণ করা যায় না। 




                     ডাক্তারবাবুর কথা ভাবতে ভাবতে আর্যদার বাড়ি পৌছোয় প্রিয়। আন্দোলন থেমে থাকলে গ্রামবাসীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে আর্যর। কখনও ওরা আসে , কখনও বা ফোনের মাধ্যমে কথা হয়। ডাক্তার নিয়োগের বিষয়টি নিয়ে আর্যও অস্বস্তির মধ্যে রয়েছে। তার পরামর্শ নিয়েই গ্রামবাসীরা আন্দোলন শুরু করেছিলেন। পরেও প্রতিটি ব্যাপারেই তার মত নিয়েছেন। তাকে নিজেদের মধ্যেই একজন ধরে নিয়েছিলেন তারা। একজন সাংবাদিকের কাছে এটা কম বড়ো পাওয়া  নয়। সে নিজেও কবে যেন ওই আন্দোলনেরই শরিক হয়ে উঠেছিল।এত কিছুর পরেও ডাক্তার নিয়োগ না হওয়ায় তারও নিজেকে ব্যর্থ মনে হয়। তাই একদিন সে সরাসরি জেলাশাসককে জিজ্ঞেস করেছিল -- একটা গ্রামের মানুষ এতদিন ধরে ডাক্তারের দাবি জানাচ্ছেন। আপনারা কি একটা ডাক্তার দিতে পারেন না ? 
---- পারি তো।
---- পারেন , তাহলে দিচ্ছেন না কেন ?
---- দেখুন এই দাবির মুখে যদি আমরা ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে  ডাক্তার বহাল করি তাহলে সবাই ছোটখাটো বিষয় নিয়েও আন্দোলন শুরু করে দেবে। তখন পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে একবার ভাবুন তো ? দেখা যাবে কুকুরের চিৎকারে রাতে ঘুম হচ্ছে না তো একটি পাড়ার লোক কুকুর ধরার দাবিতে পোলিও বয়কট শুরু করে দিলেন। কোথাও মশা-মাছি কানের কাছে ভন ভন করছে তো, মশা-মাছি মারার দাবিতে পানীয় জল বয়কট শুরু করে দিলেন সেই গ্রামের মানুষ। 
ডি, এম সাহেবের শ্লেষাত্মক কথাগুলো শুনে খুব রাগ হয়ে যায় আর্যর। বলে কি লোকটা ? জেলা প্রশাসনের সর্বময় কর্তা হয়েও মানুষের আবেগ, অনুভূতি নিয়ে এত হাল্কা চালে কথা বলতে পারলেন ? তবু নিজেকে সংযত করে সে বলে ---কিন্ত দাবিটা তো অনায্য নয়। প্রশাসন যদি তার দায়িত্ব পালন না করে তাহলে তো মানুষকে আন্দোলনকে হাতিয়ার করতেই হয়। এই করতে গিয়ে যদি বড়ো রকম অঘটন কিছু ঘটে যায় তখন কি হবে ? 
---- প্রশাসনিক ভাবেই তার মোকাবিলা করা হবে।
সেদিন আর কোন কথা বলতে পারে নি আর্য। জেলাশাসকের কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল সে। কি অদ্ভুত যুক্তি! স বাই উন্নয়নের দাবিতে আন্দোলন করে বসতে পারে বলে আন্দোলনের মুখে ডাক্তার দেওয়া যাবে না!  বরং ওই দাবিকে দাবিয়ে রাখার জন্য ডাক্তার পাঠানোর ক্ষমতা থাকা স্বত্ত্বেও উদাসীনতা অবলম্বন করা হবে। কথাটা অবশ্য গ্রামবাসীদের বলতে পারে নি আর্য। তারা মনে আঘাত পেতে পারেন ভেবেই সে বলে নি কথাটা। প্রিয়কে দেখে সেই কথাটাই মনে পড়ে যায় তার। তাকে দেখে কিছুটা আশ্চর্যও হয়। পরশুই তো ফোনে কথা হল , কই আসার কথা তখন কিছু বলল না তো ? তাহলে কি হঠাৎ গুরুতর কোন কিছু ঘটে গেল নাকি ?
প্রিয়র মুখের দিকে উদ্বেগ ভরা দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে আর্য। সেটা লক্ষ্য করে তার আসার উদ্দেশ্যটা খুলে বলে প্রিয়। কথাটা শোনার পর আর্য বলেন , কাল টিভিতে আমিও খবরটা দেখেছি। ভালই হল আপনি এসেছেন। বিষয়টি নিয়ে আপনাদের সঙ্গে কথা বলব ভাবছিলাম। শেষ চেষ্টা হিসাবে আর একবার অনশন করে দেখা যেতেই পারে। তবে তার আগে পুরো বিষয়টি লিখিতভাবে প্রশাসনের সকল স্তরে জানিয়ে দিতে হবে।
আরও কিছুক্ষণ আলোচনার পর গ্রামে ফিরে আর্যদার কথাটা সবাইকে বলে প্রিয়। তারপরই শুরু হয়ে যায় নতুন উদ্যোমে আন্দোলনের প্রস্তুতি।



         ( ক্রমশ )  

       নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 


শীঘ্রই দেশ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হতে চলেছে আমার তৃতীয় উপন্যাস ------
  
                                  


                       ----০---



No comments:

Post a Comment