অন্তরালে
অর্ঘ্য ঘোষ
( ধারাবাহিক উপন্যাস )
পরদিনই প্রিয় আর ঋজু যাত্রার বই কিনতে সাঁইথিয়া যায়। শিক্ষালয় থেকে পছন্দ করে দুটো যাত্রার বই কিনে ফেরার সময় ফিমেল, পোশাক, বিবেক , যন্ত্রীদের জন্য কথা বলতে লাভপুরের যাত্রাপাড়ায় নামে তারা। কিন্তু যাত্রাদলের ম্যানেজারদের সঙ্গে কথা বলে, তাদের হতাশ হয়ে পড়তে হয়। কারণ যাত্রাপাড়ার ৭ টি দলের মধ্যে ৬ টি দলের মানেজারদের সঙ্গে কথা বলে তারা জানতে পারে তাদের পান্তা নবান্নের দিনে অন্যত্র চুক্তি হয়ে গিয়েছে। তাই তাদের নিয়ে যাত্রা করতে হলে দিন পাল্টাতে হবে। বাকি দলটির আবার বিবেক গায়ক নেই। ম্যানেজার শিবপ্রসাদ দাস জানিয়ে দেন , কিছু করার নেই। হয় যাত্রার বই থেকে বিবেকের গান বাদ দিতে হবে, নয়তো নিজেদেরই কাউকে গাইতে হবে।শুনে খুব দোটানায় পড়ে যায় প্রিয়রা। কাছে পিঠে যাত্রাপার্টি বলতে রয়েছে সেই কাটোয়ায়।
কিন্তু সেখান থেকে দল এনে যাত্রা করা আবার তাদের পৌঁছে দিয়ে আসা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। অন্যান্য বছর হলে তাও কথা ছিল। এবার যাত্রার পরেই অনশন কর্মসূচি রয়েছে। সেইদিকে নজর দেবে না , যাত্রাপার্টিকে পৌঁচ্ছে দিতে যাবে ? তাছাড়া কাটোয়াতেও যে যাত্রা পার্টির বায়না হয়ে যাবে না তার নিশ্চয়তা কি আছে ? তাদের নবান্নের দিনেই আশেপাশের গ্রামেও নবান্ন রয়েছে। ওইসব গ্রামেও যাত্রার চল রয়েছে। তাই লাভপুরের মতো কাটোয়ার যাত্রাদলগুলিরও বায়না হয়ে যাওয়ারই কথা। লাভপুরের যাত্রাদলের লোকেরাও সেই কথাই বললেন। অগত্যা নারায়ণী অপেরার সঙ্গেই চুক্তি করে বায়না করার সিদ্ধান্ত নেয় প্রিয়। সেটা শুনে ঋজু বলে , বিবেক ছাড়া যাত্রা হয় নাকি আবার ?
---- বিবেক ছাড়া যাত্রা হবে কে বলেছে ?
---- তাহলে কি তুই গাইবি ?
----- দরকার হলে গাইতে হবে।
মুচকি হেসে ম্যানেজারের হাতে বায়নার টাকাটা ধরিয়ে দিয়ে গদিঘর থেকে বেরিয়ে আসে প্রিয়। সে অবশ্য মনে মনে বিকল্প একটা ব্যবস্থা ভেবেই বায়নাটা করেছে। সেটা হলে ভালো বই খারাপ হবে না। কিন্তু এখনই সে ঋজুদার কাছে সেটা খোলসা করে না। ঋজুও কৌতুহল চেপে রাখতে পারে না। ফেরার পথে প্রিয়কে জিজ্ঞেস করে -- আচ্ছা তোর
পরিকল্পনাটা কি বলতো ? তুই কি সত্যি সত্যিই বিবেকের গান করবি নাকি ?
রহস্যময় গলায় প্রিয়ও বলে , ওই যে তখন বললাম দরকার হলে করতে হবে।বিবেক গায়ক অভাবে যাত্রা হবে না , এটা তো হতে পারে না।
---- কি জানি বাবা , তোর মতিগতি ঠিক বুঝতে পারছি না। শেষে ডোবাবি না তো ? আমাদের গ্রামের যাত্রার কিন্তু সুনাম আছে, দেখিস সেটা যেন থাকে।
---- আরে অত ভাবছ কেন। সুনামটা তো বেড়ে যেতেও পারে ।
---- সেটা হলে তো কথাই নেই।
--- দেখাই যাক না।
বলে প্রিয় গ্রামে ঢোকার আগে ঋজুদাকে একটুক্ষণ রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রেখে একবার গঙ্গাধর বাবাজীর আখড়ায় ঢোকে। আখড়ায় তখন বাবাজী-মাজী কেউ ছিলেন না। দু'জনেই মাধুকরীতে গ্রাম ঘুরতে বেরিয়েছেন। আখড়াতে সে সময় এক ভক্ত ছিলেন। বাবাজীকে সন্ধ্যেবেলায় মাচানতলায় আসার জন্য তাকে বলেই আখড়া থেকে বেরিয়ে আসে প্রিয়। ঋজু কিছু প্রশ্ন করার আগেই তার হাতে যাত্রার বই দুটো দিয়ে বাড়ির পথ ধরে ফেলে সে।
যেতে যেতেই হাত নেড়ে বলে -- বেশ ওই কথাই রইল তাহলে, সন্ধ্যেবেলায় মাচানতলায় দেখা হচ্ছে। তুমি ততক্ষণ পারলে বইগুলো সবাইকে একটু চোখ বুলিয়ে নিতে বলো।
বাড়ি ফিরে খাওয়া দাওয়া করার পর মা বলেন , হ্যারে এর মধ্যে নবান্নে আসার জন্য বেহাই মশাইদের একদিন নিমন্ত্রণ করে আসতে হবে। কবে যেতে পারবি দেখ।
কথাটা শুনেই মনটা আনন্দে নেচে ওঠে প্রিয়র। নিমন্ত্রণ করতে গেলেই স্বাতীর সঙ্গে দেখা হবে। তারপর যখন নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে আসবে তখন স্বাতীর সান্নিধ্য লাভের সুযোগ ঘটতে পারে।
---- কি রে কি ভাবছিস ? মায়ের কথায় ভাবনার জগত থেকে ফেরে প্রিয়। বলে , ভাবছি অনশনের প্রচার করতে তো ওদের গ্রাম যাবই। তখন যদি বলে আসি ?
--- না রে সেটা ভালো দেখায় না। অন্য কেউ হলে তাও কথা ছিল। কিন্তু মেয়ের শ্বশুরবাড়ি বলে কথা। তুই বাবা আলাদা করে একদিন গিয়ে বলে আয়।
প্রিয়ও মনে মনে সেটাই চাইছিল। প্রচারে যাওয়ার সময় কেউ না কেউ তো সঙ্গে থাকবেই , তাই স্বাতীর সঙ্গে ভালো করে কথাও বলতে পারবে না। কিন্তু একা গেলে সেই সমস্যা হবে না। তাই কপট উদাসীনতার ভাব দেখিয়ে বলে , বেশ বলছ যখন তখন না হয় যাব একদিন।
ছেলের কপটতা ধরতে অসুবিধা হয় না হরপার্ব্বতীর। খুব হাসি পায় তার। প্রিয়র ভাবখানা দেখে মনে হয় নেহাৎ মা বলছে বলে তাকে যেতে হচ্ছে। নাহলে তার যেন একেবারেই যাওয়ার ইচ্ছে নেই। প্রিয়ও বোঝে তার ভাবের ঘরে চুরি, মায়ের কাছে ধরা পড়ে গিয়েছে। তাই সে পালিয়ে বাঁচে। পুলকিত মন নিয়েই মাচানতলায় পৌঁছোয় সে। ততক্ষণে অনেকেই পৌঁছে গিয়েছে সেখানে। ঋজুদার কাছে থেকে বই নিয়ে পচ্ছন্দও করা হয়ে গিয়েছে। সবাই অভ্র রায়ের লেখা 'আলোর ঠিকানা ' বইটাই পচ্ছন্দ করেছেন।সে পৌঁচ্ছোতেই শুরু হয়ে যায় পাঠ নির্বাচনের পর্ব। এতদিন প্রসাদ মোড়লই এ ব্যাপারে ছড়ি ঘোরাত। সেই ঠিক করে দিত কে কি পাঠ করবে। তার ছেলে অরবিন্দের নায়কের পাঠ ছিল বাঁধা। সে নিজের চরিত্র ঠিকমতো ফুটিয়ে তুলতে পারত না। কিন্তু বাবার দৌলতে নায়কের চরিত্রটা তারজন্যই বরাদ্দ ছিল। এ নিয়ে অন্যান্য অভিনেতাদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ থাকলেও কেউ প্রকাশ করার সাহস করত না। তাহ
লে হয়তো যাত্রাটাই বন্ধ হয়ে যেত। প্রসাদ মোড়ল নিজে অবশ্য অভিনয় করত না। সে প্রম্পট আর পরিচালনা করত। আর কেউ সুখ্যাতি অর্জন করলে তার কৃতিত্ব দাবি করত। যেন তার পরিচালনার গুণেই এমনটা হয়েছে। কিন্তু নিজের ছেলের অক্ষমতার দায় স্বীকার করত না। তাই প্রসাদ মোড়ল না থাকায় সবার মধ্যেই একটা খুশী খুশী ভাব কাজ করে।
প্রশান্তকাকা তো বলেই ফেলেন -- ভালোই হয়েছে সবজান্তাটা নেই। এবারে না থাকার দলে তো ওরা দুই বাপ ব্যাটা। প্রম্পট আর পরিচালনাটা এবার থেকে বরং অশ্বিনীদাই করবেন। প্রসাদ মোড়লের থেকে অনেক গুণে ভালো হবে।
একেবারে খাঁটি সত্যি কথা। অশ্বিনীমাস্টারের নাটক সম্পর্কে যথেষ্ট ভালো জ্ঞান থাকা স্বত্ত্বেও এতদিন প্রসাদ মোড়লের দাপটে কোন গুরুত্ব পান নি। প্রিয় জানে , শুধু তাদের যাত্রাই নয়। প্রতিটি ক্ষেত্রে আসল গুণী মানুষেরা কোণঠাসা হয়ে প্রচারের আড়ালেই থেকে যান। আর কিছু প্রচারলোভী সুবিধাখোর মানুষ প্রভাব প্রতিপত্তির জোড়ে দাপিয়ে বেড়ান। খুব দৃষ্টিকটু লাগলেও তা আস্তে আস্তে চোখ সহা হয়ে যায়। অশ্বিনীমাস্টার পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়ায় খুব ভালো লাগে প্রিয়র। পরিচালক নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর অবধারিত ভাবে যে প্রশ্নটি উঠে আসে সেটি হলো , বিবেকের কি হবে ? প্রশান্তকাকা প্রিয়র দিকে ফিরে বলেন -- ঋজু বলছিল তুই নাকি বিবেক গাইবি ? বিবেক গাওয়া কিন্তু সহজ নয় , পারবি তো ? শেষ পর্যন্ত প্রসাদ মোড়লদের টিটকিরি শুনতে হবে না তো ?
---- আমার উপর ভরসা রেখেই দেখুন না , কি করি আমি।
প্রশান্তকাকার কথা শুনে প্রিয় বুঝতে পারে বিবেকের বিষয়টি নিয়ে সবাই খুব উদ্বেগে রয়েছেন। তারও উদ্বেগ কম হয় না।
সে যা ভেবেছে শেষ পর্যন্ত সেটা হবে তো ? ঘন - ঘন রাস্তার দিকে তাকায় প্রিয়। তার চাপা উদ্বেগটা কেউ লক্ষ্য করে না। তাই, পার্ট নির্বাচন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সবাই। উদ্বেগ ভুলে প্রিয়কেও তাতে মন দিতে হয়। সেই সময় ' জয় হোক বাবারা সব , জরুরী তলব কেন গো ?' বলে ক্লাব ঘরে ঢোকেন গঙ্গাধর বাবাজী।ঘাড় ঘুরিয়ে বাবাজীকে এসময় ক্লাব ঘরে দেখে সবাই কিছুটা অবাকই হয়। কেবল হাসি ফুটে ওঠে প্রিয়র মুখে।
সে বলে , আসুন - আসুন। আমরা একটা সমস্যায় পড়ছি। আপনাকেই উদ্ধার করতে হবে।
---- সে কি গো বাবারা , আমি ভিক্ষারী বৈষ্ণব মানুষ। আমি উদ্ধার করার কে ? উদ্ধার তো স্বয়ং ইশ্বর করবেন গো। তবু বলো শুনি তোমাদের সমস্যাটা , যদি কোন কাজে লাগতে পারি দেখি।
প্রিয় বলে , দেখাদেখি নয় , আপনাকে পারতেই হবে। এতে গোটা গাঁয়ের মান-সম্মান জড়িয়ে আছে। আপনি না করতে পারবেন না। আপনাকে আমাদের যাত্রায় বিবেক গাইতে হবে।
--- কিন্তু আমি কি পারব ?
--- খুব পারবেন। আপনার ভরাট গলায় টহল, কানে যেন মধু ঢালে। শুধু বিবেকই নয় , আরও একটি কাজ আপনাকে এই গ্রামের জন্য করতে হবে ?
---- আবার কি কাজ গো বাবা ?
----- আগে তো আপনি মুখে মুখে সমাজের বিভিন্ন অব্যবস্থা নিয়ে গান বেঁধে গাঁয়ে গাঁয়ে চারণ গান গেয়ে বেড়াতেন। আমাদের অনশন কর্মসূচিতেও আপনাকে সেই ভূমিকা নিতে হবে। আমাদের উদ্দেশ্য আপনাকে গানের মাধ্যমে আরও অনেক গাঁয়ে পৌঁচ্ছে দিতে হবে। আমার ধারণা মাইক বা অন্যান্য প্রচারের থেকে আপনার চারণ গান মানুষকে অনেক বেশি উদ্বুদ্ধ করবে। অনেকেই আমাদের সমর্থন জানাবেন। তাতে কাজটা অনেক সহজ হবে।
এতক্ষণ প্রিয়র কথা শুনতে শুনতে কথা হারিয়ে ফেলেছিল সবাই। প্রথম মুখ খোলেন প্রশান্তকাকা। উচ্ছ্বসিত গলায় বলে -- অভাবনীয় ভাবনা। এর থেকে ভালো আর কিছু হয় না। আমাদের এই আবদার আপনাকে রাখতেই হবে বাবাজী।
---- তোমরা ভালোবেসে আমাকে এত বড়ো দায়িত্ব দিতে চাইছ আমি কেমন করে তা অস্বীকার করি বলো। বেশ গো বাবারা, তোমাদের এই সেতুবন্ধনের যজ্ঞে আমি কাঠবেড়ালির ভুমিকা পালন করব।
বাবাজীর কথা শুনে স্বস্তি ফেরে সবার মনে।
( ক্রমশ )
Excellent
ReplyDelete