অন্তরালে
অর্ঘ্য ঘোষ
( ধারাবাহিক উপন্যাস )
টানা পনেরো দিন যমে- মানুষেটানাটানির পর জ্ঞান ফেরে প্রিয়র।চোখ মেলে চাইতেই দেখতে পায় অনেকগুলো ঝাপসা মুখ চেয়ে আছে তার দিকে। মুখগুলো একে একে স্পষ্ট হয়। মধুরিমা , স্বাতী , প্রশান্তকাকা, জীতেনকাকা, আর্যদা আরও অনেক মুখ। মুখগুলোর মাঝে তার চোখ আর একটা মুখ খুঁজে বেড়ায়।কিন্তু সেই মুখটা দেখতে পায় না সে। একটা মুখ ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে তার দিকে।সেই মুখটা দেখেই সে বুঝতে পারে তার চোখ যে মুখটাকে খুঁজছিল সেই মুখটা কেন নেই ?
বাবার ন্যাড়া মাথাই বুঝিয়ে দেয় মা আর নেই। সেদিনই তো সে মায়ের মাথাটা কোলে নিয়ে চেতনা হারিয়েছিল। চোখের সামনে সেদিনের সেই বীভৎস ছবিটা ভেসে ওঠে। সে এমনই অধম সন্তান মায়ের মুখে আগুনটুকু পর্যন্ত দিতে পারল না। মায়ের মুখে আগুন দিতে হল বাবাকে। তার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে জলের ধারা। বাবা এগিয়ে এসে তার কপালে হাত রাখেন। তার চোখের জল মুছিয়ে দিতে গিয়ে বাবাও কেঁদে ফেলেন। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না প্রিয়। সেও ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। বাবা বলেন , কাঁদিস না বাবা। তোর মা চলে গেল। এখন তুইও যদি ভেঙে পড়িস তাহলে আমি কি করে থাকি বলত ?
বাবার কথা শুনে প্রবল কান্নায় ভেঙে পড়ে প্রিয়।অশ্রুরুদ্ধ গলায় বলে -- আমার জন্যই মাকে চলে যেতে হল। আমি যদি এই আন্দোলন শুরু না করতাম তাহলে মাকে চলে যেতে হত না। সেইজন্য মা আমার হাতে আগুন পর্যন্ত নিলেন। মা-- মাগো, তুমি ফিরে এসো মা।
সেইসময় একজন নার্স এসে বলেন -- রোগীর কাছে এত লোক ভীড় করবেন না। ওনার ব্রেনে চাপ পড়বে। ডাক্তারবাবু দেখতে পেলে আমাদের বকাবকি করবেন। একজন বাদ দিয়ে সবাই বাইরে যান প্লিজ।
সেই কথা শুনে সবাই একে একে দরজার দিকে পা বাড়ায়। স্বাতীও বেরিয়ে যাচ্ছিল। মধুরিমা তার কাছ গিয়ে কানে কানে কিছু বলে। তারপর প্রিয়র বেডের কাছে ফিরে যায় স্বাতী। বাকিরা সবাই ঘর থেকে বেড়িয়ে যেতেই সে প্রিয়র মাথার কাছে টুলটা টেনে নিয়ে বসে।আলতো হাতে প্রিয়র চোখের জল মুছিয়ে দেয়। কিন্তু সান্ত্বনা দেওয়ার কোন ভাষা খুঁজে পায় না। কি সান্ত্বনা দেবে ? প্রিয় যে কত মাতৃভক্ত সন্তান তার তো তা অজানা নয়। মাও ছিলেন ছেলে অন্ত প্রাণ।
ছেলে আন্দোলনের হোতা , তাই মা অনশনে না গেলে গ্রামের মানুষের চোখে ছেলে ছোট হয়ে যাবে বলে কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে বি,ডি,ও অফিসে গিয়েছিলেন। প্রিয়ই স্বাতীর একটা হাত নিজের হাতে তুলে নিয়ে সান্ত্বনা খোঁজার চেষ্টা করে। স্বাতী বলে , লক্ষ্মীটি তুমি একটু শান্ত হও। তোমার মনের কষ্টটা আমিও অনুভব করছি। কিন্তু ডাক্তারবাবু বলেছেন মাথায় বেশি চাপ পড়লে তোমার ক্ষতি হতে পারে।
---- কি আর ক্ষতি হবে ? বড়োজোর মরে যাব এই তো ? মা গিয়েছে , আমিও চলে যাব।
সঙ্গে সঙ্গে প্রিয়র মুখে হাত চাপা দিয়ে স্বাতী বলে , তোমার কিছু হয়ে গেলে আমি কি নিয়ে থাকব ? তাছাড়া তুমি যদি এভাবে ভেঙে পড়ো তাহলে তো মায়ের আত্মা শান্তি পাবে না ?
---- কেন ?
---- মায়ের মনের ইচ্ছা অপূর্ণ থাকলে মা শান্তি পাবেন ?
---- মায়ের মনে ইচ্ছা মানে ?
--- তোমরা ডাক্তারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছিলে। মা'ও তো মনে মনে তাই চেয়েছিলেন। তাই তো তোমাদের সব কাজে সমর্থন যুগিয়েছিলেন তিনি।এখন মায়ের সেই আশা পূরণ না করে তুমি যদি এভাবে ভেঙে পড়ো তাহলে তিনি শান্তি পাবেন ?
---- তুমি ঠিক বলেছো স্বাতী। মায়ের জীবন দান আমি বৃথা হতে দেব না।
---- ঠিকই তো।
---- কিন্তু কি করে আমি মায়ের আশা পূরণ করব ? এরপর আর কি কেউ আন্দোলন করতে আসবে ?
---- কে বললে আসবে না ? তুমি জানো ? 'জীবনসুরক্ষা' কমিটির লোকেরা আরও এককাট্টা হয়ে উঠেছেন। তারা মাচানতলায় মায়ের শহীদবেদী নির্মাণ করাচ্ছেন। সেই শহীদবেদী ছুঁয়ে সবাই ফের ঝাঁপিয়ে পড়ার শপথ নেবেন।সেইজন্য সবাই তোমার ফেরার অপেক্ষায় রয়েছেন। তবে ডাক্তার নিয়ে আর মন হয় আন্দোলন করতে হবে না।এবারে খোদ মুখ্যমন্ত্রী হস্তক্ষেপ করেছেন। মায়ের মৃত্যুর খবর সংবাদ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পরই একমাসের মধ্যে ডাক্তার নিয়োগের পাশাপাশি স্বাস্থ্যকেন্দ্রটিকে হাসপাতালে উন্নীত করার ঘোষণা করেছেন তিনি। আর সেই হাসপাতালে তোমাকে একটা চাকরি দেওয়া হবে বলেও ঘোষণা করা হয়েছে।
স্বাতীর কথা শেষ হয় না। স্থান কাল ভুলে প্রিয় চিৎকার করে --- না , যে সরকারের পুলিশ আমার মাকে গুলি করে মেরেছে সেই সরকারের দয়ার দানের চাকরি আমি করব না।
প্রিয় আচমকা চিৎকার করে ওঠায় কিছু বলার সুযোগ পায় না স্বাতী। সেই নার্সটি এগিয়ে এসে বলেন , আর তো আপনাকেও আমি থাকতে দিতে পারছি না। তাছাড়া ভিজিটিং আওয়ার্স শেষ হয়ে এল। প্লিজ আপনি এবার বাইরে যান।
অগত্যা পিছন ফিরে প্রিয়কে দেখতে দেখতে বাইরে চলে যেতে হয় স্বাতীকে। আর নানান চিন্তা ভীড় করে আসে প্রিয়র মাথায়। সেই ডাক্তার এল , কিন্তু চলে গেল একটি প্রাণ। একটা চাকরি দিয়ে সেই প্রাণের দাম চোকাতে চাইছে সরকার। কিন্তু সন্তানের কাছে মায়ের জীবনের চেয়ে বড়ো কিছু হতে পারে না।সরকারের ভূমিকার থেকে গ্রামের মানুষের আন্তরিকতা তাকে মুগ্ধ করে। মায়ের স্মৃতিরক্ষার জন্য তারা স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে যে উদ্যোগ নিয়েছে তার জন্য গ্রামবাসীদের কাছে সে সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবে। আরও সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে প্রিয়।সৌরভ আর ঋজুকে হাসপাতালে রেখে সেদিনের মতো বাড়ি ফিরে যায় সবাই। প্রথমে সবাই প্রিয়দের বাড়িতেই যায়।শোকসন্তপ্তপরিবারকে স্বান্তনা দেন তারা।কিন্তু কিছুতেই মন মানে না প্রভাত কুসুমের। পরিবারের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে হরপার্ব্বতীর স্মৃতি। মনেও কি কম স্মৃতি ছড়িয়ে আছে তার ? সব মনে পড়ে যাচ্ছে একে একে ? বিয়োগ ব্যাথায় বুক ফেটে যাচ্ছে। কি করে এই সংসারে থাকবেন তা ভেবে পান না তিনি। এখন তাও মধুরিমারা আছে।লোকজন আসারও বিরাম নেই। সবার সঙ্গে স্মৃতিচারণ করতে করতে মনে হয় হরপার্ব্বতী তাকে ছেড়ে চলে যায় নি।
যেন পুকুর ঘাটে গিয়েছে। একটু পরেই ফিরে আসবে। কিন্তু একদিন তো মধুরিমারাও চলে যাবে। লোকজনের আসা যাওয়াও কমে আসবে। তখন যে হরপার্ব্বতীহীন সংসার তার কাছে অসার হয়ে যাবে। তবু প্রিয়র কথা ভেবেই তাকে বুক বাঁধতে হবে। প্রিয়কে স্থিতু না করে তিনি যে মরেও শান্তি পাবেন না। হরপার্ব্বতীও কি শান্তি পাবে ? সবাই তাকে প্রিয়র সঙ্গে বিয়ে দিয়ে স্বাতীকে ঘরে তোলার পরামর্শ দিয়েছেন। ছেলেকে স্থিতু করতে সেটাই করবেন বলে মনে মনে ঠিক করেছেন প্রভাতকুসুমও। কালাশৌচের বিধিনিষেধ মানবেন না তিনি। প্রয়োজনে রেজিস্ট্রি করে বিয়ে দেবেন প্রিয়র। ছেলের জন্য হরপার্ব্বতীর কাছে আর্শিবাদ চেয়ে নেবেন তিনি। আরও দিন পাঁচেক হাসপাতালে কাটিয়ে বাড়ি ফেরে প্রিয়। সেই খবর ছড়িয়ে পড়ার পর গোটা গ্রামের লোক ভেঙে পড়ে তাদের বাড়িতে। অতসীকাকী, সুরোপিসি, ভানুমতীজ্যেঠি সবাই তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা জানান , মায়ের অভাব পূর্ণ হওয়ার নয় জানি। কিন্তু আমরা সবাই তোমার পাশে আছি।
প্রশান্তকাকা বলেন -- বৌদিকেও আমরা কোনদিন ভুলতে পারব না। নিজের জীবন দিয়ে তিনি আমাদের দাবি পূরণ করে দিয়ে গেলেন। তবে প্রসাদ মোড়লকে আমরা ছাড়ব না। আমাদের মাঝে ভাড়াটে লোক ঢুকিয়ে দিয়ে ওই শয়তানটাই তো গন্ডগোল পাকিয়ে দিল।
সেই কথা শুনে প্রশান্তকাকার মুখ দিয়ে তাকায় প্রিয়।জীতেনকাকা বলেন, এদিকের ঝামেলাটা একটু মিটে যাক তারপর দেখছি ওকে।
প্রশান্তকাকা ফের বলতে শুরু করেন -- ঝামেলা তো আর চুকে যাওয়ার মুখে।সকালেই অজিতবাবুর কাছে খবর পেলাম ডাক্তারবাবু আর নার্সের কোয়ার্টার সাফসুতরো করা হচ্ছে। আজই নাকি শহর থেকে ডাক্তারবাবু আর দু'জন নার্স এসে যোগ দেবেন। আর কয়েকজন লোক এসে এক্সরে, ই,সি,জি, সিটি স্ক্যানের মেশিন বসানোর কাজ শুরু করে দিয়েছেন। দু'চারদিনের মধ্যে নাকি ওইসব মেশিনও পৌঁচ্ছে যাবে।
জীতেনকাকা বলেন , তাহলে বৌদির শহীদ বেদীতে মালা দিয়ে আজই স্মরণসভাটা করা উচিত। প্রিয় কি বলছ ?
গ্রামের মানুষের এই সহমর্মিতা প্রিয়র মনটাকে কিছুটা হালকা করে। সে সম্মতি জানায়। ঋজুদা শোকসভার খবরটা আর্যদাকেও জানিয়ে দেয়। ঠিক হয় বিকালে ঋজুদারা এসে প্রিয়কে মাচানতলায় নিয়ে যাবে। তারপর তখনকার মতো সবাই বাড়ি ফিরে যায়। আর একরাশ শুন্যতা গ্রাস করে নেয় বাড়িটাকে। মায়ের ছবির সামনে গিয়ে বসে প্রিয়।অবিরাম ধারায় তার চোখ দিয়ে জলের ধারা গড়িয়ে পড়ে। মায়ের কথা ভাবতে ভাবতেই একসময় ঘুমিয়ে পড়ে সে। ঋজুদার ডাকে বিকালে ঘুম ভাঙে তার। মাচানতলায় যাওয়ার জন্য ঋজুদারা তাকে নিতে এসেছে। তাদের সঙ্গেই মাচানতলায় পৌঁছোয় সে।ক্লাবঘরেই ঢুকেই দেখতে পায় সামনের দেওয়ালে ঝুলছে মায়ের ছবি। সেই ছবিতে দেওয়া হয়েছে রজনীগন্ধার মালা। মাকে প্রনাম করে মাচানতলায় অনুষ্ঠানস্থলে গিয়ে বসে প্রিয়। অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগেই আর্যদারা এসে পৌঁছোন।
আর্যদাদের সঙ্গে ডাক্তারবাবুও আসেন। সবাই এসে তাকে ঘিরে বসেন।তারাও সান্ত্বনা দেন। তারই মধ্যে শহীদবেদীতে মালা দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়। অনেকেই স্মৃতিচারণ করেন। তাকেও বলতে বলা হয়। মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে মায়ের কথা বলতে গিয়ে গলা বুজে আসে তার। সে কোন রকমে বলতে পারে -- আমার মা আজ এই গ্রামের মা হয়ে উঠেছেন। সন্তান হিসাবে তাই আমি গর্বিত।
সবার শেষে ডাক্তারবাবু বলেন -- গ্রামবাসীরা তাকে শহীদের মর্যাদা দিয়ে যথার্থ কাজ করেছেন। তার আত্মবলিদানের কথা আমরা কোনদিন যেন বিস্মৃত না হই। তার জন্যই এই গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্র আজ হাসপাতালের মর্যাদা পেতে চলেছে।
তারপরই অনুষ্ঠান শেষ হয়।অনুষ্ঠান শেষে ডাক্তারবাবুরা প্রিয়কে নিয়ে তাদের বাড়ি যায়।সেখানেই কথাটা পাড়ে আর্য।
No comments:
Post a Comment