Short story, Features story,Novel,Poems,Pictures and social activities in Bengali language presented by Arghya Ghosh

অন্তরালে -- ৪৯




      

     অন্তরালে 


          অর্ঘ্য ঘোষ 



  ( ধারাবাহিক উপন্যাস ) 



কথাটা বলার আগে চোরের মতো একবার ইতিউতিচেয়ে নেয় ভবানী ডাক্তার। গলাটা অনেকখানি নামিয়ে সে বলে , ওষুধের  দোকান থেকেই দেখতে পায় সারাক্ষণ রোগীর চাপ সামলাতে তোমাকে হিমসিম খেতে হয়। সময়মতো খাওয়া দাওয়াও হয়না। এত যে কর তার দাম কি পাও ?
প্রিয় বুঝতে পারে সাপ বের করার আগে সাপুড়ের মতো ঝাঁপিটা নাড়িয়ে নিচ্ছে ভবানীডাক্তার। তাই সে 'ও নিরাসক্তের মতো বলে , কই আর পাই ? আজকের দিনে কে কার কাজের দাম দেয় বলুন ?  
--- এই দেখ ঠিক ধরেছো। ওইসবের কোন দাম নেই। তবে আমরা কিন্তু কাজের মর্যাদা দিতে জানি।
ভবানীডাক্তারের ভণ্ডামি আর সহ্য করতে পারে না প্রিয়। তাই কিছুটা বিরক্তির সুরে বলে -- সে কি আর আমি জানি না। বেশ এবার ঝেড়ে কাসুন তো দেখি। কি বলতে এসেছেন খোলসা করে বলুন।  আমার পরিশ্রম দেখে শুধু শুধু সহানুভূতি দেখাতে যে আপনারা আসেন নি তা আমি বুঝি। 
--- তা বুঝবে বই কি , তুমি  বুদ্ধিমান। তাই তো আমরা তোমার কাছে একটা লোভনীয় প্রস্তাব নিয়ে এসেছি।
প্রিয় বুঝতে পারে এবারে ঝাঁপি থাকে সাপ বের করতে শুরু করেছে ভবানী ডাক্তার। আর প্রসাদ মোড়ল সাপুড়ের সাগরেদের মতো তার মুখের দিকে চেয়ে ভাবগতিক লক্ষ্য করে চলেছে। প্রিয়ও তাই তাদের ভড়কি দেওয়ার জন্য গলায় আগ্রহ ঝরিয়ে বলে --- লোভনীয় প্রস্তাব ?
---- এই যে তুমি এত পরিশ্রম কর , সরকার তো তোমাকে বরাদ্দ বেতনের বাইরে একটা ফুটো পয়সাও দেয় না।
--- না তা তো দেয় না। 
---- তাহলে তুমি বাড়তি কাজ করবে কেন ? সবাই যেমন আসে যায় মাইনে পায় গোছের চাকরি করে তুমিও তেমনি করবে।
এবারে আর মেজাজ ধরে রাখতে পারে না প্রিয়। কড়া গলায় বলে , বাড়তি পয়সা দেওয়ার তো কথা নয় ,  তাই দেবে কেন ?  কাজ করার জন্যই তো চাকরিটা নিয়েছি। কাজ করার পারিশ্রমিক হিসাবে সরকার আমাকে  বেতনও দেয়।
আচমকা প্রিয়র ভাব পরিবর্তনে ভবানী ডাক্তার কিছুটা থতমত খেয়ে যায়। প্রথম প্রথম মনে হচ্ছিল সে বুঝি টোপ গিলেছে। কিন্তু এখন দেখছে সে ভুল ভেবেছিল।তবুও সহজে হাল ছাড়ার পাত্র সে নয়।গলায় আরও মধু ঢেলে সে বলে , চাকরি তো অনেকেই করে। কিন্তু বোকার মতো প্রাণপাত কেউ করে ? কাজ না করলেও মাসে মাসে বেতন তো কেউ 
আটকাতে পারবে না ? উপরন্তু আমাদের প্রস্তাবে রাজী হলে বেতনের টাকা তো পাবেই , আবার উপরি আয়ও হবে তোমার। 
--- দেখুন প্রথমেই বলে রাখি উপরি আয়ের লোভ আমার নেই। তবু শুনিই আপনাদের প্রস্তাবটা। 
--- দেখ ,  দু'পয়সা লাভের জন্য আমরা মোটা টাকা খরচ করে হাসপাতালের দেখাদেখি ডায়্যাগনস্টিক্ সেন্টারটা খুলেছি। বেতন দিয়ে কর্মী পুষতে হচ্ছে। কিন্তু হাসপাতালে সুবিধা পাওয়ায় কেউ আমাদের কাছে যাচ্ছে না। তাই বসে বসে মার খাচ্ছি আমরা।
--- সে তো হবেই। বিনা পয়সায় পরীক্ষা হলে টাকা খরচ করতে কেউ যাবে কেন ?  আপনাদের আগেই সেটা বোঝা উচিত ছিল। 
--- সেইজন্যই তো তোমার কাছে আসা। যাতে সবাই আমাদের ওখানেই পরীক্ষা করাতে যায় , সেই ব্যবস্থাটাই তোমাকে করতে হবে।
--- মানে ?
--- মানে তুমি দিনের পর দিন  হাসপাতালের পরীক্ষার মেসিনগুলো বিকল করে রাখবে। আর যারা হাসপাতালে পরীক্ষা করাতে আসবে তাদের আমাদের কাছে পাঠিয়ে দেবে। তাহলেই রোগী পিছু একটা কমিশন তোমার বাঁধা। 



                                            এইতো ঝাঁপি থেকে সাপ বেরিয়ে পড়েছে। প্রিয়র হাত আর চোয়াল ফের শক্ত হতে শুরু করে। রাগে ঠোঁট তিরতির করে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে কোন কথা বলতে পারে না সে। বেশ কিছুক্ষণ পর নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বলে, একটা কথা আপনাদের বলি শুনে রাখুন। এই চাকরি আমি মায়ের জীবনের বিনিময়ে পেয়েছি। তাই কাজে যোগ দেওয়ার আগে মায়ের বেদী ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যতদিন চাকরি করব , ততদিন মানুষের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করব। সরকার আমাকে যা বেতন দেয় তাতেই আমার হেসে খেলে চলে যায়। বড়োলোক হওয়ার মোহ আমার নেই। ছেলেমেয়ে নিয়ে ঘরসংসার করি। সরকার গরীব মানুষের জন্য যে পরিষেবার ব্যবস্থা করেছে।  তা আমি জীবন থাকতে বিফলে যেতে দেব না।
--- ঠিক আছে , তোমাকে আজই কিছু বলতে হবে না। দু'চারদিন ভেবে জানালেও চলবে। 
--- ভাবাভাবির কিছু নেই। আপনারা বরং শেষ কথাটা শুনে যান , এ নিয়ে এরপর আর একটি কথা বললেই আমি পুলিশের কাছে অভিযোগ জানাব।
এবারে মুখ খোলে প্রসাদ মোড়ল। শ্লেষাত্মক সুরে সে বলে , এর আগেও তো অনেক কিছু করে দেখছো, কিছু লাভ হয়েছে কি ? এবারেও হবে না। কিন্তু আমাদের কথা অমান্য করার মাসুল তোমাকে গুনতে হবে , এই বলে গেলাম।
একরাশ উত্তাপ ছড়িয়ে ডায়্যাগনস্টিক্ সেন্টার থেকে বেরিয়ে যায় শয়তান দুটো। আর কিছুক্ষণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে প্রিয়। কি করবে সে কিছু ভেবে পায় না। নিজের জন্য ভয় সে পায় না। কিন্তু ওরা যদি তার স্ত্রী-ছেলেমেয়ের কোন ক্ষতি করে দেয় ? তাহলে  সে সইবে কেমন করে ? ওই শয়তানদের জন্যই বাবা-মা'কে হারাতে হয়েছে। সেই ক্ষত এখনও শুকোয় নি। তার উপরে মেয়েটার বিয়ে ঠিক হয়ে রয়েছে। সেটা যদি কলকাঠি নেড়ে বানচাল করে দেয় ? প্রসাদ মোড়লদের বিশ্বাস নেই। ওরা সব পারে। আর ভাবতে পারে না প্রিয়। মাথার ভিতরটা কেমন পাগল - পাগল লাগে তার। কারও সঙ্গে একবার আলোচনা করতে পারলে ভালো হত। প্রথমে ভাবে স্বাতীকে ব্যাপারটা খুলে বলবে।পরক্ষণেই মনে হয় শুধু শুধু ওকে চিন্তায় ফেলা হবে। একই কারণে ডাক্তারবাবু ,  প্রশান্তকাকাদেরও সে কথাটা বলতে পারে না। এ কান সে কান হতে হতে ঠিক স্বাতীর কানেও পৌঁছে যাবে কথাটা। আর্যদা আর বোলপুরের  ডাক্তারবাবু বলা যেতে পারে কথাটা। কিন্তু তাতেই বা কি লাভ হবে ? তাদেরও তো সেই পুলিশে অভিযোগ জানানোর পরামর্শ দেওয়া ছাড়া কিছু করার নেই।




                                              কিন্তু থানা পুলিশ করে লাভ হওয়ার সম্ভবনা খুব কম। বরং উল্টো বিপত্তিতে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই সে ব্যাপারটা চেপে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু তার চিন্তাগ্রস্ত ভাবটা চোখ এড়ায় না স্বাতীর। বাড়ি ফেরা মাত্রই ঠিক ধরে ফেলে সে। স্বামীকে চা-জলখাবার দেওয়ার সময় সে বলে, কি ব্যাপার গো তোমার চোখ মুখ এত শুকনো শুকনো দেখাচ্ছে কেন ? 
স্ত্রীর প্রশ্নের মুখে অস্বস্তিতে পড়ে প্রিয়। কি করে সে এখন ? স্বাতীর কাছে এর আগে কোন কথা সে গোপন রাখে নি।কিন্তু এই কথাটা সে বলবে কেমন করে ? এমনিতেই বিয়ের আগে থেকেই প্রসাদ মোড়লদের সম্পর্কে স্বাতীর মনে একটা ভীতি রয়েছে। তার উপর এই কথাটা শুনলে উতলা হয়ে পড়বে। তাই খুব দোটানায় পড়ে সে। স্বাতীই সেই  দোটানা থেকে তাকে উদ্ধার করে। নিজে থেকেই বলে ওঠে , অঃ বুঝেছি। মেয়ের বিয়ে ফাইন্যাল হয়ে গিয়েছে বলে এখন থেকে চিন্তা শুরু করে দিয়েছো তো ? আরে বাবা সে তো এখন বছর দুয়েক দেরি আছে। তাছাড়া অত ভাবছ কেন ? মেয়ে তো আমাদের একটাই। আমার গয়নাগাটি যা আছে তা দিয়ে দিব্যি মেয়েকে সাজিয়ে গুজিয়ে শ্বশুরবাড়ি পাঠানো হবে। এখন থেকে তুমি অত ভেব না তো। সে যেদিন যা হওয়ার হবে। তখন দেখা যাবে। স্বাতীর কথা শুনে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে প্রিয়। আপাতত তো স্বাতীকে মিথ্যা বলতে হল না। স্বাতীর মতোই সে'ও মনে মনে বলে, যেদিন যা হওয়ার হবে। তখন দেখা যাবে।কিন্তু মন থেকে ভাবনাটা তাড়াতে পারে না। একা থাকলেই স্ত্রী-ছেলেমেয়ের সম্পর্কে দুশ্চিন্তা না করে সে পারে না। বিশেষ করে সেদিন মেয়ের কথা শুনে তার দুশ্চিন্তা আরও বেড়ে যায়।বিছানায় শুয়ে শুয়েই সে শুনতে পায় মালা তার মাকে বলছে , জানো মা আজ তো আমি একাই স্কুল থেকে ফিরছিলাম। বেলেপুকুর কালীতলার কাছে একটা মোটর সাইকেলে দুটো ছেলে একেবারে আমার ঘা ঘেঁষে চলে গেল। আমি সাইকেল থেকে নেমে পড়ছিলাম তাই রক্ষা , নাহলে ঠিক চাপা পড়ে যেতাম।
স্বাতী মেয়েকে বলে , তুই নিশ্চয় রঙ সাইডে চালাচ্ছিলি। এরপর থেকে দেখে শুনে চালাবি।
মালা বলে , না গো মা আমি ঠিক দিকেই চালাচ্ছিলাম। ওরা মনে হয় ধাক্কা মারবে বলেই ওইভাবে গায়ের উপর এসে পড়েছিল।
-- হ্যা লোকের আর খেয়ে দেয়ে কাজকর্ম নেই। ইচ্ছা করে ওকে ধাক্কা মারতে যাবে।
মেয়ের কথার আর কোন আমলই দেয় না স্বাতী। কিন্তু কথাটা শুনেই অজানা আশঙ্কাই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে প্রিয়র। মেয়ের বিয়ে একরকম ফাইন্যাল হয়ে গিয়েছে। এখন যদি ওর কিছু একটা ক্ষতি করে দেয় শয়তানগুলো , তাহলে সারা জীবনটা ওর বরবাদ হয়ে যাবে। কথাটা ভাবতে যেন দম বন্ধ হয়ে আসে প্রিয়র। অথচ আশংকার কারণটা মুখ ফুটে কাউকে বলতে পারে না সে। তাই অব্যক্ত যন্ত্রণায় যেন তার বুকটা ফেটে যায়। কয়েকদিন পর আরও দুশ্চিন্তার কথা শোনায় শঙ্খ।একটা চার চাকার গাড়ি  নাকি তারও পিছু ধাওয়া করেছিল। বিপদের আঁচ পেয়ে সে সাইকেল নিয়ে মাঠে নেমে পড়ে। তখন কয়েকজন লোক জানলা দিয়ে মুখ বের করে তাকে দেখতে দেখতে গাড়ি নিয়ে হুস করে পেরিয়ে যায়। এবারেও ছেলের কথাতে আমল দেয় না স্বাতী। কিন্তু কিছুদিন পর স্বাতীই  আশঙ্কার কথা শোনায় প্রিয়কে। ছেলেমেয়েরা স্কুলে আর সে হাসপাতালে চলে গেলে অপরিচিত দু'জন লোক নাকি তাদের বাড়ির আশেপাশে সন্দেহজনক ভাবে ঘোরাঘুরি করে। সে বাইরে বের হলেই ভদ্রলোকের মতো মুখ করে দূরে চলে যায়। প্রিয় লক্ষ্য করে স্ত্রী'র চোখে মুখে কেমন যেন একটা ভীত সন্ত্রস্ত ভাব ফুটে ওঠে। শঙ্কিত গলায় সে বলে , এখন মনে হচ্ছে , ছেলেমেয়েগুলোর কথাই ঠিক। হ্যা গো কি ব্যাপার বলতো তো ?
আসল কথাটা স্ত্রীকে বলতে পারে না প্রিয়। কেবল স্ত্রীর মন থেকে ভয় দূর করতে সে  বলে , ওসব তোমার মনের ভুল। 
মুখে ওই কথা বলে বটে, কিন্তু প্রিয়ও মনে মনে শঙ্কিত হয়ে পড়ে। কোপটা কখন কার ঘাড়ে  পড়বে সেই দুশ্চিন্তা তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় তাকে।




             ( ক্রমশ ) 





     নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 


শীঘ্রই দেশ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হতে চলেছে আমার তৃতীয় উপন্যাস ------
  
                                  


                       ----০---


No comments:

Post a Comment