অন্তরালে
অর্ঘ্য ঘোষ
( ধারাবাহিক উপন্যাস )
প্রিয় মনে মনে ভগবানকে বলে , ঝড় ঝাপটা যাই আসুক না কেন , সেটা যেন তার উপর দিয়েই বয়ে যায়। পরিবারের উপরে যেন কোন আঁচ না পড়ে। প্রসাদ মোড়লদের জন্য মা - বাবাকে হারাতে হয়েছে তাকে। সেই ক্ষত আজও শুকোয় নি। নি:সাড়ে বুকের ভিতরে অবিরাম রক্ত ক্ষরণ হয়। আর যেন সেই ঘটনা না ঘটে। মন থেকে দুশ্চিন্তাটা তাড়িয়ে হাসপাতালে যাওয়ার উদ্যোগ নেয় প্রিয়। স্বাতী বলে , আজ তো রবিবার। আজও কি সাত সকালে হাসপাতালে না গেলেই নয় ?
স্ত্রীর প্রশ্নের খুব বিব্রত হয়ে পড়ে প্রিয়। এখন সারা সপ্তাহে তো স্বাতীকে বিশেষ একটা সময় দিতে পারে না। তাই রবিবারটা স্বামীর সঙ্গ লাভের প্রত্যাশায় থাকে স্বাতী। কিন্তু সেটাও হয়ে ওঠে না বললেই চলে। এমনিতে রবিবারে তার হাসপাতালে না গেলেও চলে। কারণ হাসপাতালের স্বীকৃতি মিললেও এখনো অন্য কোন ডাক্তার বা স্বাস্থ্যকর্মী মেলেনি। তাই সেই আউটডোর পরিষেবাই চালু রয়েছে। রবিবার ছুটির দিন। আউটডোর পরিষেবাও বন্ধ থাকে। তার উপরে ডাক্তারবাবু গ্রামের বাড়িতে চলে যান। তাই রবিবারে রোগী থাকে না বললেই চলে। তবু তাকে যেতেই হয়। কারণ হাসপাতাল খোলা থাকলে সিস্টাররা বাড়ি যেতে পারেন না। তাই তারাও একজন পালা করে রবিবারে বাড়ি যান। প্রিয় আর একজন সিস্টারকে হাসপাতাল সামলাতে হয়। কিন্তু
গতকাল বিকালের দিকে দেবিকা সিস্টার চলে যাওয়ার পর , কাকলি সিস্টারের বাবার অসুখের খবর আসে। প্রিয়কে দায়িত্ব দিয়ে তাকেও বাড়ি চলে যেতে হয়েছে। এই অবস্থায় সে স্বাতীকে কি বলবে ? এমন দিনে স্বামীকে কাছে পাওয়ার আবদার করাটাই স্বাভাবিক। টানা কয়েকদিন ধরে শৈত্য প্রবাহ চলছে , কনকনে ঠান্ডা। সূর্যের দেখা নেই। মানুষজনও বিশেষ একটা প্রয়োজন না হলে বাড়ি থেকে বেরোচ্ছে না। তার উপরে আবার সকাল থেকে ঝিরঝিরে বৃষ্টি। সেটা দেখেই স্বাতী বলে , বৃষ্টি মাথায় আজ আর না'ই বা গেলে। আজ আর কেউ পরীক্ষা করাতে আসবে না। আর এলেও কেউ খবর পাঠাবে। তখন না হয় যেও। ততক্ষণ তুমি রান্নাশালে বোস। গল্প করতে করতে খিচুড়ি রান্না করি। তারপর সবাই একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া হবে। কতদিন একসঙ্গে খাওয়া হয়নি বলো তো ? তারপর বিকেলের দিকে বরং একবার হাসপাতাল ঘুরে আসবে।
খুব দোটানায় পড়ে যায় প্রিয়। ডাক্তারবাবু নেই , নেই সিস্টাররাও। সে না গেলে তো হাসপাতালের তালাটাই খুলবে না। সেই অবস্থায় কেউ এলে তাকে চরম বিপাকে পড়তে হবে। শুধু শুধু ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে তাকে। তখন ব্যাপারটা নিয়ে প্রসাদ মোড়লরা জলঘোলা করতে পারে। তার থেকেও বড়ো কথা ডাক্তারবাবু - সিস্টারদের
অবর্তমানে রোগীরা যাতে হয়রানির শিকার না হয় সেটা দেখা নিজের কর্তব্য বলেই মনে করে প্রিয়। সেই কর্তব্যে অবহেলা করতে তার মন চায় না। আবার স্ত্রীর মনে কষ্ট দিতেও তার নিজেরই কষ্ট হয়। স্বাতীর চাহিদা খুবই কম। স্বাতী তার বাধ্যবাধকতাটাও বোঝে। তাই স্বাতীকে বলে , লক্ষ্মীটি রাগ কোর না। আজ হাসপাতালে কেউ নেই। আমি না গেলে তালাও খুলবে না। আমি যাব আর চলে আসব। তুমি ততক্ষণ রান্না করে রাখো।
স্বামীর কথা শুনে অভিমানে ঠোঁট ফোলায় স্বাতী। অনুযোগের সুরে বলে , জানি তো আমার আবদারের কোন মূল্য তোমার কাছে নেই। আমারই ভুল, তবু তোমার কাছে আবদার করতে যায়।
চারদিকটা একবার দেখে নিয়ে স্ত্রীকে বুকে টেনে নিয়ে প্রিয় বলে , কে বললে তোমার আবদারের মূল্য আমার কাছে নেই? আসলে আজ কেউ হাসপাতাল নেই। তাই কোন রুগি এসে ফিরে গেলে আমার খুব খারাপ লাগবে বলেই যাওয়া।
কথাটা শুনে নরম হয় স্বাতী। বলে বেশ , যাও ঘুরে এসো। বেশি দেরি কোর না কিন্তু। আমি রান্না করে রাখছি। খাওয়াটা যেন একসঙ্গে হয়। আমরা সবাই না খেয়ে থাকব কিন্তু। দেখো কথাটা যেন ভুলে যেও না আবার। আর যাওয়ার সময় ছাতাটা নিয়ে যাও। আসার সময় মনে করে এনো কিন্তু। ভুলে হাসপাতালে ফেলে রেখে ভিজতে ভিজতে চলে এসো না।
স্ত্রীকে আশ্বস্ত করে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার উপক্রম করতেই ছেলেমেয়ে দুটোও পড়ার ঘরের দরজা থেকে বলে , বাবা তাড়াতাড়ি আসবে কিন্তু। খিচুড়ি ঠান্ডা হয়ে গেলে জমবে না।
হেসে ছেলেমেয়েদের উদ্দেশ্য হাত নাড়তে নাড়তে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় প্রিয়। হাসপাতালে পৌঁচ্ছে মনে হয় স্বাতীর কথা না শুনে ভুলই করেছে সে। কেউ কোথাও নেই। কেবল ভবানীডাক্তারের ওষুধের দোকানে কিছু লোক বসে রয়েছে। তাকে দেখেই ভবানী ডাক্তারের দৃষ্টিটা যেন চঞ্চল হয়ে ওঠে বলে মনে হয় প্রিয়র। সে আমল না দিয়ে ডায়্যাগনস্টিক্ সেন্টার খোলে। মেশিনগুলো ঝাঁড়পোছ শুরু করে। মেশিনগুলোকে সে নিজের বাড়ির মুল্যবান সামগ্রীর মতোই যত্ম করে। মেশি
নগুলোর জন্যই তো কত মানুষ সুস্থতা ফিরে পায়। আর এই মেশিনগুলোকেই কিনা বিকল করে রাখতে বলছিল ভবানী ডাক্তাররা। ভবানী ডাক্তারদের কথা মনে আসতেই ফের দুশ্চিন্তা শুরু হয় তার। কথাটা স্বাতীকে বলতে না পারার জন্য তার সব থেকে খারাপ লাগে। আর এখন যা পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে তাতে তো কথাটা বলাই যাবে না। স্বাতীর মুখটা যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে। না , আজ সকাল সকাল বাড়ি যেতেই হবে। নাহলে হয়তো অভিমানে কথা বলাই বন্ধ করে দেবে স্বাতী। স্ত্রীর কথা ভাবতে ভাবতেই পায়ের শব্দে মুখ তুলে তাকায় প্রিয়। দেখতে পায় একটা কাগজ হাতে এগিয়ে আসছে আরতি।আরতি গ্রামেরই মেয়ে। বাল্য বিধবা , একাই থাকে। ৩৫/৩৬ বছর বয়স হবে। ভবানী ডাক্তারের বাড়িতে কাজ করে। তাকে এসময় হাসপাতালে আসতে দেখে কিছুটা অবাকই হয় প্রিয়। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে তার দিকে। সেটা লক্ষ্য করে আরতি হাতের কাগজটা এগিয়ে দিয়ে বলে , কয়েকদিন ধরেই আসব আসব ভাবছিলাম। কিন্তু সবার সামনে লজ্জার মাথা খেয়ে আসতে পারছিলাম না। আজ কেউ নেই দেখে এলাম।
--- কেন লজ্জার কি হল ?
---- লজ্জা হবে না। বিধবা হয়ে আসা ইস্তক যে বাড়ির জন্য প্রাণপাত করে চলেছি সে বাড়ির লোকেদের এ রকম ব্যবহারে লজ্জা হবে না বলো ? ওদের না হয় লজ্জা সরম নেই , কিন্তু লজ্জার মাথা খেয়ে আমি কি করে সবার সামনে কথাটা বলি বলতো ? ছোটলোক হতে পারি , পেটের জন্য লাথি ঝাঁটা খেতে পারি , কিন্তু অন্নদাতার বদনাম কি করে করি বলো ?
--- কি হয়েছে ?
--- কি আর হবে ? কথায় আছে না গরীবের যতদিন গতর ততদিন কদর। যাদের বাড়িতে খেটে খেটে হাড়মাস কালি হয়ে গেল তারাই সামান্য ক'টা টাকার জন্য এমন করবে তা ভাবতেও পারি নি।
--- কেন কি করেছে ?
--- তাহলে খুলেই বলি শোন। বেশ কয়েকদিন ধরে বুকে একটা ব্যাথা হচ্ছিল তাই ভবানীডাক্তারকে বলি। তাকে ছাড়া কাকেই বা বলব ? যার বাড়িতে কাজ করি সে নিজেইযখন ডাক্তার তখন তাকেই বলা উচিত কিনা বলো ?
প্রিয় হ্যা - না কিছু বলে না। আরতি অবশ্য তার তোয়াক্কাও করে না। সে সমানে বলে চলে , কিন্তু ভবানীডাক্তার কথা কানেই তোলে না। শেষে একদিন গিন্নিমার কাছে মাইনের টাকা ক'টা নিয়ে ভবানী ডাক্তারের চেম্বারে যে ডাক্তারবাবু আসেন তাকেই দেখালাম।তা ডাক্তারবাবু তো বুকে কল-টল লাগিয়ে দেখে শুনে বললেন বুকের ছবি করতে হবে। কথাটা গিয়ে বললাম ভবানীডাক্তারকে। শুনে টুনে লোকটা কি বলল জানো ?
---- কি ?
---- বললে ছবি করার খরচ জানিস ? ওসব ছবি টবি করাতে হবে না। ছোটলোকদের কিছু হয় না। দিন কতক পরে এমনিই সেরে যাবে।
কেঁদে ফেলে আরতি। সে কান্না আর থামে না।কাঁদতে কাঁদতে বলে, সত্যিই আমাদের কিছু হয় না। স্বামীকে খেয়েছি। বাবা-মা'কে খেয়েছি। ভাই আর ভাইয়ের বৌয়ের কাছে গলা ধাক্কা খেয়েছি। তবু তো ঠিক বেঁচে আছি।মরণ হয় নি।
কথাটা শুনেই মনটা খুব খারাপ হয়ে যায় প্রিয়র । ভবানী ডাক্তার অর্থ পিশাচ তা সে ভালো করেই জানে। কিন্তু এতটা যে চশমখোর হতে পারে তা সে ভাবতে পারে নি। যে মেয়েটি তাদের সংসারে বছরের পর বছর জীবনীশক্তি নিংড়ে দিয়ে চলেছে তারই জীবন বাঁচাতে নিজেদের সেন্টারে একটা ছবি করে দিতে পারল না ? কত এমন খরচ পড়ে একটা ছবি করতে ? যাই পড়ুক না কেন , মানুষের জীবনের চেয়ে তো কোন কিছুই মুল্যবান হতে পারে না। আরতিকে আশ্বস্ত করে প্রিয়। স্বান্ত্বনা দিয়ে বলে , কিছু ভেব না। আমিই তোমার ছবি করে দিচ্ছি দাঁড়াও। সেই কথা শুনে আরতি প্রিয়র দুই হাত জড়িয়ে ধরে বলে , কিন্তু আমি তো টাকা পয়সা কিছু দিতে পারব না।
--- এটা সরকারি হাসপাতাল। এখানে টাকা পয়সা লাগে না।
--- এখন বুঝতে পারছি কেন লোকে তোমার এত সুখ্যাতি করে। অনেকেই বলছিল , তুই তো ভবানীডাক্তারের বাড়িতে কাজ করিস। ভবানী ডাক্তারের সঙ্গে প্রিয়র ক্ষার রয়েছে। তাই তোর পরীক্ষা প্রিয় করবে বলে মনে হয় না।সেই কথা শুনেই তো প্রথমে আসতে সাহস পাচ্ছিলাম না।
--- তোমাকে যারা ওসব কথা বলেছেন তারা ঠিক বলেন নি। এটা সরকারি হাসপাতাল , ব্যক্তিগত রাগ মেটানোর জায়গা নয়।
তাছাড়া ভবানী ডাক্তারের উপরে যদি আমার রাগ থেকেই থাকে তার ঝাল তোমার উপরে মেটাব কেন? তুমি তো ওদের বাড়িতে কাজ কর মাত্র। ভবানীডাক্তার নিজে এলেও আমি আর পাঁচজন রুগীর ক্ষেত্রে যা করি , ওর ক্ষেত্রেও তাই করতাম। বাদ দাও ওইসব কথা। এসো তোমার এক্সরেটা করে দিই। তারপর বাড়ি যেতে হবে। ছেলেমেয়েগুলো সব আমার জন্য না খেয়ে বসে থাকবে।
প্রিয়র কথা শেষ হয় না। পরীক্ষা শুরু করার আগেই তার গায়ের লোম খাড়া হয়ে ওঠে। কনকনে ঠান্ডাতেও সারা শরীর ঘেমে ওঠে তার।
No comments:
Post a Comment