Short story, Features story,Novel,Poems,Pictures and social activities in Bengali language presented by Arghya Ghosh

অন্তরালে -- ৪৮




  
  
      অন্তরালে 


                অর্ঘ্য ঘোষ 


   ( ধারাবাহিক উপন্যাস ) 



সৌরভ তাকে গ্রামের ভিতরটুকু এগিয়ে দিয়ে যায়। রাস্তায় আসতে আসতে তার স্বাতীর কথা মনে পড়ে। সে না ফেরা পর্যন্ত স্বাতী উদ্বেগে থাকবে তা জানে প্রিয়। স্বাতী যে অধীর আগ্রহে তার ফেরার প্রতীক্ষায় ছিল তা বাড়ির দরজায় পা দিয়েই টের পায় সে। কড়া পর্যন্ত নাড়তে হয় না। পায়ের শব্দ আন্দাজ করে দরজা খুলে দিয়ে তার মুখের দিকে উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে স্বাতী। স্ত্রীর উদ্বেগ ভরা মুখ দেখে মজা করার লোভ সামলাতে পারে না প্রিয়। ছেলেমেয়ে দু'টো তখন পড়ার ঘরে।তাই মজা করার সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাই না সে। তাই মুখটা যতটা সম্ভব হতাশাগ্রস্থ করে সে'ও স্ত্রীর মুখের দিকে চেয়ে থাকে। স্বামীর মুখের ওই অবস্থা দেখেই স্বাতীর ভিতরটা যেন চুপসে যায়। খারাপ খবর কিছু শুনতে হবে বলে সহসা কিছু জিজ্ঞেস করতে পারে না। আবার উদ্বেগ চেপেও রাখতে পারে না। একসময় শুকনো গলায় কোন রকমে সে বলে -- কি গো , কি হলো ? তোমাকে অমন শুকনো শুকনো দেখাচ্ছে কেন ? 
--- কি আর হবে , তোমার কথা শুনে গাল বাড়িয়ে চড় খেয়ে এলাম।
প্রিয়র কথা শুনে আরও মুসড়ে পড়ে স্বাতী। তার মুখ দিয়ে আর কথা সরে না। জ্বরো রুগীর মতো মিন মিন করে জিজ্ঞেস করে -- কেন গো ? 
--- ছেলের বাবা তো পুরোপুরি শুনলেনই না। কথা পাড়তে না পাড়তেই বললেন , আপনাদের তো আস্পর্ধা কম নয় ?  বামন হয়ে চাঁদ ধরতে এসেছেন ? জানেন কত বড় বড় ঘরের মেয়ের বাবারা বিয়ের জন্য ঝুলোঝুলি করছে। সোনা -দানা সামগ্রীতে একেবারে ঘর ভরিয়ে দেবে। আপনাদের ওইসব দেওয়ার ক্ষমতা আছে ? তারপর একপ্রকার গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিলেন। সৌরভের সামনে কি অপমান বলো তো ?
এবারে চোখ দুটো ছলছল করে ওঠে স্বাতীর। মেয়ের বিয়ের সমন্ধ ভেঙে যাওয়ার চেয়েও স্বামীর অপমানটা বুকে বড়ো বাজে তার। তাই কিছুটা উত্তেজিত গলায় বলে , ভারি তো আমার চাঁদ। ওর ছেলে ছাড়া যেন আমার মেয়ের বিয়ে হবে না। নেহাত বাড়িতে আসা যাওয়া করে তাই মায়া বসে গিয়েছিল বলেই না বলতে যাওয়া। ওদের চেয়েও ভালো ঘরে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেখিয়ে দেব। মেয়ে কি আমাদের ফ্যালনা নাকি। রূপে লক্ষ্মী না হলেও এ গাঁয়ে আমাদের মালার চেয়ে সুন্দরী মেয়ে কেউ একটা দেখিয়ে দিক তো আমাকে। পড়াশোনাতেই বা কম কিসের ?
প্রিয় বোঝে নিজের মনকে সান্ত্বনা দিচ্ছে স্বাতী। কিন্তু ভিতরে ভিতরে তার বুকটা ফেটে যাচ্ছে। নেহাত সে সামনে আছে তাই। নাহলে এইক্ষণ কেঁদে ভাসাত। বেচারাকে আর কষ্ট দিতে প্রিয়রই এবার কষ্ট হয়। তাই শব্দ করে হেসে ওঠে সে।
স্বামীকে ওইভাবে হাসতে দেখে অবাক হয়ে যায় স্বাতী। অবাক চোখে চেয়ে থাকে প্রিয়র দিকে। প্রিয় হাসতে হাসতেই বলে , আরে এতক্ষণ তোমার সঙ্গে মজা করছিলাম। নাও এবার বরণডালা সাজাও। ছেলের বাবা-মা তোমার মেয়ের সঙ্গে  বিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে আজ হলে কাল যাবেন না।
প্রিয়র কথা শুনে স্থান - কাল ভুলে যায় স্বাতী। ছুটে গিয়ে স্বামীর বুকে আলতো হাতে কিল মারতে থাকে। প্রিয় যেন তরুণী স্বাতীকেই খুঁজে পায়। চুলে হালকা পাক ধরছে , শরীর ভারী হয়েছে। তবুও আবেগ - অনুভুতি আর অনুরাগ সেই একই আছে। সে প্রবল আকর্ষণে স্ত্রীকে বুকে টেনে নেয়। স্বাতীর আনন্দাশ্রু ভিজে যায় তার বুক। 
স্ত্রীর মুখটা তুলে ধরে তীব্র আশ্লেষে চুম্বন করে প্রিয়। স্বাতী কপট রাগ দেখিয়ে বলে , মেয়ের বিয়ে হয়ে গেলেই কিছুদিন পর দাদু হয়ে যাবে সে খেয়াল আছে ? 
--- কেন দাদু হলেই যে নিজের স্ত্রীকে চুমু খাওয়া যাবে না সে কথা কোথায় লেখা আছে শুনি ?



                আর কথা এগোয় না। বাবার উপস্থিতি টের পেয়ে ছেলেমেয়ে দুটো পড়ার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে। স্বাতী দ্রুত রান্নাঘরের দিকে চলে যায়। ছেলেমেয়েদের কাছে ডেকে কথাটা বলে প্রিয়। শঙ্খ আর মালার সঙ্গে তার বন্ধুর মতোই সম্পর্ক। প্রিয় তাদের সঙ্গে সব কথা ভাগ করে নেয়। ছেলেমেয়েরাও তাকে সব কথা খুলে বলে। এমন কি ভালো লাগা , ভালোবাসার কথাও। মালার সঙ্গে সৌমিককের ঘনিষ্ঠতার আভাসটা তো সে প্রথম শঙ্খের কাছেই পেয়েছিল। মা'কেই বরং ছেলেমেয়ে দুটো একটু যেন সমঝেই চলে। তা নিয়ে স্বাতীর বোধহয় একটু চাপা ঈর্ষাই রয়েছে। সেটা তার উপরে মাঝে মধ্যে ক্ষোভ হয়ে ঝড়ে পড়ে। ছেলেমেয়ের আড়ালে স্বাতী বলে , ছেলেমেয়েদের অত তোল্লাই দিয়ে মাথায় তোলা কিসের ?  এরপর বাবা বলে মানবে ? 
স্ত্রীর কথা প্রিয় কানে তোলে না। হাসতে হাসতে বলে , ছেলেমেয়েরা যে ভগবানের অংশ গো। আর মাথার উপরেই তো ভগবানের ঠাঁই।
--- তোমার আর দেখে বাঁচি না।
প্রিয় হেসেই চলে। অগত্যা রণে ভঙ্গ দিতে হয় স্বাতীকে। সরাসরি বাবার মুখে কথাটা শুনে মালার চোখে মুখে কেমন যেন লজ্জা - লজ্জা ভাব ফুটে ওঠে।সেটা লক্ষ্য করেই বোনকে রাগাতে পিছনে লাগে শঙ্খ।মালা বাবাকে অনুযোগ জানায় , দেখ বাবা দাদা কি করছে। বারণ কর। ভালো হবে না বলছি।
--- খারপটা কি হবে শুনি ?
--- কি হবে দেখবি ?  বলেই আলতো করে দাদার চুলের মুঠি ধরে মালা। চিৎকার করে ওঠে শঙ্খ। সেটা দেখেই এক লহমায় যেন নিজের ছেলেবেলাটাই প্রিয়র চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তারাও দুই ভাইবোন ওইরকম করত। আবার ভালোবাসার টানও ছিল খুব। ছেলেমেয়ের মধ্যেও সেটা লক্ষ্য করে ভালো লাগে  প্রিয়র। মৃদু হাসি ফুটে ওঠে তার মুখে। সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত স্ত্রীর সঙ্গে মেয়ের বিয়ে, ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা হয়। একসময় স্বামীর বুকে মুখ ডুবিয়ে দেয় স্বাতী। স্ত্রীকে দৃঢ় আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরে  প্রিয়। অনেকদিন পর একে অন্যকে নতুন করে খুঁজে পায় তারা। রাতের সেই মধুময় অনুভূতির কথা ভাবতে ভাবতেই পরদিন হাসপাতালে যায় প্রিয়। অন্যান্যদিনের মতো সেদিনও ডায়্যাগনস্টিক সেণ্টারে ভীড় উপছে পড়া ভীড়। যতদিন যাচ্ছে ভীড় তত বাড়ছে। এখন অন্যান্য জায়গায় চিকিৎসা করিয়েছেন এমন রোগীরাও পরীক্ষা করানোর জন্য এখানে আসেন। কাজ করতে করতেই সে দেখতে পায় ভবানী  ডাক্তারদের সেন্টারে মাছি তাড়ানোর মতো অবস্থা। হবে নাই বা কেন ? হাসপাতালে নুন্যতম খরচ কিম্বা নিখর্চায় পরীক্ষা করানোর সুযোগ পেলে কে আর টাকা দিয়ে ভবানী ডাক্তারের সেন্টারে পরীক্ষা করাতে যাবে ? তাই ডায়্যাগনস্টিক্ সেন্টারটা করে ভবানীডাক্তারদের আঙুল কামড়ানোর দশা হয়েছে। তার উপরে সামনেই হাসপাতালের ডায়্যাগনস্টিক্ সেন্টারে রোগীদের উপছে পড়া ভীড় তাদের হতাশা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু সেটাই যে ওদের গাত্রদাহের কারণ হবে তা ভাবতে পারে নি প্রিয়। কিছুক্ষণ পরেই সেটা টের পায় সে।



                          
                                                    পরীক্ষা শেষ করে সবে বেসিনে হাত ধুতে শুরু করেছে সেইসময় অত্যন্ত চুপিসারে ডায়্যাগনস্টিক্ সেন্টারে এসে ঢোকে ভবানীডাক্তার আর প্রসাদ মোড়ল। সেন্টারে সে তখন একা , ভবানী ডাক্তার আর প্রসাদ মোড়লরা যেন এই সুযোগটার জন্যই অপেক্ষা করছিল,  তা ওদের ভাবগতিক দেখেই বুঝতে পারে প্রিয়। তাই অবাক হয়ে তাদের মুখের দিকে চেয়ে থাকে সে। ভবানী ডাক্তার গলায় যেন মধু ঢেলে বলে , কবে কি হয়েছে সেটা মনে করে  আমাদের বসতেও বলবে না নাকি? 
একই সুরে প্রসাদ মোড়লও বলে , আমরা কিন্তু সব ভুলে তোমার সঙ্গে সুসম্পর্ক করতেই এসেছি। বিবাদ পুষে রেখে লাভ কি ? বরং দু'পক্ষেরই ক্ষতি।
কথাগুলো শুনে রাগে গা রি-রি করে ওঠে প্রিয়র। মায়ের যন্ত্রণা কাতর মুখটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। এই শয়তানগুলোর জন্যই মা'কে হারিয়েছে সে। শুধু কি মা ? বাবার মৃত্যুর জন্যেও পরোক্ষে কি এই শয়তানরাই দায়ি নয় ? নিজের অজান্তেই তার চোয়াল আর হাতের মুঠো শক্ত হয়ে ওঠে। পরক্ষণে মনে পড়ে যায় এটা হাসপাতাল। এখানে সবার সমান অধিকার। সেই কথা ভেবেই বহু কষ্টে নিজেকে সামলায় প্রিয়। শুধু অবাক হয়ে শয়তান দুটোর মুখের দিকে চেয়ে থাকে সে। এভাবে চুপিচুপি হাসপাতালে আসার পিছনে ওদের কিছু একটা উদ্দেশ্য যে আছে তা অনুমান করতে অসুবিধা হয় না তার।উদ্দ্যেশটা যে মহৎ নয় তাও সে ভালোই জানে।তবু সৌজন্যের খাতিরে দুটি চেয়ার দেখিয়ে বলে -- বসুন।
চেয়ারে বসে প্রথমে মুখ খোলে ভবানী ডাক্তার।  তার কথা শুনে কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে প্রিয়।


        
          ( ক্রমশ ) 




     নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 


শীঘ্রই দেশ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হতে চলেছে আমার তৃতীয় উপন্যাস ------
  
                                  


                       ----০---

No comments:

Post a Comment