অন্তরালে
অর্ঘ্য ঘোষ
( ধারাবাহিক উপন্যাস )
এ নিয়ে গ্রামের মানুষের আক্ষেপের শেষ নেই। মাচানতলার আসরে প্রায়ই সেই আক্ষেপ শোনা যায়। প্রশান্তকাকা বলেন, আমরা এত যে আন্দোলন করলাম , একজনকে হারাতে পর্যন্ত হলো কিন্তু ভবানীডাক্তারদের মৌরসিপাট্টা তো ঘুচল না।
প্রিয় বলে, আসলে মানুষেরা সচেতন না হলে ভবানীডাক্তারদের আধিপত্য ঘুচবে না।জীতেনকাকা বলেন , মানুষকে ওরা ভুল বোঝাচ্ছে। আমি সেদিন সন্ধ্যেবেলায় ওদের পিছনে আসতে আসতে নিজের কানে শুনেছি।ভবানীডাক্তার রোগীদের বলছে, আগে কলকাতা, ভেলোর , ব্যাঙ্গালোর সব ঘুরে তারপর আমার কাছে এসো। ভাবা যায় ! এইট পাশের বিদ্যে নিয়ে ভেলোর , ব্যাঙ্গালোরের ডাক্তারদের চ্যালেঞ্জ দিচ্ছে ভবানী। লোকগুলোও তেমনি গদগদ হয়ে বলছে , ডাক্তারবাবু আপনার মতো কেউ হয় না।
আর সেই সুযোগ নিয়ে গলা কাটে ভবানীডাক্তার।
প্রিয় বলে, শুধু ভবানীডাক্তারই নয় , শহরের একশ্রেণীর ডাক্তার , নার্সিংহোমের মালিকও ভবানী ডাক্তারের মতোই রোগীদের গলা কাটে। আসলে সরকারি হাসপাতালগুলোতে প্রয়োজনীয় পরিষেবা না পেয়ে মানুষকে ওইসব কসাইদের হাঁড়িকাঠেই গলা বাড়িয়ে দিতে হয়।
প্রশান্তকাকা বলে , তবু তুই হাসপাতালে আছিস বলেই ওদের উপর মানুষের অন্ধ বিশ্বাসটা অনেকখানিই কমে গিয়েছে।
সেই কারণেই তো প্রিয় দিন দিন ভবানী ডাক্তারদের আরও চক্ষুশুল হয়ে উঠেছে। প্রিয় অবশ্য তাতে বিশেষ একটা আমল দেয় না। সে নিজের কাজটুকু নিষ্ঠার সঙ্গে করে।তার নিষ্ঠা আর আন্তরিকতার জন্য সে বাস্তবিক ভাবে অনেকের কাছেই প্রিয় হয়ে উঠেছে। সুস্থতা ফিরে পেয়ে কতজন তাকে স্বেচ্ছায় বখশিশ দিতে আসে। সে মাথাটা নামিয়ে দিয়ে সবিনয়ে বলে , মাপ করবেন ওসব নিতে পারব না। ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসার করি, আর্শিবাদ করুন ওদের যেন মানুষ করতে পারি।জবাবে তারা বলেন , তোমার মতো ভালোমানুষদের মাথায় যে স্বয়ং ইশ্বরের আর্শিবাদের হাত থাকে গো। দেখ তারই আর্শিবাদ তোমার ছেলেমেয়েরা মানুষের মতো মানুষ হবে।
ভগবানের আর্শিবাদেই হোক, কিম্বা ওইসব শুভানুধ্যায়ীদের শুভকামনাতেই হোক ছেলেমেয়েদের নিয়ে প্রিয়র কোন দুশ্চিন্তা নেই। সে নিজে অবশ্য ওদের বিশেষ সময় দিতে পারে না , কিন্তু স্বাতীর তত্ত্ববধানে তারা আজ গ্রামের আর পাঁচটা ছেলেমেয়ের মতো মানুষ হয়ে উঠেছে। শঙ্খ স্কুলের গণ্ডী পেরোতে চলছে। মেয়েটাও আগামী বছর মাধ্যমিকে বসবে। এমনিতে সময় দিতে না পারলেও সন্ধ্যায় যখন সে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরে তখন দুই ভাইবোনই তাকে নিয়ে পড়ে।একে অন্যের নামে নালিশ করে। পিঠোপিঠি ভাইবোন হলে যা হয়। প্রিয় শোনে আর হাসে। ওদের নিয়েই তো তাদের জগত। রাতে স্ত্রীর সঙ্গে ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা হয় প্রিয়র। ইদানীং মেয়ের বিয়ে নিয়ে বড়ো বেশি উতলা হয়ে পড়েছে স্বাতী। তার অবশ্য কারণও আছে। এমনিতেই গ্রামাঞ্চলে মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়াই দস্তুর।
তার উপরে মালার সমবয়সী মেয়েদের সব বিয়ে হয়ে গিয়েছে। স্বাতীও অবশ্য বসে নেই। সে পাশের গ্রাম সেরুনিয়ার অরবিন্দ ঘোষের ছেলে সৌমিককে মনে মনে জামাই করবে বলে ঠিক করে বসে আছে। ছেলেটিকে প্রিয়রও অপচ্ছন্দ নয়। শঙ্খর সঙ্গেই পড়ে সে। শঙ্খর সঙ্গে মাঝে মধ্যে তাদের বাড়িও আসে। স্বাতীর দাবি মালা আর সৌমিকের মধ্যে নাকি অনুরাগের পালা চলছে। একদিন রাতে সেই প্রসঙ্গ তুলেই অনুযোগ করে , কেমন বাবা তুমি ? চোখের সামনে মেয়েটা লাউলতার মতো বেড়ে উঠছে আর তুমি হাত গুটিয়ে বসে আছ ? কোথাই বিয়ের ব্যবস্থা করবে তা নয় , গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়াচ্ছ। ওদের পড়াশোনা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হয় নি। কিন্তু মা বলে তো আর মেয়ের বিয়ে নিয়ে তত্ত্ব করে বেড়াতে পারি না।
স্ত্রীকে আশ্বস্ত করতে প্রিয় বলে , হবে রে বাবা হবে। আগে ওর বিয়ের বয়সটা হতে দাও।
---- আমি ওসব জানি না। মালার বয়সী গ্রামে আর একটাও মেয়ে আছে ?
---- দেখ , কে কি করছে তা জানি না। কিন্তু আমি একজন সরকারি কর্মী হয়ে বেআইনী কাজ করতে পারব না।আঠারো বছরের আগে কিছুতেই মেয়ের বিয়ে দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হবে না।
--- আরে বাবা তাই হবে। দেখতে দেখতেই মালার আঠারো বছর বয়স হয়ে যাবে। কথায় আছে লাখ কথা না হলে বিয়ে হয় না। আগে কথা চালাচালিটা শুরু কর। আমি ওই ছেলে হাতছাড়া করতে পারব না। বিয়ে হলে দু'টিতে মানাবেও ভাল। আর কেমন চোখের সামনে থাকবে। তুমি বাপু এখন থেকেই ওর বাবার কাছে কথাটা পাকা করে রাখ।
--- যথা আজ্ঞা দেবী।
অগত্যা স্ত্রীর তাড়নায় একদিন সৌরভকে নিয়ে সেরুনিয়া যায় প্রিয়। অরবিন্দ ঘোষ সম্পন্ন চাষি। চাষ ছাড়াও হাসকিং মিল রয়েছে। তাদের এক ছেলে এক মেয়ে। মেয়ে মৌরি মালাদের স্কুলেই একক্লাস নীচে পড়ে। মালাকে সে ভালোভাবেই চেনে। অরবিন্দবাবুর কথাতেই তা স্পষ্ট হয়ে যায়। বিয়ের কথাটা পাড়তেই অরবিন্দবাবু বলেন , আরে মশাই আমিই তো প্রস্তাবটা নিয়ে আপনার বাড়ি যাব ভাবছিলাম।
--- আপনি ?
---- তবে আর বলছি কি আমার গৃহিণী তার কন্যার মুখে আপনার মেয়ে আর আমার ছেলের অনুরাগের কথা শোনার পর থেকে কেবলই তাড়া লাগাচ্ছেন। আমি যত বলি হ্যা গো আমরা পাত্রপক্ষ। নিজে থেকে পাত্রীপক্ষের বাড়ি গেলে যে মানসম্মান থাকে না। কিন্তু উনি কানে তুললেই তো। এখন আপনারা এসেছেন , আমার মুখটা রক্ষা হোল।
বলেই হো-হো করে প্রাণ খোলা হাসি হেসে ওঠেন। সেই হাসি দেখেই প্রিয় বুঝতে পারে মানুষটা ভালোই। এ ঘরে বিয়ে হলে মালা সুখেই থাকবে।
সেটা আরও নিশ্চিত হয়ে যায় সৌমিকের মা প্রতিভাদেবীর কথায়। গোলগাল চেহেরার মহিলার মধ্যে কেমন যেন একটা গিন্নিমা-গিন্নিমা ভাব। মিস্টিজল নিয়ে কোনরকম ভনিতা না করেই বলে , আমি বাপু অত রাখঢাক করে কথা বলতে পারি না। মৌরির মুখে যেদিনই আপনার মেয়ের কথা শুনেছি সেদিনই ওকে ঘরের বৌ করে আনব ঠিক করে ফেলেছি। কতদিন কর্তাকে বলেছি , একবার যাও গো। ওদের তো মেয়ে। কোথাও কথাবার্তা বলে ফেললে তখন মুসকিল হয়ে যাবে। তা ওনার তো সেই এক কথা , জন্ম মৃত্যু বিয়ে , তিন বিধাতা নিয়ে। ওই মেয়ের বিয়ে যদি বিধাতা এ বাড়িতে লিখে থাকেন তাহলে তা খন্ডন করার নাকি কারও সাধ্যি নেই।
--- কি মিলল তো আমার কথা ? স্ত্রীর দিকে চেয়ে প্রশ্নটা ছুড়ে দেন অরবিন্দবাবু।
স্ত্রী অবশ্য কোন জবাব না দিয়ে বলেন , এখন আপনারা এসেছেন। একেবারে পাকা কথা হয়ে যাক।
সেই কথা শুনে প্রিয় কিছুটা দপকে যায়। পাকা কথা বলতে উনি কি দেনা-পাওনার কথা বলছেন বাকি। কথা শুরু হতে না হতেই যারা দেনাপাওনার প্রসঙ্গ তোলে তাদের ভালোমানুষী সম্পর্কে সংশয় রয়েছে। প্রিয়কে চুপ করে থাকতে দেখে প্রতিভাদেবী বোধহয় প্রিয়র মনের ভাবটা আন্দাজ করতে পারেন। তাই বলেন , আরে ছি ছি আপনারা যা ভাবছেন তা নয়। ভগবানের কৃপা আর আপনাদের বাবা-মায়ের আর্শিবাদে আমাদের সংসারে অভাব কিছু নেই। তাই চাহিদাও কিছু নেই। সে আপনাদের মন যা চায় , মেয়েকে দেবেন। আমি কেবল দিনক্ষণ পাকা করার কথা বলছিলাম।
প্রিয়র বুক থেকে পাষাণভার নেমে যায়। হাসি মুখে বলে , আঠারো বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার পর আপনারা যেদিন চাইবেন সেদিনই বিয়ে হবে। তার মাঝে মেয়েকে একদিন দেখে এলে ভালো হয়। ছেলে তো আমাদের দেখা।
প্রতিভাদেবী বলেন , বেশ তাই হবে। আমাদের মেয়ে দেখার বাধ্যবাধকতা কিছু নেই। ছেলেরই যেখানে মেয়েকে পচ্ছন্দ সেখানে আমরা না দেখলেও হত। কিন্তু বলছেন যখন তখন নিয়ম রক্ষার্থে খোকনের বাবারা বরং একদিন ঘুরে আসবেন। পাকা কথা কিন্তু আজই হয়ে গেল। আঠারো বছর হলেই মাকে আমার ঘরে নিয়ে আসব।
সম্মতি জানিয়ে হবু বেহায় -- বেহানের কাছে বিদায় নিয়ে ঘোষবাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে প্রিয়রা। সেখান থেকে সৌরভের সঙ্গে মধুরিমাদের বাড়ি যায় প্রিয়। তাকে দেখে অভিমান ঝড়ে পড়ে বোনের গলায়।অনুযোগের সুরে বলে, বাবা-মা মারা যাওয়ার পর আমাকে তো পরই করে দিয়েছিস দাদা। তবু ভালো ভাইঝির বিয়ে উপলক্ষ্যে বোনের কথা মনে পড়ল।মধুরিমার অনুযোগ অমুলক নয়। সত্যিই কাজের চাপে বোনের সঙ্গে যোগসূত্রটা ক্ষীণ হয়ে এসেছে। মধুরিমাও আর আগের মতো যেতে পারে না। আসলে তারও সংসার ছেড়ে নড়ার উপায় নেই। বয়সের ভারে শ্বশুর - শাশুড়ি দুজনেই দীর্ঘদিন ধরে শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে রয়েছেন। তারপর রয়েছে ছেলের পড়াশোনা।
মধুরিমার একমাত্র ছেলে অভিজিৎ মালারই সমবয়সী। একা হাতেই সবদিক সামলাতে হয় মধুরিমাকে। ওদিকে স্বাতীরও সংসার ফেলে বাপের বাড়ি আসা হয় না। তাই ভাইফোঁটাতে প্রিয় আসে মধুরিমার বাড়ি। আর সৌরভ যায় তাদের বাড়ি। তাই দীর্ঘদিন পর দাদাকে পেয়ে আর ছাড়তে চায় না মধুরিমা। বোনকে সান্ত্বনা দিয়ে প্রিয় বলে , পর করে দেওয়া কি অতই সহজ রে ? তুই পারবি এক থালায় খাওয়া , এক বিছানায় শোওয়া , কারো কিছু হলে একসঙ্গে কেঁদে ভাসানোর কথা ভুলে আমাকে পর করে দিতে ?
তারপরই হারানো দিনের ঝাঁপি খুলে যায়। মধুরিমা বলে , দাদা তোর মনে আছে খেলতে খেলতে হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়ে পায়ের আঙুলে রক্ত দেখে আমি যত না কেঁদেছিলাম তুই কেঁদেছিলি আরও বেশি।
--- মনে নেই আবার ? আর একবার তুতান আমাকে মেরেছিল বলে তুই ঢিল ছুড়ে ওর কপাল ফুলিয়ে দিয়েছিলি। এসব কথা কি ভোলা যায় বল ? স্মৃতিচারণার মধ্যে দিয়ে সময়টা যে কিভাবে কেটে যায় তা দু'জনেই বুঝতে পারে না। কথায় কথায় ফেরার সময় হয়ে আসে প্রিয়র। শ্বশুর - শাশুড়ির সঙ্গে দেখা করে বোনের কাছে বিদায় নিয়ে বাড়ি ফেরার রাস্তায় নামে সে।
No comments:
Post a Comment