অন্তরালে
অর্ঘ্য ঘোষ
( ধারাবাহিক উপন্যাস )
স্বাতীর কোল আলো করে আসে ফুটফুটে এক পুত্রসন্তান। সবাই বলাবলি করে প্রভাতকুসুমই ফিরে এসেছেন। চোখ মুখের আদল অনেকটা প্রভাতকুসুমের মতোই। প্রিয়র মুখেও যেন তারই বাবার মুখ বসানো। প্রিয় আদর করে ছেলের নাম রাখে শঙ্খ। ছেলেকে নিয়ে আদরে-সোহাগে ভরে উঠে প্রিয়-স্বাতীর সংসার।হাসপাতালে যাওয়ার আগে ছেলেকে আদর করা চাই ই চাই। ছেলেও তেমনি বাবার খুব ন্যাওটা হয়ে পড়েছে। বাবার বাড়ির ফেরার সময় হলেই ঠিক বুঝতে পারে। উশখুশ করতে থাকে। বাবার কোলে উঠে শান্ত হয়। সেটা দেখেই স্বাতী মজা করে বলে - ছেলের জন্য মায়ের আদর কিন্তু কমে গিয়েছে। এখন আর হাসপাতালে যাওয়ার আগে ছেলে হলেই চলে , মায়ের খোঁজ পড়ে না।
স্বাতীর অনুযোগ মিথ্যা নয়। আসলে শঙ্খটা ভীষণ দুষ্ট হয়েছে। সে কোলে থাকলে কিছুতেই তার মাকে আদর করতে দেবে না। স্বাতীও সেটা জানে।
তাই মজা করে খোঁটা দিতে ছাড়ে না। প্রিয়ও মজা করতে ছাড়ে না -- আমার তো উল্টোটাই মনে হয়। ছেলেই মায়ের সব আদর সোহাগ কেড়ে নিয়েছে। বাবার ভাগ্যে আর ছিটেফোঁটাও জুটছে না।
---- ইঃ তা বইকি !
--- তাই নয় ? কই দেখি তো।বলেই স্ত্রীকে কাছে টানতেই শশব্যস্ত হয়ে স্বাতী বলে ওঠে - ফের দুষ্টুমি , ছেলে রয়েছে না!
অগত্যা নিজেকে সামলে নেয় প্রিয়। ততক্ষণে শঙ্খও তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে শুরু করেছে। যেই স্বাতীকে কাছে টেনেছে সে অমনি হাত দিয়ে মাকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। ছেলেটা ওইরকম , যখন স্বাতীর কাছে থাকে তখন প্রিয় কাছাকাছি হলেও একইভাবে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। ভাবখানা এমন যখন যার কাছে থাকবে তার ভাগ কাউকে দেওয়া যাবে না ।ছেলের ওই ভাবভঙ্গি দেখে স্বাতী তার কচি হাত দুটি ধরে -- ওলে বাবালে, আমাল ছেলেটা কি হিংছুটে লে।
ছেলে সেই কথার মর্মার্থ অনুধাবন করতে না পেরে ফের হাত ছাড়িয়ে তাকে সরিয়ে ঁদেওয়ার চেষ্টা করে।স্বাতী তখন স্বামীকে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে বুকে মাথা রেখে বলে -- এটা কাল বাবা ? এটা তো আমাল বাবা।
অমনি শঙ্খ কচি কচি হাতে মায়ের মাথায় চাপড় মারতে মারতে বলে -- আমাল বাবা। আমাল বাবা।
ছেলের কথা শুনে স্বামী- স্ত্রী দু'জনেই হেসে উঠে। চুমায় চুমায় ভরিয়ে দেয় তাকে।একসময় কপট অভিমানের ভাব দেখিয়ে স্বাতী ছেলেকে বলে , ঠিক আছে মা কে চায় না তো ? বাবা যখন হাসপাতালে চলে যাবে তখন ?
সমস্যাটা কি হতে পারে তা ঠিকঠাক উপলব্ধি করতে পারে না শঙ্খ। তাই মায়ের মুখের দিকে চেয়ে থাকে সে। অবশ্য তার সমস্যা হওয়ার কথাও নয়। নিজের দাদু- ঠাকুমা না থাকলে কি হবে , সেই অভাবটা পূরণ করে দেন অতসীকাকী, সুরোপিসি, প্রশান্তকাকা, জীতেনকাকারা। প্রিয় হাসপাতালে থাকার সময় তাদের কোলে কোলেই মানুষ হয় ছেলেটা। স্বাতীও আর একা সবদিক সামাল দিতে পারে না। শীঘ্রই তার বাড়িতে আসতে চলেছে আরও এক নতুন অতিথি। ৯ মাসের ভরা পোয়াতি সে। তাই অতসীকাকী , ভানুমতিজ্যেঠিরা প্রায়ই এসে ছেলে সামালানো , সংসারের টুকটাক কাজ করে দিয়ে যান। স্বাতীর শাশুড়ি মায়ের অভাবটা পূরণ করার চেষ্টা করেন তারা। অতসীকাকীরাই সেদিন বলছিলেন , ভাবগতিক দেখে মনে হচ্ছে দেখো এবার হয়ত তোমার শাশুড়ি মেয়ে হয়ে আসছে।
প্রিয়ও বলছিল কথাটা। সেদিন রাতে দুষ্টুটা ঘুমিয়ে পড়ার পর স্ত্রীকে কাছে টেনে নিয়ে কথাটা পাড়ে সে। স্বাতীকে জিজ্ঞেস করে -- তুমি কি চাও?
--- তুমি কি চাও আগে বলো ?
--- আমি চাই মেয়ে হোক।
--- আমিও তাই চাই।
--- আমার মনে হচ্ছে এবার আমাদের মেয়েই হবে।মেয়ের রূপ ধরে মা'ই আবার আমাদের কাছে ফিরে আসবেন দেখো।
অনাগত অতিথির অস্তিত্ব অনুভব করার জন্য স্ত্রীর পেটে কান রাখে প্রিয়। আর লজ্জা জড়ানো গলায় স্বামীর চুলে আঙুল চালাতে চালাতে স্বাতী বলে , পাগল একটা।
প্রতাশা মতোই মাস খানেকের মাথায় ফুটফুটে একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেয় স্বাতী। অতসীকাকীই সবদিক সামলে দেন। আঁতুর না ঘোচা পর্যন্ত রান্নাবান্নার দায়িত্বও তিনি নিজের ঘাড়ে তুলে নেন। সুরোপিসি এবং অন্যান্য মহিলারাও কাজের ফাঁকে ফাঁকে এসে তাকে সাহায্য করে। তারা না থাকলে কি যে হত কে জানে ? মধুরিমারও আসার উপায় নেই। সে নিজেও সন্তানসম্ভবা। তার উপরে শাশুড়ি শয্যাশায়ী। তাই ভাইঝি হওয়ার খবর পেয়ে আসতে না পেরে সে যে ছটফট করছে তা অনুমান করতে কষ্ট হয় না প্রিয়র। তবে গ্রামের মানুষ বিশেষ করে অতসীকাকীরা খুব করছেন। অতসীকাকী তো তাদের বাড়িতেই পড়ে রয়েছেন সারাক্ষণ। আসলে অতসীকাকীদের নিজের বলতে তো কেউ নেই।
তাই ছেলেমেয়ে দুটোকে নিজের নাতিনাতনীর মতোই ভালোবেসে ফেলেছেন। প্রশান্তকাকাকেও প্রিয় তাদের বাড়িতেই খেতে বলে।
কারণ তাদের বাড়িতে কাজকর্ম করে অতসীকাকীর পক্ষে বাড়ি গিয়ে তার জন্য আবার রান্না করা সম্ভব নয়। প্রশান্তকাকা অবশ্য মৃদু আপত্তি জানিয়ে বলেছিলেন , ওসবের আবার কি দরকার ? আমি দিব্যি দু'টো ফুটিয়ে নিতে পারতাম। সে অভ্যাস আমার আছে। আগে যখন তোদের কাকীমা বাপেরবাড়ি যেত তখন তো রান্না করেই খেয়েছি।
প্রশান্তকাকার কথা শুনে ফুট কাটেন অতসীকাকী -- সে কথা আর বোল না। বাপেরবাড়ি তো সেই ন'মাসে - ছ'মাসে এক-আধ বেলাকার জন্য যেতাম। আর ওই এক- আধ বেলা রান্না করতে গিয়েই হেঁসেলের যা দশা করতে তা সামলাতে গিয়ে আমার আর বাপের বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছাটাই হারিয়ে যেত।
--- সেই জন্যই তো ইচ্ছা করে ওইসব করতাম।
কথাটা জানে প্রিয়ও। প্রশান্তকাকা কাকীকে ছেড়ে থাকতে পারেন না। কাকীও তাই। ছেলেপুলে না থাকলে পতি বা পত্নীপ্রেম একসময় পারস্পরিক বাৎসল্যে রূপান্তরিত হয়। তাই কাকা-কাকীমায়ের তরজা উপভোগ করতে করতেই প্রিয় বলে , সে যখন যা করেছেন করেছেন , এখন এসব চলবে না। কাকীমা এখানে এসে রান্না করবেন আর আপনি বাড়িতে হাত পুড়িয়ে খাবেন তা হবে না। আমাদের কথা বাদ দিন , কাকীমায়ের কথা ভাবুন। কাকীমার কি তাহলে এখানে গলা দিয়ে ভাত নামবে ?
আর আপত্তি করতে পারেন না প্রশান্তকাকা। বাড়ির কাজ সামলে তিনিও চলে আসেন। প্রিয় হাসপাতালে চলে গেলে শঙ্খকে সামলান তিনি।
সবকিছু ঠিকঠাকই হয়ে যায়, তবু মধুরিমার আক্ষেপের অন্ত নেই। মাঝে একদিন সৌরভকে নিয়ে ভাইঝিকে দেখতে এসেছিল সে। কিন্তু বেশিক্ষণ থাকতে পারে নি। সেইদিনই ফিরে যেতে হয়েছিল তাকে। এইসময় স্বাতীর পাশে থাকতে না পারায় বার বার তার গলা থেকে ঝড়ে পরছিল আক্ষেপ। প্রিয় তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে , এতে আক্ষেপের কি আছে ? তুই তো আর ইচ্ছা করে এড়িয়ে যাচ্ছিস না। পরিস্থিতির উপরে তো কারও হাত নেই।
স্বাতীও তাকে একই কথা বলে আশ্বস্ত করে। তবে মনটা কিছুটা শান্ত হয় মধুরিমার। সেইদিনই সে ভাইপোর নামের সঙ্গে মিলিয়ে ভাইঝির নাম ঠিক করে দিয়ে যায় মালা।শঙ্খ - মালাকে নিয়ে এখন স্বাতীর ভরা সংসার।দেখতে দেখতে ছেলেমেয়েগুলো বড়ো হয়ে উঠছে , প্রিয়কেই ছেলেমেয়ের পড়াশোনার দিকটাও দেখতে হয়।হাসপাতালের চাপ দিন দিন বেড়েই চলেছে। তাই প্রিয়র চাপও অনেক বেড়ে গিয়েছে। কারণ প্রিয় তার কাজটাকে শুধু চাকরি বলে মনে করে না। বরং সেবামূলক মনোভাবে কাজ করে সে।
হাসপাতালে তাই রোগীদের লাইন পড়ে যায়। কেউ লজ্জায় ডাক্তারকে গোপন কথা বলতে পারছে না তারা প্রিয়দাকে বলে। প্রিয় ডাক্তারকে চুপিচুপি তা জানিয়ে দেয়। কারও প্রয়োজনীয় ওষুধ হাসপাতালে নেই , কেনার ক্ষমতাও নেই। তারাও ধরে প্রিয়দাকে। প্রিয় হয় বোলপুরের ডাক্তারবাবুকে ধরে স্যাম্পলের ওষুধ আনিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে , নয়তো সামর্থ্য অনুযায়ী নিজে ওষুধ কেনার টাকা দিয়ে দেয়।মাঝে মধ্যে ডাক্তারবাবুকে এ নিয়ে আক্ষেপ করতে শোনা যায়। তিনি বলেন , দুর্ভাগ্য কি জানেন আমাদের এমন অনেক ওষুধ লিখতে হয় যা এখানকার হাসপাতালে পাওয়া যায় না। অথচ শহরে পাওয়া যায়। অনেক সময় সরকারি হাসপাতালের ওষুধ লেবেল পাল্টে চলে আসে খোলাবাজারে। গরীব মানুষকে সেইসব ওষুধই চড়া দাম দিয়ে কিনতে হয়। আর এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসাদার ফুলে ফেঁপে লাল হয়ে যায়।
কথাটা সত্যি মনে হয় প্রিয়রও। এই তো কয়েক বছরের মধ্যে তাদের চোখের সামনে ওষুধের দোকান করে আঙুল ফুলে যেন কলাগাছ হয়ে ওঠেছে প্রসাদ-মোড়ল আর ভবানীডাক্তার। হাসপাতালের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রোগীদের ভীড় দেখে আর লোভ সামলাতে পারে নি। ওষুধের দোকানেই খুলে ফেলেছে ডায়াগনস্টিক সেন্টার।শহর থেকে একজন ডাক্তারকে নিয়ে এসেও সপ্তাহে একদিন বসাচ্ছে তারা। বাকি দিনগুলি ওই ডাক্তারের ব'কলমে আগের মতোই বহাল তবিয়তে চিকিৎসা করছে ভবানীডাক্তার।
আসলে চিকিৎসার আড়ালে অবৈধ গর্ভপাতের রমরমা কারবার চালাচ্ছে তারা। কতজনকে যে প্রাণ দিতে হয়েছে ওর হাতে তার ঠিক নেই। সব জেনেও কিছু করার নেই। এইতো সেদিন মাচানতলায় গিয়ে প্রিয় জানতে পারে ভবানীডাক্তার নাকি মোটা টাকার বিনিময়ে গরীব ঘরের একটা কুমারী মেয়ের গর্ভপাত ঘটাতে গিয়ে মেরে ফেলেছে। মেয়েটির গ্রামের লোকেরা হইচই শুরু করে। প্রশান্তকাকারাও উত্তেজনার আঁচে ফুটতে থাকেন। সবাই বলাবলি করতে থাকে , বড়ো বাড় বেড়েছে ভবানীদের। ডাক্তারখানা নয় , কসাইখানা খুলেছে। লোকগুলো একবার এসে বলুক আমাদের। তারপর দেখুক না কি করি। কসাইখানায় তালা ঝুলিয়ে জেল খাটিয়ে ছাড়ব ওদের।প্রিয় বলে , ওসব কিছুই হবে না দেখবেন। সব ধামাচাপা পড়ে যাবে। এ তো আর নতুন কিছু নয়। কতবার হয়েছে , ওরা প্রভাব খাটিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে।এবারও তার অন্যথা হবে না।
প্রিয়র অনুমানই সত্যি হয়। লোকলজ্জা আর মোটাটাকার প্রলোভনে চুপচাপ হয়ে যায় গ্রামের লোকেরা। চুপিচুপি মেয়েটাকে নিয়ে গিয়ে দাহ করে দেয় তারা। আসলে এইসব বিষয়ে খারাপ কিছু হয়ে গেলেও লোকলজ্জা আর নিজেরাও আইনী জটিলতায় জড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় সাধারণত কেউ উচ্চবাচ্য করে না। আর উচ্চবাচ্য করেও খুব একটা লাভ কিছু হয় না। কারণ সব পুলিশ - প্রশাসনের সকল স্তরে টাকা খাওয়ানো থাকে ভবানী ডাক্তারদের। তাই কোন না কোন স্তরে সব ধামাচাপা পড়ে যায়। আর সেই সুযোগে মানুষের জীবন নিয়ে ভবানী ডাক্তাররা লাগে তুক না লাগে তাকের খেলা চালিয়ে যায়।
( ক্রমশ )
No comments:
Post a Comment