অন্তরালে
অর্ঘ্য ঘোষ
( ধারাবাহিক উপন্যাস )
খাওয়া-দাওয়া শেষে সবাই যে যার বাড়ি ফেরার উপক্রম করেছে। প্রভাতকুসুমও তদারকি শেষে নিজে খাওয়াদাওয়া করে শোওয়ার ঘরে চলে যান়। স্বাতী প্রতিদিনকার মতো প্রেসারের ওষুধ দিতে গিয়েই চিৎকার করে ওঠে ---তাড়াতাড়ি সবাই এস , বাবা কেমন করছে দেখে যাও।
স্বাতীর চিৎকার শুনেই প্রিয় ছুটে যায় বাবার ঘরে। বাবা তখন বিছানায় শুয়ে ছটফট করছেন। চোখের দৃষ্টি ক্রমেই নিস্প্রভ হয়ে আসছে। বাবার বুকে হাত বোলাতে বোলাতে প্রিয় বলে , তোমার কি কষ্ট হচ্ছে বলো বাবা ? ছেলের মুখের দিকে চেয়ে ক্ষণেকের জন্য চোখ মেলে চান প্রভাতকুসুম। তার মুখে ফুটে ওঠে ম্লান হাসি। ছেলের মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ক্ষীণ স্বরে বলেন , তোমার মতো সন্তান যার তার আবার কষ্ট কিসের ?
কথাগুলো বলতে বলতেই নিঃশেষ হয়ে আসে প্রভাতকুসুমের জীবনীশক্তি। মাথা থেকে নিঃসাড় হয়ে আসা হাতটা নেমে এসে পড়ে ছেলের কোলে। সেই হাতটা নিজের হাতে তুলে নিয়ে নির্বাক হয়ে যায় প্রিয়। ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে বাবার মুখের দিকে। ততক্ষণে মধুরিমা - সৌরভরাও ঘরে ছুটে এসেছে। ছুটে এসেছেন দুই ডাক্তারবাবু , নার্স। ছুটে আসেন প্রশান্তকাকারাও। সুশোভনবাবু , প্রভাতকুসুমের হাতটা তুলে নিয়ে কিছুক্ষণ পরীক্ষার পর নামিয়ে রেখে দিয়ে বলেন -- উনি চলে গিয়েছেন।আচমকা হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চলে যেতে হল ওনাকে। রোগটা এমনই , চিকিৎসার কোন সুযোগ মেলে না। আমরা দু'জন ডাক্তার- নার্স থাকা স্বত্ত্বেও কিছু করার সুযোগ পেলাম না। এটাই আমাদের দুর্ভাগ্য।
ডাক্তারবাবুর হাত নামিয়ে রাখা দেখেই মধুরিমারা বুঝে গিয়েছিল বাবা আর নেই। তাই কান্নায় ভেঙে পড়ে তারা।স্বাতী আর মধুরিমা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেই চলে। তাদের সান্ত্বনা দিতে গিয়ে অতসীকাকী, সুরোপিসি, ভানুমতিজ্যেঠিরাও আর নিজেদের ধরে রাখতে পারে না , তারাও কেঁদে ফেলেন। নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো করে অতসীকাকী বলেন , হবে না কেন দিদি যে আমার সাক্ষাৎ সতীলক্ষ্মী পতিঅন্তঃ প্রাণ ছিলেন গো। তাই দাদাকেও বেশিদিন কাছ ছাড়া করে রাখতে পারলেন না।
সুরোপিসি বলেন , দাদাই বা কম কিসের ? সবাইকে খাইয়ে দাইয়ে কি রকম সাধুর মতো চলে গেলেন। ওইসব কথায় আরও শোকবিহ্বল হয়ে পড়ে মধুরিমারা। কেবল প্রিয়রই কোন ভাবান্তর হচ্ছিল না। সে একবার প্রতিবেশীদের কথা শুনছিল আর একবার ক্রন্দনরতা স্ত্রী কিম্বা বোনের দিকে ভাবলেশহীন চোখে চেয়ে দেখছিল। যেন ঘটনার গুরুত্বই সে অনুধাবন করতে পারছে না।অতসীকাকীরা বলছিল, আহারে একবছরের মাথায় মা-বাবা হারিয়ে ছেলেটা শোকে পাথর হয়ে গিয়েছে।
বাবা-মায়ের আদরের সন্তান ছিল তো। সবাই বলছিল , ওকে একবার কাঁদানো বড় দরকার। বুকে জমাট বেঁধে থাকা যন্ত্রণা বের হওয়া প্রয়োজন। নাহলে হয়তো শোকে বোবা হয়ে যাবে। কিন্তু নানা রকম ভাবে চেষ্টা করেও কেউ প্রিয়কে কাঁদাতে পারে না। তার মুখ ফুটে কোন কথাও বের হয় না। এমন কি প্রভাতকুসুমকে যখন মুখাগ্নির জন্য ঘর থেকে বের করে বাঁশের খাটে শোওয়ানোর জন্য তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তখন মধুরিমারা মৃতদেহ আঁকড়ে ধরে সমানে কেঁদে চলছে , তখনও সে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়েই আছে। মধুরিমা তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে -- দাদারে বাবা চলে যাচ্ছেন দেখ। আর আমাদের কেউ রইল না রে দাদা। আর কাকে আমরা বাবা বল ব?
শেষবারের মতো একবার বাবা বলে নে দাদা।দেখ--দেখ তোর মুখে বাবা ডাক শোনার জন্য বাবা কেমন চেয়ে আছেন দেখ।
মধুরিমার কান্নায় সবার চোখ ভিজে যায়। কিন্তু প্রিয়র কোন ভাবান্তর হয় না। অগত্যা হাল ছেড়ে দিয়ে মুখাগ্নির জন্য মৃতদেহ গ্রামের ঢেলাইচন্ডী তলায় নিয়ে যাওয়ার জন্য বের করা হয়। নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে এসে অন্যদের মতো ফেরা হয় নি গঙ্গাধর বাবাজীরও। তিনিই গ্রামের কয়েকজনকে নিয়ে নাম সংকীর্তন শুরু করেন। তার গলায় শেষ যাত্রার চিরন্তনী গান 'বোল হরি বোল, পথেরই সম্বল বলো ভাই ' ধ্বনিত হতেই পরিবেশটা আরও শোকবহ হয়ে ওঠে। তারই মাঝে প্রশান্তকাকা বলেন , ওরে প্রিয়কে নিয়ে এসে একবার বাবার শেষ যাত্রায় কাঁধটা দেওয়ার ব্যবস্থা কর।ততক্ষণে ঋজুরা মালা দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছে প্রভাতকুসুমের খাট। তারাই প্রিয়কে তুলে নিয়ে এসে খাটের একটা দিক তার কাঁধে তুলে দেয়। তাতেও কোন ভাবান্তর হয় না প্রিয়র। কিন্তু সমান তালেই সে বাবার খাট কাঁধেই ঢেলাইচন্ডীতলায় পৌঁচ্ছে যায়। মুখাগ্নির আগে পর্যন্ত পুতুলের মতো পুরোহিতের সমস্ত নির্দেশ মেনে কাজ করে চলে সে।বিপত্তি ঘটে মুখে আগুন ছোঁওয়ানোর সময়।
ঘিয়ে ভেজা তুলোয় আগুন ধরিয়ে পুরোহিত বাবার মুখে ছোঁওয়ার কথা বললেও সে তা কানে তোলে না। একবার করে আগুনটা বাবার মুখের কাছে নিয়ে যায় আর দ্রুত হাত সরিয়ে নিয়ে আসে। বার কয়েক ওই রকম করার পর পুরোহিত যেই আগুনটা প্রভাতকুসুমের মুখে ছোঁওয়ানোর জন্য প্রিয়র হাতটা এগিয়ে ধরতে গিয়েছেন অমনি সে তীব্র বেগে হাতটা সরিয়ে নিয়ে চিৎকার করে ওঠে -- না --না দিও না , বাবার কষ্ট হবে।
তার চিৎকারে থতমত খেয়ে যান পুরোহিত। বাকিদের মনে অবশ্য তার মুখে কথা শুনে স্বস্তি ফেরে। সবাই তো অন্যরকম আশঙ্কা করেছিলেন। প্রিয় বাবার মুখের দিকে চেয়ে নির্বাক হয়ে বসে থাকে। অতসীকাকী , সুরোপিসিরা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন , না বললে কি হয় বাবা ? তোমার হাতের আগুনটুকু না পেলে বাবা যে শান্তিতে যেতে পারবেন না।
--- দেব না আমি যেতে। আমাদের ফেলে চলে গেলেই হল ? আমরা কার কাছে থাকব ?
অভিমান হত গলায় কথাগুলো বলে ফুঁপিয়ে ওঠে প্রিয়। মধুরিমা আর স্বাতীও একই অনুনয় করে প্রিয়কে। ফের ভাবলেশহীন চোখে সবার মুখের দিকে চেয়ে থাকে প্রিয়। তারপর কাঁপা কাঁপা হাতে বাবার মুখে আগুন ছুঁয়ে প্রবল কান্নায় ভেঙে পড়ে সে। বুকের ভিতরে জমাট বেঁধে থাকা বরফটা কান্না হয়ে গলতে থাকে। প্রিয়কে ধরে কেঁদে চলে মধুরিমা আর স্বাতীও। শ্মশানবন্ধুরা একসময় মৃতদেহ তুলে নিয়ে শ্মশানের উদ্দেশ্য রওনা দেন। গ্রামের লোকেরা প্রিয়দের হাত ধরে বাড়ির দিকে নিয়ে যায়। হরিধ্বনির মধ্যে শেষবারের মতো গ্রাম ছেড়ে চলে যান প্রভাতকুসুম।সেদিকে চেয়ে ঝাপসা হয়ে উঠে সবার চোখ। ক্রমশ গঙ্গাধর বাবাজীর গলায় ক্ষীণ হয়ে আসে অন্তিম যাত্রার গানের সুর। কান পেতে সেই সুর শোনার চেষ্টা করে প্রিয়। ওই সুরের মাধ্যমেই যেন বাবার সোহাগ স্পর্শ বাহিত হয়ে আসে তার কাছে।কত কথা মনে পড়ে যায় একে একে। তার কষ্ট হবে বলে কোনদিন তাকে চাষের কাজ করতে দেন নি বাবা। নিজে না খেয়ে ভালো খাবারটা তার পাতে তুলে দিয়েছেন। চরম অনটনের মধ্যেও তার সব আবদার মিটিয়েছেন। প্রিয়ও মনে মনে ঠিক করেছিল সে'ও একদিন বাবা - মাকে সুখী করবে। মা তো সংসার সুখের মুখ দেখার আগেই চলে গিয়েছেন। তাদের সংসার সবে সুখের মুখ দেখতে শুরু করেছে। কিন্তু বাবা সেই সুখ ভোগ না করেই চলে গেলেন। দুটি মানুষ সারা জীবন তাদের সুখের জন্য সর্বস্ব উজার করে দিয়ে চলে গেলেন। সে তাদের সুখী করতে পারল না। এই আক্ষেপ সে ভুলবে কেমন করে।
ওইসব কথা ভাবতে ভাবতে প্রিয়র চোখ ভিজে যায়। মধুরিমা তার পাশে এসে বসে। প্রথমে সবাই চেয়েছিল প্রিয়ও শ্মশানবন্ধুদের সঙ্গে শ্মশানে যাক। সেখানে নাকি পাঁচজনের মাঝে ভুলে থাকতে পারবে। খাওয়া-দাওয়ার বিধিনিষেধও নেই শ্মশানে। কিন্তু সে চোখের সামনে চিতার আগুনে বাবার লীন হয়ে যাওয়া সইতে পারবে না বলে মধুরিমা আর স্বাতী তাকে নিয়ে যেতে দেয় নি। তার পরিবর্তে শ্মশানবন্ধুদের সঙ্গে সৌরভ গিয়েছে। সৌরভ ছিল বলে প্রিয়কে হৃদয় বিদারক দৃশ্যটা দেখতে হয় না। শুধু তাই নয় , সৌরভই শ্রাদ্ধশান্তি সহ সমস্ত পারলৌকিক কাজকর্মগুলো সামলে দেয়। গ্রামের মানুষজনও পালাক্রমে এই কয়েকদিন প্রিয়দের বাড়িতে পড়েছিলেন বললেই চলে।স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডাক্তারবাবু আর সিস্টাররাও নিয়মিত এসে সান্ত্বনা দিয়ে গিয়েছেন। মাঝে একদিন বোলপুর থেকে ডাক্তারবাবু , আর্যদা আর কয়েকজন সাংবাদিকও এসেছিলেন। ওইসব মানুষজনের আসা - যাওয়ায় বাবার শুন্যতা কিছুটা হলেও ভুলে থাকতে পেরেছিল প্রিয়।কিন্তু একসময় শোকের আবহ কমে আসে।
কমে যায় লোকজনের আসা-যাওয়াও। মধুরিমা আর সৌরভরাও একদিন বাড়ি ফিরে যায়। তারপরই নতুন করে বাবার শুন্যতা গ্রাস করে নেয় প্রিয়কে। ঘুরে ফিরে বাবার কথা মনে পড়ে যায় তার। আর বাবার কথা মনে এলেই মা'ও সামনে এসে দাঁড়ান। বাড়িটা বড়ো ফাঁকা ফাঁকা লাগে। স্বাতীর সঙ্গে স্মৃতিচারণ করে সেই শুন্যতাটা ভরাট করার চেষ্টা করে প্রিয়। ওই ভাবেই কেটে যায় সময়। এখন রোগীদের নিয়েই প্রিয়র আরও বেশি সময় কাটে। কারণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র এখন গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের স্বীকৃতি লাভ করেছে। চালু হয়েছে ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এখন সেখানেই কাজ করতে হয় প্রিয়কে। তাই সবদিক সামলে বাড়ি ফিরতে প্রায়ই দেরি হয়ে যায় তার। তবে স্বাতী এখন অবশ্য আর আগের মতো রাগ অভিমান করে না। সে জেনে গিয়েছে প্রিয়র উপরে রোগী এবং তার পরিবারের লোকেরা খুব ভরসা করেন। তাছাড়া ওই কাজের মধ্যে বাবা-মায়ের অভাবটাও কিছুটা হলেও ভুলে থাকতে পারে প্রিয়। স্বাতীও সংসারের নানা কাজে নিজেকে ডুবিয়ে রাখার চেষ্টা করে। তবুও কেমন যেন শুন্য লাগে তার। এক বছরের মাথায় শুন্যতাটা কিছুটা যেন পূর্ণ হয়ে যায়।
No comments:
Post a Comment