Short story, Features story,Novel,Poems,Pictures and social activities in Bengali language presented by Arghya Ghosh

অন্তরালে -- ৪৪




  
     
     অন্তরালে 


         অর্ঘ্য ঘোষ 


  ( ধারাবাহিক উপন্যাস ) 



পরদিন সকালে খাওয়া-দাওয়ার কথাটা শ্বশুরমশাইয়ের কাছে পাড়ে স্বাতী। প্রিয়ও তখন বাবার কাছেই বসেছিল। স্বাতী দুজনকে চা দিতে গিয়ে শ্বশুরমশাইয়ের উদ্দেশ্য বলে, বাবা একটা কথা বলার ছিল।
স্বাতীর হাত থেকে চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে প্রভাতকুসুম বলেন , কি কথা বলো মা ?
--- বলছি আপনার ছেলে তো প্রায়ই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডাক্তারবাবু , সিস্টারদের কাছে খাওয়া--দাওয়া করে আসে। অথচ আমরা একদিনও ওদের খাওয়াতে পারি নি। তাই বলছিলাম কি ওদের একদিন নিমন্ত্রণ করে খাওয়ালে কেমন হয় ? 
--- খুব ভালো হয়। একি আর বলার অপেক্ষা রাখে ? প্রিয় ওদের কাছে খেয়ে আসুক বা না'ই আসুক আমাদের আরও আগে ওদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানো উচিত ছিল। কারণ ওরা তো শুধু প্রিয়র সহকর্মীই নন , ওরা যে আমাদের গ্রামের অতিথিও। কথাটা আমিও কয়েকদিন ধরে বলব বলব ভাবছিলাম। কিন্তু প্রিয়র পক্ষে সবদিক সামাল দেওয়া সম্ভব হবে না ভেবেই কিছু বলি নি। কারণ শুধু ডাক্তারবাবু বা সিস্টারদের বললেই তো আর হবে না মা , বোলপুরের ডাক্তারবাবু , আর্যদেরও বলতে হয়। তারপর ধরো তোমাদের মায়ের কাজের সময় যারা সব কাজকর্ম করেছে তাদেরও কি বাদ দিতে পারবে ? রান্নাবান্না করে অধিকাংশই তো সেদিন আর খেতে পারেনি।তাই পরে কোন একদিন খাওয়াতেই হত তাদের। সব মিলিয়ে বড়ো খরচের ধাক্কা। এখন তো আর আমি চাষবাস ঠিক মতো করতে পারি না। প্রিয় এখনও বেতন পায় নি। তাই কি করে প্রিয় একা সবদিক সামল দেবে তা ভেবে পাচ্ছি না।
শ্বশুরমশাইয়ের কথা শুনে স্বামীর মুখের দিকে তাকায় স্বাতী। 
প্রিয় বাবাকে আশ্বস্ত করে , তুমি অত চিন্তা কোর না তো। আজ বেতন পায় নি কিন্তু পাব তো একদিন।
--- বেশ তাহলে কর। প্রশান্ত, জীতেন , তোর বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আলোচনা করে একটা দিন ঠিক করে ফেল।
স্বাতীর মুখে হাসি ফোটে। অনেকদিন পর তাদের বাড়িতে লোক সমাগম হচ্ছে বলে তার খুব ভালো লাগে। কেবল নিজে হাতে রান্না করে খাওয়াতে পারবে না বলে তার মনে একটু আক্ষেপ থেকে যায়। অত লোকের রান্না তো আর তার পক্ষে নিজে হাতে করা সম্ভব নয়। সেই আক্ষেপ অবশ্য পরে  কোন একদিন মিটিয়ে নেওয়া যাবে।শ্বশুরমশাই তার প্রস্তাবে এক কথায় সায় দেওয়ায় আক্ষেপটা কিছুটা প্রশমিত হয়ে যায়।সত্যি বলতে কি মাটির মানুষ বলতে যা বোঝায় প্রভাতকুসুম ঠিক যেন তাই। এ বাড়ির বৌ হওয়ার পর থেকে স্বাতী তো তাই দেখে আসছে। 
বাবার সম্মতি পাওয়ার পরই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বেরনোর মুখে  প্রিয় স্ত্রীকে বলে, নাও তা হলে এবার লেগে পড়ো।
স্বাতী বলে ,  আমার তো আর লাগার ব্যাপার কিছু নেই মশাই। সব তো তোমাকেই করতে হবে এখন। 
--- মানে ? 
---- মানে আর তো আমাকে রান্নাটাও করতে হচ্ছে না। আমি সেদিন শুধু গিন্নিপনা করে ঘুরে বেড়াব। তুমিই বরং কোমর বেঁধে লেগে পড়ো।
--- বাহ , বেশ তো। এ যে দেখছি জলে নামিয়ে দিয়ে পাড়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখার মতো ব্যাপার।
আরও কিছুক্ষণ স্ত্রীর সঙ্গে ওইভাবে খুনসুটি করে স্বাস্থ্যকেন্দ্র অভিমুখে রওনা দেয় প্রিয়। যাওয়ার পথে  মাচানতলায় সবার সামনে কথাটা পাড়ে প্রিয়। শুনে প্রশান্তকাকারা বলেন , এই তো কয়েকদিন আগেই খাওয়া দাওয়া হোল, আবার কেন ?
--- দেখুন আমি তো এখন মাঝে মধ্যে ডাক্তার নার্সদের কাছে খাওয়া-দাওয়া করে বাড়ি ফিরি তাই আপনাদের বৌমা বলল, ওদেরও একদিন খাওয়ানো উচিত। তারপর আর্যদা - ডাক্তারবাবুরাও বিয়ের দিনে আমাদের একটা পয়সাও খরচ করতে দেন নি , অথচ বৌভাতে আসতে পারেন নি। সেই ভেবেই ---। 
---- সেইদিক থেকে দেখতে গেলে ঠিকই আছে। তবে আবার আমাদের কেন ? 
---- বারে আপনাদের বাদ দিয়ে কি করে হবে ? এতদিন বিপদে-আপদে একসঙ্গে আছি আর খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে আপনাদের বাদ দিয়ে কি হয় কখনও ?




                      এরপর আর কেউ কোন আপত্তি তুলতে পারেন না। প্রিয় লক্ষ্য করেছে ডাক্তার নিয়ে আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকেই প্রসাদ মোড়লদের কয়েকটা ঘর বাদ দিয়ে গ্রামের সবেতেই কেউ কাউকে  বাদ দিয়ে ভাবতে পারেন না। সে বাড়ির সত্যনারায়ণ - লক্ষ্মীপুজোই হোক কিম্বা নামকীর্তনই হোক।সবকিছুতেই সবাইকে জড়িয়ে নেওয়ার একটা প্রবণতা তৈরি হয়েছে। প্রিয়ও এখন গ্রামের লোকেদের বাদ দিয়ে কিছু ভাবতে পারে না। গঙ্গাধরবাবাজীকেও সে তাদেরই একজন মনে করে। তাই তাকে নিমন্ত্রণ করে আনা এবং পৌঁছে দিয়ে আসার জন্য সে ঋজুদাকে দায়িত্ব দেয়। অন্যান্য  প্রস্তুতিও শুরু হয়ে যায়। শনিবার দিন ঠিক করা হয়। রাত পোহালেই শনিবার , তাই অত অল্প সময়ের মধ্যে সবদিক সামাল দেওয়ার অসুবিধা আর তড়িঘড়ি সবাইকে পাওয়া যাবে না ভেবে প্রথমে রবিবারে  দিন ঠিক করা হয়। কিন্তু ওইদিন আবার ডাক্তারবাবু থাকেন না। চিকিৎসা করতে গ্রামে যান। সিস্টাররাও সপ্তাহে একজন করে পালাক্রমে বাড়ি যান। তাই তাদের কথা ভেবেই দিনটা পরিবর্তন করা হয়।সেইমতো ডাক্তারবাবু আর সিস্টারদেরও জানানো হয়।তারা জিজ্ঞাসা করেন , কি ব্যাপার প্রিয়বাবু বিবাহবার্ষিকী নাকি ?  
--- না-না , সে রকম কিছু ব্যাপার নয়। বিবাহবার্ষিকীর দেরি রয়েছে। আপনারা এসেছেন বেশ কিছুদিন হল।  আমি গ্রামের ছেলে হয়ে একদিনও আপনাদের বাড়ি নিয়ে আপ্যায়ন করতে পারিনি।উল্টে প্রায়ই আপনাদের কাছে থেকে খেয়ে বাড়ি ফিরি।
তার কথা শুনে দেবিকা সিস্টার বলে ওঠেন -- তার মানে আপনি ধার শোধ করতে খাওয়াচ্ছেন বলুন ? 
প্রশ্নটা শুনে খুব বিড়ম্বনায় পড়ে প্রিয়। স্বাতীর কথা ধরতে গেলে এক হিসাবে তাই - ই হয়।  কিন্তু সেটা কি বলা উচিত হবে ? খুব দোটানায় পড়ে সে। পরক্ষণেই ভাবে লুকোছাপারই  বা কি আছে ? সেই ভেবে আসল কথাটাই বলে ফেলে সে। কোনরকম রাখঢাক না করেই সে বলে, দেখুন সত্যি কথা বলতে কি  আমার ওইসব লোক-লৌকিকতার ব্যাপারগুলো সবসময় আসে না। প্রায়ই তো আপনাদের কাছে খেয়ে ফিরি। তাই স্বাতী একদিন বলল, রোজ রোজ ডাক্তারবাবু আর সিস্টারদের কাছে খেয়ে এলেই হবে ?  ওদেরও তো মাঝে মধ্যে খাওয়ানো উচিত।
তার কথা শুনে শব্দ করে হেসে ওঠেন সবাই। তাদের হাসি দেখে অপ্রস্তু হয়ে পড়ে প্রিয়। 
কাকলি সিস্টার বলেন , এই জন্যই আপনাকে এত ভালো লাগে আমাদের। আপনি খুব সরল বলেই সত্যি কথাটা এভাবে বলতে পারলেন। আর সংসারে তো এমনটাই হওয়া উচিৎ। একজন ভুলোমনা হলে অন্যজন সময় মতো সেই ভুল শুধরে দেবেন। এরপর তো আপনার মিসেসকে দেখার আগ্রহ আরও বেড়ে গেল।
---- উনিও তো আপনাদের তার হাতের রান্না খাইয়ে দেখানোর জন্য আগ্রহের আতিশয্যে ফুটছেন।
 --- তাই বুঝি ? বেশ মিসেসকে বলবেন স্বামীর পরিবর্তে তিনি আমাদের কথা মনে রাখায় তাকে আমাদের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ। আপনার মুখে ওনার কথা শুনেই মনে হচ্ছে খুব মিষ্টি মনের মেয়ে উনি। তাই আমাদেরও আর ওনার সঙ্গে আলাপ করার তর সইছে না।
ডাক্তারবাবু আর সিস্টারদের মুখে স্ত্রীর প্রশংসা শুনে গর্বে বুকটা ভরে ওঠে প্রিয়র। তাই ফুরফুরে মন নিয়ে বাড়ি ফেরে সে। কিন্তু রাতের বেলা স্বাতীর কাছে সেই কথাটা পাড়তেই অপ্রস্তুতের একশেষ হতে হয় তাকে। রাতের বিছানায় স্ত্রীকে কাছে টেনে বড়ো মুখ করে কথাটা বলে সে। আর তা শুনেই স্বাতী -- তুমি তো আচ্ছা লোক।
--- কেন কি হলো আবার ?  
--- আচ্ছা ওই কথা কেউ বলে ? আমার স্ত্রী বলল তাই আপনাদের খেতে বলা, কেউ বলে কোন দিন ? তোমার কি কাণ্ডজ্ঞান কি কোনদিন হবে না ? 
--- আচ্ছা আমি ভুলটা কি বললাম ?  তোমার বলা আর আমার বলা কি আলাদা হল ? ডাক্তারবাবু - সিস্টাররা তো খারাপ কিছু বললেন না।
--- তারা মুখের সামনে বুঝি নিন্দে করবেন ? তা কি বললেন তারা শুনি ? 
--- প্রথমে অবশ্য তুমি যা বললে তাই বলেছিলেন।তারপর বললেন আপনি সরল বলেই আপনাকে এত ভালো লাগে। তারপরই তো হেসে উঠলেন।
স্বামীর কথা শুনে হেসে ওঠে স্বাতীও। তারপর স্বামীর মুখটা নিজের মুখের কাছে টেনে নিয়ে বলে, আমারও তো তোমাকে এই জন্যই এত ভালো লাগে। তুমি সারাজীবন এই রকমই সাদাসিধে থেকো। তাহলেই হবে , আর কিছু চাই না আমার।
বলেই স্বামীর ঠোঁটে নিজের ঠোঁট মিশিয়ে দেয় সে। স্ত্রীর  সোহাগে প্রিয়ও ডুবিয়ে দেয় নিজেকে।




                   পরদিন সকাল থেকেই তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়।সেদিন স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে ফেরার পথে সে মধুরিমাদের বাড়ি অভিমুখে রওনা দেয়।গ্রামে ঢোকার মুখে থেকেই মধুরিমাদের বাড়ির দরজাটা চোখে পড়ে।আর কত কথা মনের মাঝে ভীড় করে আসে।  আগে যখনই এসেছে স্বাতীই তখন দরজা খুলে সামনে দাঁড়িয়েছে। স্বাতীর মুখের দিকে চেয়ে খোলা দরজা পেরিয়ে ভিতরে ঢুকতে  ভুলে যেত সে। তাই নিয়ে কতদিন যে বোনের টিপ্পনী হজম করতে হয়েছে তার ঠিক নেই।সব যেন আজ ছবির মতো মানসপটে ভেসে ওঠে। আগে ওই দরজাটা যখনই চোখে পড়ত তখনই তার বুকের ভিতর কেমন যেন ধুকপুকুনি শুরু হয়ে যেত। আজ আর সেটা টের পাচ্ছে না সে। কারণ আজ যে দরজার ওপারে আর স্বাতী নেই। স্বাতী এখন তারই প্রতীক্ষায় অন্য একটি দরজার দিকে চেয়ে বসে রয়েছে।শুধুই কি স্বাতী ?  সেও কি কখন বাড়ি ফিরে স্বাতীর মুখ দেখবে বলে সময় গোনে না ? স্বাতীর কথা ভাবতে ভাবতেই দরজায় গিয়ে কড়া নাড়ে প্রিয়। দরজা খুলে তাকে দেখে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে থাকে মধুরিমা।  উদ্বেগ ঝড়ে পড়ে তার গলায় -- কিরে তুই হঠাৎ , সবাই ভালো আছে তো ?  বাবার শরীর ঠিক আছে তো ?
--- কেন বোনের বাড়ি হঠাৎ আসতে পারি না ? আরে বাবা দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই। সবাই ভালো আছে।
তারপর আসল কারণটা খুলে বলে। শুনে মধুরিমা বলে, ভালোই হলো আমরাও কয়েকদিন ধরে বাবাকে দেখতে যাব যাব ভাবছিলাম।
মধুরিমার শ্বশুর-শাশুড়িকেও যাওয়ার কথা বলে বাড়ি ফেরার মুখে মাচানতলায় পৌঁছোয় প্রিয়।
সেখানেই সবাইকে পেয়ে যায় সে।এমনিতেই প্রশান্তকাকা আর জীতেনকাকাকে গ্রামের সবাইকে বলার জন্য সে সেইদিনই বলে দিয়েছিল, তবু আরও একবার নিজে মুখে বলে দেয়। ঋজুদার ফোন থেকে ডাক্তারবাবু আর আর্যদাদেরও জানিয়ে দেয়। প্রথমে আর্যদারা হঠাৎ করে আসা অসুবিধা হবে বলে জানান। তখন প্রিয়কে ব্রম্ভ্রাস্ত্র প্রয়োগ করতে হয়। অভিমানহত গলায় সে বলে , এখনই আমাদের গ্রামে বড়ো একটা কিছু ঘটে গেলে তখন কি খবর তুলতে ছুটে আসতেন না ? ভাবুন  সেই রকমই বড়ো একটা ঘটনা  ঘটে গিয়েছে। 
তার কথা শুনে ফোনের ওপারে হেসে ওঠেন আর্য। হাসতে হাসতেই বলেন , ওরে বাবা আপনি যে মোক্ষম চালে ফেললেন দেখছি। ঠিক আছে যাব - যাব। ডাক্তারবাবুকে নিয়ে যথাসময়ে পৌঁছে যাব। আয়োজনের আর কোন ত্রুটি ছিল না।সব কিছুই ঠিকঠাক ছিল। প্রসাদ মোড়লই মাঝখান থেকে বাগড়া দেওয়ার চেষ্টা করে। সেদিন স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে অপমানিত হয়ে ফিরে আসার পর আর ওমুখো নাহলেও সে আর ভবানী ডাক্তার শেয়ারে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সামনেই ওষুধের দোকান খোলার তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে। শোনা যাচ্ছে সেখানে নাকি শহর থেকে ডাক্তার এসে বসবেন। পরে ডায়াগনস্টিক সেন্টারও খুলবে তারা। সে তারা খুলতেই পারে। তা নিয়ে প্রিয়র কোন মাথাব্যথা নেই। কিন্তু প্রিয়কে নিয়ে ওদের মাথাব্যাথার অন্ত নেই।  আসলে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যারাই আসে তারাই প্রথমে প্রিয়র খোঁজ করে। প্রিয়ও সবাইকে প্রয়োজন অনুযায়ী সাহায্য করে। তাই সে বাস্তবিক অর্থেই সবার প্রিয় হয়ে উঠেছে। সেটাই গাত্রদাহের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রসাদ মোড়লের। এতদিন সবেতেই এলাকার বাসিন্দাদের যেকোন প্রয়োজনে তার কাছেই ছুটে আসতে হয়েছে। তাই প্রিয় নির্ভরশীলতাটা কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারে না সে। তারই বহ্বিঃপ্রকাশ ঘটে প্রিয়দের বাড়ির খাওয়া দাওয়ার দিনে। সেদিন  ডাক্তারবাবুদের নিয়ে যখন তাদের বাড়ি যাচ্ছিল তখন মাঝপথে তাদের আটকানোর চেষ্টা করে প্রসাদ মোড়ল। সে তখন তার সাগরেদের নিয়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সামনে ওষুধের দোকান তৈরির তদারকি করছিল। ডাক্তারবাবুদের বেরোতে দেখে এগিয়ে এসে বলে , সদলবলে কোথাও যাওয়া হচ্ছে বুঝি ?
প্রসাদ মোড়লের  গায়ে পড়া ভাব লক্ষ্য করে বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে ওঠে ডাক্তারবাবুর। কিন্তু বিরক্তি চেপে রেখে বলেন , দেখতেই তো পাচ্ছেন।
--- সে তো পাচ্ছিই। কিন্তু স্বাস্থ্যকেন্দ্র ছেড়ে চলে যাচ্ছেন যে বড়ো , এই সময় রোগী এলে কি হবে শুনি ? রোগী দেখা, না পাড়া বেড়ানো আপনাদের দায়িত্ব ? 
---- আমাদের দায়িত্ব কি সেটা আমরা জানি। আর আমরা খুব দূরেও যাচ্ছি না। প্রিয়বাবুর বাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যাচ্ছি। আপনি তো রইলেন, রোগী এলে আপনিই বরং খবরটা দিয়ে আসবেন। তখন না হয় সঙ্গে সঙ্গে চলে আসব।
প্রসাদ মোড়লকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে  প্রিয়দের বাড়ি অভিমুখে রওনা দেন ডাক্তারবাবুরা। আসতে আসতেই প্রিয় লক্ষ্য করে প্রসাদ মোড়লের মুখটা কালো হয়ে গিয়েছে। কথাটা শুনে গ্রামের লোকেরা খাপ্পা হয়ে ওঠেন। প্রশান্তকাকা বলেন , একের পর এক অপদস্থ হয়েও লোকটার লজ্জা নেই।
জীতেনকাকা বলেন , ওর কপালে এবার মার নাচছে।পরিস্থিতি ঘোরালো হতে চলেছে দেখে প্রিয় বলে, আজকের দিনে ওর কথা বাদ দিন তো।
ডাক্তারবাবুও একই কথা বলেন। তারপরই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। একে একে সবাই এসে পৌঁচ্ছোতে শুরু করেন। কাজের ফাঁকে ফাঁকে প্রিয় তাদের নিয়ে গিয়ে স্বাতীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। সবাই স্বাতীর সুখ্যাতি করেন।সিস্টাররা তোকথায় কথায় সেইদিনের কথাটা তুলে তাকে রাগানোর চেষ্টা করে। স্বাতীও ওদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মজা করে তাকে নিয়ে। 
সিস্টাররা বলেন, প্রিয়বাবু কিন্তু আপনার হাতের রান্না খাওনোর লোভ দেখিয়ে নিয়ে এসেছেন আমাদের। কিন্তু রান্না তো দেখছি অন্য লোকে করছেন।
--- আমার হাতের রান্না এমন কিছু লোভনীয় নয়। আর আমার হাতের রান্না পালিয়েও যাচ্ছে না। সে আর একদিন হবে।
--- তা বললে কি চলে ভাই ?  শুধু শুধু আমরাই বা খেয়ে থাকব কেন ? এরপর কর্তা-গিন্নি জোড়ে গিয়ে আমাদের আপ্যায়ণের সুযোগ দিয়ে আসবেন তবেই না আবার আমাদের আসাটা মানাবে।
স্বাতী আর প্রিয়র বুঝতে অসুবিধা হয় না তাদের কথা ধরে প্যাঁক দিচ্ছেন সিস্টাররা। তাই তারা হেসে ফেলে।  হাসি-ঠাট্টার মধ্যেই বোলপুর থেকে ডাক্তারবাবুরা এসে পৌঁছোন। তাদের সঙ্গেও এখানকার ডাক্তারবাবু আর সিস্টারদের আলাপ করিয়ে দেয় প্রিয়। মধুরিমারাও এসে পৌঁছোয় সেই সময়। তারাও যোগ দেয় আলোচনায়। গল্পগুজবের মধ্যেই যেন আনন্দের হাট বসে যায়। সব থেকে খুশী দেখায় প্রভাতকুসুমকে। স্ত্রীকে হারিয়ে মনের দিক থেকে অনেকটাই একা হয়ে পড়েছিলেন তিনি। অনেকদিন পর বাড়িতে একসঙ্গে অনেক লোক দেখে সাময়িকভাবে হলেও সে একাকীত্বটা দূরে সরিয়ে তিনিও তদারকিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। খাওয়ার সময় পরিবেশনকারীদের ডেকে ডেকে কার পাতায় আর একটু মাংস , তো কার পাতায় আর দুটো মিস্টি দেওয়ার নির্দেশ দিচ্ছিলেন। বাবাকে ওই ভূমিকায় দেখে খুব ভালো লাগে প্রিয়র। কিন্তু বাবার শরীরের যা অবস্থা তাতে ওই ধকল নিতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়বে কিনা সেই আশঙ্কা ও দেখা দেয় তার মনে। তার আশঙ্কাটাই যেন সত্যি হয়।


                             ( ক্রমশ ) 





     নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 


শীঘ্রই দেশ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হতে চলেছে আমার তৃতীয় উপন্যাস ------
  
                                  


                       ----০---

No comments:

Post a Comment