Short story, Features story,Novel,Poems,Pictures and social activities in Bengali language presented by Arghya Ghosh

অন্তরালে -- ৪৩




      অন্তরালে


             অর্ঘ্য ঘোষ



  ( ধারাবাহিক উপন্যাস )




ডাক্তারবাবুর কোয়ার্টারের সামনে পৌঁছোতেই তারা দেখতে পায় একটি বড়ো রুই মাছ আর এক ঝুড়ি সবজি নিয়ে বসে আছে প্রসাদ মোড়ল আর ভবানী ডাক্তার। ডাক্তারবাবু বেরোতেই তারা দু'জনে উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার করেন।ডাক্তারবাবুও হাত জোড় করে নমস্কার করেন তাদের। প্রসাদ মোড়ল নিজেদের পরিচয় দিয়ে বলেন , আপনারা এসেছেন শুনেই আলাপ করতে এসেছি।
---- খুব ভাল করেছেন। কিন্তু এসব কি ?
--- পুকুরের টাটকা মাছ আর জমির সতেজ ফসল।
---- কিন্তু এসব তো আমি নিতে পারব না।
---- কেন -- কেন নিতে পারবেন না কেন ?
---- নিতে পারব না কারণ আমি এভাবে নিতে অভ্যস্থ নই।
---- তবে কাল যে দেখলাম ওরা সব দিয়ে গেল।
--- ওঃ  তাই বুঝি ওদের দেখাদেখি পাল্লা দিতে আপনারা হাজির হয়েছেন ? হ্যা, আপনি ঠিকই দেখেছেন , কাল কয়েকজন এসে ওইসব দিয়ে গিয়েছি। আপনাদের মতোই ওদের কাছে থেকেও প্রথমে কিছু নিতে চাই নি। কিন্তু পরে মত পাল্টাতে বাধ্য হয়েছিলাম।
---- কেন খুব চাপাচাপি করছিল বুঝি ?
---- তা চাপ কিছুটা ছিল বইকি, তবে সেটা ওদের আন্তরিকতার। কারও দেখাদেখি চলে আসেন নি। আর প্রায় গোটা গ্রামের লোকই একসঙ্গে এসেছিলেন। একসঙ্গে বেশি লোক যেখানে থাকে , সাধারণত কুঅভিপ্রায় সেখানে থাকে না। সর্বোপরি ওদের মধ্যে আমার একজন সহকর্মীও ছিলেন।  তাই আর ওদের ফেরাতে পারি নি।
---- সহকর্মী ?
---- ওঃ আপনি বুঝি জানেন না। আপনাদের গ্রামের দেবপ্রিয়বাবু ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কর্মী হিসাবে আজই এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যোগ দিচ্ছেন।
---- ওঃ আমাদের সরকারের দেওয়া দয়ার দান।
---- এ কথা বলাটা বোধ হয় আপনার ঠিক হল না প্রসাদবাবু।
--- কেন , ঠিক হলো না কেন ? আমি তো ঠিক কথাই বলেছি।
---- না , ঠিক বলেন নি।কারণ সরকারটা শুধু আপনাদের নয় , সরকারটা জনগণের।আর চাকরিটাও দয়ার দান নয়, সরকারের ঘোষিত নীতি। আর আমি যতদুর জানি প্রিয়বাবুর যথেষ্ট যোগ্যতাও রয়েছে। এই চাকরি না নিলেও উনি অন্যত্র অনায়াসেই চাকরি পেতে পারতেন। বেশ আপনারা এখন আসুন। আউটডোরে যাওয়ার সময় হয়ে এল। আজ প্রথম দিন , বুঝতেই পারছেন নানা ব্যস্ততা রয়েছে।




                            বলেই নমস্কার করে কোয়ার্টারের দিকে ফেরার উপক্রম করেন ডাক্তারবাবু। আর সেটা লক্ষ্য করে চোয়াল ঝুলে যাওয়ার মতো অবস্থা হয় প্রসাদ মোড়লের। একদিন আগে বাইরে থেকে আসা তাদেরই সরকারের অধীনে চাকরি করা একজন ডাক্তার তার মতো প্রভাবশালী একজন নেতার মুখে মুখে এই ভাবে কথা বলতে পারে তা সে ভাবতেও পারে না। তাই তার মুখ থেকে আর কথা বেরোয় না। তার পরিবর্তে মুখ খোলে ভবানী ডাক্তার। সে বলে , স্যার সবজি নিয়েছেন বললেন। কিন্তু মাছ তো নেন নি। মাছটা আমার পুকুরের। ওটা আপনি রাখুন।
--- আপনি ?
 ভবানী ডাক্তার নিজের পরিচয় দিয়ে বলে , স্যার আপনি আসার আগে আমি এখানকার মানুষের চিকিৎসা করতাম।এক ধরণের সেবাই বলতে পারেন আর কি। আমি না থাকলে তো সব বিনা চিকিৎসায় পচে মরত।
--- কিন্তু আমি তো শুনেছি এ গ্রামে কোন পাশ করা ডাক্তার নেই।
---- আপনি ঠিকই শুনেছেন স্যার। আমি ওই যাকে বলে হাতুড়ে ডাক্তার। কিন্তু আমি দীর্ঘদিন ধরেই এই এলাকায় সুনামের সঙ্গে আলোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি , আয়ুবেদিক এমন কি কবিরাজি চিকিৎসা করতাম। কিন্তু সরকার আর তা করতে দেবে না।
---- বাবা আপনি তো দেখছি অনন্ত গুণের অধিকারী।একসঙ্গে এত বিভাগের চিকিৎসা বড়ো হাসপাতাল নাসিংহোমেও হয় কিনা জানা নেই। মারাত্মক ব্যাপার। আপনাদের কি করা উচিৎ জানেন তো ?  মানুষের জীবন নিয়ে এভাবে ছেলে খেলা করার জন্য আপনাদের জেলে পোরা উচিত। আপনাদের ব্যবসা বন্ধ করে ঠিকই করেছে সরকার। আরও আগেই করা উচিত ছিল।
---- সেই জন্যই তো স্যার আপনার কাছে আসা।
--- মানে ?
---- এতদিন গাঁয়ের লোকেদের দেখার কেউ ছিল না , আমি ছিলাম। এখন আপনি এসেছেন তাই আমি আর চিকিৎসা করব না। খুব শীঘ্রই এই স্বাস্থ্যকেন্দ্র নাকি হাসপাতাল হতেচলেছে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সামনেই আমার একটা জায়গা রয়েছে। ঠিক করেছি সেখানেএকটা ওষুধের দোকান করব। আপনাকে স্যার সেই দোকানে বসতে হবে। তাতে স্যার আপনারও ভাল উপরি আয় হবে। আমারও ভালো ওষুধ বিক্রি তো হবেই , আপনার ছত্রছায়ায় টুকটাক প্র‍্যাকটিসটাও চালিয়ে যেতে পারব। চাইলে আপনাকে কমিশনও দিতে পারি।
---- বাঃ আপনার চিন্তাভাবনা তো বেশ সুদুর প্রসারী। কিন্তু আমি যে আপনাকে ওইব্যাপারে কোন সাহায্য করতে পারব না। কারণ আমার অত টাকার মোহ নেই। আমি ঠিককরেছি মানুষের প্রয়োজনে  স্বাস্থ্যকেন্দ্রেই ২৪ ঘন্টা চিকিৎসা করব। এবারকিন্তু আর সত্যিই সময় নেই। আজকের মতো আপনারা বরং আসুন।
বলে ডাক্তারবাবু ভিতরে যাওয়ার উপক্রম করতেই ভবানী মিন মিন করে বলে -- স্যার তাহলে এগুলো ?
--- এনেছেন যখন তখন আর ফিরে নিয়ে যেতে বলে আপনাদের অপমান করতে চাই না। কিন্তু বিনা পয়সায়ও আপনাদের কাছে থেকে কিছু নিতে পারব না।
বলেই পকেট থেকে একটা একশ টাকার নোট বের করে ভবানী ডাক্তারের হাতে ধরিয়ে দেন।তারপর কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কোয়ার্টারে ঢুকে যান ডাক্তারবাবু।ভবানীডাক্তার তবু পিছন থেকে বলে ওঠে -- আমার কথাটা একটু ভেবে দেখবেন স্যার।তার কথা ডাক্তারবাবুর কানে পৌঁছোয় কিনা ঠিক নেই , কিন্তু কোন উত্তর মেলে না।
তাই হতাশ হয়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে বেরিয়ে যায় তারা। তারা চলে যেতে কোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে ডাক্তারবাবু বলেন -- যত সব ব্যাড এলিমেণ্ট। অজিতবাবুর মুখে আগেইওদের কথা শুনেছিলাম। কিন্তু ওরা যে এতটা সুযোগ সন্ধানী আর ধুরন্ধর হতে পারে তাভাবতে পারি নি। বাদ দিন ওদের কথা। সকাল থেকে শুধু শুধু অনেকটা সময় নষ্ট হয়ে।চলুন আউটোরে যাই।


        
                                     আউটডোর খুলে বসতে না বসতেই কোথা থেকে যেন ডাক্তারবাবুর আসার খবর পেয়ে এক - দুই করে রোগীরা ভীড় জমাতে শুরু করেন। ডায়াগনস্টিক সেন্টার চালু না হওয়া পর্যন্ত ডাক্তারবাবু প্রিয়কে রোগীদের নামের টিকিট লেখা আর ওষুধ দেওয়ার কাজ চালিয়ে যেতে বলেন। প্রিয় সেই মতো কাজ শুরু করে। সুশোভনবাবুর চেম্বারে  কাজ করার অভিজ্ঞতাটা তার এক্ষেত্রে কাজে লেগে যায়।একদিনেই ডাক্তারবাবু আর নার্সদের অমায়িক ব্যবহারের কথা লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। তারপর থেকে  স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রোগীর সংখ্যা উত্তোরত্তর বাড়তে  থাকে। দূর দুরান্তের লোকেরাও এখন শহরে যাওয়ার পরিবর্তে রাতবিরাতে ছুটে আসে। এখনও পর্যন্ত খাতায় কলমে আউটডোর পরিষেবাই বরাদ্দ রয়েছে। কিন্তু ডাক্তারবাবু নিজের দায়িত্বে পেটের রোগ ,  বিষ খাওয়া রোগীদের ভর্তি রেখে দিন রাত এক করে চিকিৎসা করেন। রাত বিরেতে রোগী এলে ডাক পড়ে প্রিয়রও। সবার প্রচেষ্টায় এতদিন অবহেলিত হয়ে পড়ে থাকা স্বাস্থ্যকেন্দ্রটাই মানুষের আস্থা আর ভরসাস্থল হয়ে ওঠে। সেই আস্থা আর ভরসাকে আরও জোরদার করতে সবাই নাওয়া - খাওয়া ভুলে যায়। বিশেষ করে প্রিয় অধিকাংশ দিনই বাড়িতে খেতে আসার অবকাশ পায় না। কোনদিন ডাক্তারবাবু, কোনদিন বা সিস্টাদের অনুরোধে তাদের কোয়ার্টারেই খেতে হয় তাকে। আর তখন স্বাতীর জন্য তার খুব কষ্ট হয়। একসঙ্গে খাওয়ার জন্য তার ফেরার অপেক্ষায় বসে থাকে মেয়েটা। কতদিন খেয়ে নিতে বলেছে। কিন্তু সে কথা কানে তোলে নি স্বাতী।প্রিয় অবশ্য সুরোপিসি কিম্বা ভানুমতীজ্যেঠির মাধ্যমে তার ফিরতে না পারার খবরটা স্বাতীকে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু কাজ সামলে সুরোপিসিদের বাড়ি ফিরিতেও সেই বেলা গড়িয়ে যায়। তাই সেইসময় খবর পাঠানো আর না পাঠানো একই ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। আর তাই বাড়ি ফিরেই স্বাতীর চোখে জল ভরা মেঘের আভাস পায় প্রিয়। সেটা অভিমান হয়ে ঝড়ে পড়ে রাতের বিছানায়।স্বাতী যথারীতি উল্টো দিকে পাশ ফিরে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে পড়ে। আর প্রিয়কে তার মানভঞ্জনে তৎপর হতে হয়। বার কয়েক স্বাতীর গায়ে হাত রাখে , আর স্বাতী হাত সরিয়ে দিতে দিতে খাটের একবারে শেষপ্রান্তে চলে যায়। তখন স্বাতীকে টেনে বুকের কাছে নিয়ে আসে প্রিয়। সোহাগভরা গলায় বলে, সরতে সরতে শেষে খাট থেকে পড়ে গেলে হবেটা কি শুনি ?  আমার পাঁচটা নয় , দশটা নয়, মোটে একটাই  বৌ।
---- অঃ পাঁচ - দশটা হলে বুঝি খুব ভালো হত ? একটা বৌ হয়েই আমার বুঝি আদরে চাদর ছিঁড়ে যাচ্ছে?  বাড়িতে যে একজন তার জন্য না খেয়ে বসে থাকে সে খেয়ালই থাকে না বাবুর। থাকবেই বা কি করে ? তার যে সিস্টাররা আছেন। রোজ রোজ গাঁয়ের মেয়ে 'সেতে'র হাতের রান্না খেতে কি আর ভালো লাগে? শহুরে দিদিমনিদের রান্নার কাছে 'সেতে'র রান্না কি লাগে ? 
স্ত্রীর কথা শুনেই প্রিয় বুঝতে পারে অভিমান খুব তীব্রতর হয়েছে। যখনই অভিমান তীব্র হয় তখন স্বাতী তার অত সুন্দর নামটাকে বিকৃত করে 'সেতে' বলে। সে কোনদিন স্ত্রীর নাম বিকৃত করে না। বড়োজোর আদর সোহাগের সময় 'সাতু --- সাতু ' করে। আসলে এসব হচ্ছে মাঠে যাওয়ার প্রভাব। ছোটবেলায় মায়ের সঙ্গে সে'ও যখন মাঠে যেত তখন শুনেছে মহিলারা স্বামীর বিরুদ্ধে কিছু বলতে গিয়ে পরোক্ষে আদর সোহাগের অভিব্যক্তিটাই সবার সামনে তুলে ধরে। সুরমা তাদের সঙ্গেই পড়ত। তার মা মাধবীকাকীকেই সে বলতে শুনেছে , যতই যাই বল বাবা, আমাদের সুরোর বাপের সেই 'মেধে'কে না হলে চলে না। নিজের মাধবী নামটা অবলীলায় 'মেধে' বলে মাধবীকাকী যে স্বামী সোহাগেরই বহ্বিঃপ্রকাশ ঘটাতেন তা সেদিন উপলব্ধি করতে না পারলেও আজ আর বুঝতে অসুবিধা হয়না তার। স্বাতীও যে সেই মাঠ সংস্কৃতিকেই হাতিয়ার করে স্বামী সোহাগ ব্যক্ত করতে চাইছে সেটা আন্দাজ করে স্ত্রীকে আরও কাছে টেনে নিয়ে বলে ,বোঝ না কেন,  রোগী থাকে বলেই আমি আসতে পারি না। নাহলে আমার কি তোমার পাশে বসে একসঙ্গে খেতে ইচ্ছা করে না ?
স্বাতী তখন স্বামীর বুকে মুখ ডুবিয়ে দিয়ে বলে , বুঝি গো বুঝি। রোগীদের জন্য সবাই যখন তোমার দরদের প্রশংসা করে তখন গর্বে আমার বুক ভরে যায়। কিন্তুবেশিক্ষণ তোমাকে দেখতে না পেলেই আমার খুব অভিমান হয়ে যায়।
---- পাগলি মেয়ে একটা।
---- তা মশাই শুধু ডাক্তারবাবু আর সিস্টারদের কাছে খেলেই হবে। মাঝে মধ্যে খাওয়াতেও তো হয়। একদিন ওদের খাইয়ে দেখিয়ে দাও তোমার 'সাতু'ও রান্নাটা নেহাত খারাপ করে না।
প্রিয় বুঝতে পারে স্বাতী এবারে সুরে ফিরেছে। তাই  সে'ও সুরে বাঁধে নিজেকে। সোহাগ ভরা গলায় বলে , ভালো বলেছে তো 'সাতু'।আমারই মনে আসা উচিত ছিল। কিন্তু তোমার মনে এল।এইজন্যই তো তোমাকে আমার এত ভালোলাগে। এত ভালোবাসি তোমাকে। সোনাবৌ আমার। বলে স্ত্রীকে আদরে সোহাগে ভরিয়ে তোলে প্রিয়। ঠোঁটে ঠোঁট রেখে স্ত্রীর মুখের দিকে অপলকে চেয়ে থাকে সে। স্বামীর বুকে মুখ ডুবিয়ে দেয় স্বাতী। দুজনেইবুকের ভিতর ঝড়ের দাপাদাপি টের পায়। সেই ঝড়ে একের পর এক দু'হাট করে খুলে যায় মনআর শরীরের সমস্ত দরজা। স্বাতীর অভিমানের মেঘটা কেটে গিয়ে কখন যে বৃষ্টি হয়ে ঝড় থেমেছে তা ওরা টের  পায় না।



    

        (  ক্রমশ ) 






     নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 


শীঘ্রই দেশ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হতে চলেছে আমার তৃতীয় উপন্যাস ------
  
                                  


                       ----০---


No comments:

Post a Comment