অন্তরালে
অর্ঘ্য ঘোষ
( ধারাবাহিক উপন্যাস )
ডাক্তারবাবুদের কাছে বিদায় নিয়ে প্রিয়রা সুরোপিসি আর ভানুমতিজ্যেঠিদের বাড়ি যায়। কাজের কথাটা পাড়তেই তারা উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন। হওয়ারই কথা , তাদের মতো বিধবাদের কাছে ওইরকম একটা কাজ পাওয়া মানে তো ভগবানের আর্শিবাদ পাওয়ার সামিল। কারণ গ্রামে তেমন কাজ কোথাই ? স্বামীকে হারানোর পর অনেক বিধবাকে পরের বাড়িতে মুড়িভাজা , ধান সিদ্ধ করে ছেলেমেয়ে মানুষ করতে হয়। সে বড়ো লাঞ্ছনার জীবন। কোলের সন্তানটিকে নিয়ে কি শীত -- কি বর্ষা ভোর রাতে পৌঁছোতে হয় বাবুদের বাড়ি। তারপর উনুনশালের পাশে চট পেতে সন্তানকে শুইয়ে রেখে কাজে লেগে পড়তে হয় তাদের। সকালে বাবুবাড়ির ছেলেমেয়েরা উঠে যখন ভালো কিছু খায় তখন তা পাওয়ার জন্য তাদের সন্তানরা কেঁদে ককিয়ে যায়। কিন্তু কেউ ফিরেও দেখে না। উপরন্তু গৃহিণীরা বিরক্তি প্রকাশ করে বলেন , এত করে বলি বেহায়াগুলোকে এনো না।
তবু কথা কানে তুলবে না। ওইসব কথা শুনে চোখে ফেটে জল আসে সুরোপিসিদের। অনেক কথা মনের মধ্যে ভিড় করে আসে। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে না। বলতে পারে না মাগো ছেলেমেয়ে সবার সমান। দুধের সন্তানকে কি করে বাড়িতে ফেলে আসি বলো ? আমাদের বাড়িতে তো খাবার নেই। বুকের দুধটুকুই তো ওদের খাবার।ওইসব কথা মনে পড়তেই যন্ত্রণায় বুকটা যেন ফেটে যায়। তবুও কান্না চেপে কাজ করে যেতে সুরোপিসিদের। কাজ শেষে চাট্টি মুড়ি কিম্বা চাল আঁচলে বেঁধে সন্তান কোলে বাড়ি ফেরে তারা। যা পায় তাতে সবার পেট ভরে না।
তবু সেই কাজই করতে হয় তাদের। বছরান্তে পুজোর সময় জোটে একটা মোটা কাপড়। কিন্তু সেই কাপড়টা নিয়েও চরম দোটানায় পড়তে হয় তাদের। পুজোতে অর্থাভাবে যেখানে ছেলেমেয়েদের একটা সস্তার জামাও জোটে না সেখানে মা হয়ে তারা কি করে বাবুদের দেওয়া নতুন কাপড় পড়বেন ? কতবার গৃহকর্ত্রীকে বলেছেন , গিন্নিমা বাড়িতে দু'টো ছোট ছেলেমেয়ে রয়েছে , তাই বলছিলাম কি আমাকে যে টাকা দিয়ে কাপড় দেন সেই টাকা দিয়েই যদি ওদের জন্য একটা জামা এনে দিতেন তাহলে খুব ভালো হত। আমি কোন রকমে চালিয়ে নেব। কিন্তু পুজোর দিন ছেলেমেয়ে দুটো ছেঁড়া জামা পড়ে থাকলে মনে খুব কষ্ট হয়।
শুনেই গিন্নিমা হয়তো মুখ ঝামটা দিয়ে বলে ওঠেন , শোন তুমি ছেঁড়া কাপড় পড়ে কাজে এলে আমাদের মাথা কাটা যাবে। সবাই ভাববে আমরা বোধহয় তোমাকে পুজোতে কিছু দিই নি। তাছাড়া নোংরা কাপড় পড়ে মুড়ি ভাজলে সেই মুড়ি খেতেও রুচি হবে না।অগত্যা মুখ বুজে গৃহিণীর কথা মেনে নিতে হয়। শুধু কি গৃহিনীর কথা। সুরোপিসিদের মতো ভাগ্যহত বিধবাদের আরও কত কিছুই তো মুখ বুজে মেনে নিতে হয়। অনেকসময় তাদের বাড়ির গৃহস্বামীর যৌন লালসারও শিকার হতে হয়। কিন্তু সেই লাঞ্ছনার কথাও মুখ ফুটে কাউকে বলতে পারে না। একদিকে কাজ হারানোর আশংকা , অন্যদিকে তাদেরই স্বভাব চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন ওঠার অনিবার্য পরিনতির কথা ভেবে দিনের পর দিন মুখ বুজে ওই ধরণের যৌন শোষণ মেনে নিতে হয় তাদের। ভগবান আর ভাগ্যের দোহাই পেড়ে মনকে সান্ত্বনা দেন তারা।
সেই সুরোপিসিদের সামনে এইরকম একটা সম্মানজনক কাজের সুযোগ ভগবানের আর্শিবাদ সামিল মনে হবে তাতে আশ্চর্য কি ? সেটা তাদের কথাতেও ধরা পড়ে। কপালে হাত ঠেকিয়ে দুজনেই বলেন -- এতদিনে ঠাকুর আমাদের দিকে মুখ তুলে চাওয়ার সময় পেলেন।
সুরোপিসিদের আনন্দে ভরা মুখগুলো দেখে খুশী মনে বাড়ি অভিমুখে রওনা দেয় প্রিয়রা। মাঝপথে আরও একটা খুশীর খবর যেন তাদের জন্য অপেক্ষা করেছিল। মাচানতলার কাছে পৌঁছোতেই তারা দেখতে পায় এগিয়ে আসছেন নিত্য পিওন। কাছাকাছি পৌঁছোতেই তিনি একটা খাম প্রিয়র হাতে এগিয়ে দেন। খাম খুলে চিঠিটা হাতে নিতেই বাকিরা জিজ্ঞাসু চোখে তার দিকে চেয়ে থাকেন। চিঠিটা পড়া শেষ হতে প্রিয়র মুখে ফুটে ওঠে খুশীর আভাস। সেটা লক্ষ্য করেই প্রশান্তকাকা বলেন , যাক বাবা দুশ্চিন্তা দূর হল। খারাপ খবর ছাড়া তো এ গ্রামে চিঠিপত্র বড়ো একটা আসে না। নিশ্চয় কোন খুশীর খবর আছে।
প্রিয় বলে , হ্যা, এখানেই আমার নিয়োগপত্র এসেছে। সাতদিনের মধ্যে কাজে যোগ দিতে বলেছে।
প্রিয়র কথা শেষ হয় না , সবার গলায় ঝড়ে পড়ে উচ্ছাস। প্রশান্তকাকা বলেন, আজ যে দেখি সবই খুশীর খবর। এবার বোধহয় আমাদের রাহুরদশা ঘুচল।
ঋজুদা বলে , আর্যদার জন্য এটা এত তাড়াতাড়ি সম্ভব হল। নাহলে সরকারের তো ১৮ মাসে বছর। ওইরকম কত ঘোষণাই তো করে। কিন্তু কার্যকর হতে বছরের পর বছর পেরিয়ে যায়।
প্রশান্তকাকা বলেন , বিশেষ করে এখানে নিয়োগটা আর্যবাবুর জন্যই সম্ভব হয়েছে।
প্রিয়ও জানে সেটা। তাই সবার আগে আর্যদা আর ডাক্তারবাবুকে খবরটা জানানো কথা মনে হয় তার।
ঋজুদার ফোনে সে একে একে আর্যদা আর ডাক্তারবাবুকে খবরটা দেয় প্রিয়। দুজনেই খুব খুশী হন। ডাক্তারবাবু তো বলেই ফেলেন --- শুধু শুধু এতবড়ো একটা খুশীর খবর দিলে চলবে না। বৌভাতে আমারা ফাঁকি পড়ে গিয়েছি। আর ফাঁকি দিলে চলবে না কিন্তু। রীতিমতো কবজি ডুবিয়ে খাওয়াতে হবে।
---- চলে আসুন যে কোনদিন। আপনাদের খাওয়াতে পারাটা শুধু আমার কাছেই নয় , এই গ্রামের কাছেও সৌভাগ্যের ব্যাপার।
---- সে হবে একদিন। তোমাদের সঙ্গে কাটানোটা আমাদের কাছেও লোভনীয় ব্যাপার।
কথা বলতে বলতে মাচানতলায় মায়ের বেদীর সামনে পৌঁচ্ছে যায় প্রিয়।ফোনটা ঋজুদার হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বেদীর উপরে নিয়োগপত্রের খামটা নামিয়ে হাটু মুড়ে বসে সে। তারপর বেদীর উপরে কপাল ছুঁইয়ে মনে মনে বলে , মাগো তোমার জীবনের বিনিময়ে এই চাকরি আমি নিতে চাই নি। গ্রামের মানুষের কথা ভেবে চাকরিটা আমাকে নিতে হচ্ছে মা। তুমি আর্শিবাদ করো আমি যেন মানুষের সেবা করতে পারি।
মুহুর্তের মধ্যে মায়ের হাসিমাখা মুখটা তার চোখের সামনে ভেসে উঠে। ঠোঁটটা তির তির করে কেঁপে ওঠে তার। নিজেকে আর সামলে রাখতে পারে না সে।ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। দুদিক থেকে দুটি হাত এগিয়ে এসে তুলে ধরে তাকে। প্রিয় তাকিয়ে দেখে প্রশান্তকাকা আর জীতেনকাকারা তাকে ধরে আছেন। তাদের চোখেও জল।তাদের হাত ধরেই বাড়িতে ফেরে প্রিয়। বাড়িতে পা দিয়ে অবশ্য নিজেকে সামলে নেয় প্রিয়। কারণ তাকে কান্নাকাটি করতে দেখলে বাবা ভেঙে পড়বেন। এমনিতে মা চলে যাওয়ার পর বাবা মনের দিক থেকে খুব দুর্বল হয়ে পড়েছেন। আসলে সচরাচর কেউ কাউকে ছেড়ে থাকেন নি। তাই বাবা মনের দিকে একাও হয়ে পড়েছেন। প্রিয় নানা ভাবে বাবার শুন্যতা ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু তা যে বিশেষ ফলপ্রসূ হয় না তা বুঝতে অসুবিধা হয় না তার। আসলে কিছু কিছু শুন্যস্থান কিছুতেই পূর্ণ হয় না। তাই নিজেকে যতদুর সম্ভব স্বাভাবিক করে তোলে সে।প্রশান্তকাকারাই তার চাকরি পাওয়ার খবরটা বাবাকে জানায়।
সেটা শোনার পর বাবা বলেন , খুব ভালো খবর। বোস সবাই , মিষ্টি মুখ করে যাও। আজ প্রিয়র মা বেঁচে থাকলে খুব খুশী হতেন। এই আশংকাটাই করছিল প্রিয়। সে জানত চাকরি পাওয়ার প্রসঙ্গে মায়ের কথা উঠবেই। আর ফের বাবা একাকীত্ব অনুভব করবেন। কিন্তু করারও তো কিছু নেই। মা যে মায়ার বাঁধনে তাদের জড়িয়ে রেখেছেন। বাবার মন খারাপের কথা ভেবে সে দ্রুত প্রসঙ্গ পরিবর্তনের চেষ্টা করে। স্বাতীও সেই সময় মিষ্টি জল নিয়ে আসায় পরিস্থিতিটা আরও স্বাভাবিক হয়ে যায়। বাবা বলেন , নাও সবাই মিষ্টি মুখ করো। স্বস্তি ফেরে প্রিয়র মনে। ঠিক হয় পরদিন সকালেই কাজে যোগ দেবে প্রিয়। সেই মতো সকালেই স্নান করে বেরনোর আগে মায়ের ছবিতে প্রনাম করে বাবার সামনে এসে দাঁড়ায় প্রিয়। তারপর বাবার পায়ে হাত ছুঁইয়ে প্রনাম করে। বাবা তার মাথায় হাত রেখে বলেন , আর্শিবাদ করি দেশ ও দশের একজন হয়ে ওঠো।
বাবার কথা শুনে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে প্রিয়র। দেশ ও দশের একজন হয়ে ওঠার কথাটা হয়তো উপমা , কিন্তু ক'জন বাবা এভাবে ছেলেকে আর্শিবাদ করতে পারেন ! দেশ ও দশের একজন হতে না পারলেও পাঁচজনের একজন হওয়ার চেষ্টা করবে সে।বাবার কাছে থেকে সে স্বাতীর সঙ্গে দেখা করার জন্য ঘরে যায়। ঘরে ঢুকতেই স্বাতীকে দেখে অবাক হয়ে যায় সে।গরদের শাড়ি, কপালে সিঁদুর টিপ, পায়ে আলাদা , চিবুকে ঘামের মুক্তোদানায় তাকে যেন সম্পূর্ণ অন্যরকম লাগে। সে চোখ ফেরাতে পারে না। কাজল কালো দীঘল চোখ দুটিতে যেন আটকে যায় তার চোখ। চোখে চোখ রেখে তার কাছে এগিয়ে এসে স্বাতী কাপড়ের কোনটা উঁচু করে তুলে ধরে বলে , নাও মাথাটা নোয়াও দেখি।
সে মাথা নিচু করতেই স্বাতী কাপড়ের আঁচলে বাঁধা ঠাকুরের প্রসাদী ফুলটা তার মাথায় ছুঁইয়ে দেয়। আর ফের মায়ের কথা মনে পড়ে যায় তার।
মাও পরীক্ষা দিতে কিম্বা বাইরে কোথাও গেলে এভাবেই তার মাথায় ফুল ছুঁইয়ে দিতেন।আপনা থেকেই তার চোখ ভিজে যায়। সেটা লক্ষ্য করে স্বাতী সেই জল মুছিয়ে দিয়ে তার চোখের পাতায় আলতো করে ঠোঁট ছোঁওয়ায়। সে'ও স্ত্রীর ঠোঁটে নামিয়ে আনে তার ঠোঁট। তারপর স্বাতীর হাত দুটো ধরে বলে -- আসি।
স্বাতী বলে , এসো।
দরজা পার হতে হতে প্রিয় দেখতে পায় স্বাতী দুহাত কপালে ঠেকাচ্ছে।ফের সামনে এসে দাঁড়ায় মা।মায়ের কথা ভাবতে ভাবতেই মাচানতলায় পৌঁচ্ছে যায় সে। মায়ের বেদীতে প্রণাম করে উঠে দাঁড়াতেই দেখে পিছনে এসে দাঁড়িয়ে রয়েছে সুরোপিসি আর ভানুমতীজ্যেঠি। তারাও বেদীতে প্রনাম করে। তারপর তিনজনেই এক সঙ্গে স্বাস্থ্যকেন্দ্র পৌঁছোয়। কিন্তু স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পৌঁছোতেই তাদের চক্ষু চড়ক গাছ হয়ে যায়।
( ক্রমশ )
----০---
No comments:
Post a Comment